বাংলাদেশে যত ধরনের বিরোধ, মামলা-মোকদ্দমা বা প্রতারণার ঘটনা ঘটে, তার বড় অংশই জমি বা সম্পত্তিকে ঘিরে। কারণ স্পষ্ট যে সম্পত্তি মানুষের জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ, আর এই সম্পদের সঙ্গে যুক্ত আইন সম্পর্কে অধিকাংশ মানুষই অসচেতন। অথচ সম্পত্তি–সংক্রান্ত লেনদেনে আমাদের সবচেয়ে শক্ত সুরক্ষাবলয় হলো সম্পত্তি হস্তান্তর আইন, ১৮৮২। এই আইন সম্পর্কে ন্যূনতম ধারণা থাকলে দীর্ঘদিনের ঝামেলা, প্রতারণা, আদালতের ঘোরপ্যাঁচ ইত্যাদি বেশির ভাগই এড়ানো যায়।

প্রথমত, সম্পত্তি হস্তান্তর আইন ক্রেতা ও বিক্রেতা—উভয়ের অধিকার ও দায়িত্ব নির্ধারণ করে। ধারা ৫৫ অনুযায়ী, একজন বিক্রেতা সম্পত্তি সম্পর্কে কোনো ধরনের গুরুত্বপূর্ণ তথ্য গোপন করতে পারবেন না। মালিকানা ত্রুটি, মামলাজট, দখল সমস্যা, পাওনাদারির বিষয় সম্পর্কে ক্রেতাকে পরিষ্কারভাবে জানাতে হবে। অন্যদিকে ক্রেতারও আইন অনুযায়ী দলিল যাচাই, রেকর্ড পরীক্ষা এবং নির্ধারিত প্রক্রিয়া অনুসরণ করার দায় রয়েছে। এই মৌলিক নীতিগুলো না জানার কারণেই বহু মানুষ প্রতারণার শিকার হন।

অনেকেই মনে করেন, জমি কেনা মানেই শুধু চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করা। বাস্তবে বিষয়টি অনেক বেশি জটিল। এই আইনে সম্পত্তি হস্তান্তরের বিভিন্ন পদ্ধতি নির্দিষ্ট করা হয়েছে—বিক্রয়, বন্ধক (মর্টগেজ), লিজ, বিনিময়, দান (গিফট) এবং নালিশযোগ্য দাবি (অ্যাকশনেবল ক্লেইম)। এগুলোর প্রতিটির আলাদা ধারা ও শর্ত আছে। উদাহরণস্বরূপ, ধারা ৫৮-১০৪ পর্যন্ত বিভিন্ন ধরনের বন্ধকের নিয়ম দেওয়া আছে। এগুলোর নিয়ম না বুঝে কোনো চুক্তিতে সই করলে পরে দেখা যায় চুক্তি বাতিল, ক্ষতি বা দীর্ঘ মামলা ছাড়া আর কিছুই নেই।

দানপত্রের ক্ষেত্রেও ভুল ধারণা প্রচুর। অনেকে মনে করেন, মৌখিক দান করলেই যথেষ্ট, যা সম্পূর্ণ ভুল। ধারা ১২২-১২৯ স্পষ্টভাবে বলে, দান অবশ্যই লিখিত, রেজিস্ট্রি করা, স্বেচ্ছায় প্রদান এবং গ্রহণযোগ্য হতে হবে। এসব শর্ত না মানলে দানপত্র আদালতে টিকবে না।

সম্পত্তি–সংক্রান্ত প্রতারণা আমাদের দেশে ক্রমে বাড়ছে। নকল দলিল, একই জমি একাধিক ব্যক্তির কাছে বিক্রি বা রেকর্ডে জালিয়াতির মতো অপরাধগুলো সাধারণ ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথচ আইন জানলে অনেক প্রতারণা আগেই চিনে ফেলা যায়। জমি কেনার আগে খতিয়ান, পর্চা, রেকর্ড, দখল—সব যাচাই করেই ক্রয় করা উচিত। এতে প্রতারণার সুযোগ অনেক কমে যায়।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো জমি নিয়ে প্রতারণা কোনো সাধারণ অপরাধ নয়; এটি কঠোর শাস্তিযোগ্য অপরাধ। বাংলাদেশ দণ্ডবিধির ধারা ৪২০ অনুযায়ী, প্রতারণার মাধ্যমে সম্পত্তি হাতিয়ে নিলে সাত বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড এবং জরিমানা হতে পারে। নকল বা জাল দলিল তৈরি করলে দণ্ডবিধির ধারা ৪৬৭ ও ৪৬৮ অনুযায়ী কারাদণ্ড বা অর্থদণ্ড হতে পারে। আবার কারও সম্পত্তি গোপনে বিক্রি করলে বিক্রেতা ধারা ৪০৬ ও ৪০৯ অনুযায়ী অপরাধমূলক বিশ্বাসভঙ্গের দায়ে ৩ থেকে ১০ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড অথবা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতে পারেন। অর্থাৎ সম্পত্তি নিয়ে প্রতারণা কোনোভাবেই হালকাভাবে নেওয়ার মতো বিষয় নয়।

এ ছাড়া রেজিস্ট্রেশন আইন, ১৯০৮ অনুসারে স্থাবর সম্পত্তির বিক্রয় অবশ্যই রেজিস্ট্রি করতে হয়। রেজিস্ট্রি ছাড়া কোনো দলিল আদালতে গ্রহণযোগ্য নয়। অনেকেই রেজিস্ট্রি না করে অগ্রিম টাকা নেওয়া বা মৌখিক চুক্তির ওপর ভিত্তি করে জমি বিক্রি করেন, যা ভবিষ্যতে ভয়াবহ জটিলতা সৃষ্টি করে।

বাংলাদেশের আদালতগুলোতে জমি বা সম্পত্তি–সংক্রান্ত মামলাই সবচেয়ে বেশি। এর বড় কারণ হলো অজ্ঞতা ও অসচেতনতা। আইন সম্পর্কে সামান্য জ্ঞান থাকলে, সঠিক কাগজপত্র যাচাই করলে এবং নির্ধারিত প্রক্রিয়া অনুসরণ করলে বিরোধ ও মামলা বহুলাংশে কমে যাবে।

সম্পত্তি মানে শুধু জমি বা বাড়ি নয়; এটি আমাদের ভবিষ্যৎ, পরিবারের নিরাপত্তা, সন্তানের উত্তরাধিকার এবং অর্থনৈতিক স্থিতি। তাই সম্পত্তি নিয়ে সচেতন থাকা মানে নিজের স্বপ্নকে সুরক্ষিত করা। আর এই সুরক্ষার প্রথম শর্ত হলো আইন জানা। সম্পত্তি হস্তান্তর আইন জানলে শুধু নিজে প্রতারিত হওয়া থেকে রক্ষা পাওয়া যায় না; বরং অন্যের প্রতারণা চিহ্নিত করা, ভুল চুক্তি এড়ানো এবং ঝুঁকির জায়গা চেনা সহজ হয়।

অতএব, আমাদের সবার উচিত এই আইনের কমপক্ষে মূল ধারাগুলোর ধারণা রাখা। এতে কেবল ব্যক্তিগত ক্ষতি এড়ানো যায় না; বরং সমাজে জমি-সম্পত্তি নিয়ে বিরোধের হার কমে আসে। সচেতনতা বাড়লে প্রতারণা কমবে, আইনি জট কমবে আর মানুষের আস্থা বাড়বে।

যদি নিজের সম্পদ রক্ষা করতে চান, তবে আইনের জ্ঞানই আপনার সবচেয়ে শক্ত ঢাল।

তাকবির জাহান শিক্ষার্থী, আইন ও ভূমি প্রশাসন অনুষদ, পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: আইন জ ন আম দ র অন য য় অপর ধ সবচ য়

এছাড়াও পড়ুন:

বিশ্বের বৃহত্তম শহরের তালিকায় দ্বিতীয় অবস্থানে ঢাকা

জনসংখ্যার কারণে বাংলাদেশের ঘনবসতিপূর্ণ রাজধানী ঢাকার বিশ্বের বৃহত্তম শহরের তালিকায় দ্বিতীয় অবস্থানে উঠে এসেছে। ২০৫০ সালের মধ্যে এটি বিশ্বের বৃহত্তম শহর হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক বিষয়ক বিভাগের বিশ্ব নগরায়ন সম্ভাবনা ২০২৫  প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়েছে।

প্রতিবেদনে দেখা গেছে, বিশ্বের ৩৩টি মেগাসিটির মধ্যে ১৯টিই এশিয়ায় অবস্থিত। ইন্দোনেশিয়ার রাজধানী জাকার্তা বিশ্বের বৃহত্তম শহর যেখানে চার কোটি ১৯ লাখ মানুষ বাস করে, তার পরেই বাংলাদেশের ঢাকা, যেখানে তিন কোটি ৬৬ লাখ মানুষ বাস করে।

জাপানের রাজধানী টোকিওর জনসংখ্যা তুলনামূলকভাবে স্থিতিশীল- তিন কোটি ৩৪ লাখ মানুষ। তালিকায় টোকিও বাংলাদেশের ঘনবসতিপূর্ণ রাজধানী ঢাকার পরে তৃতীয় স্থানে নেমে এসেছে। অপরদিকে ঢাকা নবম থেকে দ্বিতীয় স্থানে উঠে এসেছে। এটি ২০৫০ সালের মধ্যে বিশ্বের বৃহত্তম শহর হয়ে উঠবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

জাতিসংঘ জানিয়েছে, মেগাসিটির সংখ্যা - যাদের জনসংখ্যা ১ কোটিরও বেশি - ১৯৭৫ সালে মাত্র আটটি ছিল। চলতি বছর তা বেড়ে ৩৩-এ পৌঁছেছে। জাকার্তা, ঢাকা এবং টোকিও ছাড়াও শীর্ষ ১০টিতে থাকা অন্যান্য এশিয়ান শহরগুলি হল: ভারতের নয়াদিল্লি, চীনের সাংহাই ও গুয়াংজু, ফিলিপাইনের ম্যানিলা, ভারতের কলকাতা এবং দক্ষিণ কোরিয়ার সিউল।

ঢাকার দ্রুত প্রবৃদ্ধির পেছনে আংশিকভাবে গ্রামীণ এলাকা থেকে মানুষ রাজধানীতে চলে আসা, সুযোগের সন্ধানে যাওয়া অথবা বন্যা ও সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির মতো সমস্যার কারণে নিজ শহর ছেড়ে চলে আসার মতো বিষয়গুলো রয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে রাজধানীর জনসংখ্যা পরিস্থিতি আরো খারাপ হয়েছে।
 

ঢাকা/শাহেদ

সম্পর্কিত নিবন্ধ