জলবায়ু পরিবর্তন এখন শুধু ভবিষ্যতের ভীতিকর পূর্বাভাস নয়; বরং আমাদের বর্তমান বাস্তবতা। বৈশ্বিক উষ্ণায়নের জন্য যে গ্রিনহাউস গ্যাসগুলো দায়ী, তার মধ্যে সবচেয়ে ক্ষতিকর একটি হলো মিথেন। এর বড় অংশ আসে আমাদের অতি পরিচিত গবাদি পশু অর্থাৎ গরু, ছাগল আর মহিষের পেট থেকে। হ্যাঁ, ঠিকই পড়েছেন। এই জাবর কাটা প্রাণীগুলো তাদের হজম প্রক্রিয়ার সময় ঢেকুর, নিঃশ্বাস ও বর্জ্যের মাধ্যমে প্রতিনিয়ত বিপুল পরিমাণ মিথেন গ্যাস নিঃসরণ করে। বৈশ্বিকভাবে প্রতিবছর এ ধরনের গবাদি পশু থেকে নির্গত হয় প্রায় ১০০ মিলিয়ন টন মিথেন, যার গ্লোবাল ওয়ার্মিং ক্ষমতা কার্বন ডাই-অক্সাইডের তুলনায় প্রায় ৮০ গুণ। এভাবে উৎপন্ন মিথেন পৃথিবীর মোট গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনের প্রায় ১৬ শতাংশ।

প্রশ্ন উঠতে পারে, এই বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের ভূমিকা কী? আশ্চর্য হলেও সত্য, আমাদের দেশের গবাদি পশু খাত থেকে প্রতিবছর প্রায় ৩০ মিলিয়ন টন কার্বন ডাই-অক্সাইডের সমতুল্য মিথেন নির্গত হয়, যা বৈশ্বিক নির্গমনের প্রায় ১ শতাংশ। আর্থিক দৃষ্টিকোণ থেকে এই ক্ষতির পরিমাণ বছরে প্রায় ৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ভাবা যায়, শুধু গরুর হজম প্রক্রিয়া থেকেই আমাদের অর্থনীতি এমন বিশাল ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে!

এখানেই আশার আলো দেখাচ্ছে আধুনিক বিজ্ঞান। গবেষণায় দেখা গেছে, সঠিক প্রযুক্তি ও ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে এই নির্গমন ৫০ শতাংশ পর্যন্ত কমানো সম্ভব। অস্ট্রেলিয়ার ‘এসিসিইউ স্কিম’ অনুযায়ী এক টন কার্বন হ্রাসের দাম যেখানে ৩৫ অস্ট্রেলিয়ান ডলার, সেখানে খোলা বাজারে এই দর ১০০ ডলার পর্যন্ত হতে পারে। সেই হিসাবে বাংলাদেশ যদি মিথেন নির্গমন অর্ধেক কমাতে সক্ষম হয়, তাহলে এই ‘সবুজ অর্থনীতি’ সম্ভাব্য প্রায় ১.

৫ বিলিয়ন ডলার বাজারমূল্যের হয়ে দাঁড়াবে!
সম্ভাবনাকে বাস্তবে রূপ দিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে এক অভিনব আবিষ্কার। অস্ট্রেলিয়ার গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘লোম বায়ো’র বিজ্ঞানী ড. আবেদ চৌধুরী ও তাঁর গবেষক দল সম্প্রতি আবিষ্কার করেছেন বিশেষ ধরনের প্রাকৃতিক ছত্রাক, যা গবাদি পশুর হজম প্রক্রিয়ায় মিথেন উৎপাদন ৯০ শতাংশ পর্যন্ত কমিয়ে দিতে সক্ষম। সবচেয়ে চমকপ্রদ, ছত্রাকটি কোনো রকম জেনেটিক মোডিফিকেশন ছাড়াই কাজ করে এবং পশুর স্বাস্থ্যে বিরূপ প্রভাব ফেলে না। এটি পশুখাদ্যে ফিড অ্যাডিটিভ হিসেবে মেশালে কার্যত মিথেন নির্গমন বন্ধ হয়ে যায়।

২০২৫ সালের মার্চে ‘বায়োটেকনোলজি রিপোর্টস’ জার্নালে এ গবেষণা প্রকাশিত হয়েছে। এই আবিষ্কারের ভিত্তিতে গড়ে উঠেছে নতুন কোম্পানি ‘রোম এগ্রিকালচার’। প্রতিষ্ঠানটি এমন মডেল তৈরি করছে, যাতে খামারি নিজেই ছোট ছোট ইউনিটে এই ছত্রাক উৎপাদন করতে পারবেন, অনেকটা মাইক্রোব্রুয়ারির মতো। এতে খরচ কমবে এবং খামার থেকে খামারে প্রযুক্তি ছড়িয়ে দেওয়া সহজ হবে। পরীক্ষামূলক পর্যায়ে ফলাফল আশাব্যঞ্জক। বাস্তব খামার ব্যবস্থাপনাতেও কার্যকারিতা প্রমাণিত হলে এটি হতে পারে জলবায়ু রক্ষায় যুগান্তকারী পদক্ষেপ।

গবাদি পশুর গ্যাস মানেই কেবল জলবায়ুর জন্য হুমকি– এ ধারণা আজ বদলাতে শুরু করেছে। সঠিক প্রযুক্তি ও বিজ্ঞানভিত্তিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে মিথেন গ্যাস হতে পারে সবুজ অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি। এ যেন এক নীরব বিপ্লব। পশুখাদ্যে থাকা এক বিন্দু ছত্রাক হয়ে উঠছে বৈশ্বিক উষ্ণতার হাত থেকে পৃথিবী বাঁচানোর অন্যতম হাতিয়ার।
এই উদ্ভাবন আমাদের দেখিয়ে দিয়েছে, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সঠিক প্রয়োগের মাধ্যমে আমরা শুধু পৃথিবীকেই রক্ষা করা নয়, বরং অর্থনৈতিকভাবেও লাভবান হতে পারি। আশা করা যায়, আগামী কয়েক বছরের মধ্যে এই ছত্রাকভিত্তিক ফিড অ্যাডিটিভ বিশ্বব্যাপী খামারগুলোতে ছড়িয়ে পড়বে। এমন প্রতিটি আবিষ্কারই আমাদের সাহস জোগায়– বিজ্ঞানের হাতে হাত রেখে আমরা এখনও সুস্থ, সবুজ ও সুন্দর পৃথিবীর স্বপ্ন দেখতে পারি।

ড. তানভীর হোসেন: অস্ট্রেলিয়াপ্রবাসী
কৃষিবিজ্ঞানী ও বিজ্ঞান লেখক

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: ন র গমন আম দ র

এছাড়াও পড়ুন:

বিশ্ব সংগীত দিবস উদযাপনে দুই আয়োজন

একটাই দিন। একটি বিশেষ উপলক্ষ। কিন্তু দুইটি ভিন্ন ভেন্যুতে আয়োজনের ভাবনা ছিল একই- ‘সুরের ছোঁয়ায় শান্তি ও সুস্থতা’। ২১ জুন ছিল বিশ্ব সংগীত দিবস। সংগীতের মাধ্যমে বিশ্বজনীন সংহতি, সাম্য ও মানবতার বার্তা ছড়িয়ে দেওয়ায় ছিল দিবসের লক্ষ্য।

জাতীয় নাট্যশালায় বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির ব্যানারে এক বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা, অন্যদিকে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘সৃষ্টি বিশ্বময়’-এর নিবেদনে এক মরমি পরিবেশনা। দুই মঞ্চে দুই রকম সুর, তবে চেতনায় অভিন্ন।

বিশ্ব সংগীত দিবস উপলক্ষে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে শুক্রবার বিকেলে এক আন্তরিক আয়োজন করে ‘সৃষ্টি বিশ্বময়’। যার শিরোনাম ছিল ‘সুরের ছোঁয়ায় শান্তি’। মূল উদ্দেশ্য, সংগীতকে মানুষের কাছে একটি নিরাময় শক্তি হিসেবে উপস্থাপন করা, যাকে ঘিরে গড়ে উঠতে পারে যুদ্ধহীন এক মানবিক সমাজ।

অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন- বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব খায়রুল আলম সবুজ। তিনি বলেন, ‘সংগীতের শক্তি এমনই যে, তা হৃদয়ের অন্ধকার দূর করে মননে আলোক ছড়াতে পারে। সংগীতই পারে হানাহানিমুক্ত পৃথিবীর পথে মানুষকে নিয়ে যেতে।’

অনুষ্ঠানে শুভেচ্ছা বক্তব্য দেন উদযাপন পর্ষদের আহ্বায়ক সাংবাদিক বাসুদেব ধর ও সদস্যসচিব অলক দাশগুপ্ত। আয়োজনের সূচনায় চর্যাপদের পদ, আবৃত্তি ও আধুনিক বাদ্যযন্ত্রের এক ব্যতিক্রমধর্মী কম্পোজিশন পরিবেশন করেন লাইসা বিনতে কামাল, রত্না দত্ত, সন্দীপা বিশ্বাসসহ একঝাঁক তরুণ শিল্পী। নৃত্য পরিবেশন করেন অংকিতা অথৈ। এছাড়া একক সংগীত, দলীয় পরিবেশনা ও আবৃত্তি পরিবেশন করেন বর্ষা রাহা, রজত শুভ্র, ফয়সাল আহমেদ, সানোয়ারা জাহান নিতু, ব্যান্ডদল ‘ব্রেথলেস’সহ অনেকেই। 

বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির উদ্যোগে জাতীয় নাট্যশালায় অনুষ্ঠিত হয় আরেক আয়োজন-‘সুরের সম্মিলন’। সন্ধ্যায় নাট্যশালার সম্মুখে জাতীয় সংগীতের সুর ও বেলুন উড়িয়ে এ উৎসবের উদ্বোধন করেন একাডেমির সচিব ও দায়িত্বপ্রাপ্ত মহাপরিচালক মোহাম্মদ ওয়ারেছ হোসেন। সঙ্গে ছিলেন একাডেমির সংগীত, নৃত্য ও আবৃত্তি বিভাগের পরিচালক মেহজাবীন রহমান ও বিশিষ্ট সংগীতশিল্পীরা।

সভাপতির বক্তব্যে ওয়ারেছ হোসেন বলেন, ‘যে দেশে যত বেশি সাংস্কৃতিক চর্চা হয়, সে দেশে যুদ্ধ ও সহিংসতা টিকে থাকতে পারে না। সংগীত মানুষের হৃদয়ের কালো দাগ মুছে দিতে পারে।’

শোভাযাত্রার পর মূল মিলনায়তনে শুরু হয় সাংস্কৃতিক পরিবেশনা। প্রথমে ছিল যন্ত্রসঙ্গীত ও কণ্ঠসংগীতের কোলাজ পরিবেশনা। এরপর মঞ্চে আসে আদিবাসী ব্যান্ড ‘চিম্বুক’ ও ‘বম শিল্পীগোষ্ঠী’। পরে জনপ্রিয় তারকা শিল্পীদের সমবেত পরিবেশনায় মুখর হয় মিলনায়তন। শেষ পর্বে কোলাজ ব্যান্ডের পরিবেশনায় জমে ওঠে সমাপ্তি অনুষ্ঠান।

উল্লেখ্য, বিশ্ব সংগীত দিবসের সূচনা হয় ১৯৮২ সালে ফ্রান্সে, তৎকালীন সংস্কৃতি মন্ত্রী জ্যাক ল্যাং ও সংগীত পরিচালক মরিস ফ্লেয়োরে’র উদ্যোগে। ২১ জুন, গ্রীষ্মের দীর্ঘতম দিনে, সংগীতকে সকলের জন্য উন্মুক্ত করতে এই দিবস উদযাপন শুরু হয়, যা এখন বিশ্বব্যাপী পালিত হয়।

সম্পর্কিত নিবন্ধ