রাজধানীর কারওয়ান বাজার মেট্রোরেল স্টেশনের একটি প্রবেশ পথের সামনে দাঁড়িয়ে সাহায্যের জন্য হাত পাতছিলেন মরিয়ম বেগম (ছদ্মনাম)। আর্তনাদের সুরে বলছিলেন, ‘আমার বেটাকে বাঁচান, সাহায্য করেন। আমি অসহায় হয়ে রাস্তায় নামছি। বেটাকে হারালে আমার আর কেউ থাকবে না।’

এই দৃশ্য চোখে পড়ে গত ২৭ সেপ্টেম্বর। মরিয়ম সাহায্য চেয়েই যাচ্ছিলেন। কিন্তু সাড়া খুব একটা পাচ্ছিলেন না। কাছে গিয়ে কথা বললাম তাঁর সঙ্গে। তিনি বললেন, তাঁর এক ছেলে, এক মেয়ে। ছেলে একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকের ছাত্র। মেয়েটি সরকারি একটি কলেজে পড়ে। ছেলের ক্যানসার ধরা পড়ে আট মাস আগে। তাঁর চিকিৎসার ব্যয় মেটাতেই মানুষের সহায়তা চাইছেন।

মরিয়ম বেগম বিভিন্ন জায়গা থেকে আর্থিক সহায়তা পেয়েছেন। ছেলের সহপাঠীরাও সাহায্য করেছেন। তবে তা যথেষ্ট নয়। এ জন্য মরিয়মকে হাত পাততে হচ্ছে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ছেলের চিকিৎসায় খরচ হয়েছে ১০ লাখ টাকার বেশি। এর মধ্যে ছিল তাঁর প্রয়াত স্বামীর রেখে যাওয়া তিন লাখ টাকা। ছেলের চিকিৎসা খরচ জোগাতে তাঁরা এখন প্রায় নিঃস্ব।

বিগত তিন মাসে রাজধানীর বিভিন্ন জায়গায় মানুষের কাছে সাহায্যপ্রার্থী ও ভিক্ষাবৃত্তিতে যুক্ত ৫০ জনের সঙ্গে কথা বলেছে প্রথম আলো। এ ক্ষেত্রে বেছে নেওয়া হয়েছে তাঁদের, যাঁদের পোশাক ও সাহায্য চাওয়ার ধরন নিয়মিত ভিক্ষাবৃত্তিতে যুক্ত মানুষের মতো নয়।

প্রথম আলো যে ৫০ জনের সঙ্গে কথা বলেছে, তাঁদের ৩৮ জন রোগে আক্রান্ত হয়ে কিংবা স্বজনের চিকিৎসার খরচ মেটানোর জন্য রাস্তায় নামার কথা জানান। ৬ জন জানান, তাঁরা কর্মসংস্থান হারিয়ে উপায় না পেয়ে ভিক্ষাবৃত্তিতে নেমেছেন। অন্য কাজের আয় দিয়ে পরিবার চালাতে না পেরে সহায়তা চাওয়ার কথা বলেছেন ৪ জন। দুর্যোগে বাড়িঘর হারিয়ে রাস্তায় নামার কথা বলেছেন ২ জন।

‘আর পেরে উঠছি না’

রাজধানীর মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেটের সামনে ১ অক্টোবর পাওয়া যায় এক ব্যক্তিকে, যিনি নিজেকে স্কুলশিক্ষক বলে দাবি করেন (না প্রকাশ করা হলো না)। তিনি বলেন, তিনি কিডনি রোগে আক্রান্ত। চিকিৎসা করাতে গিয়ে ইতিমধ্যে কয়েক লাখ টাকা ঋণগ্রস্ত হয়েছেন। ডায়ালাইসিসের পেছনে সপ্তাহে ছয় হাজার টাকা খরচ জোগাতে তিনি মানুষের কাছে হাত পাতছেন।

স্কুলশিক্ষকের বাড়ি গাইবান্ধায়। তিনি ‘লোকলজ্জা থেকে বাঁচতে’ নিজের এলাকায় পথেঘাটে মানুষের কাছে হাত পাতেন না। মাঝে মাঝে ঢাকায় এসে রাস্তায় মানুষের কাছে সাহায্য চান। তিনি বলেন, ‘ঋণের ভার, সংসারের খরচ ও নিজের চিকিৎসা—সব সামলাতে গিয়ে আর পেরে উঠছি না।’

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) ২০২৪ সালে একটি গবেষণায় জানায়, দেশের ৬১ শতাংশ পরিবার স্বাস্থ্য ব্যয় মেটাতে গিয়ে বিপাকে পড়ে। ২০২২ সালের হিসাবে, সে বছর দেশের জনসংখ্যার ৩ দশমিক ৭ শতাংশ দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে গিয়েছিল স্বাস্থ্য ব্যয় মেটাতে গিয়ে।

জনকল্যাণমুখী রাষ্ট্রে মানুষের স্বাস্থ্যসেবা ব্যয়ের বড় অংশ বহন করার কথা সরকারের। কিন্তু বাংলাদেশে স্বাস্থ্য খাতে ব্যক্তির নিজস্ব খরচ বাড়ছেই। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিট ‘বাংলাদেশ ন্যাশনাল হেলথ অ্যাকাউন্টস ১৯৯৭-২০২০’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে জানায়, ২০১৮ সালে ব্যক্তির পকেট থেকে ব্যয় হয়েছে ৬৪ শতাংশ। উল্লেখ্য, ২০২০ সালের তথ্যের ওপর ভিত্তি করে প্রকাশিত ২০২৩ সালের হিসাবে বলা হয়েছে, চিকিৎসায় ব্যক্তির পকেট থেকে ব্যয়ের হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে সাড়ে ৬৮ শতাংশ।

প্রথম আলো চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে পথে নামা যে ৩৮ জনের সঙ্গে কথা বলেছে, তাঁদের অনেকে প্রথমে বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নেন। কিন্তু খরচের কুলিয়ে উঠতে না পেরে পরবর্তীতে কেউ কেউ সরকারি হাসপাতালে সেবা নিতে গিয়েছেন। তবে সেখানে অসহযোগিতা এবং স্বজনপ্রীতির অভিযোগ করেছেন তাঁরা। আর বেসরকারি হাসপাতালের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে তাঁরা জানান, সেখানে খরচের পরিমাণ বেশি।

রাজধানীর শাহবাগে মানুষের কাছে সাহায্য চাইছিলেন চুয়াডাঙ্গার এক ব্যক্তি। বয়স ৫০-এর আশপাশে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, তিনি কৃষিকাজ করে সংসার চালাতেন। কিডনিতে সমস্যা ধরা পড়েছে। চিকিৎসক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে দিয়েছেন। কিন্তু অর্থাভাবে সেটাও করাতে পারছেন না। তিনি বলেন, তিনি পারছেন না বলে তাঁর দুই মেয়েকে কৃষিকাজে নিযুক্ত করেছেন। সেটা দিয়ে কোনোমতে সংসার চলছে। চিকিৎসার জন্য তিনি সাহায্য চাচ্ছেন।

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বড় বড় অবকাঠামো উন্নয়নে বেশি জোর দেওয়া হতো। স্বাস্থ্য খাত ছিল অবহেলিত। বিশ্বব্যাংকের ওয়েবসাইটে দেওয়া হিসাব (২০২২) অনুযায়ী, মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) অনুপাতে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দের দিক দিয়ে ভারত, শ্রীলঙ্কা, নেপাল ও ভুটানের চেয়ে পিছিয়ে বাংলাদেশ।

অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর ১১টি খাতের সঙ্গে স্বাস্থ্য সংস্কার নিয়ে একটি কমিশন গঠন করা হয়। স্বাস্থ্য খাত সংস্কার কমিশন তাদের সুপারিশে বলেছে, দেশে জাতীয় বাজেটের কমপক্ষে ১৫ শতাংশ বরাদ্দ স্বাস্থ্য খাতে থাকা উচিত। জিডিপির অনুপাতে বরাদ্দ হওয়া উচিত ৫ শতাংশ। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার ২০২৫-২৬ অর্থবছরে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ রেখেছে জাতীয় বাজেটের ৫ দশমিক ৩ শতাংশ, যা সুপারিশের তিন ভাগের এক ভাগের মতো।

স্বাস্থ্য সংস্কার কমিশনের সুপারিশগুলো জাতীয় ঐকমত্য কমিশনে আলোচনা হয়নি। বাস্তবায়নে জোরালো উদ্যোগ নেই। এমন অবস্থায় কমিশনের প্রধান জাতীয় অধ্যাপক এ কে আজাদ খান গত ৩ আগস্ট প্রধান উপদেষ্টাকে একটি চিঠি দেন। এতে সুপারিশ দ্রুত বাস্তবায়নে পদক্ষেপ নেওয়ার অনুরোধ জানানো হয়।

এ কে আজাদ খান মনে করেন, স্বাস্থ্য খাত সংস্কার কমিশনের সুপারিশগুলো বাস্তবায়িত হলে মানুষের সমস্যা অনেকটাই কমবে। তিনি প্রথম আলোকে, সংস্কার কমিশনের সুপারিশে প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবাকে মানুষের অধিকার ও সরকারের জন্য বাধ্যবাধকতা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। আর দুরারোগ্য রোগ চিকিৎসার বিষয়টি বিমার আওতায় আনার কথা বলা হয়েছে। সুপারিশ বাস্তবায়নের অগ্রগতি নিয়ে সন্তুষ্ট কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘কেউই তো সন্তুষ্ট নয়।’

‘দিনের বেলা বাইর অইতে শরম করে বাজান’

রাজধানীতে রাতেও ভিক্ষা করতে দেখা যায় মানুষকে। তাঁদের একজনকে ১ অক্টোবর পাওয়া গেল মহাখালীতে। ৫৩ বছর বয়সী এই নারী বলেন, তাঁর স্বামী মারা গেছেন। ছেলে নেই। এক মেয়ে আছে। তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ নেই সাত বছর। তবে মেয়ে ওই নারীর কাছে তাঁর ছেলেকে রেখে গেছেন, যার বয়স এখন ১৫ বছর।

ওই নারী বলেন, আগে কাপড় বিক্রি করে সংসার চালাতেন। কিন্তু অসুস্থতার জন্য এখন সেই কাজও করতে পারেন না। বাধ্য হয়েই ভিক্ষা করেন। তিনি বলেন, ‘দিনের বেলা বাইর অইতে শরম করে, বাজান। তাই রাইতে একটু বাইর অই। খুব কষ্ট হয় চলতে। ওষুধ আর খাওনের খরচ জোগাইতে বাইর অই।’

সরকার সমাজসেবা অধিদপ্তরের মাধ্যমে বিধবা ও স্বামী নিগৃহীতা নারীদের ভাতা দেয়। পরিমাণ মাসে ৬৫০ টাকা। ২৯ লাখ নারী এই ভাতা পান। তবে বহু নারী পান না। আবার ৬৫০ টাকা মাত্র ১৩ কেজি চালের দামের সমান।

স্বল্প ও নিম্ন আয়ের মানুষের পরিবারে উপার্জনক্ষম কেউ রোগাক্রান্ত হলেই পরিবারটিতে বিপর্যয় নেমে আসে। যেমন সিদ্দিক উল্লাহ (ছদ্মনাম) পেশায় গাড়ি চালক ছিলেন। তবে ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে কাজ হারান। তারপর তাঁর মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ (স্ট্রোক) হয়। এতে এক হাত ও এক পা অচল হয়ে যায় তাঁর। হারিয়ে ফেলেন কথা বলার শক্তিও।

সিদ্দিকের স্ত্রী ৫ অক্টোবর রাজধানীর মগবাজারে মানুষের কাছে সাহায্য চাইছিলেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, তাঁদের তিন মেয়ে। দুই মেয়ে স্বামীর সংসার করে। এক মেয়ে বিয়ে হলেও তাঁদের সঙ্গে থাকেন। স্বামীর চিকিৎসা, নিজের ওষুধ, সংসারের খরচ—সব মিলিয়ে অনেক টাকা লাগে। মানুষের কাছে হাত পাতা ছাড়া তাঁর আর কোনো উপায় ছিল না।

জীবনযাত্রার উচ্চ ব্যয়, সে অনুপাতে আয় বৃদ্ধি না পাওয়া, কর্মসংস্থান প্রয়োজনীয় হারে না বাড়ায় ভিক্ষাবৃত্তি বেড়েছে বলে মনে করেন কেউ কেউ। এ বিষয়ে কোনো জরিপ না থাকলেও রাস্তাঘাট, দোকানপাট, বাজার—যেখানেই যাওয়া হোক, অনেক মানুষকে ভিক্ষাবৃত্তিতে নিয়োজিত থাকতে দেখা যায়।

রাজধানীর শেওড়াপাড়ার বাসিন্দা শাহাবুদ্দিন খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আধ ঘণ্টা রাস্তায় দাঁড়ালে আপনার কাছে অন্তত পাঁচজন মানুষ ভিক্ষা চাইবে। এত বেশি মানুষ ভিক্ষাবৃত্তিতে আগে ছিল বলে মনে হয় না।’

সমাজসেবা অধিদপ্তর বলছে, সারা দেশে কতসংখ্যক মানুষ ভিক্ষাবৃত্তিতে যুক্ত সে সংক্রান্ত কোনো তথ্য তাদের কাছে নেই। ভিক্ষুক বেড়েছে কি না, তাও তাদের অজানা। অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো.

শাহ জাহান সম্প্রতি প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা একটি জরিপের কথা ভাবছেন।

অবশ্য দেশে দারিদ্র্যের হার বেড়ে যাওয়া দেখে কেউ কেউ ধারণা করছেন, দেশে ভিক্ষাবৃত্তি বেড়েছে। পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের (পিপিআরসি) গবেষণা অনুযায়ী, ২০২২ সালে দেশে দারিদ্র্যের হার ছিল ১৮ দশমিক ৭ শতাংশ (সরকারি হিসাব), যা বেড়ে ২০২৫ সালে দাঁড়িয়েছে ২৭ দশমিক ৯৩ শতাংশ।

যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও শিক্ষক খান মোহাম্মদ রবিউল আলম নিম্ন আয়ের মানুষের সঙ্গে নিয়মিত কথা বলেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ভিক্ষাবৃত্তি বেড়েছে, তা বোঝার জন্য বিস্তৃত গবেষণার প্রয়োজন নেই, আশপাশে তাকালেই বোঝা যায়। এর কারণ অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো নয়।

রবিউল আলম আরও বলেন, অর্থনৈতিক অবস্থা সব শ্রেণির মানুষের ওপরই আঘাত করেছে। সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত নিম্ন আয়ের মানুষ। তাঁদের একাংশ শেষ উপায় হিসেবে ভিক্ষাবৃত্তিকে বেছে নিয়েছেন।

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পরে...

প্রথম আলোর অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে সবচেয়ে বেশি প্রাণ দিয়েছে শ্রমজীবী ও নিম্ন আয়ের মানুষ। কিন্তু অভিযোগ আছে, অন্তর্বর্তী সরকার শ্রমজীবী ও নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য বাড়তি কিছু করেনি। কিন্তু সরকারি চাকরিজীবীদের বাৎসরিক বেতন বৃদ্ধির হার বাড়ানোর পর আবার গঠন করা হয়েছে বেতন কমিশন।

অর্থনীতিবিদ ও নাগরিক অধিকার কমিটির সদস্য আনু মুহাম্মদ প্রথম আলোকে বলেন, প্রধান উপদেষ্টা শূন্য বেকারত্ব ও শূন্য দারিদ্র্য নিয়ে স্বপ্ন দেখেন। কিন্তু তাঁর সময়ে দুটোই বেড়ে গেছে। রাস্তাঘাটে আমরা মানুষদের যে অবস্থা দেখি, সেটা প্রমাণ করে উন্নতির বদলে অবস্থার আরও অবনতি হয়েছে।

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ন ম ন আয় র ম ন ষ প রথম আল ক বর দ দ পর ব র র জন য দশম ক সরক র অবস থ র খরচ

এছাড়াও পড়ুন:

দেশে দরিদ্র ৩ কোটি ৬০ লাখ

দারিদ্র্য কমানোর ক্ষেত্রে উল্টো পথে হাঁটছে বাংলাদেশ। বিশ্বব্যাংক বলছে, দেশে চার বছর ধরে দারিদ্র্যের হার বাড়ছে। সংস্থাটির অনুমিত হিসাব, ২০২৫ সালে দারিদ্র্যের হার হতে পারে ২১ শতাংশের কিছু বেশি। দেশে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩ কোটি ৬০ লাখ।

দেশের জনসংখ্যার বড় একটি অংশ দারিদ্র্যসীমার কিছুটা ওপরে থাকে। তারা উচ্চ মূল্যস্ফীতির মতো বিভিন্ন আঘাতের কারণে দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যাওয়ার ঝুঁকিতে থাকে। বিশ্বব্যাংকের হিসাবে ২০২২ সালে সংখ্যাটি ছিল ৬ কোটি ২০ লাখ।

দেশে দারিদ্র্যের হার হিসাব করে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)। সংস্থাটির খানা আয়–ব্যয় জরিপে এ তথ্য উঠে আসে। সর্বশেষ খানা আয়-ব্যয় জরিপ করা হয়েছিল ২০২২ সালে। তখন সার্বিক দারিদ্র্য হার ছিল ১৮ দশমিক ৭ শতাংশ।

বিশ্বব্যাংকের হিসাবটি মূলত প্রাক্কলন, যা করা হয়েছে ‘মাইক্রো-সিমুলেশন মডেল’ নামের একটি পদ্ধতি ব্যবহার করে। শ্রমবাজারের গতিশীলতা, প্রবাসী আয় এবং সরকারের ভর্তুকি ব্যয়কে ভিত্তি ধরে মাইক্রো-সিমুলেশন মডেলে দারিদ্র্যের হার পর্যালোচনা করা হয়েছে বলে জানিয়েছে বিশ্বব্যাংক।

বাংলাদেশে বিগত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশক থেকে উল্লেখযোগ্য হারে দারিদ্র্য কমতে শুরু করে (১৯৯১–৯২ সালে ছিল ৫৬ দশমিক ৭ শতাংশ)। ২০০০ সালের পর থেকে তা আরও গতি পায়। বাংলাদেশ দারিদ্র্য কমানোর দিক থেকে বিশ্বে সুনাম কুড়িয়েছিল। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, সে ক্ষেত্রে সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশ পেছন দিকে হাঁটছে।

‘বাংলাদেশ: দারিদ্র্য ও বৈষম্য বিশ্লেষণ, সমৃদ্ধির পথে অগ্রযাত্রা’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বিশ্বব্যাংক দারিদ্র্যের হারের নতুন হিসাব দিয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার রাজধানীর এক হোটেলে প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয় এবং আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। অনুষ্ঠানটি আয়োজন করে বিশ্বব্যাংক ও বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (পিআরআই)।

অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পিপিআরসির নির্বাহী চেয়ারম্যান হোসেন জিল্লুর রহমান। তিনি দেশে দারিদ্র্য কমার অতীত চিত্র তুলে ধরে বলেন, ২০২২ থেকে ২০২৫ সাল দুর্ভাগ্যজনকভাবে ‘উল্টো ঘুরে যাওয়ার’ সময়কাল। বিশ্বব্যাংকের তথ্য দেখায়, এটি কোনো আকস্মিক পতন নয়, এটাই বাস্তবতা, দারিদ্র্য বেড়েছে।

পিপিআরসিও দারিদ্র্য হার নিয়ে গত আগস্টে জরিপ প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সেখানে বলা হয়, ২০২৫ সালে দেশের সার্বিক দারিদ্র্য বেড়ে ২৭ দশমিক ৯৩ শতাংশ হয়েছে।

বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন অনুসারে, বর্তমানে মাসিক মাথাপিছু আয় ২ হাজার ৭৫০ টাকা হলে নিম্ন দারিদ্র্যসীমা এবং ৩ হাজার ৮৩২ টাকা হলে মোট দারিদ্র্যসীমা ধরা হয়।

দারিদ্র্য কেন বাড়ছে

বিশ্বব্যাংকের সিনিয়র অর্থনীতিবিদ সার্জিও অলিভিয়েরা অনুষ্ঠানে প্রতিবেদনের বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন। এতে দারিদ্র্য বৃদ্ধির কারণ হিসেবে মোটাদাগে যথেষ্ট কর্মসংস্থান সৃষ্টি না হওয়া, চাকরি হারানো, উচ্চ মূল্যস্ফীতি, মজুরি সেভাবে বৃদ্ধি না পাওয়া ইত্যাদিকে দায়ী করা হয়েছে। সংস্থাটি বলছে, ২০২৩ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে ২০ লাখ কর্মসংস্থান কম হয়েছে। ২০২৫ সালে আরও ৮ লাখ কর্মসংস্থান কম হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। চাকরির বাজার সংকুচিত হওয়ার সবচেয়ে বড় ধাক্কাটি পড়েছে নারী ও তরুণদের ওপর।

২০১৬ সালের পর বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ধরনে পরিবর্তন এসেছে বলে মনে করে বিশ্বব্যাংক। সংস্থাটি বলেছে, এ সময়ে সামগ্রিকভাবে বছরে প্রায় ১৫ লাখ নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে। তবে তার ৬৩ শতাংশই হয়েছে কৃষি খাতে। কৃষিতে কর্মসংস্থানে আয় কম। শহরে কর্মসংস্থান সৃষ্টি অনেকটা স্থবির ছিল।

হোসেন জিল্লুর রহমান

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • দেশে দরিদ্র ৩ কোটি ৬০ লাখ