যুক্তরাষ্ট্রকে নিয়েই ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে একমত ইউরোপ
Published: 3rd, March 2025 GMT
ট্রাম্প-জেলেনস্কির নজিরবিহীন বাগ্বিতণ্ডার পর ইউক্রেনে শান্তি ফেরানোর লক্ষ্যে তৎপর হয়েছে ইউরোপ। ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে রাশিয়ার সঙ্গে সমঝোতা করতে পদক্ষেপ নেওয়ার ব্যাপারে একমত হয়েছেন ইউরোপের নেতারা। তবে যুক্তরাষ্ট্রকে সঙ্গে নিয়েই এটা করতে চান তাঁরা। এ লক্ষ্যে চার দফা পরিকল্পনা প্রকাশ করা হয়েছে।
ইউক্রেন নিয়ে আলোচনা করতে গতকাল রোববার যুক্তরাজ্যের রাজধানী লন্ডনে এক সম্মেলনে বসেছিলেন ইউরোপের বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানেরা।
পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটো ও ইউরোপের ২৭ দেশের জোট ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) শীর্ষ নেতাদের পাশাপাশি ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কিও সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন।
আরও পড়ুনলন্ডন সম্মেলনে ইউক্রেনের পক্ষে চার বিষয়ে মতৈক্য৪ ঘণ্টা আগে‘সিকিউর আওয়ার ফিউচার’ শীর্ষক এই সম্মেলনের আয়োজন করেছিলেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার। গতকাল বাংলাদেশ সময় রাত সাড়ে আটটায় শুরু হয়ে প্রায় দুই ঘণ্টা সম্মেলন চলে। সেই আলোচনা শেষে সংবাদ সম্মেলন করেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী স্টারমার।
ইউক্রেন যুদ্ধ ও এতে ইউরোপের নিরাপত্তা শঙ্কা প্রসঙ্গে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা এখন ইতিহাসের এক সন্ধিক্ষণে রয়েছি। এটা কথা বলার কোনো সময় নয়। স্থায়ীভাবে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য সবাই ঐক্যবদ্ধ ও একসঙ্গে কাজ করার এবং পদক্ষেপ নেওয়ার সময় এটা। ইতিহাস আমাদের একটা কথা বলে, ইউরোপের কোথাও যদি সংঘাত চলতে থাকে, তা একদিন সবার দুয়ারে ধাক্কা দেবে।’
আরও পড়ুনসবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে, লন্ডন সম্মেলন শেষে ইউরোপীয় কমিশনের প্রধান৪ ঘণ্টা আগেভবিষ্যতে আবারও এ বিষয়ে আলোচনার জন্য ইউরোপের নেতারা বৈঠক করবেন জানিয়ে স্টারমার বলেন, এসব পদক্ষেপের গতি অব্যাহত রাখতে ও একটি পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করার জন্য শিগগিরই আবার বৈঠকে বসার বিষয়ে একমত হয়েছেন নেতারা।
ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধের লক্ষ্যে সম্মেলনে যে পরিকল্পনা নেওয়া হলো, তাতে বৈঠকে থাকা অনেক দেশ যুক্ত হতে চায় বলে জানান ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘আমি এটা খুব গুরুত্ব দিয়ে অনুধাবন করি যে কিছু দেশ এগিয়ে না এলে আমরা যে অবস্থানে আছি, সেখানেই থেকে যাব। আমরা এগিয়ে যেতে পারব না। তাই ইউরোপকেই বড় দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে।’
আরও পড়ুনইউক্রেন নিয়ে লন্ডন সম্মেলনের ওপর নজর রাখছে মস্কো৫ ঘণ্টা আগেচার দফা শান্তি পরিকল্পনা
ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে লন্ডন সম্মেলনে চার দফা একটি পরিকল্পনার বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে বলে জানান কিয়ার স্টারমার। তিনি বলেন, যুদ্ধ বন্ধে একটি পরিকল্পনা প্রণয়নের জন্য ইউক্রেনের সঙ্গে কাজ করতে একমত হয়েছে যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও অন্য ইউরোপীয় দেশ। এই পরিকল্পনা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনা করা হবে এবং এরপর যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ মিলে এই পরিকল্পনা নিয়ে এগোবে।
ইউক্রেনে শান্তি প্রতিষ্ঠার বিষয়ে সম্মেলনে চার দফা পরিকল্পনা হলো: যুদ্ধ চলাকালে ইউক্রেনে সামরিক সহায়তা অব্যাহত রাখতে হবে এবং রাশিয়ার ওপর অর্থনৈতিক চাপ বৃদ্ধি করতে হবে; স্থায়ী শান্তির ক্ষেত্রে ইউক্রেনের সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে এবং যেকোনো শান্তি আলোচনার টেবিলে ইউক্রেনকে অবশ্যই রাখতে হবে; শান্তিচুক্তির ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণ ঠেকানোর লক্ষ্যে কাজ করতে হবে ইউরোপের নেতাদের; ইউক্রেনের সুরক্ষার জন্য একটি জোট গঠন করতে হবে এবং দেশটিতে শান্তি নিশ্চিত করতে হবে।
আরও পড়ুনইউরোপের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা ও ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে আলোচনা৫ ঘণ্টা আগেকিয়ার স্টারমার বলেন, ‘আজ এ সম্মেলনের মাধ্যমে যে গতি এল, সেটাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্যই এই পরিকল্পনা। এর লক্ষ্য শান্তি প্রতিষ্ঠা করা এবং এটা নিশ্চিত করা যে আমরা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আছি। ইউরোপ ও যুক্তরাজ্যের নিরাপত্তা নিশ্চিতের এটাই সবচেয়ে ভালো উপায়।’
এর পাশাপাশি রাশিয়ার বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাওয়ার জন্য ইউক্রেনকে ১৬০ কোটি পাউন্ড দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন কিয়ার স্টারমার। যুক্তরাজ্যের দেওয়া এই অর্থ খরচ করে ইউক্রেনের জন্য পাঁচ হাজারের বেশি ক্ষেপণাস্ত্র কেনা হবে। ওই ক্ষেপণাস্ত্রগুলো ইউক্রেনের আকাশ প্রতিরক্ষার কাজে ব্যবহার করা হবে।
স্টারমার বলেন, ‘ইউরোপকে অবশ্যই বড় দায়িত্ব নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। তবে আমাদের এই মহাদেশে শান্তি প্রতিষ্ঠার পদক্ষেপ ও তা সফল হওয়ার জন্য অবশ্যই যুক্তরাষ্ট্রের শক্তিশালী সমর্থন থাকতে হবে।’
আরও পড়ুনইউক্রেন নিয়ে লন্ডনে সম্মেলন শুরু, যোগ দিয়েছেন ইউরোপের নেতারা৬ ঘণ্টা আগেসম্মেলনে ছিলেন জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎজ। সম্মেলন শেষে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, যুদ্ধ শেষে ইউক্রেনে যেন একটি শক্তিশালী সামরিক বাহিনী থাকে, সেটা নিশ্চিত করা পশ্চিমা মিত্রদেশগুলোর মূল লক্ষ্য হবে। সবকিছুর ভিত্তি হবে ইউক্রেনের একটা শক্তিশালী সামরিক বাহিনী।
আরও পড়ুনইউরোপ কি যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড়া ইউক্রেনে শান্তি নিশ্চিত করতে পারবে২ ঘণ্টা আগে‘খারাপ পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে’
সম্মেলনে ‘ভালো ও খোলামেলা আলোচনা’ হয়েছে বলে জানিয়েছেন ইউরোপীয় কমিশনের প্রধান উরসুলা ভন ডার লিয়েন। সম্মেলন শেষে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমাদের প্রতিরক্ষাব্যবস্থা শক্তিশালী করতে হবে। সত্যিকার অর্থে আমাদের বিশাল পরিসরে অগ্রসর হতে হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘এখন আমাদের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো ব্যয় বাড়ানো। সবচেয়ে খারাপ কিছুর জন্য আমাদের প্রস্তুত থাকাটা গুরুত্বপূর্ণ।’
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের উদ্দেশে বার্তা দিয়ে উরসুলা ভন ডার লিয়েন বলেন, ‘আমরা আপনার সঙ্গে কাজ করতে প্রস্তুত রয়েছি গণতন্ত্র রক্ষার জন্য, এই নীতি বজায় রাখার জন্য আপনি আপনার প্রতিবেশী দেশে আক্রমণ করতে পারবেন না বা শক্তি প্রয়োগ করে সীমান্ত পাল্টে ফেলতে পারবেন না।’
সম্মেলনে নজর ছিল রাশিয়ার
স্বাভাবিকভাবেই লন্ডন সম্মেলনে নজর ছিল রাশিয়ার। গতকাল রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ সেই সম্মেলনের আগে অভিযোগ করেন, ৫০০ বছর ধরে বিশ্বে ঘটে যাওয়া দুঃখজনক ঘটনাগুলোর সবই হয় ইউরোপ থেকে সৃষ্টি হয়েছে অথবা ইউরোপীয় নীতির কারণে ঘটেছে। লাভরভ এটাও বলেন, কোনো সংঘাত উসকে দেওয়ার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো ভূমিকা ছিল না।
শুক্রবার হোয়াইট হাউসে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্সের বাগ্বিতণ্ডা হয়। এরপর জেলেনস্কি ও ইউক্রেনের পাশে দাঁড়িয়েছেন ইউরোপের নেতারা। যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনের ওপর থেকে সমর্থন পুরোপুরি প্রত্যাহার করে নিচ্ছে এবং এর ফলে দেশটি রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে আরও ‘ব্যাকফুটে’ চলে যাবে—ইউরোপের শঙ্কার মধ্যে এ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হলো।
গতকালের সম্মেলনে অন্যান্যের মধ্যে যোগ দেন ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ, ইতালির প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়া মেলোনি, সামরিক জোট ন্যাটোর প্রধান মার্ক রুটে। পোল্যান্ড, ডেনমার্ক, ইতালি, নেদারল্যান্ডস, নরওয়ে, স্পেন, কানাডা, ফিনল্যান্ড, সুইডেন ও চেক প্রজাতন্ত্রের নেতারাও সম্মেলনে যোগ দেন।
এখন ইউক্রেনের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা নিয়ে যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সের মতো অন্যান্য দেশেরও এগিয়ে আসা উচিত বলে মনে করেন লন্ডনভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ইউরেশিয়া ডেমোক্রেসি ইনিশিয়েটিভের নির্বাহী পরিচালক পিটার জালমায়েভ। তিনি আল-জাজিরাকে বলেন, ইউরোপ যদি এবার জেগে না ওঠে, তাহলে আর কখনোই জাগবে না।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ইউর প র ন ত র ইউক র ন র প য় ছ ন ইউর প ন শ চ ত কর ন ইউর প র ইউর প য় পদক ষ প র জন য র বল ন ক জ কর আম দ র গতক ল
এছাড়াও পড়ুন:
ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে ভোট, একমত ইউনূস ও তারেক
ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচনের সময় নির্ধারণ নিয়ে রাজনীতিতে টানাপোড়েন যেভাবে অনিশ্চয়তার দিকে যাচ্ছিল, লন্ডন বৈঠকে তা অনেকটা কেটেছে।
গতকাল শুক্রবার অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের এই বৈঠক হয়। বৈঠক শেষে যৌথ বিবৃতিতে ঘোষণা আসে, সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করা গেলে আগামী বছরের রমজান মাসের আগে অর্থাৎ ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে নির্বাচন হতে পারে। এর মধ্য দিয়ে লন্ডন বৈঠক নিয়ে দেশে যে কৌতূহল ও উৎকণ্ঠা ছিল, সেটার সমাপ্তি ঘটেছে।
চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দাবি জানিয়ে আসছিল বিএনপিসহ বিভিন্ন দল। এর মধ্যেই ৬ জুন ঈদুল আজহার আগের দিন জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস বলেছিলেন, জাতীয় নির্বাচন ২০২৬ সালের এপ্রিলের প্রথমার্ধে অনুষ্ঠিত হবে।
নির্বাচনের সময়সীমা নিয়ে সরকারপ্রধানের এই ঘোষণা বিএনপি মেনে নিতে পারেনি। এ নিয়ে দলটির নেতারা প্রকাশ্যেই অসন্তুষ্টির কথা জানান। অবশ্য সরকার–ঘনিষ্ঠ সূত্র থেকে জানা গেছে, ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে নির্বাচনের সময় নির্ধারণের জন্য উপদেষ্টাদের কেউ কেউ জাতির উদ্দেশে ভাষণের আগে অধ্যাপক ইউনূসকে পরামর্শ দিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি এপ্রিলকে উপযুক্ত মনে করেছিলেন।
জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণের এক সপ্তাহের মাথায় লন্ডন বৈঠকে নির্বাচনের সময়সীমা নিয়ে নতুন ঘোষণা এল। ধারণা করা হচ্ছে ফেব্রুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহে ভোট হতে পারে।
নির্বাচনের সময়সীমা নিয়ে ঐকমত্যে পৌঁছানোর ঘটনাকে বিবৃতি দিয়ে স্বাগত জানিয়েছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও জোট। দলগুলো বলেছে, এর মাধ্যমে জাতি ‘স্বস্তির বার্তা’ পেয়েছে।
এ বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল গত রাতে প্রথম আলোকে বলেন, অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস ও তারেক রহমানের বৈঠক নিয়ে অনেকের দুর্ভাবনা ছিল। সেটা কেটে গেছে, গোটা জাতি স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেছে। অধ্যাপক ইউনূস দুঃসময়ে জাতির অভিভাবক হিসেবে নিজের বিশালত্ব, গভীরতা ও প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়েছেন। বিএনপি নেতা তারেক রহমানও যথোচিত সৌজন্যবোধ, পরিণত বুদ্ধি ও রাষ্ট্রনায়কসুলভ সম্ভাবনার স্বাক্ষর রেখেছেন। তিনি বলেন, বিচার বা সংস্কার বিষয়ে সরকারের সঙ্গে বিএনপির বড় ধরনের মতপার্থক্য নেই। মতপার্থক্য ছিল নির্বাচনের সময় নিয়ে। দুজনের (ইউনূস-তারেক) বৈঠকের পর এই মতপার্থক্যও অনেকটা কমে এসেছে।
যদিও লন্ডন বৈঠকে নির্বাচনের সম্ভাব্য সময় নিয়ে সরকার ও বিএনপির মধ্যে যে প্রক্রিয়ায় সমঝোতা হয়েছে এবং সেটি যেভাবে যৌথ ঘোষণার মাধ্যমে প্রকাশ করা হয়েছে, তাতে সন্তুষ্ট হতে পারেনি জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন, জাতীয় নাগরিক পার্টিসহ (এনসিপি) কয়েকটি রাজনৈতিক দল। দলগুলোর নেতারা বলছেন, ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে নির্বাচনের ব্যাপারে তাঁদের ভিন্নমত নেই। দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দলের সঙ্গে এ বিষয়ে সরকারের সমঝোতায়ও তাঁরা অসন্তুষ্ট নন। তাঁদের প্রশ্ন এক জায়গায়। সেটি হচ্ছে, সরকার এভাবে একটি দলের সঙ্গে নির্বাচনের বিষয়ে যৌথ ঘোষণা দিতে পারে কি না? এটা কতটা নৈতিক।
লন্ডন বৈঠকের বিষয়ে এনসিপির আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়ায় বলা হয়, জুলাই ঘোষণাপত্র প্রণয়ন, মৌলিক সংস্কার বাস্তবায়নে জুলাই সনদ কার্যকর করা ও বিচারের রোডম্যাপ ঘোষণার পরই নির্বাচনসংক্রান্ত আলোচনা চূড়ান্ত হওয়া উচিত। এনসিপি মনে করে, নির্বাচন প্রশ্নে সরকার কেবল একটি রাজনৈতিক দলের অবস্থান ও দাবিকেই বেশি প্রাধান্য দিচ্ছে।
এ বিষয়ে জামায়াত ও ইসলামী আন্দোলন দলীয় ফোরামে আলোচনা করে আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানাবে বলে দলীয় সূত্র জানিয়েছে।
গতকাল যুক্তরাজ্যের রাজধানী লন্ডনের ডরচেস্টার হোটেলে সেখানকার সময় সকাল নয়টায় (বাংলাদেশ সময় বেলা দুইটা) অধ্যাপক ইউনূস ও তারেক রহমানের মধ্যে বৈঠক শুরু হয়। তাঁরা প্রায় দেড় ঘণ্টা কথা বলেন। এর মধ্যে বড় একটি সময় অধ্যাপক ইউনূস ও তারেক রহমান একান্তে বৈঠক করেন। পরে ওই হোটেলেই যৌথ সংবাদ সম্মেলন করেন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম ও তারেক রহমানের আন্তর্জাতিক সম্পর্কবিষয়ক উপদেষ্টা হুমায়ুন কবির। একান্ত আলোচনায় দুই নেতা ‘সন্তুষ্ট’ হয়েছেন বলে তাঁরা জানান।
সংবাদ সম্মেলনে যৌথ বিবৃতি (সরকার ও বিএনপি) পড়ে শোনান নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান। তাতে বলা হয়, অত্যন্ত সৌহার্দ্যমূলক পরিবেশে অধ্যাপক ইউনূস ও তারেক রহমানের মধ্যে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। তারেক রহমান প্রধান উপদেষ্টার কাছে আগামী বছরের রমজানের আগে নির্বাচন আয়োজনের জন্য প্রস্তাব করেন। দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াও মনে করেন, ওই সময় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে ভালো হয়। প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, তিনি আগামী বছরের এপ্রিলের প্রথমার্ধের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘোষণা দিয়েছেন। সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করা গেলে ২০২৬ সালের রমজান শুরু হওয়ার আগের সপ্তাহেও নির্বাচন আয়োজন করা যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে সেই সময়ের মধ্যে সংস্কার ও বিচারের বিষয়ে পর্যাপ্ত অগ্রগতি অর্জন করা প্রয়োজন হবে।
যৌথ বিবৃতিতে আরও বলা হয়, তারেক রহমান প্রধান উপদেষ্টার এ অবস্থানকে স্বাগত জানান এবং দলের পক্ষ থেকে তাঁকে ধন্যবাদ জানান। প্রধান উপদেষ্টাও তারেক রহমানকে ফলপ্রসূ আলোচনার জন্য ধন্যবাদ জানান।
প্রশ্নোত্তরে যা বললেন সরকার ও বিএনপির প্রতিনিধিপরে প্রশ্নোত্তর পর্বে এক সাংবাদিক জানতে চান, তাহলে কি সরকার এপ্রিলের প্রথমার্ধে নির্বাচনের ঘোষণা থেকে সরে আসছে? জবাবে নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান বলেন, ‘যৌথ ঘোষণায় এই বিষয়টি সুস্পষ্টই বলা আছে। আপনারা শুনেছেন। যদি সব কাজ সময়মতো আমরা করতে পারি এবং বিচার ও সংস্কারের ব্যাপারে পর্যাপ্ত অগ্রগতি হয়, তাহলে নিশ্চয়ই সেটা করা যেতে পারে।’
তাহলে নির্বাচনের একটি নির্দিষ্ট তারিখ নির্ধারণে সমস্যাটা কোথায়? এমন প্রশ্নের জবাবে খলিলুর রহমান বলেন, ‘আমরা কোনো সমস্যা দেখছি না। নির্বাচন সম্পর্কে আজকে যৌথ বিবৃতিতে আমরা বলে দিয়েছি দুই পক্ষই। আমরা আশা করব, নির্বাচন কমিশন শিগগিরই একটা তারিখ ঘোষণা করবে।’
নির্বাচনের সম্ভাব্য সময়সীমা ছাড়া লন্ডন বৈঠকে আর কী কী বিষয়ে আলোচনা হয়েছে, এ ছাড়া সংস্কার, বিচার, জুলাই ঘোষণা নিয়ে কোনো সমঝোতা হয়েছে কি না, সে সম্পর্কে যৌথ বিবৃতিতে পরিষ্কার ধারণা পাওয়া যায়নি।
তবে যৌথ সংবাদ সম্মেলনে এ-সংক্রান্ত এক প্রশ্নের জবাবে বিএনপি নেতা আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘সব বিষয়ে আলোচনা তো হবে, এটাই স্বাভাবিক। আমরা তো নতুন বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় নিয়ে সামনের দিকে এগোচ্ছি। আমরা সবাই চাই, দেশ গড়ার যে প্রত্যয় আমরা নিয়েছি, আমরা ঐক্যবদ্ধভাবে সেই কাজটা করব। বাংলাদেশ গড়ার যে প্রত্যয় নিয়ে আমরা সবাই ঐকমত্যে এসেছি, শুধু নির্বাচনের আগে নয়, নির্বাচনের পরও সেটা আমরা সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাব।’
অধ্যাপক ইউনূসের সঙ্গে তারেক রহমানের বৈঠকে জুলাই সনদ নিয়ে কোনো কথা হয়েছে কি না, জানতে চাইলে আমীর খসরু বলেন, ‘জুলাই সনদ নিয়ে তো ইতিমধ্যে আলোচনা চলছে দেশে। এ ব্যাপারে আমাদের মধ্যে ইতিমধ্যে সিদ্ধান্ত আছে যে ঐকমত্যের ভিত্তিতে জুলাই সনদ হবে। সংস্কারের ব্যাপারেও একই উত্তর আমাকে দিতে হয় যে ঐকমত্যের ভিত্তিতে আমরা সংস্কার ও জুলাই সনদ—দুটোই করব। সবার ঐকমত্যের পরিপ্রেক্ষিতে সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে এবং আমি নিশ্চিত, খুব কম সময়ের মধ্যে আমরা সেই সিদ্ধান্ত নিতে পারব।’
এক সাংবাদিক প্রশ্ন করেন, নতুন রাজনৈতিক দল এনসিপি নির্বাচন কমিশনের সংস্কার ছাড়া নির্বাচনে যাবে না বলে ঘোষণা করেছে। এ বিষয়ে কোনো আলোচনা হয়েছে কি না? জবাবে আমীর খসরু মাহমুদ বলেন, ‘এ ব্যাপারে এখানে আলোচনার কোনো সুযোগ আছে বলে আমি মনে করি না।’ এ প্রশ্নে নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান বলেন, ‘এটা তাদের (এনসিপি) জিজ্ঞেস করুন। প্রতিটি দলের নিজস্ব মতামত আছে। তবে আমরা সবাইকে নিয়ে নির্বাচনটা করতে চাচ্ছি।’
প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, নির্বাচনের আগেই শেখ হাসিনার হত্যাযজ্ঞের বিচারপ্রক্রিয়া তিনি শেষ করতে চান এবং পরে তাঁকে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবেন। এ ব্যাপারে বৈঠকে আলোচনা হয়েছে কি না, সেটা হয়ে থাকলে নির্বাচনের রূপরেখায় এর কোনো প্রভাব ফেলবে কি না? এমন প্রশ্নের জবাবে খলিলুর রহমান বলেন, ‘যৌথ বিবৃতিতে এর উত্তর দেওয়া আছে। সংস্কার এবং বিচার; দুই বিষয়ে পর্যাপ্ত অগ্রগতির কথা বলা হয়েছে এবং আমরা মোটামুটি কনফিডেন্ট (আত্মবিশ্বাসী) যে এই অগ্রগতি আমরা নির্বাচনের আগেই দেখতে পাব।’
তারেক রহমানের দেশে ফেরা নিয়ে বৈঠকে কোনো আলোচনা হয়েছে কি না বা তিনি কবে দেশে ফিরতে পারেন? এমন প্রশ্নের উত্তরে আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘এ ব্যাপারে আলোচনার কোনো প্রয়োজনীয়তা আছে বলে আমরা মনে করি না। তারেক রহমান সাহেব যখনই ইচ্ছা দেশে ফিরে যেতে পারবেন। সুতরাং এটার সিদ্ধান্ত তিনি নেবেন, সময়মতো।’
সংবাদ সম্মেলনে শেষ প্রশ্ন ছিল, ‘বৈঠকে আলোচনায় আপনারা কি সন্তুষ্ট?’ সমস্বরে এ প্রশ্নের জবাব দেন খলিলুর রহমান ও আমীর খসরু মাহমুদ। দুজনই বলেন, ‘নিশ্চয়ই সন্তুষ্ট।’ এর সঙ্গে আমীর খসরু বলেন, ‘আমরা তো বলছি নির্বাচনের আগে নয়, নির্বাচনের পরও নতুন বাংলাদেশ গড়ার ক্ষেত্রে আমাদের সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।’ এরপর খলিলুর রহমান বলেন, ‘সন্তুষ্ট না হলে তো যৌথ ঘোষণা আসার কথা নয়।’
‘চারদিকে যে অনিশ্চয়তা ছিল, সেটা কেটেছে’অধ্যাপক ইউনূস ও তারেক রহমানের বৈঠকের পর ঢাকায় বিএনপির গুলশান কার্যালয়ে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর প্রতিক্রিয়া জানান। তিনি বলেন, বৈঠক সফল হয়েছে। সবকিছু যে একটা অনিশ্চিত অবস্থায় চলে গিয়েছিল, সেই অবস্থাকে কাটিয়ে জাতিকে আবার সামনে এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখিয়েছেন দুই নেতা।
মির্জা ফখরুল বলেন, লন্ডনের বৈঠকের পর তারেক রহমানের সঙ্গে তাঁর ফোনে কথা হয়েছে। এ সময় তারেক রহমান দলের নেতা–কর্মীদের অভিনন্দন ও জনগণের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান। একই সঙ্গে সঠিক দিকনির্দেশনা দেওয়ার জন্য তাঁর মা ও দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার প্রতি শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা জানান।
বিএনপির মহাসচিব দলের নেতা-কর্মীদের পক্ষ থেকে তারেক রহমান ও প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ইউনূসের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান। তিনি বলেন, অত্যন্ত বিচক্ষণতার সঙ্গে তিনি (ইউনূস) তারেক রহমানকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। সবকিছু একটা অনিশ্চিত অবস্থায় চলে গিয়েছিল, সেই অবস্থা কাটিয়ে জাতিকে আবার সামনের দিকে ও আশা নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখিয়েছেন দুই নেতা।