জাতীয় নির্বাচন ও নারী: ইশতেহারের প্রতিশ্রুতি ও বাস্তবায়নে ফারাক কি ঘুচবে
Published: 26th, November 2025 GMT
সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে আগামী তিন মাসের মধে৵ বাংলাদেশে বহুপ্রতীক্ষিত ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কতটা সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন সম্পন্ন করতে পারবে, তা নিয়ে জনমনে এখনো অনিশ্চয়তা থাকলেও রাজনৈতিক দলগুলো ইতিমধ্যে জোরেশোরে তাদের প্রস্তুতি শুরু করেছে। আর সেই প্রস্তুতির ধারাবাহিকতায় কিছুদিনের মধ্যেই আমরা হয়তো তাদের নির্বাচনী ইশতেহারও পেয়ে যাব। তবে আনুষ্ঠানিক ইশতেহার ঘোষণার অনেক আগেই বিভিন্ন বক্তৃতা ও সভায় অনানুষ্ঠানিকভাবে তাদের নানা প্রতিশ্রুতির কথা আমরা শুনতে পাচ্ছি।
এর মধ্যে কিছুদিন ধরে যে বিষয়টি নিয়ে বিশেষভাবে আলোচনা হচ্ছে, তা হলো নারীদের অধিকার ও কর্মজীবন প্রসঙ্গে রাজনৈতিক নেতাদের অবস্থান। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, কর্মজীবী নারীদের কর্মঘণ্টা কমানোর প্রসঙ্গে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা.
জামায়াতে ইসলামীর আমিরের এ বক্তব্যের পর সমাজের বিভিন্ন স্তর এবং গণমাধ্যমে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। দেশের বিশাল নারী শ্রমশক্তির কর্মঘণ্টা কমানো কিংবা ভর্তুকি দেওয়ার পরিকল্পনা অর্থনৈতিক দৃষ্টিতে কতটা যৌক্তিক—এই প্রশ্নে অন্য রাজনৈতিক দলগুলোও এখন মতামত দিচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান প্রশ্ন তুলেছেন, ‘নারীর কর্মঘণ্টা কমানোর কথা বলে কি চাকরিদাতাদের কৌশলে নারীদের চাকরি না দেওয়ার দিকে উৎসাহিত করা হচ্ছে না?’ শুধু তা–ই নয়, তিনি কর্মক্ষেত্রে সারা দেশে ডে কেয়ার সেন্টার স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন, যাতে নারীদের পরিবার ও পেশার মধ্যে যেকোনো একটিকে বেছে নিতে বাধ্য না হতে হয়।
২০ নভেম্বর তারেক রহমান নারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পাঁচটি কর্মপরিকল্পনার কথা উল্লেখ করেন। এর মধ্যে ছিল জাতীয় অনলাইন সুরক্ষা–পদ্ধতি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ডিজিটাল নিরাপত্তা শিক্ষা এবং আরও কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ।
নারীর সামাজিক ক্ষমতায়ন নিশ্চিত না হলে রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের স্বপ্ন কেবল ইশতেহারের পাতায় লেখা শব্দ হিসেবেই থেকে যাবে। বাস্তবে তা রূপ নিতে এই দেশের নারীদের আরও বহু বছর অপেক্ষা করতে হবে। তাই এবারের নির্বাচনে প্রতিটি নারীর ভেবেচিন্তে এমন দলকে ভোট দেওয়া প্রয়োজন, যে দল সমতার পথে আরও এক ধাপ এগোতে নারীদের জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি করতে বাস্তব ভূমিকা রাখবে।অন্যদিকে আস-সুন্নাহ ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান শায়খ আহমাদুল্লাহ সম্প্রতি এক বক্তৃতায় বলেন, বাংলাদেশে যৌতুককে জাদুঘরে পাঠিয়ে দেওয়ার কৃতিত্ব একমাত্র ওলামায়ে কেরামের। কাজেই দেখা যাচ্ছে, প্রায় ১৩ কোটি ভোটারের মধ্যে অর্ধেক নারী ভোটারদের সমর্থন পেতে ইতিমধ্যে রাজনৈতিক নেতারা নানা কৌশলী বক্তব্য দেওয়া শুরু করেছেন। তবে প্রশ্ন হলো বিভিন্ন সময়ে নির্বাচনের আগে ঘোষণা দেওয়া এসব রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি ক্ষমতায় যাওয়ার পর রাজনৈতিক দলগুলো কতখানি বাস্তবায়ন করে।
বিএনপি ২০০১ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে জাতীয় সংসদের আসনসংখ্যা ৫০০-তে উন্নীত করা এবং সরাসরি নির্বাচনের মাধ্যমে নারীদের আসন বাড়ানোর করার কথা বলেছিল। ক্ষমতায় থাকার সময়ে তারা সংসদে নারীদের সংরক্ষিত আসন ৩০ থেকে বাড়িয়ে ৪৫ করেছিল; পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগ তা ৫০টিতে উন্নীত করে।
আরও পড়ুননারী–পুরুষের সমতা: আসিয়ান থেকে যা শিখতে পারেন আমাদের তরুণেরা১৩ নভেম্বর ২০২৫বিএনপি ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে প্রকাশিত ইশতেহারের একটি অংশে ২০০১ সালের পরবর্তী পাঁচ বছরে তাদের ‘সফলতা’গুলোর বিবরণ দেয়। সেখানে দলটি দাবি করে, ২০০১ থেকে ক্ষমতায় থাকাকালে নারীদের ক্ষমতায়ন ও মর্যাদা বাড়ানোর লক্ষ্যে ব্যবসায়ে আগ্রহী এবং আত্মকর্মসংস্থানমূলক কর্মকাণ্ডে নিয়োজিত নারীদের সহজ শর্তে ও কম সুদে ঋণ দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি চাকরিতে নারীদের নিয়োগ ও পদোন্নতিতে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে।
এর বাইরে যৌতুক প্রথা, অ্যাসিড নিক্ষেপ এবং নারী ও শিশু পাচার রোধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া, পাশাপাশি মাতৃমৃত্যুর হার ন্যূনতম পর্যায়ে নামিয়ে আনার প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখার কথাও বলা হয় ২০০৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে। তবে বিএনপির ২০১৮ সালের ইশতেহারে যুব, নারী ও শিশু—এই তিনটি শিরোনামকে একত্রে রেখে কিছু অঙ্গীকার করা হয়, যেখানে নারীদের ‘ন্যায়সংগত’ সম্পত্তির উত্তরাধিকার দেওয়ার কথা উল্লেখ করা হয়। এই লক্ষ্যের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বিদ্যমান আইন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখার কথাও বলা হয় ইশতেহারে। তবে ‘ন্যায়সংগত’ শব্দটির কোনো ব্যাখ্যা সেখানে পাওয়া যায় না।
আরও পড়ুনরাজনৈতিক দলগুলোর ইশতেহারে নতুনত্ব আনা জরুরি২৮ অক্টোবর ২০২৫এ ছাড়া ক্রীড়াক্ষেত্রে নারীদের উন্নয়নে পৃষ্ঠপোষকতা করা, নারী নির্যাতন, যৌতুক প্রথা, অ্যাসিড নিক্ষেপ, যৌন হয়রানি, ধর্ষণ, নারী ও শিশু পাচার রোধে কঠোর ও কার্যকর আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের প্রতিশ্রুতিও দেয় বিএনপি।
আওয়ামী লীগ ১৯৯৬ সালের সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ইশতেহারে বলেছিল, ক্ষমতায় গেলে জাতিসংঘের মানবাধিকার সনদ অনুযায়ী নারী ও শিশুদের সম–অধিকার তারা প্রতিষ্ঠা করবে।
পরবর্তী সময়ে ২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে দলটির ‘দিনবদলের সনদ’ শিরোনামের ইশতেহারে নারীর ক্ষমতায়ন প্রসঙ্গে চারটি প্রতিশ্রুতি ঘোষণা করা হয়। সেগুলো হলো ১. নারীর সম–অধিকার ও সুযোগ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ১৯৯৭ সালে প্রণীত ‘নারী উন্নয়ন নীতি’ পুনর্বহাল করা; ২. জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত মহিলা আসনের সংখ্যা ৩৩ শতাংশে উন্নীত করা; ৩. নারী নির্যাতন বন্ধে কঠোর আইনি ব্যবস্থা নেওয়া এবং ৪. বৈষম্যমূলক আইনগুলো সংশোধনসহ কর্মক্ষেত্রে নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।
ইশতেহারের শিক্ষা ও বিজ্ঞান অংশে নারীশিক্ষা উৎসাহিত করার লক্ষ্যে উপবৃত্তি অব্যাহত রাখার কথাও উল্লেখ করা হয়। ইশতেহার অনুযায়ী, ২০০৮ সালে নারীর ক্ষমতায়ন, সম-অধিকার ও সুযোগ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ১৯৯৭ সালে আওয়ামী লীগ সরকার কর্তৃক প্রণীত ‘নারী উন্নয়ন নীতি’ পুনর্বহাল করা হয়। এ ছাড়া পারিবারিক সহিংসতা (দমন ও নিরাপত্তা) আইন ২০১০, মানব পাচার প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ আইন ২০১২ এবং পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইন ২০১১—এ তিনটি আইনও এই সরকারের মেয়াদে প্রণয়ন করা হয়।
তবে নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের জন্য সংসদে সংরক্ষিত আসনে সরাসরি নির্বাচন এবং এক-তৃতীয়াংশ আসন বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করতে পারেনি আওয়ামী লীগ।
এ ছাড়া নারীর ক্ষমতায়ন বিষয়ে জাতীয় পার্টি অষ্টম এবং নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ইশতেহারে সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে সংরক্ষিত মহিলা আসন ৩০ থেকে ৬৪–তে উন্নীত করার প্রতিশ্রুতি দেয়। সর্বশেষ ২০২৬ সালের নির্বাচন সামনে রেখে চূড়ান্ত মনোনয়ন তালিকায় বড় পরিবর্তন আনতে যাচ্ছে জামায়াতে ইসলামী। নারী ও অমুসলিমদের জন্য আলাদা আসন বরাদ্দ রাখার কথাও জানিয়েছেন দলের নীতিনির্ধারকেরা।
বিভিন্ন দলের সংসদ নির্বাচনের ইশতেহারগুলোতে দেখা যায়, নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পায়। সংরক্ষিত নারী আসন বাড়ানো এবং প্রত্যক্ষ নির্বাচনের বিষয়টি বারবার উঠে এসেছে। অথচ বাস্তবে ২০০৮ সালে গণপ্রতিনিধিত্ব আইনের সংশোধনীতে রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য ২০২০ সালের মধ্যে সর্বস্তরে ৩৩ শতাংশ নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার যে বাধ্যবাধকতা ছিল, কোনো দলই তা পূরণ করতে পারেনি।
নারীর সামাজিক ক্ষমতায়ন নিশ্চিত না হলে রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের স্বপ্ন কেবল ইশতেহারের পাতায় লেখা শব্দ হিসেবেই থেকে যাবে। বাস্তবে তা রূপ নিতে এই দেশের নারীদের আরও বহু বছর অপেক্ষা করতে হবে। তাই এবারের নির্বাচনে প্রতিটি নারীর ভেবেচিন্তে এমন দলকে ভোট দেওয়া প্রয়োজন, যে দল সমতার পথে আরও এক ধাপ এগোতে নারীদের জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি করতে বাস্তব ভূমিকা রাখবে।
উম্মে ওয়ারা সহযোগী অধ্যাপক, ক্রিমিনোলজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
*মতামত লেখকের নিজস্ব
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ন শ চ ত কর র ইশত হ র ইশত হ র র ২০০৮ স ল স রক ষ ত র লক ষ য প রসঙ গ র জন য ত কর র আওয় ম ব যবস আসন ব সরক র ব এনপ
এছাড়াও পড়ুন:
জাতীয় নির্বাচন ও নারী: ইশতেহারের প্রতিশ্রুতি ও বাস্তবায়নে ফারাক কি ঘুচবে
সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে আগামী তিন মাসের মধে৵ বাংলাদেশে বহুপ্রতীক্ষিত ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কতটা সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন সম্পন্ন করতে পারবে, তা নিয়ে জনমনে এখনো অনিশ্চয়তা থাকলেও রাজনৈতিক দলগুলো ইতিমধ্যে জোরেশোরে তাদের প্রস্তুতি শুরু করেছে। আর সেই প্রস্তুতির ধারাবাহিকতায় কিছুদিনের মধ্যেই আমরা হয়তো তাদের নির্বাচনী ইশতেহারও পেয়ে যাব। তবে আনুষ্ঠানিক ইশতেহার ঘোষণার অনেক আগেই বিভিন্ন বক্তৃতা ও সভায় অনানুষ্ঠানিকভাবে তাদের নানা প্রতিশ্রুতির কথা আমরা শুনতে পাচ্ছি।
এর মধ্যে কিছুদিন ধরে যে বিষয়টি নিয়ে বিশেষভাবে আলোচনা হচ্ছে, তা হলো নারীদের অধিকার ও কর্মজীবন প্রসঙ্গে রাজনৈতিক নেতাদের অবস্থান। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, কর্মজীবী নারীদের কর্মঘণ্টা কমানোর প্রসঙ্গে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান বলেছেন, ক্ষমতায় গেলে নারীদের কর্মঘণ্টা আট ঘণ্টা থেকে কমিয়ে পাঁচ ঘণ্টা করা হবে। তিনি আরও বলেন, ‘পাঁচ ঘণ্টার পারিশ্রমিক মালিকপক্ষ পরিশোধ করবেন এবং অতিরিক্ত ৩ ঘণ্টার পারিশ্রমিক সরকার দেবে। যাঁরা ঘরের কাজ করবেন, তাঁদের রত্নগর্ভা মা হিসেবে সম্মানিত করা হবে।’
আরও পড়ুনসংরক্ষিত নারী আসনে নির্বাচন: ব্রিটিশ আমল ও পাকিস্তান পর্ব হয়ে বর্তমান চিত্র২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৪জামায়াতে ইসলামীর আমিরের এ বক্তব্যের পর সমাজের বিভিন্ন স্তর এবং গণমাধ্যমে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। দেশের বিশাল নারী শ্রমশক্তির কর্মঘণ্টা কমানো কিংবা ভর্তুকি দেওয়ার পরিকল্পনা অর্থনৈতিক দৃষ্টিতে কতটা যৌক্তিক—এই প্রশ্নে অন্য রাজনৈতিক দলগুলোও এখন মতামত দিচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান প্রশ্ন তুলেছেন, ‘নারীর কর্মঘণ্টা কমানোর কথা বলে কি চাকরিদাতাদের কৌশলে নারীদের চাকরি না দেওয়ার দিকে উৎসাহিত করা হচ্ছে না?’ শুধু তা–ই নয়, তিনি কর্মক্ষেত্রে সারা দেশে ডে কেয়ার সেন্টার স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন, যাতে নারীদের পরিবার ও পেশার মধ্যে যেকোনো একটিকে বেছে নিতে বাধ্য না হতে হয়।
২০ নভেম্বর তারেক রহমান নারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পাঁচটি কর্মপরিকল্পনার কথা উল্লেখ করেন। এর মধ্যে ছিল জাতীয় অনলাইন সুরক্ষা–পদ্ধতি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ডিজিটাল নিরাপত্তা শিক্ষা এবং আরও কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ।
নারীর সামাজিক ক্ষমতায়ন নিশ্চিত না হলে রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের স্বপ্ন কেবল ইশতেহারের পাতায় লেখা শব্দ হিসেবেই থেকে যাবে। বাস্তবে তা রূপ নিতে এই দেশের নারীদের আরও বহু বছর অপেক্ষা করতে হবে। তাই এবারের নির্বাচনে প্রতিটি নারীর ভেবেচিন্তে এমন দলকে ভোট দেওয়া প্রয়োজন, যে দল সমতার পথে আরও এক ধাপ এগোতে নারীদের জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি করতে বাস্তব ভূমিকা রাখবে।অন্যদিকে আস-সুন্নাহ ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান শায়খ আহমাদুল্লাহ সম্প্রতি এক বক্তৃতায় বলেন, বাংলাদেশে যৌতুককে জাদুঘরে পাঠিয়ে দেওয়ার কৃতিত্ব একমাত্র ওলামায়ে কেরামের। কাজেই দেখা যাচ্ছে, প্রায় ১৩ কোটি ভোটারের মধ্যে অর্ধেক নারী ভোটারদের সমর্থন পেতে ইতিমধ্যে রাজনৈতিক নেতারা নানা কৌশলী বক্তব্য দেওয়া শুরু করেছেন। তবে প্রশ্ন হলো বিভিন্ন সময়ে নির্বাচনের আগে ঘোষণা দেওয়া এসব রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি ক্ষমতায় যাওয়ার পর রাজনৈতিক দলগুলো কতখানি বাস্তবায়ন করে।
বিএনপি ২০০১ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে জাতীয় সংসদের আসনসংখ্যা ৫০০-তে উন্নীত করা এবং সরাসরি নির্বাচনের মাধ্যমে নারীদের আসন বাড়ানোর করার কথা বলেছিল। ক্ষমতায় থাকার সময়ে তারা সংসদে নারীদের সংরক্ষিত আসন ৩০ থেকে বাড়িয়ে ৪৫ করেছিল; পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগ তা ৫০টিতে উন্নীত করে।
আরও পড়ুননারী–পুরুষের সমতা: আসিয়ান থেকে যা শিখতে পারেন আমাদের তরুণেরা১৩ নভেম্বর ২০২৫বিএনপি ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে প্রকাশিত ইশতেহারের একটি অংশে ২০০১ সালের পরবর্তী পাঁচ বছরে তাদের ‘সফলতা’গুলোর বিবরণ দেয়। সেখানে দলটি দাবি করে, ২০০১ থেকে ক্ষমতায় থাকাকালে নারীদের ক্ষমতায়ন ও মর্যাদা বাড়ানোর লক্ষ্যে ব্যবসায়ে আগ্রহী এবং আত্মকর্মসংস্থানমূলক কর্মকাণ্ডে নিয়োজিত নারীদের সহজ শর্তে ও কম সুদে ঋণ দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি চাকরিতে নারীদের নিয়োগ ও পদোন্নতিতে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে।
এর বাইরে যৌতুক প্রথা, অ্যাসিড নিক্ষেপ এবং নারী ও শিশু পাচার রোধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া, পাশাপাশি মাতৃমৃত্যুর হার ন্যূনতম পর্যায়ে নামিয়ে আনার প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখার কথাও বলা হয় ২০০৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে। তবে বিএনপির ২০১৮ সালের ইশতেহারে যুব, নারী ও শিশু—এই তিনটি শিরোনামকে একত্রে রেখে কিছু অঙ্গীকার করা হয়, যেখানে নারীদের ‘ন্যায়সংগত’ সম্পত্তির উত্তরাধিকার দেওয়ার কথা উল্লেখ করা হয়। এই লক্ষ্যের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বিদ্যমান আইন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখার কথাও বলা হয় ইশতেহারে। তবে ‘ন্যায়সংগত’ শব্দটির কোনো ব্যাখ্যা সেখানে পাওয়া যায় না।
আরও পড়ুনরাজনৈতিক দলগুলোর ইশতেহারে নতুনত্ব আনা জরুরি২৮ অক্টোবর ২০২৫এ ছাড়া ক্রীড়াক্ষেত্রে নারীদের উন্নয়নে পৃষ্ঠপোষকতা করা, নারী নির্যাতন, যৌতুক প্রথা, অ্যাসিড নিক্ষেপ, যৌন হয়রানি, ধর্ষণ, নারী ও শিশু পাচার রোধে কঠোর ও কার্যকর আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের প্রতিশ্রুতিও দেয় বিএনপি।
আওয়ামী লীগ ১৯৯৬ সালের সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ইশতেহারে বলেছিল, ক্ষমতায় গেলে জাতিসংঘের মানবাধিকার সনদ অনুযায়ী নারী ও শিশুদের সম–অধিকার তারা প্রতিষ্ঠা করবে।
পরবর্তী সময়ে ২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে দলটির ‘দিনবদলের সনদ’ শিরোনামের ইশতেহারে নারীর ক্ষমতায়ন প্রসঙ্গে চারটি প্রতিশ্রুতি ঘোষণা করা হয়। সেগুলো হলো ১. নারীর সম–অধিকার ও সুযোগ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ১৯৯৭ সালে প্রণীত ‘নারী উন্নয়ন নীতি’ পুনর্বহাল করা; ২. জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত মহিলা আসনের সংখ্যা ৩৩ শতাংশে উন্নীত করা; ৩. নারী নির্যাতন বন্ধে কঠোর আইনি ব্যবস্থা নেওয়া এবং ৪. বৈষম্যমূলক আইনগুলো সংশোধনসহ কর্মক্ষেত্রে নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।
ইশতেহারের শিক্ষা ও বিজ্ঞান অংশে নারীশিক্ষা উৎসাহিত করার লক্ষ্যে উপবৃত্তি অব্যাহত রাখার কথাও উল্লেখ করা হয়। ইশতেহার অনুযায়ী, ২০০৮ সালে নারীর ক্ষমতায়ন, সম-অধিকার ও সুযোগ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ১৯৯৭ সালে আওয়ামী লীগ সরকার কর্তৃক প্রণীত ‘নারী উন্নয়ন নীতি’ পুনর্বহাল করা হয়। এ ছাড়া পারিবারিক সহিংসতা (দমন ও নিরাপত্তা) আইন ২০১০, মানব পাচার প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ আইন ২০১২ এবং পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইন ২০১১—এ তিনটি আইনও এই সরকারের মেয়াদে প্রণয়ন করা হয়।
তবে নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের জন্য সংসদে সংরক্ষিত আসনে সরাসরি নির্বাচন এবং এক-তৃতীয়াংশ আসন বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করতে পারেনি আওয়ামী লীগ।
এ ছাড়া নারীর ক্ষমতায়ন বিষয়ে জাতীয় পার্টি অষ্টম এবং নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ইশতেহারে সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে সংরক্ষিত মহিলা আসন ৩০ থেকে ৬৪–তে উন্নীত করার প্রতিশ্রুতি দেয়। সর্বশেষ ২০২৬ সালের নির্বাচন সামনে রেখে চূড়ান্ত মনোনয়ন তালিকায় বড় পরিবর্তন আনতে যাচ্ছে জামায়াতে ইসলামী। নারী ও অমুসলিমদের জন্য আলাদা আসন বরাদ্দ রাখার কথাও জানিয়েছেন দলের নীতিনির্ধারকেরা।
বিভিন্ন দলের সংসদ নির্বাচনের ইশতেহারগুলোতে দেখা যায়, নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পায়। সংরক্ষিত নারী আসন বাড়ানো এবং প্রত্যক্ষ নির্বাচনের বিষয়টি বারবার উঠে এসেছে। অথচ বাস্তবে ২০০৮ সালে গণপ্রতিনিধিত্ব আইনের সংশোধনীতে রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য ২০২০ সালের মধ্যে সর্বস্তরে ৩৩ শতাংশ নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার যে বাধ্যবাধকতা ছিল, কোনো দলই তা পূরণ করতে পারেনি।
নারীর সামাজিক ক্ষমতায়ন নিশ্চিত না হলে রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের স্বপ্ন কেবল ইশতেহারের পাতায় লেখা শব্দ হিসেবেই থেকে যাবে। বাস্তবে তা রূপ নিতে এই দেশের নারীদের আরও বহু বছর অপেক্ষা করতে হবে। তাই এবারের নির্বাচনে প্রতিটি নারীর ভেবেচিন্তে এমন দলকে ভোট দেওয়া প্রয়োজন, যে দল সমতার পথে আরও এক ধাপ এগোতে নারীদের জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি করতে বাস্তব ভূমিকা রাখবে।
উম্মে ওয়ারা সহযোগী অধ্যাপক, ক্রিমিনোলজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
*মতামত লেখকের নিজস্ব