Samakal:
2025-06-20@00:25:14 GMT

হারিয়ে যাওয়ার নিয়ম নেই এখানে

Published: 19th, June 2025 GMT

হারিয়ে যাওয়ার নিয়ম নেই এখানে

আমাদের পাশের ফ্ল্যাটের আন্টির হাজবেন্ড ছিলেন প্রবাসী। ভদ্রলোক ওমান থাকতেন। বছর দুই বছরে দেশে আসতেন। আসার সময় লাগেজে চকলেট ও বিভিন্ন ইলেকট্রকনিক্স পণ্য নিয়ে আসতেন। আমার চৌদ্দগুষ্টির কেউ কখনো বিদেশ করেন নাই। ফলে, সেই দম্পতির মহানুভবতায় আমি মাঝে মধ্যেই বিদেশি চকলেট, সায়েন্টিফিক ক্যালকুলেটর ইত্যাদি গিফট পেতাম। নব্বই দশকের কথা। একসময় তিনি বিশাল সাইজের একটা ডেকসেট নিয়ে দেশে ফিরলেন। 
সেই আমলে ডেকসেট একটি বিরাট ব্যাপার বলে গণ্য করা হতো। মহল্লায় প্রবাসী কেউ থাকলে তাদের ওয়াইফের বেডরুমে এই জিনিস শোভা পেতো। আমি ভাবতাম, প্রবাসীদের স্ত্রীগণ খুব সংগীতপিপাসু হয়ে থাকেন।  কিছুদিন পর আবিষ্কার করলাম, ঘটনা ভিন্ন। 
একবার আন্টির সেই প্রবাসী হাজবেন্ড বিদেশ থেকে নানান নিত্যব্যবহার্য পণ্যের লগে একটি ফিতাক্যাসেটে ভয়েস রেকর্ড করে কুরিয়ারে পাঠায়ে দেন।
এখন তাঁর বাসায় আয়োজন করে সেই ক্যাসেট শোনা হবে। এ উপলক্ষে আন্টির শ্বশুর সাহেব গ্রাম থেকে আসছেন। আরও কিছু ময়মুরুব্বিও আছেন। নির্দিষ্ট সময়ে সেই ক্যাসেট প্লেয়ার চালানো হলো। 
সালামালকি দিয়া প্রবাসীর বক্তব্য শুরু হলো, আব্বা স্লামালাইকুম। উপস্থিত সকলে উচ্চস্বরে জানাইলেন, ওয়ালাইকুম। 
তারপরে রেকর্ড করা ভয়েস চলতে থাকলো, আশা করি ভালো আছেন। আপনাদের দোয়ায় সম্প্রতি একটা ভালো কোম্পানিতে আমার কাজ হইছে। উপস্থিত সকলে আওয়াজ দিলেন, আলহামদুলিল্লা!
এইরকমভাবে প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিট সেই এনালগ যুগেও ডিজিটাল কমিউনিকেশন চলতে থাকলো, যার বেশির ভাগ আলাপ বৈষয়িক। সবশেষে গ্রামের বাড়িতে ডিপ টিউবওয়েল ও মোল্লার জমিটা বর্গা দেয়ার ব্যাপারে পরামর্শ দিয়া প্রবাসী ভদ্রলোক তাঁর বক্তব্য শেষ করলেন। 
ক্যাসেট শোনা শেষে শ্বশুর সাহেব মোনাজাত ধরলেন, আমরা সেই মোনাজাতে সামিল হইলাম। প্রবাসীর কল্যাণ কামনায় সেই মোনাজাতের শেষে মিষ্টি বিতরণের পর সকলে প্রস্থান করেন, যদিও মহিলারা তখনো অন্দরে অবস্থান করতেছিলেন। সেখানে আরো কাহিনি আছে। সকলে চলে যাওয়ার পরে শুধু ভাবীসুলভ কিছু নারীর উপস্থিতিতে ক্যাসেটের উল্টাপিঠ ছাড়া হবে। 
পরে আমাদের বাসার ছুটা বুয়ার কাছ থেকে ডিটেইল জানা গেল। সে ট্যাংরা মাছ কাটতে কাটতে আমার খালারে ক্যাসেটের উল্টাপিঠের বিবরণ দিতেছিল। বিবরণ ছিল এইরকম– ‘ইছিছিছিছি, কি যে খাছড়া ব্যাডা! যদি আপনে শুনতেন!’ 
এই উপায়ে দেশে প্রথম ডিজিটাল কমিউনিকেশন সিস্টেম আবিষ্কার করেন প্রবাসীরা। আজকের ইমো মেসেঞ্জার হোয়াটসঅ্যাপের যুগে সেসব কমিউনিকেশন কিছু আর নাই!
আমরা যারা এই শহরে নব্বই দশকে বড় হচ্ছিলাম, তারা যোগাযোগের অনেক পর্যায় পার হয়ে এসেছি। আমরা হাতে প্রেমপত্র লিখে মায়ের পিছে পিছে হাঁটতে থাকা তরুণীর হাতে গুজে দেয়ার জেনারেশন। প্রযুক্তি বলতে নব্বই দশকটা ছিল ডেকসেট আর ওয়াকম্যানের জেনারেশন। ব্যান্ড মিউজিক রমরমা ছিল। 
মেটালিকার নতুন অ্যালবাম বের হইছে আমেরিকায়। সেখান থেকে এক কপি কিনে নিয়ে রেইনবোতে দিয়ে গেলেন শাফিন আহমেদ। দোকানে ক্যাসেট টু ক্যাসেট রেকর্ডিং চলতেছে। আমরা দোকানের বাইরে বসে বসে শুনি। একটি ক্যাসেট রেকর্ড হতে লাগে তিন ঘণ্টা। আইয়ুব বাচ্চু এসে প্রথম কপিটা নিয়ে গেলেন। এভাবে দিনের পর দিন রেইনবোর সামনে বসে বসেই সব গান মুখস্থ হয়ে গেছে। নিজের কপিটা পাওয়া গেল এক মাস পর। এরপর আমারে আর পায় কে? মহল্লায় এসে কোমরে ওয়াকম্যান কানে হেডফোন। কেউ ডাকলে শুনি না। মাথা দুলায়ে দুলায়ে সামনে দিয়ে হেঁটে যাবগা। এখন কত চ্যানেল, ইউটিউব– কত নতুন অ্যালবাম আসে, লাইভ রিলিজ হয়; অথচ আগের উত্তেজনা হারায়ে ফেলছি আমরা। 
এরপর কলেজে উঠে হাতে পেলাম মোবাইল ফোন। প্রিয় শিক্ষকদের পেয়েছিলাম কলেজজীবনে। ঢাকা সিটি কলেজে বাংলা ও ইংরেজি সাহিত্যের ক্লাস নিতেন তারা। তাদের একজন ছিলেন কুদ্দুস স্যার। তিনি ক্লাসে তেমন পড়াইতেন না। হাবিজাবি গল্পগুজব করতেন। অশ্লীল ধরনের রসিকতা করতেন। তারে কখনো টিচার্স কমন রুমে পাওয়া যাইতো না। ক্লাস না থাকলে কলেজের গেটে গিয়ে দারোয়ানের টুলে বসে বসে আকিজ বিড়ি টানতেন। এগুলা ২০০১ সালের কথা। তখন আমি বাংলা ফাইভ জ্বলায়ে ভাবতাম, বড় হলে বিড়ি টানতে হবে। তারে দেখে মনে হতো শিক্ষকতা একটা বেশ ফুর্তির ব্যাপার। কলেজ ছেড়ে দেয়ার পর এই শিক্ষককে খুব মিস করতাম। 

কলেজ ছেড়ে দেয়ার পর এই শিক্ষককে খুব মিস করতাম। 
অনেক পরে, ২০১৫ সালের দিকে জানতে পারি কুদ্দুস স্যার শুধু শিক্ষক নন, তিনি একজন সাহিত্যিক। শেখর ইমতিয়াজ নামে তিনি লেখেন। এই শিক্ষককে ফেসবুকে খুঁজে পাওয়া গেল। দুই একদিন ইনবক্স কমেন্টে টুকটাক কথাও হয়। 
পরে কী মনে করে আমারে তিনি ফ্রেন্ডলিস্ট থেকে ডিলিট করে দিছেন আল্লায় জানে। সম্ভবত ছাত্র হিসেবে আমার ফেসবুককেন্দ্রিক বেয়াদবি তার পছন্দ হয় নাই।  
কলেজে আমি ছিলাম উদাসমার্কা সাহিত্যভাবাপন্ন ছাত্র, পড়াশুনায় অমনোযোগি। ক্লাসে ৩৫ জন ছাত্র থাকলে আমার রোল নাম্বার হবে ৩৪, প্রতি সেমিস্টারে দুইটাতে ফেল। সায়েন্সের ক্লাসে বসে বসে পথিক ছদ্মনামে কবিতা লিখতাম। একবার ইংরেজী গ্রামার ক্লাস চলাকালীন সময়ে চৌধুরী এন্ড হুসেনখ্যাত চৌধুরী স্যার আমারে ইংরেজী খাতায় বাংলা সনেট রচনা করা অবস্থায় ধরে ফেলেন এন্ড আইডি কার্ড বাজেয়াপ্ত করেন। ওইদিন প্রথম আমি টের পাই, কবিতা লেখা একটা অপরাধ। 
তবে সিটি কলেজে মূলত প্রিয় শিক্ষক হয়ে উঠছিলেন ইংলিশ ম্যাম। তিনি শাড়ি আর শাঁখা পরে আসতেন, ইংরেজী সাহিত্য পড়াইতেন। শুধুমাত্র এই ম্যামের ক্লাসগুলা আমি গালে হাত দিয়ে শুনতাম। তারে কেন আমার ভালো লাগতো? ক্লাসের ভালো ভালো ছেলেরা আমার কাব্য প্রতিভা ও ছদ্মনামের কথা ম্যামকে গোপনে জানায়ে দেয়। পথিক নামের একটা ছেলে ক্লাসে বসে বসে ম্যাডামকে নিয়ে কবিতা লেখে এইরকম একটা গল্প আশেপাশের সেকশনগুলাতে গুজব আকারে ছড়ায়ে পরে। 
তো, সেকেন্ড ইয়ারের শেষদিকে একদিন ক্লাসে ঢুকেই ম্যাম আমারে দাঁড় করায়ে জানতে চাইলেন, বাংলা সাহিত্যের প্রথম রোমান্টিক ডায়লগ কী? আমি শরমে মরে গেলাম। আকাশ পাতাল ভাবতে ভাবতে কান টান লাল করে ফেলছিলাম।  
তার কাছেই জানতে পারি বাংলা সাহিত্যের প্রথম রোমান্টিক ডায়লগ , ‘পথিক, তুমি পথ হারাইয়াছ?’  তিনি আমাকে কপালকুন্ডলা পড়তে বলছিলেন। ওই কপালকুন্ডলা পড়তে গিয়েই সম্ভবত আমি সাহিত্যের রাস্তায় আমার জীবনের পথ হারাইলাম। 
সময়ের তালে আমরা একটা জীবনকে হারিয়ে এসেছি। অথচ হারিয়ে যাওয়ার নিয়ম নেই এখানে। সম্পর্ক মূলত সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো। এখানে কিছুই হারায় না। এক ঢেউ নিয়ে যায় আরেক ঢেউ এসে সব ফিরায়ে দেয়। ফলে লিঙ্কড ইনে পাওয়া গেল, হাতে প্রেমপত্র গুজে দেয়া সে তরুণী এখন শিকাগপ্রবাসি, পেশায় চিকিৎসক। 
এবার ক্লাস ফাইভের টেক্সট আসি। কাঠুরে ও তার কুঠারের গল্পটা আমরা সবাই জানি। ঈশপের গল্প। কুঠার দিয়ে বনে কাঠ কাটছিলেন এক কাঠুরে।
অসাবধানতাবশত তার কুঠারটি নদীতে পড়ে যায়। কাঠুরে হতাশ হয়ে নদীর ধারে বসে কাঁদতে থাকেন। তখন জলপরী এসে কাঠুরের দুঃখের কারণ জানতে চায়। কাঠুরে তার কুঠার হারানোর কথা জানালেন।
তারপর জলপরী তার জন্য সোনার কুঠার নিয়ে আসে। কাঠুরে সেটি নিজের নয় বলে ফিরিয়ে দেয়। রূপার কুঠার নিয়ে আসে। সেটিও ফিরিয়ে দেয় কাঠুরে। জলপরী তার সততায় মুগ্ধ হয়ে লোহার আসল কুঠার এবং সোনার ও রুপার কুঠার দুটিও তাকে উপহার দেয়।
ঈশপের গল্পগুলাতে একটা শিক্ষামূলক ব্যপার থাকা লাগে। এই গল্পের শিক্ষা হচ্ছে সততা ও তার পুরস্কার। পরে আরেক অসৎ কাঠুরে নদীতে নিজের কুঠার ফেলে দিয়। জলপরীর ছুটে আসলে তার হাতে স্বর্ণের কুঠার দেখে সেটাই নিজের বলে দাবী করে। এই অসততার কারণে নিজের কুঠারটাও হারায়।
বাংলাদেশের জনপ্রিয় সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ বলতেন, তার লেখায় কোন শিক্ষামূলক ব্যপার নাই। ফলে, তিনি এ গল্পটা ফিরিয়ে আনলেন এবং ভিন্ন এক পরিনতি হাজির করলেন। 
হুমায়ূনের ভার্শনটা হচ্ছে, কুড়াল হারানো সেই সৎ কাঠুরে অনেকদিন পর তার স্ত্রীকে নিয়ে বনে বেড়াতে গেছে। কাঠুরের স্ত্রী সেই নদীটি দেখতে ইচ্ছা প্রকাশ করলো। নদীর ধারে গিয়ে হঠাৎ তার স্ত্রী পানিতে পড়ে ডুবে গেল। কাঠুরে কান্না শুরু করেছে।
তার কান্না শুনে আবারও জলপরী এলো। তারপর জলপরী অতি রূপবতী রাজকন্যার মতো এক মেয়েকে পানি থেকে তুলে বলল, ‘এই কি তোমার স্ত্রী?’
কাঠুরে বলল, ‘জ্বি এই আমার স্ত্রী।‘
জলপরী বললো, ‘ভালো করে দেখে তারপর বলো।‘
কাঠুরে বলল, ‘আর দেখতে হবে না। এই আমার স্ত্রী।‘
জলপরী বলল, ‘আগের বার তোমার সততা দেখে মুগ্ধ হয়েছিলাম। এখন তুমি এটা কী করলে? আরেকটা মেয়ে দেখে নিজের স্ত্রীকে ভুলে গেলে?’
তখন কাঠুরে বলল, ‘আমি বাধ্য হয়ে বলেছি এইটাই আমার স্ত্রী। যদি না বলতাম, আপনি আরেকটা মেয়ে তুলতেন। আমি যদি বলতাম এই মেয়ে না। আপনি সবশেষে আমার স্ত্রীকে তুলতেন এবং আগের বারের মতো তিনজনকেই আমাকে দিয়ে দিতেন। এই কারণে প্রথমবারই বলেছি এটা স্ত্রী।
আমি নিতান্তই গরিব মানুষ। তিন বউকে পালবো কীভাবে? আর একটা বউকেই সামলাতে পারি না, সেখানে তিনটা বউ হলে তো আমাকেই নদীতে ঝাঁপ দিতে হবে।‘  
অনলাইনে এই গল্পেরও হাজারটা ভার্শন আছে। এর লজিক্যাল ভার্শনটা হচ্ছে, অসততার কারণে কাঠুরে এবার নিজের বউটাকেও হারায়। এথিক্যাল ভার্শন হচ্ছে, এবার শুধু তার আসল বউটাকেই ফিরত দেয়া হয়। আর কন্টেম্পোরারি ভার্শনটা হচ্ছে, এবারও কাঠুরের সততা দেখে জলপরী মুগ্ধ হলো এবং পানি থেকে তুলে তিনজনকে তো দিলোই, সাথে নিজেও তাকে বিয়ের প্রস্তাব দিলো! 
অবশেষে সৎ কাঠুরিয়া ৪ স্ত্রী নিয়ে ঘরে ফিরলো। 

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: গল প আম র স ত র প রব স র কর ড ত রপর প রথম

এছাড়াও পড়ুন:

হারিয়ে যাওয়ার নিয়ম নেই এখানে

আমাদের পাশের ফ্ল্যাটের আন্টির হাজবেন্ড ছিলেন প্রবাসী। ভদ্রলোক ওমান থাকতেন। বছর দুই বছরে দেশে আসতেন। আসার সময় লাগেজে চকলেট ও বিভিন্ন ইলেকট্রকনিক্স পণ্য নিয়ে আসতেন। আমার চৌদ্দগুষ্টির কেউ কখনো বিদেশ করেন নাই। ফলে, সেই দম্পতির মহানুভবতায় আমি মাঝে মধ্যেই বিদেশি চকলেট, সায়েন্টিফিক ক্যালকুলেটর ইত্যাদি গিফট পেতাম। নব্বই দশকের কথা। একসময় তিনি বিশাল সাইজের একটা ডেকসেট নিয়ে দেশে ফিরলেন। 
সেই আমলে ডেকসেট একটি বিরাট ব্যাপার বলে গণ্য করা হতো। মহল্লায় প্রবাসী কেউ থাকলে তাদের ওয়াইফের বেডরুমে এই জিনিস শোভা পেতো। আমি ভাবতাম, প্রবাসীদের স্ত্রীগণ খুব সংগীতপিপাসু হয়ে থাকেন।  কিছুদিন পর আবিষ্কার করলাম, ঘটনা ভিন্ন। 
একবার আন্টির সেই প্রবাসী হাজবেন্ড বিদেশ থেকে নানান নিত্যব্যবহার্য পণ্যের লগে একটি ফিতাক্যাসেটে ভয়েস রেকর্ড করে কুরিয়ারে পাঠায়ে দেন।
এখন তাঁর বাসায় আয়োজন করে সেই ক্যাসেট শোনা হবে। এ উপলক্ষে আন্টির শ্বশুর সাহেব গ্রাম থেকে আসছেন। আরও কিছু ময়মুরুব্বিও আছেন। নির্দিষ্ট সময়ে সেই ক্যাসেট প্লেয়ার চালানো হলো। 
সালামালকি দিয়া প্রবাসীর বক্তব্য শুরু হলো, আব্বা স্লামালাইকুম। উপস্থিত সকলে উচ্চস্বরে জানাইলেন, ওয়ালাইকুম। 
তারপরে রেকর্ড করা ভয়েস চলতে থাকলো, আশা করি ভালো আছেন। আপনাদের দোয়ায় সম্প্রতি একটা ভালো কোম্পানিতে আমার কাজ হইছে। উপস্থিত সকলে আওয়াজ দিলেন, আলহামদুলিল্লা!
এইরকমভাবে প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিট সেই এনালগ যুগেও ডিজিটাল কমিউনিকেশন চলতে থাকলো, যার বেশির ভাগ আলাপ বৈষয়িক। সবশেষে গ্রামের বাড়িতে ডিপ টিউবওয়েল ও মোল্লার জমিটা বর্গা দেয়ার ব্যাপারে পরামর্শ দিয়া প্রবাসী ভদ্রলোক তাঁর বক্তব্য শেষ করলেন। 
ক্যাসেট শোনা শেষে শ্বশুর সাহেব মোনাজাত ধরলেন, আমরা সেই মোনাজাতে সামিল হইলাম। প্রবাসীর কল্যাণ কামনায় সেই মোনাজাতের শেষে মিষ্টি বিতরণের পর সকলে প্রস্থান করেন, যদিও মহিলারা তখনো অন্দরে অবস্থান করতেছিলেন। সেখানে আরো কাহিনি আছে। সকলে চলে যাওয়ার পরে শুধু ভাবীসুলভ কিছু নারীর উপস্থিতিতে ক্যাসেটের উল্টাপিঠ ছাড়া হবে। 
পরে আমাদের বাসার ছুটা বুয়ার কাছ থেকে ডিটেইল জানা গেল। সে ট্যাংরা মাছ কাটতে কাটতে আমার খালারে ক্যাসেটের উল্টাপিঠের বিবরণ দিতেছিল। বিবরণ ছিল এইরকম– ‘ইছিছিছিছি, কি যে খাছড়া ব্যাডা! যদি আপনে শুনতেন!’ 
এই উপায়ে দেশে প্রথম ডিজিটাল কমিউনিকেশন সিস্টেম আবিষ্কার করেন প্রবাসীরা। আজকের ইমো মেসেঞ্জার হোয়াটসঅ্যাপের যুগে সেসব কমিউনিকেশন কিছু আর নাই!
আমরা যারা এই শহরে নব্বই দশকে বড় হচ্ছিলাম, তারা যোগাযোগের অনেক পর্যায় পার হয়ে এসেছি। আমরা হাতে প্রেমপত্র লিখে মায়ের পিছে পিছে হাঁটতে থাকা তরুণীর হাতে গুজে দেয়ার জেনারেশন। প্রযুক্তি বলতে নব্বই দশকটা ছিল ডেকসেট আর ওয়াকম্যানের জেনারেশন। ব্যান্ড মিউজিক রমরমা ছিল। 
মেটালিকার নতুন অ্যালবাম বের হইছে আমেরিকায়। সেখান থেকে এক কপি কিনে নিয়ে রেইনবোতে দিয়ে গেলেন শাফিন আহমেদ। দোকানে ক্যাসেট টু ক্যাসেট রেকর্ডিং চলতেছে। আমরা দোকানের বাইরে বসে বসে শুনি। একটি ক্যাসেট রেকর্ড হতে লাগে তিন ঘণ্টা। আইয়ুব বাচ্চু এসে প্রথম কপিটা নিয়ে গেলেন। এভাবে দিনের পর দিন রেইনবোর সামনে বসে বসেই সব গান মুখস্থ হয়ে গেছে। নিজের কপিটা পাওয়া গেল এক মাস পর। এরপর আমারে আর পায় কে? মহল্লায় এসে কোমরে ওয়াকম্যান কানে হেডফোন। কেউ ডাকলে শুনি না। মাথা দুলায়ে দুলায়ে সামনে দিয়ে হেঁটে যাবগা। এখন কত চ্যানেল, ইউটিউব– কত নতুন অ্যালবাম আসে, লাইভ রিলিজ হয়; অথচ আগের উত্তেজনা হারায়ে ফেলছি আমরা। 
এরপর কলেজে উঠে হাতে পেলাম মোবাইল ফোন। প্রিয় শিক্ষকদের পেয়েছিলাম কলেজজীবনে। ঢাকা সিটি কলেজে বাংলা ও ইংরেজি সাহিত্যের ক্লাস নিতেন তারা। তাদের একজন ছিলেন কুদ্দুস স্যার। তিনি ক্লাসে তেমন পড়াইতেন না। হাবিজাবি গল্পগুজব করতেন। অশ্লীল ধরনের রসিকতা করতেন। তারে কখনো টিচার্স কমন রুমে পাওয়া যাইতো না। ক্লাস না থাকলে কলেজের গেটে গিয়ে দারোয়ানের টুলে বসে বসে আকিজ বিড়ি টানতেন। এগুলা ২০০১ সালের কথা। তখন আমি বাংলা ফাইভ জ্বলায়ে ভাবতাম, বড় হলে বিড়ি টানতে হবে। তারে দেখে মনে হতো শিক্ষকতা একটা বেশ ফুর্তির ব্যাপার। কলেজ ছেড়ে দেয়ার পর এই শিক্ষককে খুব মিস করতাম। 

কলেজ ছেড়ে দেয়ার পর এই শিক্ষককে খুব মিস করতাম। 
অনেক পরে, ২০১৫ সালের দিকে জানতে পারি কুদ্দুস স্যার শুধু শিক্ষক নন, তিনি একজন সাহিত্যিক। শেখর ইমতিয়াজ নামে তিনি লেখেন। এই শিক্ষককে ফেসবুকে খুঁজে পাওয়া গেল। দুই একদিন ইনবক্স কমেন্টে টুকটাক কথাও হয়। 
পরে কী মনে করে আমারে তিনি ফ্রেন্ডলিস্ট থেকে ডিলিট করে দিছেন আল্লায় জানে। সম্ভবত ছাত্র হিসেবে আমার ফেসবুককেন্দ্রিক বেয়াদবি তার পছন্দ হয় নাই।  
কলেজে আমি ছিলাম উদাসমার্কা সাহিত্যভাবাপন্ন ছাত্র, পড়াশুনায় অমনোযোগি। ক্লাসে ৩৫ জন ছাত্র থাকলে আমার রোল নাম্বার হবে ৩৪, প্রতি সেমিস্টারে দুইটাতে ফেল। সায়েন্সের ক্লাসে বসে বসে পথিক ছদ্মনামে কবিতা লিখতাম। একবার ইংরেজী গ্রামার ক্লাস চলাকালীন সময়ে চৌধুরী এন্ড হুসেনখ্যাত চৌধুরী স্যার আমারে ইংরেজী খাতায় বাংলা সনেট রচনা করা অবস্থায় ধরে ফেলেন এন্ড আইডি কার্ড বাজেয়াপ্ত করেন। ওইদিন প্রথম আমি টের পাই, কবিতা লেখা একটা অপরাধ। 
তবে সিটি কলেজে মূলত প্রিয় শিক্ষক হয়ে উঠছিলেন ইংলিশ ম্যাম। তিনি শাড়ি আর শাঁখা পরে আসতেন, ইংরেজী সাহিত্য পড়াইতেন। শুধুমাত্র এই ম্যামের ক্লাসগুলা আমি গালে হাত দিয়ে শুনতাম। তারে কেন আমার ভালো লাগতো? ক্লাসের ভালো ভালো ছেলেরা আমার কাব্য প্রতিভা ও ছদ্মনামের কথা ম্যামকে গোপনে জানায়ে দেয়। পথিক নামের একটা ছেলে ক্লাসে বসে বসে ম্যাডামকে নিয়ে কবিতা লেখে এইরকম একটা গল্প আশেপাশের সেকশনগুলাতে গুজব আকারে ছড়ায়ে পরে। 
তো, সেকেন্ড ইয়ারের শেষদিকে একদিন ক্লাসে ঢুকেই ম্যাম আমারে দাঁড় করায়ে জানতে চাইলেন, বাংলা সাহিত্যের প্রথম রোমান্টিক ডায়লগ কী? আমি শরমে মরে গেলাম। আকাশ পাতাল ভাবতে ভাবতে কান টান লাল করে ফেলছিলাম।  
তার কাছেই জানতে পারি বাংলা সাহিত্যের প্রথম রোমান্টিক ডায়লগ , ‘পথিক, তুমি পথ হারাইয়াছ?’  তিনি আমাকে কপালকুন্ডলা পড়তে বলছিলেন। ওই কপালকুন্ডলা পড়তে গিয়েই সম্ভবত আমি সাহিত্যের রাস্তায় আমার জীবনের পথ হারাইলাম। 
সময়ের তালে আমরা একটা জীবনকে হারিয়ে এসেছি। অথচ হারিয়ে যাওয়ার নিয়ম নেই এখানে। সম্পর্ক মূলত সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো। এখানে কিছুই হারায় না। এক ঢেউ নিয়ে যায় আরেক ঢেউ এসে সব ফিরায়ে দেয়। ফলে লিঙ্কড ইনে পাওয়া গেল, হাতে প্রেমপত্র গুজে দেয়া সে তরুণী এখন শিকাগপ্রবাসি, পেশায় চিকিৎসক। 
এবার ক্লাস ফাইভের টেক্সট আসি। কাঠুরে ও তার কুঠারের গল্পটা আমরা সবাই জানি। ঈশপের গল্প। কুঠার দিয়ে বনে কাঠ কাটছিলেন এক কাঠুরে।
অসাবধানতাবশত তার কুঠারটি নদীতে পড়ে যায়। কাঠুরে হতাশ হয়ে নদীর ধারে বসে কাঁদতে থাকেন। তখন জলপরী এসে কাঠুরের দুঃখের কারণ জানতে চায়। কাঠুরে তার কুঠার হারানোর কথা জানালেন।
তারপর জলপরী তার জন্য সোনার কুঠার নিয়ে আসে। কাঠুরে সেটি নিজের নয় বলে ফিরিয়ে দেয়। রূপার কুঠার নিয়ে আসে। সেটিও ফিরিয়ে দেয় কাঠুরে। জলপরী তার সততায় মুগ্ধ হয়ে লোহার আসল কুঠার এবং সোনার ও রুপার কুঠার দুটিও তাকে উপহার দেয়।
ঈশপের গল্পগুলাতে একটা শিক্ষামূলক ব্যপার থাকা লাগে। এই গল্পের শিক্ষা হচ্ছে সততা ও তার পুরস্কার। পরে আরেক অসৎ কাঠুরে নদীতে নিজের কুঠার ফেলে দিয়। জলপরীর ছুটে আসলে তার হাতে স্বর্ণের কুঠার দেখে সেটাই নিজের বলে দাবী করে। এই অসততার কারণে নিজের কুঠারটাও হারায়।
বাংলাদেশের জনপ্রিয় সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ বলতেন, তার লেখায় কোন শিক্ষামূলক ব্যপার নাই। ফলে, তিনি এ গল্পটা ফিরিয়ে আনলেন এবং ভিন্ন এক পরিনতি হাজির করলেন। 
হুমায়ূনের ভার্শনটা হচ্ছে, কুড়াল হারানো সেই সৎ কাঠুরে অনেকদিন পর তার স্ত্রীকে নিয়ে বনে বেড়াতে গেছে। কাঠুরের স্ত্রী সেই নদীটি দেখতে ইচ্ছা প্রকাশ করলো। নদীর ধারে গিয়ে হঠাৎ তার স্ত্রী পানিতে পড়ে ডুবে গেল। কাঠুরে কান্না শুরু করেছে।
তার কান্না শুনে আবারও জলপরী এলো। তারপর জলপরী অতি রূপবতী রাজকন্যার মতো এক মেয়েকে পানি থেকে তুলে বলল, ‘এই কি তোমার স্ত্রী?’
কাঠুরে বলল, ‘জ্বি এই আমার স্ত্রী।‘
জলপরী বললো, ‘ভালো করে দেখে তারপর বলো।‘
কাঠুরে বলল, ‘আর দেখতে হবে না। এই আমার স্ত্রী।‘
জলপরী বলল, ‘আগের বার তোমার সততা দেখে মুগ্ধ হয়েছিলাম। এখন তুমি এটা কী করলে? আরেকটা মেয়ে দেখে নিজের স্ত্রীকে ভুলে গেলে?’
তখন কাঠুরে বলল, ‘আমি বাধ্য হয়ে বলেছি এইটাই আমার স্ত্রী। যদি না বলতাম, আপনি আরেকটা মেয়ে তুলতেন। আমি যদি বলতাম এই মেয়ে না। আপনি সবশেষে আমার স্ত্রীকে তুলতেন এবং আগের বারের মতো তিনজনকেই আমাকে দিয়ে দিতেন। এই কারণে প্রথমবারই বলেছি এটা স্ত্রী।
আমি নিতান্তই গরিব মানুষ। তিন বউকে পালবো কীভাবে? আর একটা বউকেই সামলাতে পারি না, সেখানে তিনটা বউ হলে তো আমাকেই নদীতে ঝাঁপ দিতে হবে।‘  
অনলাইনে এই গল্পেরও হাজারটা ভার্শন আছে। এর লজিক্যাল ভার্শনটা হচ্ছে, অসততার কারণে কাঠুরে এবার নিজের বউটাকেও হারায়। এথিক্যাল ভার্শন হচ্ছে, এবার শুধু তার আসল বউটাকেই ফিরত দেয়া হয়। আর কন্টেম্পোরারি ভার্শনটা হচ্ছে, এবারও কাঠুরের সততা দেখে জলপরী মুগ্ধ হলো এবং পানি থেকে তুলে তিনজনকে তো দিলোই, সাথে নিজেও তাকে বিয়ের প্রস্তাব দিলো! 
অবশেষে সৎ কাঠুরিয়া ৪ স্ত্রী নিয়ে ঘরে ফিরলো। 

সম্পর্কিত নিবন্ধ