ব্যবসা দখল করতে ৫ আগস্টের হত্যা মামলা যখন হাতিয়ার
Published: 6th, November 2025 GMT
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের প্রায় এক বছর পর ২০২৫ সালের ১৭ জুলাই সাভারের নিজ বাড়ি থেকে নিশান মোহাম্মদ ওরফে দুলালকে গ্রেপ্তার করা হয়।
তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ, ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট সাজ্জাদ হোসেন নামের একজন টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের শিক্ষার্থীকে হত্যার ঘটনায় তিনি জড়িত।
১১ মাস আগে সাভার মডেল থানায় নিহত সাজ্জাদের বাবা মোহাম্মদ আলমগীরের করা ফার্স্ট ইনফরমেশন রিপোর্ট (এফআইআর) বা এজাহারে ৩২১ জনের মধ্যে দুলালের নাম ছিল।
এজাহারে বলা হয়, ঘটনার দিন দুলালসহ ‘আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা’ সাভার বাসস্ট্যান্ডের কাছে বিক্ষোভকারীদের ধাওয়া করেন, নির্বিচারে মারধর করেন এবং তাঁরা ‘গুলিও চালান’।
সাজ্জাদ ওই বিক্ষোভে অংশ নেননি। তিনি বাজার করতে গিয়েছিলেন। সেখানে গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর তাঁকে এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয় এবং সেখানে তিনি মারা যান।
ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে পাঠানো প্রতিবেদনে পুলিশ লিখেছে, ‘প্রাথমিক তদন্তে দেখা গেছে, (দুলাল) ঘটনার সঙ্গে জড়িত।
আরও পড়ুনএকুশে আগস্টের দায় বিএনপি এড়াবে কীভাবে২১ আগস্ট ২০২১স্থানীয় লোকদের ভাষ্য ও পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে বোঝা যাচ্ছে, আসামিকে জামিনে মুক্তি দেওয়া হলে তিনি আবারও একই ধরনের অপরাধে জড়িয়ে পড়বেন। মামলাটির সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে আসামিকে কারাগারে রাখা খুবই প্রয়োজন।’
৩৯ বছর বয়সী দুলাল একজন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। তিনি তিন সন্তানের বাবা। তিনি তিন মাসের বেশি সময় ধরে কারাগারে।
এই হত্যা মামলাসহ আরও দুটি সংশ্লিষ্ট হত্যা মামলায় তাঁর জামিন এখন পর্যন্ত আদালত মঞ্জুর করেনি।
জাতীয়ভাবে পরিচিত ব্যক্তিদের মতো দুলালের গ্রেপ্তার বা আটকাদেশ গণমাধ্যমে আলোচনার বিষয় হয়নি।
দুঃখজনক হলেও, দুলালের গ্রেপ্তার ও দীর্ঘদিন ধরে আটক থাকার ঘটনা সম্ভবত বিচ্ছিন্ন না।
তাঁর গ্রেপ্তারের ঘটনা থেকে আমরা বাংলাদেশে পুলিশ ও বিচারব্যবস্থা রাজনৈতিক ও ব্যবসায়িক স্বার্থের জালে জড়িয়ে পড়ার একটা চিত্র দেখতে পাই।
আর দেখা যায় কীভাবে ‘ন্যায়বিচার’কে আর্থিক স্বার্থ হাসিলের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।
তালিকায় দুলালের নাম যেভাবে এলএজাহারে দুলালের নাম ছিল ২৩ নম্বরে। সেখানে তাঁকে ‘সাভার যুবলীগের সভাপতি’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু সাভারের স্থানীয় রাজনীতি সম্পর্কে যাঁদের সামান্য জানাশোনা আছে, তাঁরা সহজেই বুঝতে পারবেন, এটি সম্পূর্ণ মিথ্যা।
দুলাল যুবলীগের সভাপতি হওয়া তো দূরের কথা, আওয়ামী লীগের কোনো কমিটির সদস্যই ছিলেন না।
তাহলে কীভাবে এবং কেন দুলালের নাম এজাহারে আসামির তালিকায় যুক্ত হলো? নিহত সাজ্জাদের স্ত্রী সানজিদা বলেছেন, এজাহারের নামের তালিকা তৈরিতে সাভার থানা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক গোলাম মোস্তফা এবং তাঁর ভাই যুবদল নেতা শহিদুল ইসলামের বড় ভূমিকা ছিল।
সানজিদার ভাষায়, ‘এই মামলার বাদী আমার শ্বশুর। কিন্তু তাঁকে মামলাটি করতে বাধ্য করেছিলেন সাবেক চেয়ারম্যান (গোলাম) মোস্তফা ও তাঁর ভাই শহিদ (ইসলাম)। এই দুজন মিলে তাঁকে মামলা করতে বাধ্য করেন.
সানজিদা বলেছেন, ওই দুই স্থানীয় বিএনপি নেতা ‘প্রতিদিন আমাদের বাড়িতে আসতেন, বিভিন্ন নোটবুক আর কলম নিয়ে অনেক নাম নিয়ে আসতেন এবং সেই নামগুলো যুক্ত করে দিতেন’।
আরও পড়ুনরাজনৈতিক দলগুলোর ইশতেহারে নতুনত্ব আনা জরুরি২৮ অক্টোবর ২০২৫সাজ্জাদের বাবা আলমগীর স্বীকার করেছেন, তিনি এজাহারে থাকা অনেক মানুষকে চিনতেন না; তাঁর না চেনা এই মানুষগুলোর মধ্যে দুলাল একজন।
দুলালের নাম আসামির তালিকায় কীভাবে এসেছে, তার কোন ব্যাখ্যাও তিনি দিতে অপারগ। তিনি বলেন, ‘পুলিশ ও স্থানীয় বিএনপি সদস্যরা সব ঠিক করেছেন; আমি কেবল কাগজে সই করেছি।’
তবে তিনি মোস্তফা বা শহিদুলের সঙ্গে তাঁর পরিচয় থাকার কথা অস্বীকার করেছেন। শহিদুলের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাঁর সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি। তবে মোস্তফার সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়েছে।
মোস্তফা এই মামলায় তাঁর কোনো ধরনের ভূমিকা থাকার কথা অস্বীকার করেছেন এবং বলেছেন, দুলাল কে, তা তিনি জানেন না।
তবে দুলালের নাম এজাহারে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার কারণ সম্ভবত রাজনীতি নয়; বরং ব্যবসায়িক স্বার্থসংশ্লিষ্ট কারণে দুলালকে আসামি করা হয়েছে। দুলালের পারিবারিক ব্যবসা রয়েছে স্থানীয় গার্মেন্টস কারখানার সঙ্গে।
তাঁর পরিবার মনে করছে, স্থানীয় বিএনপি নেতারা দুলালের গ্রেপ্তারের সুযোগকে কাজে লাগিয়ে তাদের পারিবারিক ব্যবসা দখল করতে চেয়েছিলেন।
তাদের এই দাবীর সত্যতা যাই হোক না কেন, শহিদুল আর মোস্তফা এখন দুলালের ব্যবসা দখল করে ফেলেছে।
পার্টির দখলে পারিবারিক ব্যবসা২০১১ সালে দুলালের পরিবার উইন্টার ড্রেস লিমিটেড নামের একটি প্রতিষ্ঠানের কাছে দেড় একর জমি বিক্রি করে।
উইন্টার ড্রেস লিমিটেড সেখানে একটি তৈরি পোশাক কারখানা বানায়। দুলালের পরিবারের সঙ্গে কারখানাটির একটি চুক্তি ব্যবসায়িক চুক্তি হয়।
চুক্তি অনুযায়ী, দুলালের পরিবার কারখানার শ্রমিকদের জন্য দুপুরের খাবার সরবরাহ করত। এতে দুলালের পরিবারের একটি স্থায়ী ও লাভজনক ব্যবসার সুযোগ হয়।
২০১৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকাকালে যুবলীগ নেতা সোহেল রানা সাভারের উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান হন এবং দুলালদের আয়ের একটি বড় অংশের ভাগ দাবি করেন।
দুলালের ভাই জসিম উদ্দিন বলেন, ‘আমরা (গার্মেন্টসে টিফিন সরবরাহ করে) মাসে লাখ পাঁচেক টাকা আয় করতাম, আর রানা সেখান থেকে প্রায় তিন লাখ টাকা নিয়ে যেতেন।’
২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনের পর যখন আওয়ামী লীগ আরও শক্তিধর হয়ে ওঠে, সোহেল রানা তখন তাঁর লোকজন দিয়ে জসিমকে উত্তরা এলাকার বেস্ট ওয়েস্টার্ন রেস্তোরাঁয় ডেকে পাঠান।
জসিম বলেন, ‘সোহেল রানা চেয়েছিলেন আমি আমাদের ব্যবসা তাঁর ভাই নাসির উদ্দিনের মালিকানাধীন এভারগ্রিন এন্টারপ্রাইজের কাছে হস্তান্তর করি। তাঁরা আমাকে আগে থেকে লিখে রাখা একটি বিবৃতি দিয়ে তাতে সই করতে বলেন। এতে লেখা ছিল, আমরা আমাদের ব্যবসা তাঁদের কাছে হস্তান্তর করছি।’
এরপর এই দুই যুবলীগ সহোদর, সোহেল রানা ও নাসির উদ্দিন, দুলাল ও জসিমের পরিবারের ব্যবসা সম্পূর্ণভাবে দখল করে নেন।
আরও পড়ুনসরকারি প্রতিষ্ঠান যেভাবে একটি নদীকে ‘নিখুঁতভাবে হত্যা’ করল০৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫৫ আগস্টের পর২০২৪ সালের আগস্টে আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর সোহেল রানা এবং তাঁর ভাই নাসির উদ্দিন দেশ ত্যাগ করেন। দুলালের পরিবার আশা করে এবার হয়তো তারা তাদের ব্যবসা ফিরে পাবে। কিন্তু তা সম্ভব হয়নি।
সাভারে বিএনপি পুনরায় শক্তিশালী হওয়ার পর স্থানীয় বিএনপি নেতারা চাঁদাবাজি আর দখলের কাজে নেমে পড়েন। পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে তাঁরা নিজেদের টাকা কামানোর সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করেন।
মোস্তফা ও শহিদুল দুলালের পরিবারকে কোন রাখ-ঢাক না রেখেই বলে দিয়েছিলেন, ব্যবসার দখল তাঁরা চান।
দুলালের ভাই জসিম বলেন, ‘বিএনপির সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে আমাদের সালিস বৈঠক হয়েছে। অনেক দেনদরবার হয়েছে। তাঁরা শেষ পর্যন্ত আমাদের ২০ থেকে ৩০ শতাংশ ব্যবসা দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন, কিন্তু আমরা রাজি হইনি। কিন্তু সাজ্জাদের বাবা যখন এজাহারে দুলালের নাম অন্তর্ভুক্ত করেন, ঠিক তারপর ওই দুই ভাই গিয়ে উইন্টার ড্রেস লিমিটেডের সঙ্গে নতুন চুক্তি করে ফেলেন।’
জসিম বলেন, স্থানীয় বিএনপি নেতারা তাঁর পরিবারের সদস্যদের ব্যবসা দখলের ‘ক্ষতিপূরণ’ হিসেবে মাসে মাসে তাঁদের কিছু টাকা দিচ্ছেন।
দুলালের পরিবারের ব্যবসা দখল করার কথা মোস্তফা অস্বীকার করেছেন। তবে তিনি স্বীকার করেছেন, তাঁরা দুলালের পরিবারকে টাকাপয়সা দিচ্ছেন।
উইন্টার ড্রেস লিমিটেডের কাছে এ বিষয়ে জিজ্ঞাসা করা হলে কোম্পানিটির পরিচালকেরা কোনো জবাব দেননি।
আরও পড়ুনফুলবাড়ী গণ-অভ্যুত্থান এবং বাংলাদেশের উন্নয়ন প্রশ্ন ২৬ আগস্ট ২০২৫এক অন্ধকার ভবিষ্যতের দিকেফৌজদারি অভিযোগ যাচাই-বাছাই, তদন্তের কাজে নিয়োজিত যেকোনো ব্যক্তি-হোক পুলিশ অফিসার, প্রসিকিউটর বা ম্যাজিস্ট্রেট-যদি সততার সঙ্গে খতিয়ে দেখেন তাহলে খুব সহজেই তাদের বুঝে ফেলার কথা যে দুলালের বিরুদ্ধে অভিযোগ সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন।
এজাহারে তাঁকে একজন সিনিয়র আওয়ামী লীগ নেতা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে, যা মিথ্যা। এ ছাড়া, এজাহার তৈরি করতে যুক্ত ছিলেন রাজনৈতিক ও ব্যবসায়িক স্বার্থযুক্ত ব্যক্তিরা।
কিন্তু এসব বিষয় যদি নাও বিবেচনা করা হয়, তারপরও সবচেয়ে বড় বিষয় রয়ে যায় যে, হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে দুলালের সংশ্লিষ্টতার কোন প্রমাণ পুলিশ দিতে পারেনি।
পুলিশ বা প্রসিকিউটররা এমন কোন ইঙ্গিত পর্যন্ত দেয়নি যে ঘটনার সঙ্গে দুলালের সম্পৃক্ত থাকার পক্ষে কোনো ছবি, ভিডিও বা ফোন রেকর্ড তাদের হাতে আছে। তবুও সাভারের এই ব্যবসায়ী এখনো কারাগারে।
বাংলাদেশে বিভিন্ন আমলে যত সরকার এসেছে, কেউই আইনশৃঙ্খলা ও বিচারব্যবস্থায় এমন পরিস্থিতি বা পদ্ধতির জন্ম দিতে পারেনি যাতে সেখানে কর্মরত ব্যক্তিরা স্বাধীন ও নিরপেক্ষ ভাবে কাজ করতে পারে।
ক্ষমতায় আসার পর এক বছরের বেশি পার হওয়ার পরও দুলালের মতো নির্দোষ মানুষেরা জেলে পচছেন। তাঁরা এমন একটি ব্যবস্থার শিকার হয়েছেন, যা কিনা ন্যায়বিচারের পক্ষে কাজ না করে রাজনীতির পদসেবা করে যাচ্ছে। নির্বাচনের পর যে সরকার ক্ষমতায় আসবে, তারা আওয়ামী লীগ সরকারের সময় থেকে চলে আসা একই খারাপ, দুর্নীতিপূর্ণ বিচারব্যবস্থার দায়িত্বই পাবে।সেই কাজ যদি সরকারগুলো করত তাহলে রাজনৈতিক প্রভাবদুষ্ট গ্রেপ্তারে বাঁধা দেওয়ার মতো কর্মকর্তা হয়তো বিচারব্যবস্থায় থাকতে পারত।
বরং, ক্ষমতায় থাকা বা সরকারের সঙ্গে যুক্ত রাজনৈতিক ও ব্যবসায়িক এলিটরা আইন প্রয়োগ ও বিচারপ্রক্রিয়ায় আধিপত্য বিস্তার করে এসেছেন। এখনো করছেন।
জুলাই-আগস্টের হত্যাকাণ্ডের পরবর্তী পরিস্থিতিতে দেখা যাচ্ছে, আগের ধারা এখনো বহাল আছে। যে সময়টি পরিবর্তনের মুহূর্ত হওয়া উচিত ছিল, তা এক নতুন দফার প্রতিশোধ ও লুটপাটের সময় হয়ে দেখা দিয়েছে।
মনে হচ্ছে, আজকে যা চলছে, তা পুরোনো শাসনব্যবস্থার থেকে আলাদা কিছু নয়।
সরকার এ ধরনের অবিচার রোধের জন্য স্পষ্ট পদক্ষেপ নিতে পারত। কিন্তু উল্লেখযোগ্য কিছু করেনি সরকার।
ক্ষমতায় আসার পর এক বছরের বেশি পার হওয়ার পরও দুলালের মতো নির্দোষ মানুষেরা জেলে পচছেন। তাঁরা এমন একটি ব্যবস্থার শিকার হয়েছেন, যা কিনা ন্যায়বিচারের পক্ষে কাজ না করে রাজনীতির পদসেবা করে যাচ্ছে।
নির্বাচনের পর যে সরকার ক্ষমতায় আসবে, তারা আওয়ামী লীগ সরকারের সময় থেকে চলে আসা একই খারাপ, দুর্নীতিপূর্ণ বিচারব্যবস্থার দায়িত্বই পাবে।
তখন দেখা যাবে, শুধু সরকার বদলাল, কিন্তু বিচারব্যবস্থার অবস্থা আগের মতোই দুর্নীতিগ্রস্ত ও রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত অবস্থায় থেকে গেল।
ডেভিড বার্গম্যান দীর্ঘদিন বাংলাদেশ বিষয়ে লেখালেখি করছেন। তাঁর সঙ্গে ফেসবুকে যোগাযোগ করা যাবে এখানে: david.bergman.77377
*মতামত লেখকের নিজস্ব
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: উইন ট র ড র স ল ম ট ড স ব ক র কর ছ ন দ ল ল র পর ব র স থ ন য় ব এনপ র পর ব র র দ র ব যবস ব যবস থ র ব যবস য় ক হওয় র পর র জন ত ক পর স থ ত সরক র র ক ব যবস আগস ট র উদ দ ন ত র জন আম দ র য বল গ আওয় ম র একট
এছাড়াও পড়ুন:
দলীয় প্রার্থী ঘোষণার মাধ্যমে মজিবর রহমানের প্রত্যাবর্তন, বরিশাল বিএনপিতে ঐক্যের হাওয়া
বরিশাল মহানগর বিএনপির রাজনীতি ঘিরে চার বছর ধরে দ্বন্দ্ব-সংঘাত ছিল আলোচিত। এই দ্বন্দ্বের সূত্রপাত হয়েছিল মহানগর বিএনপির সভাপতির পদ থেকে মজিবর রহমান সরোয়ারকে সরিয়ে তাঁর বিরোধী পক্ষকে নিয়ে আহ্বায়ক কমিটি করার মধ্য দিয়ে। এই কমিটিতে মজিবরের সমর্থকদেরও দলীয় কোনো পদে রাখা হয়নি, এমনকি নগরের ৩০টি ওয়ার্ডে তাঁর অনুগত ওয়ার্ড কমিটিও ভেঙে দেওয়া হয়েছিল। এত কিছুর পরও তিনি বরিশাল-৫ (সদর) আসনে আবারও দলীয় মনোনয়ন পেয়েছেন। এতে বিবদমান সব পক্ষ বিভেদ ভুলে তাঁর পক্ষে এককাট্টা হয়ে কাজ করার ঘোষণা দিয়েছে।
গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে বরিশালে জেলা ও মহানগর বিএনপি, অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীরা এক সভায় ঐক্যবদ্ধ হয়ে ধানের শীষকে বিজয়ী করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন। দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে বরিশাল নগরের সদর রোডের অশ্বিনী কুমার হলে বিএনপির বরিশাল সদর-৫ আসনের প্রার্থী মজিবর রহমান সরোয়ারের সঙ্গে জেলা ও মহানগর বিএনপির যৌথ মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভা ঘিরে সকাল থেকেই সদর রোডে সমবেত হন বিভিন্ন ওয়ার্ড ও ইউনিটের নেতা-কর্মীরা। তাঁরা মিছিল নিয়ে অশ্বিনী কুমার হলে আসেন এবং ‘ধানের শীষের বিজয় চাই’, ‘গণতন্ত্র মুক্তি পাক’—এসব স্লোগানে মুখর হয়ে ওঠে এলাকা।
সভায় বক্তারা জানান, বরিশাল-৫ আসনে একাধিক প্রার্থী আগ্রহ প্রকাশ করলেও যিনি মনোনয়ন পেয়েছেন, সবাই তাঁর পক্ষে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করবেন বলে অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন। তাঁরা জানান, দলের ভেতরে কোনো বিভেদ নেই; বরং সবার লক্ষ্য এক—ধানের শীষকে বিজয়ী করা।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে মজিবর রহমান সরোয়ার বলেন, ‘দেশের মানুষ গত ১৬ বছর ভোট দিতে পারেনি। আজ তারা ভোটের অধিকার ফিরে পেতে মুখিয়ে আছে। সেই অধিকার ফিরিয়ে আনতেই আমাদের সংগ্রাম। ধানের শীষ শুধু একটি প্রতীক নয়—এটি জনগণের অধিকার ও স্বাধীনতার প্রতীক। যারা গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে, মানুষের ভোটাধিকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে, জনগণের ঐক্যবদ্ধ শক্তি দিয়েই তাদের দাঁতভাঙা জবাব দিতে হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘বরিশাল বিএনপি সব সময় আন্দোলনের সামনের সারিতে থেকেছে। এবারও আমরা ঐক্যবদ্ধভাবে মাঠে থাকব। ধানের শীষের পক্ষে ভোটের ঢেউ তুলতে হবে ঘরে ঘরে।’
মতবিনিময় সভায় বরিশাল নগর বিএনপির আহ্বায়ক মনিরুজ্জামান খানের সভাপতিত্বে বক্তব্য দেন মহানগরের সদস্যসচিব জিয়া উদ্দিন সিকদার, জেলা বিএনপির সদস্যসচিব আবুল কালাম, বরিশাল সদর উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক নুরুল আমীন, মুক্তিযোদ্ধা দলের সভাপতি নুরুল আলম প্রমুখ।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, ২০২১ সালের ৩ নভেম্বর মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করে কেন্দ্রীয় বিএনপি। এতে তৎকালীন সভাপতি মজিবর রহমানকে বাদ দিয়ে তাঁর বিরোধী হিসেবে পরিচিত মনিরুজ্জামান খান ওরফে ফারুককে আহ্বায়ক ও মীর জাহিদুল কবিরকে সদস্যসচিব করা হয়। এরপর ২০২২ সালের ২২ জানুয়ারি ৪১ সদস্যের পূর্ণাঙ্গ আহ্বায়ক কমিটি অনুমোদন দেওয়া হয়। সেখানে আগের কমিটির ১৭১ সদস্যের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ নেতারা কেউ স্থান পাননি। ওই কমিটি নিয়ে আপত্তি তোলেন বিলুপ্ত কমিটির অন্তত ৩১ নেতা। এরপর নগরের ৩০টি ওয়ার্ডের কমিটি বিলুপ্ত করা হয়। যার বেশির ভাগের নেতৃত্বে ছিলেন মজিবরের অনুসারীরা। এতে তাঁর অনুসারীরা রাজনৈতিকভাবে কোণঠাসা হয়ে পড়েন। যা নিয়ে নগর বিএনপির বিভেদ প্রকট হয়। পরে দলের যুগ্ম মহাসচিব পদ থেকেও তাঁকে সরিয়ে চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা করা হয়।
সর্বশেষ গত বছরের ২৩ জুন মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক কমিটি বিলুপ্ত করে একই বছরের ৪ নভেম্বর মনিরুজ্জামান খানকে আহ্বায়ক, জিয়া উদ্দীন সিকদারকে সদস্যসচিব করে ৪২ সদস্যের আহ্বায়ক কমিটি দেয় কেন্দ্র। এতে আগের আহ্বায়ক কমিটির সদস্যসচিবসহ অনেক নেতা বাদ পড়েন। ওই নেতারাও বর্তমানে মজিবরের অনুসারী পদবঞ্চিত নেতাদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে আলাদা দলীয় কর্মসূচি পালন করে আসছেন। সম্প্রতি বিরোধের জেরে একজন যুগ্ম আহ্বায়ককে হেনস্তা, বর্তমান ও সাবেক দুজন যুগ্ম আহ্বায়কের বাড়িতে একই দিনে হামলার ঘটনা ঘটে বলে অভিযোগ রয়েছে। এমন পরিস্থিতির মধ্যে মজিবর রহমান আবারও দলীয় মনোনয়ন পাওয়ায় বরিশাল বিএনপির রাজনীতিতে দীর্ঘদিন পর স্বস্তি ফিরেছে।
মজিবর রহমান বরিশাল সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র এবং একাধিকবার এই আসনে সংসদ সদস্য ও জাতীয় সংসদের হুইপ ছিলেন। একই সঙ্গে তিনি প্রায় ২০ বছর বরিশাল মহানগর বিএনপির সভাপতি ছিলেন।
নগর বিএনপির সাবেক সহসাধারণ সম্পাদক আনোয়ারুল হক তারিন প্রথম আলোকে বলেন, মজিবর রহমান সব সময়ই বরিশালে ঐক্যবদ্ধ বিএনপি চেয়েছেন, বিভেদ চাননি। এবার মনোনয়ন পাওয়ার পর তিনি বরিশালে এসে সবাইকে নিয়েই কাজ শুরু করেছেন। বৃহস্পতিবারের যৌথ সভায় বরিশাল নগর ও জেলা বিএনপির সব নেতা-কর্মী ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার অঙ্গীকার করার মধ্য দিয়ে সব বিভেদের অবসান হয়েছে।