ইরানের গুরুত্বপূর্ণ পারমাণবিক স্থাপনাগুলোতে যুক্তরাষ্ট্রের হামলার প্রতিশোধ নেওয়ার অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেছে ইরান। সেইসঙ্গে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে নতুন করে ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলার ঢেউ শুরু করেছে তেহরান।

ইরানের সশস্ত্র বাহিনীর নতুন চিফ অব স্টাফ আবদুর রহিম মুসাভি সোমবার সকালে এক সংক্ষিপ্ত বিবৃতিতে বলেন, যুক্তরাষ্ট্র রবিবার ফোরদো, নাতাঞ্জ এবং ইসফাহান পারমাণবিক স্থাপনাগুলোর ওপর হামলা চালিয়ে ইরানের সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘন করেছে এবং সরাসরি ও স্পষ্টভাবে যুদ্ধে প্রবেশ করেছে।

তিনি বলেন, “এই অপরাধী যুক্তরাষ্ট্রকে জানতে হবে, তার অবৈধ ও আগ্রাসী সন্তানকে (ইসরায়েল) শাস্তি দেওয়ার পাশাপাশি ইসলামের যোদ্ধারা এখন যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ ও সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যেকোনো পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য মুক্ত এবং আমরা এই বিষয়ে কখনোই পিছু হটব না।”

আরো পড়ুন:

পুতিন বলছেন, ইরানের বিরুদ্ধে আগ্রাসন ‘অকারণ’

‘ইরানে রেজিম চেঞ্জ হলে কে ক্ষমতায় বসবে, তা কেউ বলে দিতে পারে না’

ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ইরানের প্রতিশোধমূলক হামলার মুখপাত্র হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী ইব্রাহিম জোলফাগারি সোমবার (২৩ জুন) তার সর্বশেষ টেলিভিশন বিবৃতিতে বলেন, “যুক্তরাষ্ট্রের এই হামলার লক্ষ্য ছিল ‘মরতে বসা জায়নবাদী শাসনকে পুনরুজ্জীবিত করা’, কিন্তু এর পরিবর্তে এটি ইরানের সশস্ত্র বাহিনীর বৈধ ও বহুমুখী লক্ষ্যবস্তুর পরিসর আরো বিস্তৃত করবে এবং পুরো অঞ্চলে যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ার পথ তৈরি করবে।”

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের উদ্দেশে জোলফাগারি ইংরেজিতে বলেন, “জুয়াড়ি ট্রাম্প, তুমি হয়তো এই যুদ্ধ শুরু করতে পারো, কিন্তু শেষ করব আমরা।”

ইরানের সেনাবাহিনী সোমবার (২৩ জুন) জানিয়েছে, তারা ইসরায়েলের দিকে ফোর্টিফিকেশন-ভেদী বিস্ফোরক ওয়ারহেডযুক্ত ডজনেরও বেশি ‘ওয়ান-ওয়ে ড্রোন’ নিক্ষেপ করেছে। ইরান দাবি করেছে, সোমবার ভোর থেকে ছোড়া অধিকাংশ অস্ত্র সফলভাবে লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হেনেছে।

সোমবার দুপুরের আগে ইসরায়েলের বিভিন্ন স্থানে সতর্কতা সাইরেন বেজে ওঠে এবং দক্ষিণ ইসরায়েলের আশদোদ এলাকা ও জেরুজালেমের দক্ষিণে লাচিশ অঞ্চলসহ একাধিক স্থানে বিস্ফোরণের খবর পাওয়া যায়।

এই হামলাগুলোর ঠিক আগে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি এক্সে (সাবেক টুইটার) তার গত সপ্তাহের একটি টেলিভিশন ভাষণের অংশ পুনরায় প্রকাশ করেন। একটি অজ্ঞাত স্থান থেকে তিনি বলেছিলেন, “ইসরায়েলকে শাস্তি পেতেই হবে এবং এখন সেটিই হচ্ছে।”

ঢাকা/রাসেল

.

উৎস: Risingbd

কীওয়ার্ড: চ কর চ কর ইসর য় ল য ক তর ষ ট র র স মব র ইসর য

এছাড়াও পড়ুন:

জেসি ওয়েন্স: হিটলারের দর্পচূর্ণ করা এক ‘বুলেট’

২০১২। স্টুয়ার্ট ওয়েন র‌্যানকিন একটা কাজে গিয়েছেন জার্মানিতে। কাজ-টাজ শেষে সহকর্মীদের সঙ্গে বের হলেন একটু উদ্‌যাপন করতে। ইউরো চলছিল। কোয়ার্টার ফাইনালে গ্রিসকে ৪-২ গোলে হারিয়ে জার্মানদের ইউরো-উৎসব চাঙা রেখেছেন ওজিল-লামরা। মুখে জার্মান পতাকা এঁকে রাতের পার্টিতে মজতে মজতে ৪৫ বছর বয়সী মানুষটি হুট করে একটা ধাক্কা খেলেন।

‘কী অদ্ভুত, একেবারে স্যুরিয়াল! জার্মানিতে বসে, আমি জার্মান দলের পক্ষে গলা ফাটাই। কী অদ্ভুত, যেন চক্রপূরণ!’

র‌্যানকিন তাঁর নানার পরিচয় কোথাও জাহির করেন না। কিন্তু সেদিন সম্ভবত মনের মধ্যে ওই উপলব্ধিটুকুর জন্যই বলে ফেললেন।

সবার চোখে অবিশ্বাস। আমার অবশ্য সয়ে গেছে। ওরা জানতে চাইল, ‘লুজ লংকে চেনো? আমি বললাম, অবশ্যই।’

আড্ডার মধ্যে একটি মেয়ে মুঠোফোনের কন্ট্যাক্ট থেকে জুলিয়া লুইজি লংকে খুঁজে বের করে বলল, ‘আমি লুজ লংয়ের নাতির বন্ধু।’

তারপর কী ঘটেছে, সেটা জানা গেল গত বছর সিএনএনে র‌্যানকিনের জবানিতে। জুলিয়া লংয়ের সঙ্গে ডিনারে গিয়েছিলেন র‌্যানকিন। তাঁর ভাষায়, ‘খুব বিশেষ একটা মুহূর্ত। বিশেষ কিছু কথাবার্তাও হয়। অলিম্পিয়ানের নাতি হতে কেমন লাগে, তা নিয়ে কথা বলেছি।’

র‌্যানকিন নিশ্চয়ই সেদিন টের পেয়েছিলেন, চোখের সামনে অলিম্পিকের একখণ্ড ‘ক্ল্যাসিক’ ইতিহাসের চক্রপূরণ হতে দেখতে কেমন লাগে!

র‌্যানকিনের নানা জেসি ওয়েন্স।

জুলিয়ার দাদা লুজ লং।

দুজনই অলিম্পিক কিংবদন্তি। ১৯৩৬ বার্লিন অলিম্পিকে প্রতিদ্বন্দ্বী থেকে বন্ধু।

অ্যাডলফ হিটলারের নাৎসি রাজনীতির পাঠে নিগ্রো রক্তের সঙ্গে আর্য রক্তের ধারক জার্মানদের বন্ধুত্ব ভালো চোখে দেখা হয়নি। লুজকে সে জন্য অনেক কিছুই সইতে হয়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সেসব যন্ত্রণা-টন্ত্রণা থেকে লুজ চিরমুক্তি নিয়ে নেওয়ার পর গল্পটা আর এগোয়নি।

সেই সাক্ষাতে র‌্যানকিন ও জুলিয়ার মনে তাই রোমাঞ্চ না জেগে পারে না। তাঁরা-ই তো ইতিহাসের সন্ধিক্ষণ! আড্ডায়-আলাপে নিশ্চয়ই তাঁদের মন খুঁজে নিয়েছিল অদেখা সেই বার্লিন অলিম্পিকে। অলিম্পিয়াস্তাদিওনে সাদা-কালো সেই সময়ে আশপাশে ছোট-বড় স্বস্তিকা চিহ্ন, গ্যালারিতে উঁচু আসনে অ্যাডলফ হিটলার, চারপাশে নাৎসিজমের প্রচার আর মাঠে ভূমিষ্ঠ হওয়ার প্রসববেদনায় কাতর ইতিহাস।

সেই ইতিহাসের জন্মেই তো হিটলারের জাতিগত অহম রাইনের বুকে টুকরা টুকরা বরফ খণ্ডের মতো ভেঙে খান খান হলো!

সোনাঝরা দিনে দর্পচূর্ণ

১৯৩৩ সাল। যুক্তরাষ্ট্র ও জার্মানিতে দুটি ঘটনা ঘটল। তিন বছর পর সে দুটি ঘটনার পথরেখা এসে মিলল অলিম্পিয়াস্তাদিওনে।

সে বছর শিকাগোয় ন্যাশনাল হাইস্কুল চ্যাম্পিয়নশিপে ১০০ গজ (৯১ মিটার) দৌড় ৯.৪ সেকেন্ডে শেষ করে বিশ্ব রেকর্ড ছুঁল ওয়েন্স। ২২০ গজ (২০১ মিটার) দৌড়ে ভাঙল ন্যাশনাল হাইস্কুল (২০.৭ সেকেন্ড) রেকর্ড আর লং জাম্পে পাড়ি দিল ২৪ ফুট ৯.৫ ইঞ্চি। সে বছরই জার্মানির চ্যান্সেলর হলেন হিটলার।

জার্মানরা যে জাতিগতভাবে শ্রেষ্ঠ, তা বিশ্বের সামনে প্রমাণে তিন বছর পর বার্লিন অলিম্পিক হলো হিটলারের লক্ষ্যবস্তু। নাৎসিজমের একটা ডিসপ্লেও বিশ্বকে দেখানোর মহাপরিকল্পনা হাতে নেওয়া হলো। অতীতে আর কোনো অলিম্পিক গেমস টিভিতে বিশ্বব্যাপী প্রচার করা হয়নি। ১৯৩৬ বার্লিনই টিভিতে বিশ্বব্যাপী প্রচার পাওয়া প্রথম অলিম্পিক।

আমি হিটলারের সঙ্গে করমর্দন করতে বার্লিন অলিম্পিকে যাইনি। দৌড়াতে গিয়েছিলাম এবং সেটাই করেছি।জেসি ওয়েন্স

জার্মানদের জাতিগতভাবে শ্রেষ্ঠ প্রমাণে মরিয়া হিটলারের জার্মানি দল থেকে ইহুদি ক্রীড়াবিদেরা বাদ পড়লেন। নাৎসিদের চেতিয়ে তোলা হবে, এই ভয়ে কিছু দেশ ইহুদি ক্রীড়াবিদদের বহরে রাখল না। নাৎসিবাদের বিপক্ষে অবস্থান নেওয়ায় বহিষ্কৃত হলো লিথুয়ানিয়া। যুক্তরাষ্ট্রে প্রশ্ন উঠল, হিটলারের গেমসে অংশ নেওয়া ঠিক না বেঠিক? সেখানে কৃঞ্চাঙ্গদের সংগঠন এনএএসিপির সচিব ওয়াল্টার ফ্রান্সিস হোয়াইট বার্লিন অলিম্পিকে অংশ না নিতে ওয়েন্সকে খুব করে বোঝালেন। আমেরিকান অলিম্পিক কমিটির প্রধান আভেরি ব্রান্ডেজ ঘোষণা করলেন, গেমস রাজনীতি নয়, অ্যাথলেটদের জায়গা। ওয়েন্সের জায়গা থেকে দেখলে, বার্লিন গেমস নিয়ে চারপাশে যা শুনছিলেন, সেই অভিজ্ঞতাগুলো তাঁর জন্য নতুন না।

শুধু গায়ের রংটা যে মানুষের মধ্যে আকাশ-পাতাল ফারাকের কারণ, ওয়েন্সকে সেটা অল্প বয়সেই বুঝতে হয়েছিল। ওহাইও স্টেট ইউনিভার্সিটিতে তৃতীয় বর্ষে অলিম্পিক দলে সুযোগ পেলেন, এই বিশ্ববিদ্যালয়েই ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ডের প্রিমিয়ার অ্যাথলেট হয়েও স্কলারশিপ পাননি। অথচ এই বিশ্ববিদ্যালয়েই পেয়েছেন সেই নামটি ‘দ্য বাকায় বুলেট।’ পড়াশোনার খরচ জোগাতে কী করেননি! যুক্তরাষ্ট্রের একজন কৃঞ্চাঙ্গ নাগরিক হিসেবে তাঁর সিভিতে যেন কর্মদক্ষতার কমতি ছিল না; গ্যাস পাম্প, লিফট অপারেটর, টেবিলের ওয়েটার!

বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ড দলের অধিনায়ক, তবে (প্রথম) কৃষ্ণাঙ্গ হওয়ার জন্যই সম্ভবত ক্যাম্পাসে থাকার সুযোগ পাননি। বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে গিয়ে শ্বেতাঙ্গ সতীর্থরা যেসব রেস্টুরেন্টে খেতে যেতেন, তাঁর সেসব জায়গায় অনুমতি ছিল না।

ওয়েন্স বার্লিনে গেলেন।

কেন গিয়েছিলেন, আর হিটলার তাঁর সঙ্গে হাত মিলিয়েছিলেন কি না—এ দুটি প্রশ্নের উত্তর একসঙ্গে পাওয়া যায় অনেক পরে ওয়েন্সের বলে যাওয়া একটি কথায়। ২০১৬ সালে ‘বিল্ড’কে বলেছিলেন তাঁর মেয়ে মার্লিন ওয়েনস র‌্যানকিন, ‘তিনি সব সময় বলতেন, “আমি হিটলারের সঙ্গে করমর্দন করতে বার্লিন অলিম্পিকে যাইনি। দৌড়াতে গিয়েছিলাম এবং সেটাই করেছি।”’

এসএস ম্যানহাটান জাহাজে চেপে যুক্তরাষ্ট্র অলিম্পিক দল জার্মানিতে পৌঁছাল।
অলিম্পিক ভিলেজে ওয়েন্সের সঙ্গে দেখা হলো অ্যাডিডাসের প্রতিষ্ঠাতা এডি ড্যাসলারের। হুট করে সাক্ষাৎ নয়, ড্যাসলার রথ দেখার সঙ্গে কলাও বেচলেন; ওয়েন্স তাদের জুতা পরতে রাজি হন। কোনো আফ্রিকান-আমেরিকান অ্যাথলেটের সেটাই প্রথম স্পনসর।

ওয়েন্সকে এই জুতো দিয়েছিলেন ড্যাসলার

সম্পর্কিত নিবন্ধ