হাসিনার দুটি লকারে ৮৩২ ভরি সোনার গয়না
Published: 26th, November 2025 GMT
ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দুটি লকার থেকে ৮৩২ ভরি সোনার গয়না পাওয়া গেছে। অগ্রণী ব্যাংকে থাকা ওই লকার দুটি জব্দ করা হয়েছিল। আদালতের অনুমতি নিয়ে মঙ্গলবার একজন ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিতে লকার দুটি খোলা হয়। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) দায়িত্বশীল একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। সূত্র জানায়, লকার খোলার সময় এনবিআরের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সেলের (সিআইসি) পাশাপাশি দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), বাংলাদেশ ব্যাংকসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
‘এক টাকায়’ ৫০ বছর ধরে শিক্ষার আলো ছড়াচ্ছেন যিনি
একটি বাড়ির উঠানে প্লাস্টিকের বস্তার ওপর বসে কয়েকজন শিক্ষার্থীকে পাঠদান করাচ্ছিলেন আশি ছুঁই ছুঁই বয়সের একজন শিক্ষক। শরীরের নানা অঙ্গ-ভঙ্গির মাধ্যমে তিনি পড়া বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন শিশু শিক্ষার্থীদের। তিনি তার কাছে পড়তে আসা শিক্ষার্থীদের কাছে জানতে চাচ্ছিলেন ‘মামার বাড়ি’ কবিতা কে লিখেছেন? শিক্ষার্থীরা সমস্বরে উত্তর দেয়, কবি জসীম উদদীন।
উত্তরের জনপদ গাইবান্ধা সদর উপজেলার মদনেপাড়া গ্রামের মিনারা বেগমের বাড়ির উঠানের চিত্র এটি। শনিবার (২২ নভেম্বর) এই বাড়ির উঠানে কোমলমতি শিশুদের (নার্সারি থেকে পঞ্চম শ্রেণি) গোল করে বসিয়ে পড়াতে দেখা যায় লুৎফর রহমানকে। পড়ানো বাবদ জনপ্রতি দৈনিক এক টাকা সম্মানী নেন। এ জন্য এলাকার মানুষের কাছে তার পরিচিতি ‘এক টাকার মাস্টার’ হিসেবে।
আরো পড়ুন:
৭ ঘণ্টা পর রেল অবরোধ স্থগিত রাবি শিক্ষার্থীদের
হল খালির বিষয়ে ঢাবি প্রক্টরের জরুরি বার্তা
১৯৪৮ সালের ২৩ নভেম্বর জেলার ফুলছড়ি উপজেলার মধ্য উড়িয়া গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন লুৎফর রহমান। গাইবান্ধা শহর থেকে প্রায় ৫ কিলোমিটার দূরে গিদারী ইউনিয়নের বাগুড়িয়া গ্রাম। সেখানকার বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধের ধারে টিনের একটি ঘরে পরিবার নিয়ে বর্তমানে বসবাস করেছেন এই শিক্ষক।
স্ত্রী লতিফুল বেগমসহ দুই মেয়ে ও দুই ছেলেকে নিয়ে সংসার লুৎফর রহমানের। মেয়েদের বিয়ে হয়েছে। বড় ছেলে লাভলু এসএসসির গণ্ডি পেরুতে পারেননি। এখন ইজিবাইক চালান। ছোট ছেলে মশিউর রহমান মাদরাসা থেকে লেখাপড়া শেষ করে ইসলামি ফাউন্ডেশনে চাকরি করছেন। যদিও এখনো তার বেতন হয়নি।
লুৎফর রহমানের শিক্ষকতা জীবনের শুরু ১৯৭৫ সাল। শিশুদের ঝরেপড়া রোধে বিনা পয়সায় পড়ানো শুরু করেন তিনি। পরে অভিভাবকদের অনুরোধে এক টাকা সন্মানি নিতে শুরু করেন। তখন থেকে আজ অবধি এক টাকাই সম্মানি নেন।
বর্তমান শিক্ষার্থীদের অনেক অভিভাবক লুৎফর রহমানের কাছে পড়ালেখা করেছেন
লুৎফর রহমান ১৯৭২ সালে ফুলছড়ি উপজেলার গুণভরি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করেন। এরপর অর্থাভাবে বন্ধ হয়ে যায় পড়ালেখা। নিজে অভাবের অন্ধকারে থাকলেও সিদ্ধান্ত নেন, যে সব শিশুরা প্রাথমিকের গণ্ডি পেরুতে পারে না, তাদের বিনামূল্যে পড়ালেখা শেখানোর। এভাবেই শুরু। প্রায় ৫০ বছর ধরে চলছে তার শিক্ষার আলো ছড়ানোর এই কার্যক্রম।
স্থানীয়রা জানান, প্রতিদিন ফজরের নামাজ পড়ে বাড়ি থেকে বের হন লুৎফর মাস্টার। এরপর পায়ে হেঁটে বাড়ি বাড়ি গিয়ে ছাত্র-ছাত্রী ডেকে আনেন। পরে নির্দিষ্ট একটি বাড়িতে পাঠদান করান। শুধু নিজ এলাকা বাগুড়িয়া কিংবা মদনেরপাড়া নয়, তিনি স্থানীয় পুলবন্দি, চন্দিয়া, ঢুলিপাড়া, কঞ্চিপাড়া এবং শহরের মধ্যপাড়া, পূর্বপাড়া, মিস্ত্রিপাড়াসহ কয়েকটি এলাকার শিক্ষার্থী পড়ান। এভাবে সারাদিন ৭০ থেকে ৮০ জন শিক্ষার্থী পড়িয়ে সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরেন তিনি।
রাইজিংবিডির সঙ্গে কথা বলেছেন লুতফর মাস্টার। সরকারি বাঁধে বসবাস প্রসঙ্গে তিনি জানান, একসময় ৫০–৬০ বিঘা জমি ছিল তার। পুকুরে মাছ, গোয়াল ভরা গরু সবই ছিল। ১৯৭৪ সালের বন্যা আর নদী ভাঙনে ভিটেমাটি সব হারিয়ে আশ্রয় নেন বাগুড়িয়া গ্রামের ওয়াপদা বাঁধে। খুব অভাব তখন। এরপর থেকেই এখানে বসবাস। ঘরবাড়িও জরাজীর্ণ। সারা জীবনে একটি স্থায়ী বাড়ি করতে না পারার আক্ষেপ তার কণ্ঠে।
তিনি বলেন, “আমি ১৯৭২ সালে গুণভরি স্কুল থেকে মেট্রিক পাস করি। ১৯৭৪ সালে বন্যার পর অর্থাভাবে বন্ধ হয়ে যায় পড়ালেখা। পরের বছর ১৯৭৫ সালে সিদ্ধান্ত নেই- অসহায় ও ছিন্নমূল শিক্ষার্থীদের ঝরেপড়া বন্ধ করতে বিনামূল্যে পড়ালেখা শেখাব। তখন থেকেই শুরু। দেশের কল্যাণে দরিদ্র শিক্ষার্থীদের আলোকিত মানুষ হিসেবে গড়ে তোলাই আমার মূল লক্ষ্য।”
গর্ব করে লুৎফর রহমান বলেন, “আমার অনেক শিক্ষার্থী ডাক্তার, ব্যাংকার, শিক্ষক, পুলিশ ও সাব-রেজিষ্টার। কেউ কেউ বিদেশেও চাকরি করছে। তারা সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, আমি এতেই সন্তুষ্ট। টাকা আমার কাছে বিবেচ্য নয়। শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেওয়াই আমার লক্ষ্য।”
অভিভাবকদের ভাষ্য:
মিনারা বেগম বলেন, “২৫ বছর আগে বিয়ে হয়ে আমি এখানে এসেছি। আমার স্বামীও এক ট্যাকার মাস্টারের কাছে পড়েছেন। আমার ছেলে-মেয়েরাও তার কাছেই পড়েছে। এক ছেলে ডিপ্লোমা করছে, আরেক ছেলে কলেজে পড়ে। মেয়েটা ক্লাস থ্রিতে পড়ে। সেও তার কাছে পড়ছে। খুব মনোযোগ আর আদর দিয়ে বাচ্চাদের পড়ান লুৎফর রহমান। টাকার প্রতি তার লোভ নেই। এ ধরনের মানুষ এখন খুঁজে পাওয়া যাবে না।”
অপর শিক্ষার্থীর অভিভাবক সাথি আক্তার বলেন, “খুব সৎ এবং নিবেদিত একজন ব্যক্তি এই স্যার। আমিও তার কাছে পড়েছি। শুনেছি, আমার বাবাও তার কাছে এক টাকা দিয়ে পড়েছে। স্যার আমাদের বলেন, সমাজের শিক্ষা বঞ্চিত যেসব শিশু আছে, তাদের শিক্ষার আলোয় আলোকিত করাই তার লক্ষ্য। আজও তিনি সেটাই করছেন মাত্র এক টাকার বিনিময়ে। এই যুগে এমন দৃশ্য বিরল। তাকে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়া উচিৎ।”
মোস্তাফিজুর নামে এক অভিবাবক বলেন, “লুৎফর মাস্টারের লক্ষ্য প্রাথমিকে ঝরেপড়াসহ ভাঙনকবলিত এলাকার সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের শিক্ষাদান। অভিভাবকদের বুঝিয়ে শিশুদের নিয়ে কখনো রাস্তার ধারে, বাঁধে কিংবা গাছতলায় পড়াতে বসেন তিনি। এখন কয়েকটি বাড়িতে গ্রুপ করে পড়ান। বর্তমানে তার ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা ৫০ থেকে ৬০ জন। প্রতি ব্যাচে ১৫ থেকে ২৫ জন করে পাঠদান করে।”
শিক্ষার্থী আমির হামজা মদনের পাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী। তার ভাষ্য, “স্যার আমাদের অনেক আদর করেন। বাড়ি বাড়ি গিয়ে পড়ান। তার কাছে পড়তে আমাদের অনেক ভালো লাগে। স্যার খুব ভালো মানুষ।”
শুধু আমির হামজা নয়, তার মতো এক টাকায় পড়তে এসেছে মানসুরা তাবাসসুম, তামিম, লিজা আক্তার, আশা মনি, সুমাইয়ারা। তারা প্রত্যেকেই স্যারের কাছে পড়ে ভীষণ আনন্দিত।
লুৎফর রহমানের ছেলে মশিউর রহমান বলেন, “জন্মের পড় থেকেই দেখছি, পায়ে হেঁটে আবার সাইকেলে চড়ে ঘুরে ঘুরে শিশুদের পড়ালেখা শেখাচ্ছেন বাবা। এটি তার নেশা। আমরা বাঁধা দেই না তাকে। বিনা স্বার্থে দেশের জন্য শিক্ষিত প্রজন্ম গড়ার কাজ করছেন, যতদিন বেঁচে আছে করুক। আমরা এতেই সন্তুষ্ট।”
যাদের জীবন আলোকিত করেছেন লুৎফর রহমান:
এক টাকার এই মাস্টারের হাত ধরে এখন পর্যন্ত সহস্রাধিক শিক্ষার্থী জীবন আলোকিত হয়েছে। সমাজে তারা এখন প্রতিষ্ঠিত। সেসব শিক্ষার্থীর একজন আব্দুর রাজ্জাক। তিনি এখন সদর উপজেলার দারুল হুদা আলিম মাদারাসার অধ্যক্ষ। আব্দুর রাজ্জাক বলেন, “লুৎফর স্যারের মতো নির্লোভ ও নিরহংকারী মানুষ আর হয় না। তিনি কখনোই শিক্ষার্থীকে জিম্মি করে অতিরিক্ত অর্থ দাবি করেননি। তিনি অল্পতেই সন্তুষ্ট একজন মানুষ। আমরা তার সর্বাঙ্গীণ মঙ্গল কামনা করি।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ও বিভাগীয় চেয়ারম্যান রাফিউল ইসলাম। রাইজিংবিডি ডটকমকে তিনি বলেন, “শুধু আমি নই, আমার ভাই-বোনরাও তার কাছে পড়েছেন। তার জন্যই প্রাথমিকে ভালো রেজাল্ট করতে পেরেছি। আসলে সমাজে এই ধরনের মানুষগুলো অবহেলিত হয়। আমরা যদি তার পাশে দাঁড়াতে পারতাম, কিছুটা হলেও ঋণমুক্ত হতে পারতাম।”
লুৎফর রহমানের আরেক শিক্ষার্থী আব্দুর রাজ্জাক। চাকরি করেন ঢাকার চাটার্ড লাইফ ইন্সুইরেন্স কোম্পানীতে ম্যানেজার অডিট হিসেবে। জানতে চাইলে তিনি বলেন, “স্যারের হাত ধরেই আমার শিক্ষা জীবনের শুরু। তার অবদান কোনভাবেই অস্বীকার করা যাবে না। আজ থেকে প্রায় ৪০ বছর আগে প্রতিদিন এক টাকায় পড়তাম। এখন দিন বদলে গেছে। স্যার এখনো এক টাকায় পড়ান, যা অবিশ্বাস্য। তার ভবিষ্যত জীবনের একটু সুখের জন্য সরকারি
সহায়তা একান্ত প্রয়োজন।”
আরেক শিক্ষার্থী নুরুন্নবী সরকার। সহকারী উপ-পুলিশ পরিদর্শক হিসেবে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালে কর্মরত রয়েছেন। লুৎফর মাস্টার সম্পর্কে তিনি বলেন, '১৯৮৫ সাল থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত স্যারের কাছে পড়েছি। তিনি ছেড়া স্যান্ডেলে পাটের দড়ি বেঁধে হেটে আমাদের বাড়ি এসে ৫/৬ জনকে পড়াতেন। উনি খুব যত্ন করে ইংলিশ পড়াতেন। ওনার কারণেই আজ আমি প্রতিষ্ঠিত হতে পেরেছি।”
গিদারী ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান হারুন অর রশিদ ইদু বলেন, “লুৎফর মাস্টার একজন ব্যতিক্রমী মানুষ। মাত্র এক টাকার বিনিময়ে এলাকায় শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিচ্ছেন। তার মতো ভালো মানুষ আরো দরকার, তাহলে আমাদের সমাজ বদলে যাবে। ইউনিয়ন পরিষদ থেকে তাকে সাধ্য অনুযায়ী সুবিধা দেওয়া হয়। তাকে সরকারি-বেসরকারি পর্যায় থেকে সহায়তা করা প্রয়োজন।”
এক টাকার মাস্টারের বিষয়ে জানতে চাইলে সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মাহমুদ আল হাসানবলেন, “ওই শিক্ষককে ইতোমধ্যে কিছু সহযোগিতা করা হয়েছে। প্রয়োজন অনুযায়ী তাকে আরো সহযোগিতা করার চেষ্টা করবো।”
ঢাকা/মাসুদ