এক বছরেও ১৭ আসামির হদিস পাচ্ছে না পুলিশ
Published: 26th, November 2025 GMT
চট্টগ্রামে আইনজীবী সাইফুল ইসলাম ওরফে আলিফকে কুপিয়ে ও পিটিয়ে হত্যা মামলার ১৭ জন আসামির খোঁজ এক বছরেও পায়নি পুলিশ। তাঁরা পলাতক থাকায় শুরু করা যাচ্ছে না বিচার কার্যক্রম। এ ঘটনায় হতাশ ও ক্ষুব্ধ নিহত ব্যক্তির পরিবার। আজ বুধবার আইনজীবী সাইফুল ইসলাম হত্যা মামলার এক বছর পূর্ণ হচ্ছে।
সাইফুল হত্যা মামলার দ্রুত বিচারের দাবিতে আজ সকালে আইনজীবী ভবনের সম্মুখে মানববন্ধন এবং বিকেলে স্মরণসভার আয়োজন করেছে চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতি।
২১ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে এবং ১৭ জন এখনো পলাতক। তাঁদের বিরুদ্ধে আদালত মালামাল ক্রোকের আদেশ ও হুলিয়া জারি করেছেন। আসামিদের বিষয়ে প্রতিবেদন আসার পর মামলাটি বিচারের জন্য প্রস্তুত হয়ে দায়রা জজ আদালতে বদলি হবে।মো.রায়হানুল ওয়াজেদ চৌধুরী, সরকারি কৌঁসুলি।
হত্যা মামলাটি চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে রয়েছে। আগামী ১ ডিসেম্বর মামলার পরবর্তী তারিখ রয়েছে। জানতে চাইলে সরকারি কৌঁসুলি মো. রায়হানুল ওয়াজেদ চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, সাইফুল হত্যা মামলায় মোট ৩৯ জন আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র গ্রহণ করেছেন আদালত। এর মধ্যে ২১ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে এবং ১৭ জন এখনো পলাতক। তাঁদের বিরুদ্ধে আদালত মালামাল ক্রোকের আদেশ ও হুলিয়া জারি করেছেন। আসামিদের বিষয়ে প্রতিবেদন আসার পর মামলাটি বিচারের জন্য প্রস্তুত হয়ে দায়রা জজ আদালতে বদলি হবে। সেখানে ৩৯ জন আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরু হবে।
২০২৪ সালের ২৬ নভেম্বর জাতীয় পতাকা অবমাননার অভিযোগে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলায় সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র চিন্ময় দাসের জামিনকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষের মধ্যে আইনজীবী সাইফুলকে পিটিয়ে ও কুপিয়ে হত্যা করা হয়। এ হত্যার ঘটনায় তাঁর বাবা জামাল উদ্দিন বাদী হয়ে ৩১ জনের নাম উল্লেখ করে হত্যা মামলা করেন। এ ছাড়া পুলিশের ওপর হামলা, কাজে বাধা এবং আইনজীবী-বিচারপ্রার্থীদের ওপর হামলা ও ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনায় আরও পাঁচটি মামলা হয়। এর মধ্যে হত্যা মামলায় চলতি বছরের ১ জুলাই পুলিশ আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেয়। অভিযোগপত্রে বলা হয়, চিন্ময়ের উসকানি ও নির্দেশে আইনজীবীকে হত্যা করা হয়েছে। আইনজীবীর ঘাড়ে বঁটি দিয়ে দুটি কোপ দেন রিপন দাস। আর কিরিচ দিয়ে কোপান চন্দন দাস। পরে রাস্তায় পড়ে থাকা সাদা শার্ট ও কালো প্যান্ট পরা এই আইনজীবীকে লাঠি, বাটাম, ইট, কিরিচ ও বঁটি দিয়ে আসামিরা পিটিয়ে হত্যা করেন। গত ২৫ আগস্ট আদালত চিন্ময়সহ ৩৯ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র গ্রহণ করেন।
গত বছরের ৩১ অক্টোবর চট্টগ্রাম নগরের চান্দগাঁও মোহরা ওয়ার্ড বিএনপির তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক ফিরোজ খান বাদী হয়ে কোতোয়ালি থানায় চিন্ময় কৃষ্ণ দাসসহ ১৯ জনের বিরুদ্ধে জাতীয় পতাকা অবমাননায় রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে মামলা করেন। পরে ফিরোজ খানকে বিএনপি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। এ মামলায় চিন্ময় কৃষ্ণকে ২৫ নভেম্বর ঢাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। চিন্ময়ের জামিন শুনানিকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষের মধ্যে আইনজীবী সাইফুলকে হত্যা করা হয়। পরে চিন্ময়কে আইনজীবী সাইফুল হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। বর্তমানে তিনিসহ আইনজীবী হত্যায় কারাগারে আটক রয়েছেন ২২ আসামি। শুভ কান্তি দাশ, সুকান্ত দত্ত, রিপন দাশ, পপি দাস, সকু দাস, শিবা দাস, দ্বীপ দাসসহ ১৭ আসামি পলাতক।
পলাতক ১৭ আসামিকে গ্রেপ্তারের বিষয়ে জানতে চাইলে নগর পুলিশের সহকারী কমিশনার (গণমাধ্যম) আমিনুর রশিদ প্রথম আলোকে বলেন, আসামিদের ঠিকানায় গিয়ে পুলিশ তাঁদের পায়নি। তাঁদের গ্রেপ্তারে অভিযান অব্যাহত আছে। এই মামলার বেশির ভাগ আসামি গ্রেপ্তার রয়েছেন।
চিন্ময় কৃষ্ণকে ২৫ নভেম্বর ঢাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। চিন্ময়ের জামিন শুনানিকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষের মধ্যে আইনজীবী সাইফুলকে হত্যা করা হয়। পরে চিন্ময়কে আইনজীবী সাইফুল হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। বর্তমানে তিনিসহ আইনজীবী হত্যায় কারাগারে আটক রয়েছেন ২২ আসামি। শুভ কান্তি দাশ, সুকান্ত দত্ত, রিপন দাশ, পপি দাস, সকু দাস, শিবা দাস, দ্বীপ দাসসহ ১৭ আসামি পলাতক।চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি আবদুস সাত্তার প্রথম আলোকে বলেন, দেশব্যাপী আলোচিত এই মামলার ১৭ আসামি এক বছরেও গ্রেপ্তার না হওয়া দুঃখজনক।
এক বছরেও ছেলে হত্যার বিচার শুরু না হওয়ায় হতাশ নিহত সাইফুলের বাবা জামাল উদ্দিন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, পলাতক আসামিদের গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনা হোক। মামলাটি দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে পাঠানো হোক। তিনি আরও বলেন, ‘ছেলেকে ফিরে পাব না, কিন্তু আসামিদের ফাঁসি যাতে হয়। মৃত্যুর আগে ছেলের হত্যাকারীদের বিচার দেখে যেতে চাই।’
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: গ র প ত র কর প রথম আল ক এক বছর ও আস ম দ র আইনজ ব আস ম র
এছাড়াও পড়ুন:
বিচারের দীর্ঘসূত্রতা দূর করবে ই-পারিবারিক আদালত
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময়ে বিচার বিভাগের নানান সংস্কার হয়েছে। আইনের পাশাপাশি পদ্ধতিগত সংস্কারের বিষয়টিও আশাজাগানিয়া। এর মধ্যে কোর্ট অটোমেশন বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। নারায়ণগঞ্জ জেলায় ই-বেইলবন্ড কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে এ অটোমেশন প্রক্রিয়ার যাত্রা শুরু হয় নভেম্বরের ১৮ তারিখে। যাত্রা শুরুর পর থেকে এই প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা ও গতির কারণে এ উদ্যোগ প্রশংসিত হচ্ছে। আইনজীবীরাও একে স্বাগত জানিয়েছেন। সরকারের এ উদ্যোগকে সাধুবাদ জানিয়েছেন বিচারপ্রার্থী জনগণ।
আগামী ১ ডিসেম্বর থেকে আটটি বিভাগীয় শহরে ই-বেল বন্ডের কার্যক্রম বিস্তৃত হতে যাচ্ছে। আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টার নির্দেশে বিচার বিভাগ অটোমেশনের পরবর্তী সংযোজন ছিল ই-পারিবারিক আদালতব্যবস্থা। এখানে মামলা দায়ের থেকে শুরু করে আইনজীবী নির্বাচন, অনলাইনে কোর্ট ফি দেওয়া, হাজিরা দেওয়া, বিভিন্ন দরখাস্ত দাখিল, সাক্ষ্য গ্রহণ, মামলা ব্যবস্থাপনা, নথি ব্যবস্থাপনাসহ একটি মামলার সার্বিক কার্যক্রম এখন অনলাইনে হবে।
এখন আর কোর্ট–কাছারিতে শুধু হাজিরা দেওয়ার জন্য যাওয়ার প্রয়োজন নেই। অনলাইনেই হাজিরা দেওয়া যাবে। মামলার প্রতি তারিখ খুদে বার্তা ও ই–মেইলের মাধ্যমে জানতে পারবেন মামলার সংশ্লিষ্ট সবাই। আদালতের কর্মচারীদেরও এখন থেকে আর একই কাজ বারবার করতে হবে না। কোর্টের রেজিস্ট্রারসহ নথি বিভাজন সবই হবে কম্পিউটারে ক্লিকের মাধ্যমে।
ছয় মাসের প্রচেষ্টাআইন উপদেষ্টা এই কাজের জন্য সময় বেঁধে দেন ছয় মাস। আইন ও বিচার বিভাগের একটি ছোট দল ছয় মাস ধরে নিরলসভাবে এই সফটওয়্যার উন্নয়ন ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার কাজে যুক্ত হন। সময়ের সীমাবদ্ধতার কারণে কাজটি ছিল ‘প্রায় অসম্ভব’। কারও খাওয়া–ঘুম নেই তো, কেউ শারীরিক অসুস্থতাকে উপেক্ষা করেছেন, কেউবা সারা দিন আদালতে থেকে রাত ১২টা ১টা পর্যন্ত বসে কম্পিউটারে সফটওয়্যার পরীক্ষা করেছেন। এই অসম্ভবকে সম্ভব করতে আমাদের দলের প্রত্যেককেই প্রায় সব সাপ্তাহিক ছুটির দিন কাজ করতে হয়েছে। বারবার ডিজাইন পরিবর্তন, ফ্লো চার্ট তৈরি, সিস্টেম টেস্টিং, সব মিলিয়ে এটি ছিল এক বিশাল ‘ডিজিটাল যজ্ঞ’।
ই-পারিবারিক আদালত ব্যবস্থার কার্যকর বাস্তবায়ন শুধু আদালতকে আধুনিকায়ন নয়; এটি বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি আরও বেশি গ্রহণযোগ্য করে তোলা।এই ‘ডিজিটাল যজ্ঞে’ অন্যতম প্রধান ভূমিকা রেখেছে ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির কম্পিউটার সায়েন্স বিভাগ। তারা সম্পূর্ণ বিনা পয়সায় সফটওয়্যার উন্নয়নে সহযোগী হিসেবে কাজ করেছে। রাত নেই, দিন নেই, যখন যেভাবে তাদের সহযোগিতা চেয়েছি, তারা নিরলস পরিশ্রম করে গেছে।
এই বিশাল যজ্ঞে যারা সব সময় পাশে ছিল, তাদের মধ্যে আছেন বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট। প্রধান বিচারপতির ঘোষিত রোডম্যাপে বিচার বিভাগকে ডিজিটাল করার বিষয়টি ছিল অন্যতম। সুপ্রিম কোর্ট দিকনির্দেশনার পাশাপাশি কম্পিউটার ও কম্পিউটার সামগ্রী দিয়ে এই যাত্রাপথকে সহজ করেছে।
উপদেষ্টার বেঁধে দেওয়া সময় ছিল খুবই অপ্রতুল। তবু আমরা ডেডলাইনের মধ্যে কাজটির প্রথম ধাপ সম্পন্ন করেছি। ২৪ নভেম্বর থেকে ঢাকার একটি পারিবারিক আদালত ও ৩০ নভেম্বর থেকে চট্টগ্রামের একটি ই-পারিবারিক আদালত যাত্রা শুরু করবে।
ই-কোর্টে যা বদলাবেই-পারিবারিক আদালত শুধু একটি প্রযুক্তিগত প্রকল্প নয়, বিভিন্ন অংশীজনও নানাভাবে এর সুফল পাবে। যেমন বিচারপ্রার্থীরা যেকোনো স্থান থেকে মামলা দাখিলের সুযোগ পাবেন। ই-কোর্টে থাকছে ওটিপি ভেরিফিকেশনের মাধ্যমে পরিচয় নিশ্চিত করার ব্যবস্থা। ই-কোর্টে মামলার অগ্রগতি, তারিখ, ফলাফল পাওয়া যাবে একটি ড্যাশবোর্ডেই। এদিকে ডিজিটাল নথির কারণে নথি হারানো বা তথ্যবিভ্রান্তিরও আর সুযোগ থাকবে না।
ই-কোর্টের ফলে আইনজীবীদেরও প্রতিদিন কোর্টে হাজিরা দেওয়ার ঝামেলা কমবে। যেকোনো স্থান থেকেই তাঁরা অনলাইন হাজিরা দিতে পারবেন। এ ছাড়া অনলাইন ও অফলাইনে শুনানির বিষয়টি বিবেচনায় আছে। নিজস্ব পোর্টালে আইনজীবীর পরিচালিত সব নথি থাকবে একসঙ্গে। ফলে ব্যবস্থাপনা হবে সহজ। এদিকে যেকোনো জায়গা থেকে লগইন করে নথির কাজ যেকোনো সময়ে খসড়া করে রাখতে পারবেন আইনজীবীরা।
আদালত সহায়ক কর্মচারীদের কাজও সহজ করবে ই-কোর্ট ব্যবস্থা। ই-কোর্টের ফলে নথি জমা দেওয়া, কপি তোলা ও বারবার একই তথ্য প্রস্তুতের কাজ কমবে। কোর্টের তারিখ ও নথি যাচাই, সবই হবে সিস্টেম-জেনারেটেড। ফলে প্রশাসনিক অদক্ষতা কমে আসবে; সময় বাঁচবে এবং কাজ হবে দ্রুত।
আরও পড়ুনপারিবারিক নির্যাতনকে অপরাধ গণ্য করা হয় না১৯ জানুয়ারি ২০২২বিচারকেরাও পাবেন ই-কোর্টের সুফল। ই-কোর্টের ফলে কেস ম্যানেজমেন্ট সহজ হবে। আসন্ন কাজগুলো দেখা যাবে এক ক্লিকেই। ই-কোর্টের ফলে আদালত সহায়ক কর্মচারীদের তদারকি, কার্যক্রমের অগ্রগতি এবং কর্মীদের কাজের মান মূল্যায়ন হবে আরও স্বচ্ছ ও বাস্তবসম্মত। এ ছাড়া অনলাইনে শুনানির সুযোগের ফলে সংশ্লিষ্ট পক্ষদের অনুপস্থিতির কারণে দিনের পর দিন আর মামলা মুলতবি রাখতে হবে না। জাল বা ভুয়া কোর্ট ফিও প্রতিরোধ হবে। এর ফলে নিশ্চিত হবে সরকারের রাজস্ব আদায়।
ই-পারিবারিক আদালত ব্যবস্থার কার্যকর বাস্তবায়ন শুধু আদালতকে আধুনিকায়ন নয়; এটি বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি আরও বেশি গ্রহণযোগ্য করে তোলা। এই উদ্যোগ সফল হলে দেশের অন্যান্য আদালতেও একই ব্যবস্থা চালু হওয়ার পথ প্রশস্ত হবে। যার ফলে কমে আসবে বিচারব্যবস্থার দীর্ঘসূত্রতা।
ড. উম্মে সরাবন তহুরা উপসচিব, আইন ও বিচার বিভাগ
মতামত লেখকের নিজস্ব