ইজমা: ইসলামি আইনের অন্যতম ‘দলিল’
Published: 26th, November 2025 GMT
ইসলামি শরিয়তের ভিত্তি কোরআন ও সুন্নাহ। কিন্তু এর পরে আসে ইজমা, অর্থাৎ, উম্মাহর ঐকমত্য। ইসলামি আইন বা ফিকহের দৃষ্টিকোণ থেকে ইজমার প্রামাণিক মর্যাদা কোরআন ও সুন্নাহর পরেই।
যদিও শিয়া ও মুতাজিলা সম্প্রদায় ইজমার দলিল হওয়ার বিষয়ে আপত্তি তুলেছে, কিন্তু তাদের কথাকে ‘অস্বাভাবিক’ বলা হয়। ইজমা কোরআন-সুন্নাহ থেকে উদ্ভূত একটা অনুসরণীয় দলিল।
কেউ যদি ইজমার দলিলে রাজি না হয়, তবুও শরিয়তের প্রয়োজনে তা মানতে হবে। যেমন, এক আল্লাহর ইবাদত, রাসুল-ফেরেশতায় ইমান আনা—এগুলো ইমানের বিষয়ে ইজমা। নামাজ, সামর্থ্যবানের হজ—এগুলো ফিকহের বাস্তব ইজমা।
ইজমা উম্মাহর প্রতিনিধিত্ব করে। আলেম, নেতা, চিন্তাবিদ, শিক্ষিত, সাধারণ মুসলিম সবার মিলিত মতই ইজমা। ফিকহে মতভেদকেও ইজমা বলে মানা হয়। হ্যাঁ, মতভেদের স্বীকৃতি নিজেই একটা ইজমা। উম্মাহ সাধারণভাবে ইজমা মান্য করে থাকে, তাই এক-দুজনের বিরোধিতা এর প্রামাণিক মর্যাদায় কোনো ক্ষতি-বৃদ্ধি করবে না। (ইবনে মুনযির, আল-ইজমা, পৃষ্ঠা ১৫, দারুল কুতুবিল ইলমিয়া, বৈরুত, ১৯৯৯)
আরও পড়ুনফতোয়া কী কেন২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ইজমা কেন দলিল?কোরআনে আল্লাহ বলেছেন, যে ব্যক্তি রাসুলের বিরোধিতা করে এবং মুমিনদের পথ বাদ দিয়ে অন্য পথ অনুসরণ করে, তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। (সুরা নিসা, আয়াত: ১১৫)
এখানে ‘মুমিনদের পথ’ বলতে ইজমাকেই বোঝানো হয়েছে বলে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের আলেমরা একমত। (ইমাম শাফেয়ী, আর-রিসালা, পৃষ্ঠা ৪৬৮-৪৭২, দারুল কুতুবিল ইলমিয়া, বৈরুত, ২০০৫)
হাদিসে রাসুল (সা.
ইজমা দুই প্রকার:
১. প্রয়োজনীয় ও অকাট্য ইজমা—যা উম্মাহর জন্য অপরিহার্য। যেমন, পাঁচ ওয়াক্ত ফরজ নামাজ, রমজানের রোজা, জাকাতের নেসাব, হজের ফরজ হওয়া, মদ্যপান, ব্যভিচার, চুরির শাস্তি ইত্যাদি। এসব বিষয়ে ইজমা অস্বীকার করলে তা ‘কুফর’ হয়।
২. উম্মাহর কষ্ট দূর করার মতো ইজমা। যেমন: খলিফা নির্বাচনের পদ্ধতি, তারাবিহ নামাজের জামাত ইত্যাদি। এসব ক্ষেত্রে কিছু মাসআলায় মতভেদ থাকলেও সেগুলোর অনুমোদনযোগ্যতা ইজমার মাধ্যমে হয়। এসব বিষয়ে ইজমা অস্বীকার করলে পাপী (ফাসেক) হবে, কাফির হবে না। (আত-তাওফি, শারহু মুখতাসারির রাওদা, ৩/৪৫৬, মুয়াসসাতুর রিসালাহ, বৈরুত, ১৯৯৭)
ইবনে হাজম (রহ.) বলেন, ইজমা দাবি করা যাবে মূলত দুই জায়গায়:
ক) সাহাবিগণের ইজমা, যারা সবাই সহিহ সনদে জেনে মেনে নিয়েছেন।
খ) যার বিরোধিতা কুফর—যেমন এক আল্লাহর ইবাদত, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ, রমজানের রোজা, জাকাত, হজ, শরাব-জিনা-চুরির হদ, মৃত পশু ও শূকর হারাম ইত্যাদি। (ইবনে হাজম, আল-মুহাল্লা বিল আসার, ৪/৫০৩-৫০৫, দারুল ফিকর, বৈরুত, ১৯৮৮)
আরও পড়ুনফিকহ শাস্ত্র কাকে বলে১৭ নভেম্বর ২০২৫কাদের ইজমা গণ্য করা হয়?শুধু মুজতাহিদ আলেমদের ঐকমত্যই শরিয়ত–মতে ইজমা হিসেবে গণ্য হবে। সাধারণ মানুষের মত গণ্য করা হয় না। (ইমাম গাজ্জালী, আল-মুসতাসফা, ১/১৭৫-১৮০, দারুল কুতুবিল ইলমিয়া, বৈরুত, ১৯৯৭)
ঐতিহাসিক কয়েকটি ইজমাআবু বকর (রা.)-এর খিলাফত নির্বাচন। (ইবনুল আরাবী, আহকামুল কুরআন, ১/২৪০, দারুল কুতুবিল ইলমিয়া, বৈরুত, ২০০৩)
উসমান (রা.)-এর যুগে কোরআনকে একটি কপিতে সংকলন করা। (আল-জুরকানি, মানাহিলুল ইরফান, ১/২৫০, দারুল কিতাবিল আরাবি, বৈরুত, ১৯৯৫)
উমর (রা.) কর্তৃক তারাবিহ নামাজ জামাতের সঙ্গে পড়ানো। (ইমাম বুখারি, সহিহ বুখারি, কিতাবুস সালাতিত তারাবিহ)
মুরতাদ বা ধর্মদ্রোহীর শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। (ইবনে কুদামা, আল-মুগনি, ৯/১৮, দারুল কিতাবিল আরাবি, বৈরুত, ১৯৯৪)
আধুনিক যুগে ইজমাআজকের যুগে পৃথিবীর সব মুজতাহিদকে একত্র করা অসম্ভব বলে স্পষ্ট ইজমা হওয়া কঠিন। তবে কিছু বিষয়ে এখনো ইজমা রয়েছে—যেমন সুদ হারাম, ধূমপানের নিষিদ্ধতা ইত্যাদি। (শায়খ উসাইমিন, মাজমুউ ফাতাওয়া ওয়া রাসাইল, ৫/১২-৩০, দারুস সামায়ি, রিয়াদ, ২০১০)
ইজমা হলো উম্মাহর জন্য আল্লাহ প্রদত্ত নিরাপত্তা-ব্যবস্থা। এটি কোরআন-সুন্নাহর ব্যাখ্যা ও প্রয়োগে সবচেয়ে বড় নিশ্চয়তা দেয়। যে ব্যক্তি ইজমা অস্বীকার করে, সে আসলে উম্মাহর পথ থেকে বিচ্যুত হয়। আল্লাহ আমাদের কোরআন, সুন্নাহ ও সালাফে সালেহিনের ঐকমত্যের ওঅটল রাখুন। আমিন।
আরও পড়ুনহালাল খাদ্যাভ্যাস কেন গুরুত্বপূর্ণ৩১ আগস্ট ২০২৫উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: দ র ল ক ত ব ল ইলম য় আল ল হ ক রআন ইজম র
এছাড়াও পড়ুন:
ঐকমত্য কমিশনের বিরুদ্ধে আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগ নেই
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বিরুদ্ধে কোনো আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগ নেই বলে দাবি করেছেন কমিশনের সাবেক সহসভাপতি এবং সদ্য নিয়োগ পাওয়া প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী অধ্যাপক আলী রীয়াজ। তিনি বলেছেন, ‘আর্থিক দুর্নীতির প্রশ্নটা আপনি (প্রশ্নকর্তা) তুলেছেন, সেটি তথ্যগতভাবে ভুল। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বিরুদ্ধে কোনো আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগ নেই। কোনো বিশেষ ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান যদি কোনো মিথ্যাচার করে থাকে, তার দায়িত্ব তাকেই নিতে হবে।’
বে অব বেঙ্গল কনভারসেশন সম্মেলনের একটি পর্বে বক্তব্য দেওয়ার পর সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে অধ্যাপক আলী রীয়াজ এ কথাগুলো বলেন। আজ রোববার রাজধানীর একটি হোটেলে এ সম্মেলনের আয়োজন করে সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজ (সিজিএস)।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বিরুদ্ধে আর্থিক অসংগতির বিষয়ে জানতে চাইলে আলী রীয়াজ বলেন, ‘জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের পক্ষ থেকে সুস্পষ্টভাবে টাকার হিসাব দেওয়া হয়েছে। সরকারের বরাদ্দকৃত সাত কোটি টাকার মধ্যে দুই কোটি টাকার কম খরচ করা হয়েছে এবং কীভাবে খরচ করা হয়েছে, সেটা চিফ অ্যাডভাইজারের (প্রধান উপদেষ্টা) অফিস থেকে এবং কমিশনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে।’
অভিযোগকে মিথ্যাচার উল্লেখ করে কমিশনের সাবেক এই সহসভাপতি বলেন, ‘আপনি যে মিথ্যাচারটা রিপিট (পুনরাবৃত্তি) করেছেন, সেটার জন্য আপনাকে আমি আরেকবার শুধু স্মরণ করিয়ে দেব, যেকোনো তথ্যের সর্বশেষ ভাষ্যটি লক্ষ করা খুব জরুরি। কেননা যে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান বা সংগঠন যাঁরা এই প্রশ্ন তুলেছিলেন, তাঁরা কিন্তু এই হিসাবের পরে আর কোনো কথা বলেননি।’
এ ছাড়া আলী রীয়াজের কাছে জানতে চাওয়া হয় জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর অভিযোগের বিষয়ে। জবাবে তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ কেন, এমন পাল্টা প্রশ্ন তুলে তিনি একে মতপ্রকাশের সুযোগ সৃষ্টি বলে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, ‘দেশটার খানিকটা হলো কথাবার্তা বলার, চর্চার একটা সুযোগ তৈরি হয়েছে। যেকোনো রকম কাজ করলে তাদের সমালোচিত হওয়াটাই স্বাভাবিক। ৩০টির বেশি রাজনৈতিক দলের মধ্যে আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়ে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন একটি জাতীয় সনদ তৈরি করতে পেরেছে। এবং সেগুলো বাস্তবায়নের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। আমরা করছি।’
জনগণের সমর্থনে ভবিষ্যতে বাংলাদেশে বিভিন্নভাবে কাঠামোগত এবং সাংবিধানিক সংস্কার সম্ভব হবে—এমন আশাবাদ জানিয়ে আলী রীয়াজ বলেন, ‘ফলে যদি কেউ মনে করেন যে সংস্কারের প্রশ্নটি ইতিমধ্যে মারা গেছে এবং যাঁরা অবিচ্যুয়ারি লিখতে চান, তাঁরা লিখতে পারেন। কারণ, অবিচ্যুয়ারি লেখার অভ্যাস তাঁদের আছে এবং অন্যরা অবিচ্যুয়ারি লিখতে পারেন।’
‘বাংলাদেশের একটা ঐতিহাসিক সুযোগ তৈরি হয়েছে’ এবং তা অব্যাহত থাকবে বলে মনে করেন অধ্যাপক আলী রীয়াজ। তিনি বলেন, ‘আমি জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের পক্ষ থেকে যখন জুলাই জাতীয় সনদ স্বাক্ষরিত হয়, সেই অনুষ্ঠানে সুস্পষ্টভাবে বলেছিলাম যে একটি দলিল দিয়ে আসলে সমস্ত রকম সংস্কার সম্ভব নয়। এটি সূচনা মাত্র এবং জাতীয় সনদের যে শিরোনাম করা হয়েছে, সেটা হচ্ছে—ভবিষ্যতের পথরেখা। আশা করি, সেটা আপনাদের সবারই নজরে থাকবে।’
এর আগে সম্মেলনে অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, দক্ষিণ এশিয়ায় অনেক দেশেই ক্ষমতাসীনেরা নিজেদের ক্ষমতাকে সুসংহত করতে রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করেছে। কর্তৃত্ববাদীরা অর্থনৈতিক উন্নয়ন করলেও গণতন্ত্র ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে না পারায় বাংলাদেশে গণ-অভ্যুত্থান হয়েছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
অধ্যাপক আলী রীয়াজ মনে করেন, সরকারের মাধ্যমে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি হচ্ছে অথবা রাষ্ট্রগুলো দমনমূলক হয়ে উঠছে। তিনি বলেন, নজরদারির ক্ষমতা বৃদ্ধি করে সরকার সংকটকে টিকিয়ে রাখছে। আবার তার বিপরীতে প্রায়ই রাষ্ট্র নিজেও বহিরাগত শক্তির চাপে ভীষণভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে বলেও উল্লেখ করেন তিনি। এ ছাড়া তাঁর বক্তব্যে উঠে আসে সমসাময়িক বাংলাদেশ ও দক্ষিণ এশিয়াসহ বৈশ্বিক পরিস্থিতি।