মোদির সরকারের ইতিহাস বদলের কোপ পড়ছে কেবল মুসলিম শাসকদের ওপর
Published: 26th, November 2025 GMT
বিজেপি জমানায় আধুনিক ভারতের ইতিহাস বিনির্মাণের নবতম কোপ পড়েছে মোগল সম্রাট আকবর ও মহীশুরের শাসক টিপু সুলতানের ওপর। ‘ন্যাশনাল কাউন্সিল অব এডুকেশনাল রিসার্চ অ্যান্ড ট্রেনিং’ (এনসিইআরটি) অনুমোদিত স্কুলশিক্ষার নতুন পাঠ্যপুস্তক থেকে আকবর ও টিপু সুলতানের জন্য ব্যবহৃত বহু প্রচলিত বিশেষণ ‘গ্রেট’ বাতিল করা হয়েছে। ওই দুজন এবার থেকে আর ‘মহান’ নন।
এ নিয়ে যথারীতি চাপানউতর শুরু হয়েছে দেশের শাসক দল বিজেপির সঙ্গে প্রধান বিরোধী কংগ্রেসের। অরাজনৈতিক ইতিহাসবিদেরাও আসরে নেমেছেন। পানাপুকুরে ঢিল ছুড়লে বৃত্তাকার তরঙ্গ সৃষ্টির মতো কিছুটা হইচই হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু কালের নিয়মে অচিরেই তা মিলিয়ে যাবে। আগেও তেমনই হয়েছে। তাতে নতুন ইতিহাস তৈরি বা ইতিহাসের নতুন আখ্যান রচনার চেষ্টা থমকাবে না। রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘ (আরএসএস) ও বিজেপির যৌথ প্রচেষ্টা অব্যাহতই থাকবে। ১১ বছর ধরে যে লক্ষ্যে হিন্দুত্ববাদীরা অটল। অবিচল।
নরেন্দ্র মোদির পর আনন্দীবেন প্যাটেল গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর সংঘের নেতা দীননাথ বাটরার লেখা বই স্কুল পাঠ্যসূচিতে ঢোকানো হয় রাজ্যের ৩৫ হাজার বিদ্যালয়ে পড়ানোর জন্য।মোদি জমানার শুরু ও শিক্ষা সংস্কারনরেন্দ্র মোদি দেশের ক্ষমতায় বসেছিলেন ২০১৪ সালে। ক্ষমতাসীন হওয়ার পাঁচ মাসের মধ্যে তৎকালীন মানবসম্পদ উন্নয়নমন্ত্রী স্মৃতি ইরানির সঙ্গে টানা সাত ঘণ্টা বৈঠক করেছিলেন সংঘের নেতারা। দিল্লির মধ্যপ্রদেশ ভবনে স্মৃতি ইরানির সঙ্গে সেই বৈঠকে যোগ দিয়েছিলেন সুরেশ সোনি, দত্তাত্রেয় হোসাবোলের মতো শীর্ষ সংঘ কর্তা ও শিক্ষা ক্ষেত্রের সঙ্গে যুক্ত নেতারা।
সেই বৈঠকেই স্মৃতি ইরানিকে পাখি পড়ানোর মতো বুঝিয়ে দেওয়া হয়, কেন তাঁরা শিক্ষা ক্ষেত্রে আমূল সংস্করণ চান। ঔপনিবেশিক মূল্যবোধের জায়গায় জাগিয়ে তুলতে চান ভারতের সনাতন মূল্যবোধ ও সংস্কৃতি। স্কুলের পাঠ্যবইয়ে পরিবর্তন এনে ভারতীয়ত্বের ওপর জোর দিতে চান। বদল ঘটাতে চান প্রচলিত ইতিহাস চেতনার।
টিপু সুলতানের আঁকা প্রতিকৃতি.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
সম্রাট আকবর ও টিপু সুলতানের নাম থেকে ‘গ্রেট’ বাদ দিয়ে কী প্রমাণ করতে চাইছে মোদি সরকার
নতুন পাঠ্যপুস্তকে মোগল সম্রাট আকবর ও মহিশূরের শাসক টিপু সুলতানের ‘গ্রেট’ পদবি বাদ দেওয়া নিয়ে ভারতের রাজনীতি উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। এ নিয়ে ক্ষমতাসীন দল বিজেপির সঙ্গে বিরোধে জড়িয়েছে প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেস।
এ বছর ভারতের জাতীয় শিক্ষাবিষয়ক গবেষণা ও প্রশিক্ষণ কাউন্সিল (এনসিইআরটি) নতুন যে পাঠ্যপুস্তক ছাপিয়েছে, সেখানে মোগল সম্রাট আকবর ও মহিশূরের শাসক টিপু সুলতানের নাম থেকে ‘গ্রেট’ শব্দটি বাদ দেওয়া হয়েছে।
কংগ্রেস নেতাদের অভিযোগ, ক্ষমতাসীন বিজেপি সরকার নিজেদের রাজনৈতিক মতাদর্শের সঙ্গে দেশের ইতিহাসকে মেলাতে গিয়ে ভারতের ইতিহাসকে সংকুচিত করছে।
কংগ্রেস এ জন্য বিশেষ করে মোগল আমলের শাসকদের প্রতি বর্তমান বিজেপি সরকারের রাজনৈতিক বিরাগের দিকে ইঙ্গিত করেছে।
কিন্তু বিজেপি এবং রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ (আরএসএস) বলেছে, দীর্ঘদিন ধরে যে সংশোধনের প্রয়োজন ছিল, এই পরিবর্তনগুলো তারই অংশ।
এনসিইআরটির ছাপা নতুন পাঠ্যপুস্তকগুলো ভারতজুড়ে ২৪ হাজারের বেশি মাধ্যমিক স্কুলে (সিবিএসই) পৌঁছে গেছে।
এ প্রসঙ্গে ভারত সরকারকে দেশের ইতিহাসের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে কংগ্রেসের সংসদ সদস্য ইমরান মাসুদ বলেন, আকবর ও টিপু সুলতানরা ৭০০ বছর ধরে এ দেশ শাসন করেছেন। তাঁরা এক দিন বা দুই দিনের শাসক ছিলেন না।
ইমরান মাসুদ সরকারের দিকে প্রশ্ন ছুড়ে দিয়ে আরও বলেন, পদবি সরিয়ে নিয়ে বা যোগ করে কী অর্জন করা যাবে? তিনি ওই দুই শাসকের সময়ে ভারতের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির কথা উল্লেখ করে এএনআইকে বলেন, ‘তাঁদের শাসনামলে জিডিপি ছিল ২৭ শতাংশ। ভারতকে সে সময় সোনার পাখি বলে ডাকা হতো।’
এনসিইআরটির ছাপা নতুন পাঠ্যপুস্তকগুলো ভারতজুড়ে ২৪ হাজারের বেশি মাধ্যমিক স্কুলে (সিবিএসই) পৌঁছে গেছে।মাসুদ ব্রিটিশদের (ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি) হাতে শেষ মোগল সম্রাটকে ফাঁসির সাজা দেওয়ার এবং তাঁর সন্তানদের কঠোর শাস্তি পেতে দেখার অপমানের কথাও স্মরণ করিয়ে দেন।
মাসুদ বলেন, ‘সেই (মোগল) শাসকদের বংশধরেরা এখন কলকাতার রাস্তায় বাসন ধুয়ে জীবিকা নির্বাহ করছেন। আর যাঁরা ব্রিটিশদের সেবা করেছেন, তাঁরা বর্তমান সরকারের ক্ষমতায় বসে আছেন।’
তীব্র বিদ্রূপের সুরে মাসুদ প্রশ্ন তোলেন, ‘কে রানি লক্ষ্মী বাঈয়ের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলেন? কেন তাঁর বংশধরেরা বর্তমান সরকারের মন্ত্রীর পদে বসে আছেন? এটা নিয়ে কেন প্রশ্ন তোলা হচ্ছে না?’
আরও পড়ুনআওরঙ্গজেবের কবর ভাঙার হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি ২৬ মার্চ ২০২৫আকবর ও টিপু সুলতানরা ৭০০ বছর ধরে এ দেশ শাসন করেছেন। তাঁরা এক দিন বা দুই দিনের শাসক ছিলেন না।...ইমরান মাসুদ, কংগ্রেস আইনপ্রণেতাকংগ্রেস নেতা কে মুরালিধরনও পাঠ্যপুস্তকে ইতিহাসের পরিবর্তন করার সমালোচনা করেন।
মুরালিধরন বলেন, ‘আকবর ছিলেন সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির রাজা। তিনি হিন্দু ধর্মকেও গ্রহণ করেছিলেন। আর টিপু সুলতান ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন। এ কারণেই তাঁকে জীবন দিতে হয়েছিল। তাঁরা দুজনই মহান শাসক ছিলেন। তাঁদের প্রতি কেন্দ্রীয় সরকারের এই আচরণ একেবারেই ঠিক নয়।’
উত্তরাখণ্ড কংগ্রেসের জ্যেষ্ঠ নেতা হরিশ রাওয়াত বলেন, (পাঠ্যপুস্তক থেকে) এসব বিষয় বাদ দেওয়া বৃহত্তর এক পরিকল্পনার অংশ।
রাওয়াত সাংবাদিকদের আরও বলেন, ‘আমাদের এখন খেয়াল রাখতে হবে, বিজেপি আর কী কী বাদ দেয়।’
পাঠ্যপুস্তক থেকে গুজরাটে ২০০২ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা এবং ১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদ ভাঙার ইতিহাস পুরোপুরি গায়েব করে দেওয়া হয়েছে। উভয় ঘটনা নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে বর্তমান সরকার এবং বিজেপির জন্য রাজনৈতিকভাবে সংবেদনশীল।এই কংগ্রেস নেতা সতর্ক করে দিয়ে বলেন, ‘যদি তারা সুযোগ পায়, তবে তারা আরও অনেক কিছু বাদ দিয়ে দেবে।’
কংগ্রেস নেতা রাওয়াত ২০২৯ সালের জাতীয় নির্বাচনকে একটি মোড়-ঘোরানো মুহূর্ত হিসেবে তুলে ধরে বলেন, ‘পরিবর্তন ২০২৭ সাল থেকেই শুরু হবে।’
ভারতে পরবর্তী জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে ২০২৯ সালে।
আরও পড়ুনটিপু সুলতানের অনুসারীদের বেঁচে থাকা উচিত নয়: কর্ণাটক বিজেপিপ্রধান১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৩উগ্র হিন্দুত্ববাদী আরএসএস কী বলছে
আরএসএস নেতা সুনীল আম্বেকর বলেন, ‘ইতিহাসের পাঠ্যপুস্তকে অনেক ইতিবাচক পরিবর্তন আনা হয়েছে।’
গত শনিবার নাগপুরে এক অনুষ্ঠানে সুনীল আরও বলেন, তাঁদের পদবি বাদ দেওয়া হয়েছে। তাঁরা কেউ পাঠ্যপুস্তক থেকে বাদ পড়েননি।
শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে সুনীল বলেন, ‘তাঁদের নিষ্ঠুর কাজগুলো সম্পর্কেও জানতে হবে।’ ভবিষ্যতে পাঠ্যপুস্তকে আরও পরিবর্তন আনা হবে বলেও জানান তিনি।
উগ্র হিন্দুত্ববাদী সংগঠনটির নেতা আরও বলেন, ‘এখন তাদের কাছে “আকবর দ্য গ্রেট” থাকছে না এবং “টিপু সুলতান দ্য গ্রেট” থাকছে না।’
‘সেই (মোগল) শাসকদের বংশধরেরা এখন কলকাতার রাস্তায় বাসন ধুয়ে জীবিকা নির্বাহ করছেন। আর যাঁরা ব্রিটিশদের সেবা করেছেন তাঁরা বর্তমান সরকারের ক্ষমতায় বসে আছেন।’এ নিয়ে সমালোচনার বিষয়টি স্বীকার করে সুনীল আরও বলেন, সংশোধনের প্রয়োজন আছে, শিক্ষার্থীদের এ কথাগুলো জানানো দরকার।
স্কুলে ভারতের ইতিহাস কীভাবে পড়ানো উচিত—এ নিয়ে চলমান বিতর্কের মধ্যে এনসিইআরটির পাঠ্যপুস্তক সংশোধন ও পরিবর্তন নতুন উত্তেজনা সৃষ্টি করেছে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভারতে পাঠ্যপুস্তকে মোগল আমল, স্বাধীনতা সংগ্রাম, সাম্প্রদায়িক ভেদাভেদের ইতিহাস এবং বৈজ্ঞানিক অবদানসহ বিভিন্ন বিষয় বারবার পুনর্বিবেচনা ও সংশোধন করা হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে এনসিইআরটি বলেছে, কোভিড-১৯-এর পর শিক্ষার্থীদের ওপর থেকে চাপ কমাতে ‘অতিরিক্ত’ এবং ‘অপ্রাসঙ্গিক’ বিষয়গুলো বাদ দিয়ে এসব পরিবর্তন আনা হয়েছে। এর সঙ্গে পাঠ্যপুস্তকের বা শিক্ষার মান কমে যাওয়ার কোনো সম্পর্ক নেই।
তাঁদের পদবি বাদ দেওয়া হয়েছে। তাঁরা কেউ পাঠ্যপুস্তক থেকে বাদ পড়েননি। তাঁদের নিষ্ঠুর কাজগুলো সম্পর্কেও শিক্ষার্থীদের জানতে হবে।...সুনিল আম্বেকর, আরএসএস নেতাঅথচ পাঠ্যপুস্তক থেকে গুজরাটে ২০০২ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা এবং ১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদ ভাঙার ইতিহাস পুরোপুরি গায়েব করে দেওয়া হয়েছে। উভয় ঘটনা নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে বর্তমান সরকার এবং বিজেপির জন্য রাজনৈতিকভাবে সংবেদনশীল।
পাঠ্যপুস্তক থেকে মহাত্মা গান্ধী হত্যাকাণ্ড, আদিবাসী বিদ্রোহ, দলিত ও মুসলিম সাহিত্যের পাশাপাশি ডারউইনের বিবর্তন তত্ত্ব সম্পর্কিত বিশদ তথ্যগুলোও বাদ দেওয়ায় শিক্ষাবিদ ও বিরোধী দলগুলোর নেতারা বর্তমান পাঠ্যপুস্তক ও শিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন।
আরও পড়ুনসম্রাট আকবর, রানি এলিজাবেথ ও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির জন্ম ১৬ এপ্রিল ২০২৪