ইরানিদের ঐক্যবদ্ধ করছে ইসরায়েলি হামলা
Published: 19th, June 2025 GMT
ইরানের ওপর ইসরায়েলের চলমান আক্রমণ এ অঞ্চলের সাম্প্রতিক ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ আন্তঃসীমান্ত হামলার একটি। এটি পারমাণবিক স্থাপনার বিরুদ্ধে টার্গেট করা অভিযানের চেয়ে অনেক বেশি কিছু। এরই মধ্যে ইরানের শীর্ষ পর্যায়ের অনেক কর্মকর্তা নিহত হয়েছেন এবং যেখানে অত্যাধুনিক সাইবার আক্রমণ অন্তর্ভুক্ত।
এখন পর্যন্ত সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনার মধ্যে রয়েছে মেজর জেনারেল মোহাম্মদ বাগেরি, ইসলামিক রেভলিউশনারি গার্ড কর্পস (আইআরজিসি) কমান্ডার হোসেইন সেলামি এবং সংস্থাটির বিমানবাহিনী প্রধান আমির আলী হাজিজাদেহসহ বেশ কয়েকজন জ্যেষ্ঠ ইরানি কমান্ডারের হত্যাকাণ্ড। ১৯৮০-১৯৮৮ সালের ইরাকের বিরুদ্ধে যুদ্ধের পর থেকে নিশানাকৃত এসব হত্যাকাণ্ড ইরানের সামরিক নেতৃত্বের জন্য সবচেয়ে গুরুতর আঘাত। তবুও আপাতদৃষ্টিতে আক্রমণটি কেবল একটি সামরিক কৌশল নয়। এটি কয়েক দশক ধরে তৈরি হওয়া একটি রাজনৈতিক মতবাদের প্রকাশ।
যদিও ইসরায়েলি কর্মকর্তারা একে প্রকাশ্যে ইরানকে পারমাণবিক অস্ত্রের মালিকানা থেকে বিরত রাখার জন্য পূর্বপরিকল্পিত পদক্ষেপ হিসেবে উপস্থাপন করেছে, তবুও এর গভীর কৌশলগত যুক্তি ক্রমশ উদোম হয়ে পড়ছে। অভিযানের লক্ষ্য অস্থিতিশীলতার মধ্য দিয়ে ইসলামী প্রজাতন্ত্রের পতন ঘটানো। বছরের পর বছর ধরে ইসরায়েলি ও কিছু মার্কিন কৌশলবিদ কখনও গোপনে কিংবা প্রকাশ্যে যুক্তি দিয়ে আসছেন, ইরানের পারমাণবিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা ঠেকিয়ে দিতে একমাত্র টেকসই সমাধান হলো শাসন ব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটানো। এবারের আক্রমণ এই দীর্ঘস্থায়ী লক্ষ্যের সঙ্গে যুক্ত; কেবল সামরিক উপায়ে নয় বরং ইরানের অভ্যন্তরে মানসিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক চাপের মাধ্যমেও।
সাম্প্রতিক ঘটনাবলি ইঙ্গিত দেয়, এই অভিযান অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহের প্রাথমিক পর্যায়ে উস্কে দেওয়ার জন্য তৈরি করা হয়েছিল। এই কৌশল অতীতের শাসন ব্যবস্থা পরিবর্তনের তৎপরতা পর্যবেক্ষকদের কাছে পরিচিত। যেমন শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তাদের হত্যা, মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ, বিভ্রান্তিমূলক প্রচারণা ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো প্রতীকী লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করা। তেহরানে ইসরায়েলের সমর্থনে সাইবার আক্রমণ এবং সরকারি ভবন ও মন্ত্রণালয়গুলোতে নির্ভুলভাবে হামলা চালানো হয়েছে বলে জানা গেছে। এমনকি জাতীয় টেলিভিশন সম্প্রচার সাময়িকভাবে ব্যাহত হয়েছে, যা ইসলামী প্রজাতন্ত্রের যোগাযোগ অবকাঠামোর গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ।
ইসরায়েলি রাজনৈতিক বক্তব্য তাই বলছে। রুদ্ধদ্বার ব্রিফিং ও বেছে বেছে মিডিয়া সাক্ষাৎকারে কর্মকর্তারা স্বীকার করেছেন, ইরানের গভীর সুরক্ষিত ভূগর্ভস্থ পারমাণবিক স্থাপনা কিছু জাগ্রোস ও আলবোর্জ পর্বতমালার ৫০০ মিটারেরও বেশি নিচে চাপা পড়ে আছে বলে জানা গেছে, যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পূর্ণ অংশগ্রহণ ছাড়া ধ্বংস করা যাবে না।
বিশেষ করে এই অভিযানের জন্য জিবিইউ ৫৭ ‘ম্যাসিভ অর্ডন্যান্স পেনিট্রেটর’ বোমা ব্যবহারের প্রয়োজন হবে, যা কেবল আমেরিকান বি-২ বা বি-৫২ কৌশলগত বোমারু বিমান দ্বারা সরবরাহ করা সম্ভব। এ ধরনের সক্ষমতার অভাবে ইসরায়েলি নেতারা এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন, সরকার পরিবর্তন ছাড়া ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি বন্ধ করা অসম্ভব।
এই প্রেক্ষাপট ইসরায়েলের সমসাময়িক সামরিক ও রাজনৈতিক প্রচেষ্টায় নতুন অর্থ প্রদান করে। হামলার পর ইরানি জনসাধারণের উদ্দেশ্যে ইসরায়েলি বার্তাগুলো তীব্রতর হয়, যেখানে ইসলামিক রেভলিউশনারি গার্ডকে জাতীয় রক্ষক হিসেবে নয়, বরং ইরানি জনগণের প্রধান নিপীড়ক হিসেবে চিত্রিত করা হয়। বার্তায় ইসলামী প্রজাতন্ত্রকে ইরানি জাতি থেকে আলাদা করার চেষ্টা করা হয়েছিল। যেমন স্লোগান ছিল– ‘এটি ইরানের যুদ্ধ নয়। এটি শাসকগোষ্ঠীর যুদ্ধ।’ ইরানের শেষ শাহের জ্যেষ্ঠ পুত্র রেজা পাহলভি ও সাবেক ফুটবলার আলী করিমিসহ বিদেশে ইরানিবিরোধী ব্যক্তিত্বরা এই বর্ণনাগুলোর প্রতিধ্বনি করেছিলেন; ধর্মঘটের প্রতি সমর্থন প্রকাশ করেছিলেন। আর তারা শাসন পরিবর্তনের আহ্বান জানিয়েছিলেন।
তবে কৌশলটি সম্ভবত উল্টো ফল দিয়েছে। গণবিদ্রোহ বা জাতীয় ঐক্য ভাঙার পরিবর্তে আক্রমণগুলো রাজনৈতিকভাবে জনসাধারণের অনুভূতিকে সংঘবদ্ধ করেছে বলে মনে হচ্ছে। দীর্ঘদিন ধরে সরকারের সমালোচকসহ অনেক ইরানি জাতীয় সার্বভৌমত্বের ওপর এটি বিদেশি আক্রমণ হিসেবে দেখছেন, যার প্রতি তারা ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। ১৯৫৩ সালের সিআইএ সমর্থিত অভ্যুত্থান থেকে শুরু করে ইরান-ইরাক যুদ্ধ পর্যন্ত বহিরাগত হস্তক্ষেপগুলো একসঙ্গে মিলিত স্মৃতি গভীরভাবে যুক্ত হয়ে প্রতিরক্ষামূলক প্রতিচ্ছবিই পুনরায় জাগিয়ে তুলেছে।
এমনকি ‘নারী, জীবন, স্বাধীনতা’র দাবিতে আন্দোলনরত কর্মীদের মধ্যেও বিদেশি সামরিক হস্তক্ষেপের সঙ্গে একমত হতে লক্ষণীয়ভাবে অনীহা দেখা গেছে, যা ২০২২ সালে পুলিশ হেফাজতে মাহসা আমিনির মৃত্যুর পর দেশব্যাপী বিক্ষোভের সূত্রপাত করেছিল। বোমা বিস্ফোরিত ভবন ও নিহত ইরানি সৈন্যদের ছবি প্রচারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সহানুভূতি ও সংহতি সাময়িকভাবে শাসন পরিবর্তনের দাবির পরিবর্তে কাজ করছে। অনেকের কাছে আলোচনা রাজনৈতিক সংস্কার থেকে জাতীয় প্রতিরক্ষার দিকে স্থানান্তরিত। যদি ইসরায়েলের চূড়ান্ত লক্ষ্য থাকত শাসন ব্যবস্থার পতন ঘটানো, তাহলে তারা ইরানের রাজনৈতিক ব্যবস্থার ঐতিহাসিকভাবে টিকে থাকা এবং জাতীয়ভাবে আঘাতের ঐক্যবদ্ধ শক্তিকে অবমূল্যায়ন করতে পারত। বোমায় জেনারেলদের নিহত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ইরানের সামাজিক কাঠামো ভেঙে পড়েছে বলে মনে হচ্ছে না। বরং এটি হয়তো আবার একত্রিত হচ্ছে।
মোহাম্মদ এসলামি: পর্তুগালের মিনহো বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সহকারী অধ্যাপক; আলজাজিরা থেকে ভাষান্তর ইফতেখারুল ইসলাম
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: কর মকর ত র জন ত ক ব যবস থ লক ষ য র জন য প রক শ ইসর য ইসল ম
এছাড়াও পড়ুন:
পদ্মাপাড়ের আহত জারুল ও পাখিরা
পদ্মাপাড়ের শক্তিশালী বাতাস সঞ্চয় করে ডানা ঝাপটানো পাখিরা হারিয়ে যায় দূরে। হয়তো সে সময়টা খুব ভোরে, যখন পারাবারের ফেরিকর্মী খসরু পানকৌড়ি, মাছরাঙা পাখিদের মতোই টুপ করে বারবার জলে ডুব দিয়ে গোসল করে তার সাবানের ফেনাসমেত শরীরটা নিয়ে। যে সাবানের সাদা ফেনা সরিয়ে ফেললে তার কালো কষ্টিপাথরের মতো শরীরটা বের হয়ে যায়, যার ভেজা চেকপ্রিন্টের লুঙ্গি নিতম্ব ঊরুতে লেপটে থাকলেও তা তার দেখা সিনেমার নায়িকাদের মতো যৌন কামনার বদলে উদ্রেক করে বিরক্তির, গা শিরশির করা ঘৃণার। এ সময় প্রতিদিন ভোরে ছন্দার মাকেও দেখা যায় এক পাশে এসে বাসনকোসন মেজে নিয়ে যেতে। খসরু যতবার ডুব দেয়, ঠিক সেই বরাবর ততবারই ছন্দার মা একদলা থুতু পানিতে ফেলে, যাতে তা খসরুর গোসলকে অসম্পূর্ণই রেখে দেয়। একই সঙ্গেই সাবানের ফেনা মেখে ফরসা হতে বাধা দেয়, নিতম্ব ঊরু সব সময় অবহেলিত হয়েই পড়ে থাকে। কোনো পাখি হয়তো নদীপাড়েরই উঁচু একটা ঢিবির ওপর রাখা বাঁশে গোসল শেষ করে উঠে এদিক-ওদিক তাকায়, পাশেই কিছু উলঙ্গ শিশুও কাদা নিয়ে খেলা শেষে গোসল করতে ঝুপঝাপ লাপ দেয় পাড়ের অল্প পানিতে। কোনো পাখি হয়তো গভীর রাতে ফেরিঘাটের এই ব্যস্ততা, সারি সারি বাস, ট্রাক আর আলো-অন্ধকার ভেদ করে কালো গভীর পানিতে ছুটে চলা ফেরি চুপচাপ দেখে যায়; যেখানটায় ‘ফেরি ক্যামেলিয়া’ নামফলক লেখা দেখা যায়, ঠিক সেখানটায় বসে।
ভরদুপুরে এমনই একটা পাখি আহত হয়ে পড়ে থাকে নদীপাড়ের উত্তপ্ত সাদা বালুতে। দলছুট হয়ে উড়তে না পারায় পাখি হতবিহ্বল হয়ে এদিক-সেদিক তাকায়। বাকি পাখিরা উড়ে চলে পাল্লা দিয়ে ফেরির সাথে আর নিচে চাকায় ঘুরতে থাকা স্রোতের সাথে। সে সময় হয়তো বগুড়া থেকে বরিশালগামী নবীনবরণ বাসটাও ফেরিতে নদী পার হয়। বাস থেকে হন্তদন্ত হয়ে সাদা পাঞ্জাবি–পায়জামা পরে ইসহাক ব্যাপারীকে নামতে দেখা যায়। দূর থেকে দেখলে যে কেউ হয়তো বলবে ফেরির এক পাশে যে শৌচাগার আছে, ঠিকঠাক দরজার খিল দেওয়া ছাড়া, ভেতর ঘুটঘুটে অন্ধকার আর গন্ধময়, ব্যাপারীর হয়তো সেখানে যাওয়ার জন্যই এত তাড়াহুড়ো। কিন্তু শৌচাগার ছাড়িয়েও সে সামনে এগোয় আশপাশে না তাকিয়ে। নাহ, শুধু একবার তাকায় যেখানে চানাচুর দিয়ে মসলা, তেল, পেঁয়াজ, ধনেপাতাকুচি মুড়িতে মেশানো হয় এক ইচ্ছাকৃত উচ্চ শব্দে, সর্বনিম্ন দশ টাকার এই মুড়ি মাখার ঘ্রাণ ব্যাপারীকে তাকাতে বাধ্য করে। মুড়িমাখাওয়ালা আর তার চারপাশের ভিড় সব অগ্রাহ্য করে একটা মাইক্রোবাস আর একটা ট্রাকের মাঝখানের অল্প ফাঁকের ভেতর দিয়ে শুকনো শরীরটা ঢুকিয়ে দেয় অল্পতেই পার হওয়ার জন্য। সে সবকিছু ফেলে প্রায় দৌড়ে হাটে। খাড়া লোহার সিঁড়ির হাতল ধরে পৌঁছে যায় তিনতলায়।
খসরু তিনতলায় ব্যস্ত সবাইকে খাবারদাবার ও ভাত দেওয়ায়। তিনতলায় এক পাশে তার চিপস, প্যাকেটের ভাজাপোড়া, চা–কফির দোকান। ফ্রিজটা আপাতত নষ্ট, নাহয় সেখানে আইসক্রিম থাকে। তারই আশপাশে দুটি টেবিল আর কিছু বেঞ্চ পেতে রাখা সবার ভাত খাওয়ার আর বসার জন্য। এক কোণে তার রান্না করার ছোট রুম। এখান থেকে বের হয়েই উঁচু বেঞ্চে সে গামলা ভরে ভাত, মাছ-মাংস, তরকারি, ডাল রাখে। সে একা সব দিক সামাল দিয়ে উঠতে না পারায় এখান থেকে সবাই যে যার মতো নিয়ে খায়। মাঝেমধ্যে খসরু এসে তদারকি করে, কেউ তাকে ওতে পাত্তা দেয় বলে মনে হয় না। বিশেষত যেসব বাস–ট্রাকের ড্রাইভার, সুপারভাইজাররা নিয়মিত আসে। তার আজকের মেন্যু লালশাকভাজি, বেগুনভাজি, নদীর মাছ ভুনা আর পাতলা ডাল। ডাল সবার জন্য ফ্রি। শাপলা বাসের ড্রাইভার লালশাকের গামলা থেকে অর্ধেক শাক একাই খেয়ে ফেলে, আবার যাওয়ার সময় টাকা না দিয়েই মুহূর্তেই তিনতলা থেকে উধাও হয়ে যায়। খসরুর এখন সময় নেই তার পিছু নেওয়ার কিন্তু সে ধরবেই, এমনই সিদ্ধান্ত তার। সবকিছু শেষ হয়ে গেলে সে বাকিদের ডিমভাজি আর ডাল দেয়। এমন সময়-ই ব্যাপারী সেখানে এসে উপস্থিত হয়। ব্যাপারীকে খুব তাড়াহুড়ো করে বলতে শোনা যায়—“তত্তোরি দ্যাওসেন, দেরি হইয়্যা যাইতাসে তো।’ অল্পক্ষণ পরে মেলামাইনের জোড়া প্লেটের ওপর ভাত, ডাল, ডিমভাজি আর পাতলা শরীরটা নিয়ে ছুটতে দেখা যায় নিচে, বাসের ভেতরে। অনেকের মনেই প্রশ্ন জাগবে সে ওপরে না খেয়ে এত ছোটাছুটির কারণ কী? কারণ সেখানে তার ছেলে আবদুর রহমান আর স্ত্রী অপেক্ষায়। ছেলেকে খাইয়ে সে আবার ছুটে চলে ফেরির তিনতলায় প্লেট-গ্লাস ফেরত দেওয়ার জন্য। তাকে একটা গ্লাসও চেয়ে নিয়ে আসতে হয়েছে খসরুর কাছ থেকে; কারণ আবদুর রহমান গ্লাস ছাড়া শুধু বোতলে মুখ দিয়ে পানি খেতে পারে না।
২.নদীর পাড়ে আহত পাখিটা সূর্যের উত্তাপে গরম হওয়া বালুতে ফুটতে থাকে। মনে হয় কে যেন শরীর থেকে একটা একটা করে নরম পালক টেনে খুলে ফেলছে। বিস্ফারিত কমলা কালো চোখের মণি নিয়ে ওপরের আকাশের দিকে তাকায়, সেখানের সূর্যের আলো তার চোখে ধাঁধার সৃষ্টি করে। সূর্য আর তার মাঝখানে রংধনুর মতো একটা রাস্তা দেখা যায়। সব শক্তি সঞ্চয় করে সে ওড়ে। হায়, এক হাত সামনে যেতেই সে আবার বালুর ওপর মুখ থুবড়ে পড়ে। ইসহাক ব্যাপারী এবার তিনতলা থেকে দ্রুত নেমে আসে দোতলায় নামাজ পড়ার জায়গায়। নামাজের ভেতর কণ্ঠনালি, জিহ্বায় জোর দিয়ে পড়া ‘ইয়া কানা’বুদু ওয়া ইয়া কানাস্তাইন’ মুখ দিয়ে বের হয়ে যায়, মিলিয়ে যায় নদীপাড়ের সুবিস্তৃত হাওয়ায়, সাদা চিকচিক বালুতে। তাতে বাইরের আর্দ্রতা কিছু না কমলেও ব্যাপারীর ভেতর পুরোটা দ্রবীভূত হয়ে যায়। সে প্রস্তুতি নেয় সৃষ্টিকর্তার কাছে কিছু বলার, দীর্ঘ কোনো মোনাজাত ধরার।
৩.আহত পাখির দৃষ্টি কয়েক হাত দূরের আকন্দগাছের ঝোপের দিকে। তার চোখে ঝাপসা ধরা দেয় হালকা ময়লা বেগুনিরঙা আকন্দ ফুলের থোকাগুলো, মনে হয় এই দিনের আলোয়ও অসংখ্য তারা ফুটে আছে। যেভাবেই হোক ঝোপের কাছ পর্যন্ত পৌঁছাতে পারলে ছায়া মিলবে। পাখি তাকায় ঝোপের দিকে একবার, বিপরীত দিক থেকে রক্তের গন্ধ পেয়ে ছুটে আসা লাল পিঁপড়ার সারির দিকে একবার আর আকাশের স্বচ্ছ কাচরঙা রোদের দিকে। সে দিগ্বিদিক শূন্য হয়ে পড়ে গন্তব্য নিয়ে।
ওদিকে নবীনবরণ বাসের যাত্রীরা সবাই উঠে পড়েছে। বাসের সুপারভাইজার মাথা গুনছে, সবাই ঠিকঠাক উঠল কি না। বাসের ড্রাইভার গাড়ি নিয়ে ফেরি থেকে ডাঙায় এপারে ওঠার জন্য তৈরি। ইসহাক ব্যাপারীর বউ আকলিমা পাশে অসুস্থ ছেলেকে নিয়ে দাঁড়িয়ে গেল, নাক–মুখ বোরকায় ঢাকা আকলিমার ক্ষীণকণ্ঠ সর্বশক্তি দিয়ে বলছে—‘এই যে শুনছেননি ডেরাইভার সাব, আমাগো বাবুর আব্বা তো এক্ষনো আইসা পৌঁছায় নাই যে। হ্যায় নামাজ পড়বার গ্যাছে তো কইল। হে কই গ্যাছে, খুঁইজ্যা আনেন যে।’ সামনের সিটের দাঁড়ানো পায়জামা-পাঞ্জাবি টুপি পরা বারো-তেরো বছর বয়সী ছেলেটাও এ মুহূর্তে হাতের শসা খাওয়া বন্ধ রেখে একবার আকলিমার দিকে আরেকবার দরজার দিকে, ড্রাইভারের দিকে তাকায়। বিটলবণসহ শসার রস বেয়ে তার পাঞ্জাবির দুই হাতা ভিজিয়ে ফেলে, সেদিকে নজর দেওয়ার সময় এ মুহূর্তে না। ফেরির তৃতীয় তলায় সে সময় খসরু একটা বড় গামলায় ডাল, ডিমভাজি আর পোড়া শুকনা মরিচ নিয়ে ভাত খেতে বসে যায়। ঠিক দরজায় ঠাসা সুন্দর ঊরু বের করা লাস্যময়ী নায়িকার ছবির মুখোমুখি হয়ে। সারা দিনের এই একমুহূর্ত সময় পাওয়ার জন্য সে ছটফট করে। এ সময় সে ভাত খায় আর নায়িকার সঙ্গে একান্তে কথা বলে সুখ–দুঃখের, কোন কাস্টমার তার সঙ্গে কী ব্যবহার করল। সবশেষে প্রতিদিন এই আলাপ শেষ হয় এক কষ্ট নিয়ে। নায়িকাকে সে বলে—‘বুঝলানি আমি এই খসরু এত মাইনষেরে রান্না কইরা খাইওইলাম শুধু বাদ থাকলা আমার পেয়ারের লোক তুমি। আমার হাতের ইলিশ মাছ ভাজা শুকনা মরিচ পোড়া দিয়া আর কচি ডাঁটা চিংড়ির ঝোল খাইলে তুমি আমারে সারাডা জীবন মনে রাকতা গো, ভুলবার পারতা না, হ্যাভি টেস।’ সে গোগ্রাসে ভাত মুখে দিয়ে আবার বলতে থাকে—‘সারাডা দিন শুটিংয়ে থাহো, কী যে খাও, সবার রান্দন তো বালা না, কাছত থাকলে যত্ন–আত্তি কত্তামনি। তহন শুধু তুমার রান্দনই রানতাম গো নাইকা ।’ বলেই সে লজ্জা পেয়ে হাসে, আশপাশে কেউ দেখে ফেলল কি না খেয়াল করে। ফেরির দোতলায় সে সময় নামাজের মোনাজাতে ক্রন্দনরত ইসহাক বলছে বিড়বিড় করে—‘ইয়া আল্লাহ, আমার কথা শোনো গো আল্লাহ, কবুল কইর্যা লও সে, আমার পোলাডারে তুমি লইয়া যাইও না গো আল্লাহ। ও আল্লাহ, সারা জাহানের মালিক তুমি মায়ের কোলডা খালি কইরো না। আমি হ্যার মায়েরে কী দিয়া বুঝ দিমু গো আল্লাহ? হ্যায় তো জানে বড় হওনের লগে লগে পোলা ঠিক হইয়্যা যাইব। পোলাতো আরও রোগে পড়তাছে, হ্যার মা’য় তো সন্দেহ করতাসে আমারে। মায়ের মন তো!! আমি যেন হ্যার লগে মিছা কতা না কই। ও মাবুদ, আমি কেমনে কমু পোলার মায়েরে এই ডাউন সিনডোমের পোলার হায়াত আছে আর কয়ডা বছর মাত্র।’
৪.আকাশে হঠাৎ ছায়া নেমে আসে। কোত্থেকে মেঘের গর্জন শোনা যায়, বড় বড় ফোঁটায় বৃষ্টির পানি পড়ে। নদীপাড়ের অরিন গার্মেন্টস আরবিঅ্যান্ডবি ব্রিকফিল্ডের ছাইরঙা ধোঁয়া তখনো কুণ্ডলী পাকিয়ে আকাশের দিকে ঊর্ধ্বমুখী। আহত পাখি তার ঠোঁট হাঁ করে, বৃষ্টির পানির স্বাদ নেয় তার পিপাসার্ত জিহ্বায়। তার চোখ, শরীর ভেজে, আহত ডানার রক্ত ধুয়ে যায়। খসরু সে সময় তিনতলায় হাঁড়ি–পাতিল ধোয়ার কাজে ব্যস্ত, চুলায় তার রাতের ভাত টগবগ করে ফুটতে থাকে। সে উদাস দৃষ্টিতে দীর্ঘশ্বাস ফেলে রান্নাঘরের ছোট জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে বৃষ্টি দেখে নাকি অন্য কিছু ভাবে, সেটা বলা মুশকিল। ইসহাক ব্যাপারীর এ মুহূর্তে চোখ দিয়ে অঝোর ধারায় পানি নেমে আসে। যা এতক্ষণ ধরে বহু চেষ্টায়ও কেন জানি আসেনি। সে বলতে থাকে—‘ইয়া মাবুদ, মাবুদ রে, রাহমানুর রাহিম তুমি তো তোমার বান্দারে খালি হাতে ফেরত দাও না। আমারেও দিয়ো না। প্রয়োজন হইলে আমারে লইয়্যা যাও গো আল্লাহ, তার বিনিময়ে আমার পোলাডার জীবনডা ভিক্ষা দাও, যেমন কইর্যা ফেরত দিসিলা বাদশার পোলারে (এ সময় সে বাসা থেকে মনে করে আসা বাদশাহ বাবর আর তাঁর পুত্র হুমায়ুনের নাম বহুকষ্ট করেও মনে করতে পারে না )। ব্যাপারী আবার শুরু করে—‘আল্লাহ তুমি তো পানির ওপর থাকন অবস্থায় তোমার অসহায় বান্দার দোয়া কবুল করো। আমার চোখের সামনে আমার আবদুর রহমানরে নিয়ো না আল্লাহ।’ ব্যাপারীর সময়জ্ঞান লোপ পায়, তার হুঁশ থাকে না মোনাজাতে কতটা সময় পেরিয়ে যায়। নিচে ফেরিঘাটে এসে পৌঁছায়। হঠাৎ করে নেমে আসা বৃষ্টিতে পুরো ফেরি পিচ্ছিল কাদাময় হয়ে যায়। যারা এতক্ষণ কোনো বাস ছাড়াই শুধু নদী পার হওয়ার জন্য অপেক্ষা ছিল, তারা তাদের বস্তা বেডিং, বাচ্চা ছেলের মেয়েদের হাত ধরে পার হয় গাড়িগুলো পাড়ে ওঠার আগেই। আশপাশের ছোট ছোট মাইক্রোবাস, প্রাইভেট কার, মালবাহী ট্রাক ছোটে ধীরে ধীরে। পেছনে যাত্রীসহ নবীনবরণ বাসের ড্রাইভার গাড়ি ধীরগতিতে এগিয়ে নেয় সিরিয়াল অনুযায়ী ফেরি থেকে পাড়ে ওঠার। ব্যাপারীর বউয়ের চিৎকার, কান্নাকাটিতে আশপাশের দু–একজন সচকিত হয়ে উঠে দাঁড়ায় ব্যাপার কী জানতে। এ সময় ব্যাপারীর অসুস্থ প্রতিবন্ধী ছেলেরও ঠোঁটের দুপাশে লালা গড়িয়ে পড়ে, চোখের মণি বিস্ফারিত করে সর্বশক্তি দিয়ে সে বহুকষ্টে উচ্চারণ করে—‘আব...বা...আআআ...আব...বা...আআআ।’
অন্য আলো–য় লিখতে পারেন আপনিও। গল্প, কবিতা, প্রবন্ধসহ আপনার সৃজনশীল, মননশীল যেকোনো ধরনের লেখা পাঠিয়ে দিন। পাঠাতে পারেন প্রকাশিত লেখার ব্যাপারে মন্তব্য ও প্রতিক্রিয়া।ই–মেইল: [email protected]