এক মাস পরও শৃঙ্খলা ফেরেনি, পণ্য পেতে সময় লাগছে বেশি
Published: 26th, November 2025 GMT
ঢাকা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের পর এক মাস পেরিয়ে গেলেও আমদানি পণ্য ও কাঁচামাল সরবরাহে এখনো শৃঙ্খলা ফেরেনি। এ কারণে কার্গো উড়োজাহাজ আসা-যাওয়া কমে গেছে। ফলে ব্যবসায়ীদের আর্থিক ক্ষতির মুখোমুখি হতে হচ্ছে।
একাধিক খাতের ব্যবসায়ীরা বলছেন, আমদানি পণ্য রাখার গুদাম বা শেড পুড়ে যাওয়ার পর অস্থায়ী ব্যবস্থা করা হলেও সেখানে তৈরি পোশাক খাতের কাঁচামাল ও সরঞ্জামের বাইরে ছোটখাটো পণ্যসামগ্রী রাখা হয়। বড় পণ্য খোলা আকাশের নিচে রাখা হচ্ছে। ফলে পণ্য খুঁজে পাওয়া বেশ কঠিন হয়ে গেছে। অগ্নিকাণ্ডের আগে উড়োজাহাজে পণ্য দেশে আসার পর দু-তিন দিনের মধ্যে তা হাতে পাওয়া যেত। এখন অনেক ক্ষেত্রে পণ্য বুঝে পেতে ছয়-সাত দিন পর্যন্ত সময় লাগছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, অগ্নিকাণ্ডে দুটি স্ক্যানিং মেশিন পুড়ে গেছে। এ কারণে ঝুঁকিপূর্ণ আমদানি পণ্য যাচাই-বাছাইয়ে বেশি সময় লাগছে। আবার স্ক্যানিং যন্ত্র নষ্ট হয়ে যাওয়ায় নিষিদ্ধ পণ্য দেশে প্রবেশের ঝুঁকিও তৈরি হয়েছে। এমনকি ভুল ঘোষণা দিয়ে শুল্ক ফাঁকি দেওয়ার মতো পরিস্থিতিও তৈরি হয়েছে।
নিট পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম প্রথম আলোকে বলেন, বিমানবন্দর থেকে আমদানি পণ্য ঠিকমতো সরবরাহ হচ্ছে না। পণ্য পেতে ছয়-সাত দিন পর্যন্ত সময় লাগছে। পণ্য খালাসে সিঅ্যান্ডএফের লোকজনও ঠিকমতো ঢুকতে পারছেন না। কারণ, প্রয়োজনীয় সংখ্যক প্রবেশ পাস দেওয়া হচ্ছে না।
কাস্টমস কর্মকর্তাদের তথ্যানুযায়ী, আকাশপথে বিদেশ থেকে কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে আসা পণ্যের এক-তৃতীয়াংশ ডকুমেন্ট বা নথিপত্র। তার বাইরে তৈরি পোশাকের নমুনা (স্যাম্পল), সরঞ্জাম, ওষুধের কাঁচামাল, ইলেকট্রনিকস ও যন্ত্রপাতিও আকাশপথে আনা হয়। কয়েক ডজন এয়ার কুরিয়ার কোম্পানি এই কার্যক্রম পরিচালনা করে। এ কার্যক্রমে যুক্ত রয়েছে বিশ্বখ্যাত ডিএইচএল ও ফেডএক্সের মতো প্রতিষ্ঠান।
আমার কোম্পানির কিছু কাঁচামাল ১১ নভেম্বর থেকে চীনের একটি বিমানবন্দরে পড়ে আছে। সেই পণ্য ২ ডিসেম্বরে বিমানে তুলে দেওয়ার কথা রয়েছে। অথচ আগে দু-তিন দিনের মধ্যেই পণ্য চলে আসতমো.জাকির হোসেন, মহাসচিব, ওষুধশিল্প সমিতি
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিশ্বখ্যাত একটি কুরিয়ার প্রতিষ্ঠানের একজন কর্মকর্তা বলেন, অগ্নিকাণ্ডের বেশ কিছুদিন পর ঢাকামুখী কার্গো বিমান চলাচল আবার শুরু হয়। বর্তমানে সপ্তাহে চারটি কার্গো ফ্লাইট পরিচালনা করা হচ্ছে। আগে সপ্তাহে সাতটি কার্গো ফ্লাইট ঢাকা আসত। অগ্নিকাণ্ডের পর কার্গো ভিলেজে বিশৃঙ্খলার কারণেই মূলত ফ্লাইটের সংখ্যা কমে গেছে।
গত ১৮ অক্টোবর ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ‘কার্গো ভিলেজ কমপ্লেক্সে’ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। আগুন পুরোপুরি নেভাতে ২৬ ঘণ্টা সময় লাগে। ভয়াবহ এই অগ্নিকাণ্ডে কয়েক শ কোটি টাকার পণ্যসামগ্রী ও শিল্পের কাঁচামাল পুড়ে যায়। এ ঘটনায় অনেক ছোট ব্যবসায়ী নিঃস্ব হয়ে যান।
পণ্য সরবরাহে জটিলতা যেখানে
কার্গো ভিলেজে অগ্নিকাণ্ডের আগে পণ্য সরবরাহের জন্য পাঁচটি প্রবেশপথ বা গেট ব্যবহার করা হতো। এখন ব্যবহৃত হচ্ছে দুটি। এ ছাড়া পুড়ে যাওয়া শেড বা ছাউনিগুলো পুনর্নির্মাণ হয়নি। এ কারণে জায়গার অভাবে খোলা মাঠে পণ্য ছড়িয়ে–ছিটিয়ে রাখা হচ্ছে। যদিও অগ্নিকাণ্ডের পর পণ্য রাখার জন্য বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ নিজেরা দুটি তাঁবু ও দুটি কনটেইনার দিয়েছে। এ ছাড়া ওষুধশিল্প সমিতি ওষুধের কাঁচামাল সংরক্ষণে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত দুটি কনটেইনার দিয়েছে।
ঢাকা কাস্টমস এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের কাস্টমস সেক্রেটারি মো. সিরাজ মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, তৈরি পোশাকের জন্য শেড থাকলেও অন্যান্য বড় পণ্য খোলা আকাশের নিচে এলোমেলো রাখা হচ্ছে। তাতে পণ্য খুঁজে পেতে সময় লাগছে। মূলত পণ্য পরিবহনের জন্য ট্রলি ও হেলপার কম থাকায় সময় বেশি লাগছে।
বাংলাদেশ বেসামরিক ও বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক) ৩ নভেম্বর এক নির্দেশনায় ২৪ ঘণ্টার মধ্যে পণ্য নেওয়ার জন্য কড়াকড়ি আরোপ করে। এতে বলা হয়, ২৪ ঘণ্টা মালামাল খালাসের ব্যবস্থা থাকলেও মধ্যরাত থেকে সকাল নয়টা পর্যন্ত পণ্য নেওয়া হচ্ছে না। ফলে কার্গো এলাকায় আমদানি করা মালামাল দিন দিন বাড়ছে। এসব মালামাল যত্রতত্র রাখার কারণে বিমানবন্দর পরিচালনা ব্যাহত ও অগ্নিঝুঁকি তৈরি হচ্ছে।
১৯ নভেম্বর বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস এক নির্দেশনায় বলেছে, রাত ১২টার পর কোনো পণ্য খালাস হচ্ছে না। এতে পণ্যের জট লেগেই থাকছে।
কার্গো ভিলেজের আগুনে দেশীয় অর্ধশতাধিক ওষুধ কোম্পানির ২০০ কোটি টাকার বেশি কাঁচামাল পুড়েছে। এখনো কাঁচামাল আমদানি আগের মতো মসৃণ হয়নি। তাতে কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানের উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে বলে জানান এ খাতের ব্যবসায়ীরা।
বাংলাদেশ ওষুধশিল্প সমিতির মহাসচিব ও ডেলটা ফার্মার ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. জাকির হোসেন গতকাল মঙ্গলবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঢাকায় পণ্য আনার ক্ষেত্রে এয়ারলাইনস কোম্পানিগুলো শৈথিল্য দেখাচ্ছে। আমার কোম্পানির কিছু কাঁচামাল ১১ নভেম্বর থেকে চীনের একটি বিমানবন্দরে পড়ে আছে। সেই পণ্য ২ ডিসেম্বর বিমানে তুলে দেওয়ার কথা রয়েছে। অথচ আগে দু-তিন দিনের মধ্যেই পণ্য চলে আসত। কার্গো ভিলেজে শৃঙ্খলা ফিরে না আসায় এয়ারলাইনসগুলো ঝামেলা এড়াতে কম পণ্য পরিবহন করছে। এতে উৎপাদনে ব্যাহত হচ্ছে।’ দ্রুত পরিস্থিতির উন্নতি দরকার বলে মন্তব্য করেন তিনি।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্যানুযায়ী, বিদায়ী ২০২৪-২৫ অর্থবছরে সমুদ্র, বিমান ও স্থলবন্দর দিয়ে দেশে ৬৫ বিলিয়ন বা ৬ হাজার ৫০০ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি হয়েছে। এর মধ্যে হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে আমদানি হয়েছে ৪ দশমিক ১ বিলিয়ন বা ৪১০ কোটি ডলারের পণ্য। তার মানে এই বিমানবন্দর দিয়ে দেশের মোট আমদানির ৬ শতাংশ পণ্য আসে।
জানতে চাইলে ঢাকা কাস্টমস হাউসের কমিশনার মোসিয়ুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা দ্রুত সেবা দেওয়ার চেষ্টা করছি। আগে ১ লাখ ৫৪ হাজার বর্গফুট এলাকায় শুল্কায়ন প্রক্রিয়া চলত। এখন সেই কাজ ৪০ হাজার বর্গফুটের মধ্যে সামাল দিতে হচ্ছে। সে জন্য রাতেও পণ্য সরবরাহের ব্যবস্থা চালু রয়েছে। যদিও রাতে পণ্য সরবরাহ নেওয়া হচ্ছে কম।’
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: প রথম আল ক ক স টমস ব যবস থ ব যবস য় সময় ল গ র ব যবস র জন য আমদ ন
এছাড়াও পড়ুন:
অবশেষে তিতাসের পাইপলাইন মেরামত, নারায়ণগঞ্জে তিন দিন পর গ্যাস সরবরাহ স্বাভাবিক
নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলায় পঞ্চবটি-মুক্তারপুর উড়ালসড়ক পাইলিংয়ের সময় ফেটে যাওয়া তিতাস গ্যাসের পাইপলাইন তিন দিন পর মেরামত করা হয়েছে। আজ মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ছয়টা থেকে গ্যাস সরবরাহ স্বাভাবিক হয়। এতে টানা তিন দিন ভোগান্তিতে থাকা আবাসিক ও শিল্প-গ্রাহকদের মধ্যে স্বস্তি ফিরেছে।
তিতাস গ্যাসের ফতুল্লা অঞ্চলের ব্যবস্থাপক মো. আতিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, আজ সকাল সাড়ে ছয়টার দিকে ফেটে যাওয়া প্রধান পাইপলাইন মেরামত শেষে গ্যাস সরবরাহ চালু করা হয়েছে। তিনি বলেন, মাটির ২৫ ফুট গভীরে দুটি স্থানে পাইপলাইন ফেটে যাওয়ায় মেরামত করতে বেগ পেতে হয়েছে। মাটি খননের সময় বারবার মাটি ধসে পড়ছিল। পরে লোহার পাত দিয়ে নিরাপত্তা বেষ্টনী তৈরি করে পাইপলাইন মেরামত শেষে পুনরায় গ্যাস সরবরাহ চালু করা হয়েছে। বর্তমানে আবাসিক ও শিল্প গ্রাহক সবাই গ্যাস পাচ্ছেন।
আরও পড়ুননারায়ণগঞ্জে ফেটে যাওয়া পাইপলাইন মেরামত হয়নি, গ্যাস সরবরাহ বন্ধে ভোগান্তি১৯ ঘণ্টা আগেগত শনিবার বিকেল সাড়ে পাঁচটার দিকে সদর উপজেলার এনায়েতনগর ইউনিয়নের শাসনগাঁও এলাকায় পঞ্চবটি-মুক্তারপুর উড়ালসড়কের পাইলিংয়ের সময় মাটির গভীরে থাকা পাইপে আঘাত লাগে। এতে পাইপ ফেটে গ্যাস বের হতে থাকে। দুর্ঘটনা এড়াতে তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষ তাৎক্ষণিকভাবে জেলার বড় অংশে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করে দেয়। এতে হাজার হাজার আবাসিক ও শিল্প-গ্রাহক চরম ভোগান্তিতে পড়েন। তাঁদের বাইরে থেকে খাবার কিনে খেতে হয়েছে। অনেককে লাকড়ির চুলা, ইলেকট্রিক চুলা ও গ্যাস সিলিন্ডারে রান্নার কাজ সারতে হয়েছে। এতে বাড়তি টাকা খরচ করতে হয়েছে।
দক্ষিণ সস্তাপুর এলাকার বাসিন্দা নারায়ণগঞ্জ কলেজের প্রভাষক ফারজানা আফরোজ প্রথম আলোকে বলেন, তিন দিন পর চুলায় গ্যাস এসেছে। এই কয়েক দিন গ্যাস না থাকায় চরম ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে।
ফতুল্লা শিল্পাঞ্চলের একটি ডাইং কারখানার উপব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রথম আলোকে বলেন, তাঁদের কারখানা পুরোপুরি গ্যাসনির্ভর হওয়ায় ডাইং, সুইং, প্রিন্টিং ও ফিনিশিংসহ সব শাখার কাজ বন্ধ ছিল। এতে উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় রপ্তানির সময়সূচি ঝুঁকির মুখে পড়েছে।
শুধু পোশাক ও ডাইং কারখানা নয়, রি-রোলিং মিল, স্পিনিং মিলসহ হাজারো শিল্পকারখানার উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়। কাজ বন্ধ থাকায় উৎপাদনভিত্তিক মজুরিতে কাজ করা শ্রমিকদের এই তিন দিনে আয় কমে বিপাকে পড়তে হয়েছে।
এলাকাবাসী ও শিল্পমালিকদের অভিযোগ, পঞ্চবটি-মুক্তারপুর উড়ালসড়কের পাইলিংয়ের সময় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের অসতর্কতা, অবহেলা ও তিতাস গ্যাসের গাফিলতির কারণে গত এক বছরে ২৮ বার গ্যাসের প্রধান পাইপলাইন ফেটে গেছে। তবে এবার টানা তিন দিন সরবরাহ বন্ধ থাকা একটি নতুন রেকর্ড।
তিতাস গ্যাসের কর্মকর্তা মো. আতিকুল ইসলাম বলেন, উড়ালসড়কের কাজের স্থানে তিতাসের কর্মকর্তা ও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের লোকজন নিয়মিত উপস্থিত থাকেন। তিনি আশা প্রকাশ করেন, ভবিষ্যতে গ্যাস সরবরাহে আর কোনো সমস্যা হবে না।