মিথেন গ্যাসও হতে পারে সবুজ অর্থনীতির চালিকাশক্তি
Published: 6th, May 2025 GMT
জলবায়ু পরিবর্তন এখন শুধু ভবিষ্যতের ভীতিকর পূর্বাভাস নয়; বরং আমাদের বর্তমান বাস্তবতা। বৈশ্বিক উষ্ণায়নের জন্য যে গ্রিনহাউস গ্যাসগুলো দায়ী, তার মধ্যে সবচেয়ে ক্ষতিকর একটি হলো মিথেন। এর বড় অংশ আসে আমাদের অতি পরিচিত গবাদি পশু অর্থাৎ গরু, ছাগল আর মহিষের পেট থেকে। হ্যাঁ, ঠিকই পড়েছেন। এই জাবর কাটা প্রাণীগুলো তাদের হজম প্রক্রিয়ার সময় ঢেকুর, নিঃশ্বাস ও বর্জ্যের মাধ্যমে প্রতিনিয়ত বিপুল পরিমাণ মিথেন গ্যাস নিঃসরণ করে। বৈশ্বিকভাবে প্রতিবছর এ ধরনের গবাদি পশু থেকে নির্গত হয় প্রায় ১০০ মিলিয়ন টন মিথেন, যার গ্লোবাল ওয়ার্মিং ক্ষমতা কার্বন ডাই-অক্সাইডের তুলনায় প্রায় ৮০ গুণ। এভাবে উৎপন্ন মিথেন পৃথিবীর মোট গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনের প্রায় ১৬ শতাংশ।
প্রশ্ন উঠতে পারে, এই বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের ভূমিকা কী? আশ্চর্য হলেও সত্য, আমাদের দেশের গবাদি পশু খাত থেকে প্রতিবছর প্রায় ৩০ মিলিয়ন টন কার্বন ডাই-অক্সাইডের সমতুল্য মিথেন নির্গত হয়, যা বৈশ্বিক নির্গমনের প্রায় ১ শতাংশ। আর্থিক দৃষ্টিকোণ থেকে এই ক্ষতির পরিমাণ বছরে প্রায় ৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ভাবা যায়, শুধু গরুর হজম প্রক্রিয়া থেকেই আমাদের অর্থনীতি এমন বিশাল ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে!
এখানেই আশার আলো দেখাচ্ছে আধুনিক বিজ্ঞান। গবেষণায় দেখা গেছে, সঠিক প্রযুক্তি ও ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে এই নির্গমন ৫০ শতাংশ পর্যন্ত কমানো সম্ভব। অস্ট্রেলিয়ার ‘এসিসিইউ স্কিম’ অনুযায়ী এক টন কার্বন হ্রাসের দাম যেখানে ৩৫ অস্ট্রেলিয়ান ডলার, সেখানে খোলা বাজারে এই দর ১০০ ডলার পর্যন্ত হতে পারে। সেই হিসাবে বাংলাদেশ যদি মিথেন নির্গমন অর্ধেক কমাতে সক্ষম হয়, তাহলে এই ‘সবুজ অর্থনীতি’ সম্ভাব্য প্রায় ১.
সম্ভাবনাকে বাস্তবে রূপ দিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে এক অভিনব আবিষ্কার। অস্ট্রেলিয়ার গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘লোম বায়ো’র বিজ্ঞানী ড. আবেদ চৌধুরী ও তাঁর গবেষক দল সম্প্রতি আবিষ্কার করেছেন বিশেষ ধরনের প্রাকৃতিক ছত্রাক, যা গবাদি পশুর হজম প্রক্রিয়ায় মিথেন উৎপাদন ৯০ শতাংশ পর্যন্ত কমিয়ে দিতে সক্ষম। সবচেয়ে চমকপ্রদ, ছত্রাকটি কোনো রকম জেনেটিক মোডিফিকেশন ছাড়াই কাজ করে এবং পশুর স্বাস্থ্যে বিরূপ প্রভাব ফেলে না। এটি পশুখাদ্যে ফিড অ্যাডিটিভ হিসেবে মেশালে কার্যত মিথেন নির্গমন বন্ধ হয়ে যায়।
২০২৫ সালের মার্চে ‘বায়োটেকনোলজি রিপোর্টস’ জার্নালে এ গবেষণা প্রকাশিত হয়েছে। এই আবিষ্কারের ভিত্তিতে গড়ে উঠেছে নতুন কোম্পানি ‘রোম এগ্রিকালচার’। প্রতিষ্ঠানটি এমন মডেল তৈরি করছে, যাতে খামারি নিজেই ছোট ছোট ইউনিটে এই ছত্রাক উৎপাদন করতে পারবেন, অনেকটা মাইক্রোব্রুয়ারির মতো। এতে খরচ কমবে এবং খামার থেকে খামারে প্রযুক্তি ছড়িয়ে দেওয়া সহজ হবে। পরীক্ষামূলক পর্যায়ে ফলাফল আশাব্যঞ্জক। বাস্তব খামার ব্যবস্থাপনাতেও কার্যকারিতা প্রমাণিত হলে এটি হতে পারে জলবায়ু রক্ষায় যুগান্তকারী পদক্ষেপ।
গবাদি পশুর গ্যাস মানেই কেবল জলবায়ুর জন্য হুমকি– এ ধারণা আজ বদলাতে শুরু করেছে। সঠিক প্রযুক্তি ও বিজ্ঞানভিত্তিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে মিথেন গ্যাস হতে পারে সবুজ অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি। এ যেন এক নীরব বিপ্লব। পশুখাদ্যে থাকা এক বিন্দু ছত্রাক হয়ে উঠছে বৈশ্বিক উষ্ণতার হাত থেকে পৃথিবী বাঁচানোর অন্যতম হাতিয়ার।
এই উদ্ভাবন আমাদের দেখিয়ে দিয়েছে, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সঠিক প্রয়োগের মাধ্যমে আমরা শুধু পৃথিবীকেই রক্ষা করা নয়, বরং অর্থনৈতিকভাবেও লাভবান হতে পারি। আশা করা যায়, আগামী কয়েক বছরের মধ্যে এই ছত্রাকভিত্তিক ফিড অ্যাডিটিভ বিশ্বব্যাপী খামারগুলোতে ছড়িয়ে পড়বে। এমন প্রতিটি আবিষ্কারই আমাদের সাহস জোগায়– বিজ্ঞানের হাতে হাত রেখে আমরা এখনও সুস্থ, সবুজ ও সুন্দর পৃথিবীর স্বপ্ন দেখতে পারি।
ড. তানভীর হোসেন: অস্ট্রেলিয়াপ্রবাসী
কৃষিবিজ্ঞানী ও বিজ্ঞান লেখক
উৎস: Samakal
এছাড়াও পড়ুন:
সম্মেলনে ৪৪ জেলার চাষি ও উদ্যোক্তা
আম উৎপাদন ও বিপণন নিয়ে দেশের বিভিন্ন জেলার চাষি, উদ্যোক্তা ও গবেষকদের নিয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জে অনুষ্ঠিত হয়েছে প্রথম আম সম্মেলন। গতকাল মঙ্গলবার শিবগঞ্জ উপজেলার কানসাট ক্লাব স্টেডিয়ামে এ আয়োজন করে ম্যাংগো ডেভেলপমেন্ট ফোরাম। দিনব্যাপী সম্মেলনে দেশের ৪৪ জেলার প্রায় ৩৫০ জন আমচাষি ও উদ্যোক্তা অংশ নেন।
শিবগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) তৌফিক আজিজের সভাপতিত্বে সকালে সম্মেলনের উদ্বোধন করেন চাঁপাইনবাবগঞ্জের জেলা প্রশাসক আব্দুস সামাদ। সম্মেলনে বক্তারা আম উৎপাদন ও বিপণনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় রপ্তানিমুখী জোন চিহ্নিতকরণ, প্রশিক্ষিত রপ্তানিকারক তৈরি, আধুনিক প্যাকিং হাউস স্থাপন এবং সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বে অবকাঠামো উন্নয়নের ওপর জোর দেন।
অনুষ্ঠানে জেলা প্রশাসক আব্দুস সামাদ আম পরিবহন, ওজন পদ্ধতি ও রপ্তানির ক্ষেত্রে বিভিন্ন সমস্যা চাষিদের কাছে শোনেন এবং তা নিরসনে উদ্যোগের কথা জানান।
ঢাকার উত্তরা থেকে সম্মেলনে অংশ নেওয়া উদ্যোক্তা সাইয়েদুল বাশার বলেন, তিনি অনলাইনে আম কেনাবেচার উদ্যোগ নেন তিন বছর আগে। এ সম্মেলনে এসে স্থানীয় বেশকিছু আমচাষির সঙ্গে পরিচিত হয়েছেন। তাদের কাছ থেকে বিভিন্ন জাতের আম সম্পর্কে জানতে পেরে খুশি।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ কৃষি অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মুনজের আলম মানিক বলেন, চাঁপাইনবাবগঞ্জের চাষিরা আমের দাম নিয়ে হতাশ। রপ্তানিতেও আছে নানা বাধা। এসব সমস্যা সমাধানে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের চাঁপাইনবাবগঞ্জের বৈজ্ঞানিক কর্মকতা ড. জি এম মোরশেদুল বারী বলেন, রপ্তানির সম্ভাবনা বাড়লেও কীটনাশক, আধুনিক প্যাকেজিং, হ্যান্ডলিং সমস্যা, শীততাপনিয়ন্ত্রিত গুদাম ও পরিবহনের ঘাটতি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে রয়েছে। এ ছাড়া অনেক উদ্যোক্তার চাঁপাইনবাবগঞ্জের ভালো জাতের আম, জিআই সনদপ্রাপ্ত আম ও গবেষণায় উদ্ভাবিত হাইব্রিড জাতের রপ্তানিযোগ্য আম নিয়ে স্পষ্ট ধারণা নেই। এসব বিষয় তুলে ধরতেই তিনিসহ কয়েকজন গবেষক এ সম্মেলনে যোগ দিয়েছেন।
সম্মেলন আয়োজক কমিটির আহ্বায়ক শহীদুল হক হায়দারী শহিদ মিয়া বলেন, আম উৎপাদন, বাজারজাতকরণ ও রপ্তানিতে বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে আলোচনা ও এর সমাধান পেতে এবং সারা দেশের আম উদ্যোক্তাদের মধ্যে একটি সেতুবন্ধ তৈরি করতেই আজকের সম্মেলন।