ইরানের ওপর ইসরায়েলের চলমান আক্রমণ এ অঞ্চলের সাম্প্রতিক ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ আন্তঃসীমান্ত হামলার একটি। এটি পারমাণবিক স্থাপনার বিরুদ্ধে টার্গেট করা অভিযানের চেয়ে অনেক বেশি কিছু। এরই মধ্যে ইরানের শীর্ষ পর্যায়ের অনেক কর্মকর্তা নিহত হয়েছেন এবং যেখানে অত্যাধুনিক সাইবার আক্রমণ অন্তর্ভুক্ত।

এখন পর্যন্ত সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনার মধ্যে রয়েছে মেজর জেনারেল মোহাম্মদ বাগেরি, ইসলামিক রেভলিউশনারি গার্ড কর্পস (আইআরজিসি) কমান্ডার হোসেইন সেলামি এবং সংস্থাটির বিমানবাহিনী প্রধান আমির আলী হাজিজাদেহসহ বেশ কয়েকজন জ্যেষ্ঠ ইরানি কমান্ডারের হত্যাকাণ্ড। ১৯৮০-১৯৮৮ সালের ইরাকের বিরুদ্ধে যুদ্ধের পর থেকে নিশানাকৃত এসব হত্যাকাণ্ড ইরানের সামরিক নেতৃত্বের জন্য সবচেয়ে গুরুতর আঘাত। তবুও আপাতদৃষ্টিতে আক্রমণটি কেবল একটি সামরিক কৌশল নয়। এটি কয়েক দশক ধরে তৈরি হওয়া একটি রাজনৈতিক মতবাদের প্রকাশ।
যদিও ইসরায়েলি কর্মকর্তারা একে প্রকাশ্যে ইরানকে পারমাণবিক অস্ত্রের মালিকানা থেকে বিরত রাখার জন্য পূর্বপরিকল্পিত পদক্ষেপ হিসেবে উপস্থাপন করেছে, তবুও এর গভীর কৌশলগত যুক্তি ক্রমশ উদোম হয়ে পড়ছে। অভিযানের লক্ষ্য অস্থিতিশীলতার মধ্য দিয়ে ইসলামী প্রজাতন্ত্রের পতন ঘটানো। বছরের পর বছর ধরে ইসরায়েলি ও কিছু মার্কিন কৌশলবিদ কখনও গোপনে কিংবা প্রকাশ্যে যুক্তি দিয়ে আসছেন, ইরানের পারমাণবিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা ঠেকিয়ে দিতে একমাত্র টেকসই সমাধান হলো শাসন ব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটানো। এবারের আক্রমণ এই দীর্ঘস্থায়ী লক্ষ্যের সঙ্গে যুক্ত; কেবল সামরিক উপায়ে নয় বরং ইরানের অভ্যন্তরে মানসিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক চাপের মাধ্যমেও।

সাম্প্রতিক ঘটনাবলি ইঙ্গিত দেয়, এই অভিযান অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহের প্রাথমিক পর্যায়ে উস্কে দেওয়ার জন্য তৈরি করা হয়েছিল। এই কৌশল অতীতের শাসন ব্যবস্থা পরিবর্তনের তৎপরতা পর্যবেক্ষকদের কাছে পরিচিত। যেমন শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তাদের হত্যা, মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ, বিভ্রান্তিমূলক প্রচারণা ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো প্রতীকী লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করা। তেহরানে ইসরায়েলের সমর্থনে সাইবার আক্রমণ এবং সরকারি ভবন ও মন্ত্রণালয়গুলোতে নির্ভুলভাবে হামলা চালানো হয়েছে বলে জানা গেছে। এমনকি জাতীয় টেলিভিশন সম্প্রচার সাময়িকভাবে ব্যাহত হয়েছে, যা ইসলামী প্রজাতন্ত্রের যোগাযোগ অবকাঠামোর গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ।

ইসরায়েলি রাজনৈতিক বক্তব্য তাই বলছে। রুদ্ধদ্বার ব্রিফিং ও বেছে বেছে মিডিয়া সাক্ষাৎকারে কর্মকর্তারা স্বীকার করেছেন, ইরানের গভীর সুরক্ষিত ভূগর্ভস্থ পারমাণবিক স্থাপনা কিছু জাগ্রোস ও আলবোর্জ পর্বতমালার ৫০০ মিটারেরও বেশি নিচে চাপা পড়ে আছে বলে জানা গেছে, যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পূর্ণ অংশগ্রহণ ছাড়া ধ্বংস করা যাবে না।

বিশেষ করে এই অভিযানের জন্য জিবিইউ ৫৭ ‘ম্যাসিভ অর্ডন্যান্স পেনিট্রেটর’ বোমা ব্যবহারের প্রয়োজন হবে, যা কেবল আমেরিকান বি-২ বা বি-৫২ কৌশলগত বোমারু বিমান দ্বারা সরবরাহ করা সম্ভব। এ ধরনের সক্ষমতার অভাবে ইসরায়েলি নেতারা এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন, সরকার পরিবর্তন ছাড়া ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি বন্ধ করা অসম্ভব।
এই প্রেক্ষাপট ইসরায়েলের সমসাময়িক সামরিক ও রাজনৈতিক প্রচেষ্টায় নতুন অর্থ প্রদান করে। হামলার পর ইরানি জনসাধারণের উদ্দেশ্যে ইসরায়েলি বার্তাগুলো তীব্রতর হয়, যেখানে ইসলামিক রেভলিউশনারি গার্ডকে জাতীয় রক্ষক হিসেবে নয়, বরং ইরানি জনগণের প্রধান নিপীড়ক হিসেবে চিত্রিত করা হয়। বার্তায় ইসলামী প্রজাতন্ত্রকে ইরানি জাতি থেকে আলাদা করার চেষ্টা করা হয়েছিল। যেমন স্লোগান ছিল– ‘এটি ইরানের যুদ্ধ নয়। এটি শাসকগোষ্ঠীর যুদ্ধ।’ ইরানের শেষ শাহের জ্যেষ্ঠ পুত্র রেজা পাহলভি ও সাবেক ফুটবলার আলী করিমিসহ বিদেশে ইরানিবিরোধী ব্যক্তিত্বরা এই বর্ণনাগুলোর প্রতিধ্বনি করেছিলেন; ধর্মঘটের প্রতি সমর্থন প্রকাশ করেছিলেন। আর তারা শাসন পরিবর্তনের আহ্বান জানিয়েছিলেন।

তবে কৌশলটি সম্ভবত উল্টো ফল দিয়েছে। গণবিদ্রোহ বা জাতীয় ঐক্য ভাঙার পরিবর্তে আক্রমণগুলো রাজনৈতিকভাবে জনসাধারণের অনুভূতিকে সংঘবদ্ধ করেছে বলে মনে হচ্ছে। দীর্ঘদিন ধরে সরকারের সমালোচকসহ অনেক ইরানি জাতীয় সার্বভৌমত্বের ওপর এটি বিদেশি আক্রমণ হিসেবে দেখছেন, যার প্রতি তারা ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। ১৯৫৩ সালের সিআইএ সমর্থিত অভ্যুত্থান থেকে শুরু করে ইরান-ইরাক যুদ্ধ পর্যন্ত বহিরাগত হস্তক্ষেপগুলো একসঙ্গে মিলিত স্মৃতি গভীরভাবে যুক্ত হয়ে প্রতিরক্ষামূলক প্রতিচ্ছবিই পুনরায় জাগিয়ে তুলেছে। 

এমনকি ‘নারী, জীবন, স্বাধীনতা’র দাবিতে আন্দোলনরত কর্মীদের মধ্যেও বিদেশি সামরিক হস্তক্ষেপের সঙ্গে একমত হতে লক্ষণীয়ভাবে অনীহা দেখা গেছে, যা ২০২২ সালে পুলিশ হেফাজতে মাহসা আমিনির মৃত্যুর পর দেশব্যাপী বিক্ষোভের সূত্রপাত করেছিল। বোমা বিস্ফোরিত ভবন ও নিহত ইরানি সৈন্যদের ছবি প্রচারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সহানুভূতি ও সংহতি সাময়িকভাবে শাসন পরিবর্তনের দাবির পরিবর্তে কাজ করছে। অনেকের কাছে আলোচনা রাজনৈতিক সংস্কার থেকে জাতীয় প্রতিরক্ষার দিকে স্থানান্তরিত। যদি ইসরায়েলের চূড়ান্ত লক্ষ্য থাকত শাসন ব্যবস্থার পতন ঘটানো, তাহলে তারা ইরানের রাজনৈতিক ব্যবস্থার ঐতিহাসিকভাবে টিকে থাকা এবং জাতীয়ভাবে আঘাতের ঐক্যবদ্ধ শক্তিকে অবমূল্যায়ন করতে পারত। বোমায় জেনারেলদের নিহত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ইরানের সামাজিক কাঠামো ভেঙে পড়েছে বলে মনে হচ্ছে না। বরং এটি হয়তো আবার একত্রিত হচ্ছে।

মোহাম্মদ এসলামি: পর্তুগালের মিনহো বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সহকারী অধ্যাপক; আলজাজিরা থেকে ভাষান্তর ইফতেখারুল ইসলাম 
 

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: কর মকর ত র জন ত ক ব যবস থ লক ষ য র জন য প রক শ ইসর য ইসল ম

এছাড়াও পড়ুন:

ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা: চেরনোবিলের মতো বিপর্যয় হবে না

ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি লক্ষ্য করে বোমাবর্ষণ হলেও চেরনোবিল-ফুকুশিমার মতো বিপর্যয় ডেকে আনবে না বলে জানিয়েছেন বিজ্ঞানীরা। তারা বলেছেন, এগুলো মূলত ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ স্থাপনায় কেন্দ্রীভূত হয়েছে।

বিজ্ঞানীরা বিবিসিকে জানিয়েছেন, এ ধরনের স্থাপনায় ক্ষয়ক্ষতি হলেও তা চেরনোবিল বা ফুকুশিমার মতো ভয়াবহ ‘পারমাণবিক দুর্ঘটনা’ ঘটানোর ঝুঁকি তৈরি করে না। এর কারণ হলো সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্রে কোনো পারমাণবিক বিক্রিয়া (নিউক্লিয়ার রিঅ্যাকশন) ঘটে না। পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের রিঅ্যাক্টরে ইউরেনিয়ামের পরমাণু বিভাজিত হয়ে ফিশন প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে তাপ উৎপন্ন করে এবং তাতে তৈরি হয় অতিরিক্ত তেজস্ক্রিয় বর্জ্য।

অন্যদিকে, সমৃদ্ধকরণ স্থাপনাগুলো শুধু ইউরেনিয়ামকে জ্বালানি হিসেবে প্রস্তুত করে, সেখানে শক্তি উৎপাদনের কোনো প্রক্রিয়া চলে না। 

ব্যাঙ্গোর বিশ্ববিদ্যালয়ের পারমাণবিক উপাদান বিশেষজ্ঞ সায়মন মিডলবার্গ  বলেন, যদি কোনো সমৃদ্ধকরণ স্থাপনায় বোমা মারা হয়, তাহলে ভেতরের ইউরেনিয়াম পরিবেশে ছড়িয়ে পড়তে পারে। তবে এতে কোনো পারমাণবিক প্রতিক্রিয়া হওয়ার আশঙ্কা নেই। কাজেই এ ক্ষতি হবে স্থানীয় পর্যায়ে সীমাবদ্ধ এবং একমাত্র আশপাশের একটি ছোট এলাকা ছাড়া কোনো বিস্তৃত তেজস্ক্রিয় ঝুঁকি তৈরি হবে না।

রয়টার্স জানায়, ইরানের ভূগর্ভে নির্মিত পারমাণবিক স্থাপনাগুলোর ওপর আঘাত হানতে সক্ষম একমাত্র প্রচলিত অস্ত্র হচ্ছে মার্কিন ‘বাঙ্কার-ব্লাস্টার’ বোমা। সাম্প্রতিক ইরান-ইসরায়লে সংঘাত পরিস্থিতিতে অনেকের মনেই প্রশ্ন, যুক্তরাষ্ট্র যদি আসলেই ইরানের সন্দেহভাজন পারমাণবিক অস্ত্র স্থাপনায় শক্তিশালী বাঙ্কার-ব্লাস্টার বোমা ফেলে, তাহলে এর পরিণতি কী হবে? 

বিকিরণ ঝুঁকি বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, এই বোমা মাটির নিচের বাঙ্কার ধ্বংস করে ফেললেও এর ব্যাপক বিকিরণ দূষণের আশঙ্কা কম।

ইরানের ‘ফোরডো ফুয়েল এনরিচমেন্ট প্লান্ট’ নামের এই রহস্যময় স্থাপনা পাহাড়ের গুহায় নির্মিত এবং এখানে ইউরেনিয়াম আইসোটোপ প্রক্রিয়াকরণ করা হয়। এতে এখানে ইউরেনিয়াম সাধারণত ইউরেনিয়াম হেক্সাফ্লুরাইড নামক গ্যাস আকারে থাকে।

এ গ্যাস অণু তুলনামূলক বড় ও ভারী হওয়ায় এটি অনেক দূরে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা কম বলে জানান আলাবামা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য পদার্থবিজ্ঞান বিশেষজ্ঞ এমিলি ক্যাফ্রি। তিনি আরও বলেন, হামলার ফলে বিকিরণ বা দূষণ ওই স্থানেই সীমাবদ্ধ থাকবে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ