‘পরিবারের একমাত্র আয়ের লোককে ওরা খুন করেছে। এখন কীভাবে চলবে সংসার? দুই সন্তানের ভবিষ্যতের কী হবে? আমরা কীভাবে বেঁচে থাকব? কে আমাদের নিরাপত্তা দেবে? আমার সন্তান তার বাবাকে আর দেখবে না। আমার সব শেষ হয়ে গেছে।’ বিলাপ করতে করতে কথাগুলো বলছিলেন পুরান ঢাকার মিটফোর্ড এলাকায় নৃশংস হত্যাকাণ্ডের শিকার লাল চাঁদ ওরফে সোহাগের (৩৯) স্ত্রী লাকি বেগম।

লাল চাঁদের মরদেহ গতকাল শুক্রবার সকালে ঢাকা থেকে বরগুনায় নিয়ে আসেন স্বজনেরা। সদর উপজেলার ৭ নম্বর ঢলুয়া ইউনিয়নের ইসলামপুর গ্রামে মায়ের কবরের পাশে তাঁকে দাফন করা হয়। গ্রামের বাড়িতে এখন চলছে মাতম।

স্বজনেরা বলেন, তাঁরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। হত্যাকাণ্ডের পর থেকে এখনো হত্যাকারীদের লোকজন মুঠোফোনে হুমকি দিয়ে যাচ্ছে। লাল চাঁদের ১০ বছর বয়সী ছেলে সোহান ও ১৪ বছর বয়সী মেয়ে সোহানা। স্ত্রী লাকি বেগম (৩০) জানেন না, কীভাবে বিদ্যালয়পড়ুয়া এই দুই সন্তানকে সান্ত্বনা দেবেন!

আরও পড়ুনশরীর থেঁতলে পিটিয়ে হত্যা করা হয় লাল চাঁদকে১৫ ঘণ্টা আগে

স্বজনদের ভাষ্য, লাল চাঁদ যখন সাত মাস বয়সী, তখন বজ্রপাতে মারা যান তাঁর বাবা আইউব আলী। এরপর জীবিকার তাগিদে মা আলেয়া বেগম বরগুনা ছেড়ে ঢাকায় পাড়ি জমান। তখন থেকেই লাল চাঁদ ঢাকায় বসবাস করতেন। তিনি দীর্ঘদিন পুরান ঢাকার মিটফোর্ড এলাকায় ‘মেসার্স সোহানা মেটাল’ নামের একটি দোকান চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতেন। ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানটি ঘিরেই হত্যাকাণ্ডের সূত্রপাত।

স্বজনদের দাবি, মাসে দুই লাখ টাকা চাঁদা দাবিকে কেন্দ্র করে লাল চাঁদের সঙ্গে এলাকার একটি পক্ষের বিরোধ তৈরি হয়। চাঁদা দিতে রাজি না হওয়ায় একপর্যায়ে তাঁর ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান তালাবদ্ধ করে দেয় অভিযুক্ত ব্যক্তিরা। গত বুধবার বিকেলে বাসা থেকে ডেকে নিয়ে লাল চাঁদকে আটক করে চাঁদার জন্য দফায় দফায় চাপ দেওয়া হয়। তাতেও রাজি না হওয়ায় তাঁকে পাথরের আঘাতে হত্যা করা হয় বলে দাবি স্বজনদের।
নিহত লাল চাঁদ স্ত্রী ও সন্তান নিয়ে ঢাকার জিঞ্জিরার কদমতলী এলাকায় কেরানীগঞ্জ মডেল টাউনে বসবাস করতেন।

আরও পড়ুনপুরান ঢাকায় লাল চাঁদ হত্যার বিচার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে হবে: আসিফ নজরুল৫ ঘণ্টা আগে

আজ শনিবার দুপুরে বরগুনার ইসলামপুর গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, লাল চাঁদের স্ত্রী লাকি বেগম হাউমাউ করে কাঁদছিলেন। তাঁকে সান্ত্বনা দিতে গিয়ে কান্না থামাতে পারছিলেন না স্বজনেরাও।

বেলা সাড়ে ১১টার দিকে বরগুনা জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি নজরুল ইসলাম মোল্লা পরিবারটির খোঁজখবর নিতে যান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘নিহত সোহাগ আমাদের দলীয় লোক। শোকাহত পরিবারটির পাশে আমরা আছি। আইনি ও আর্থিক সহযোগিতা করা হবে।’

লাল চাঁদের বাড়ির সামনে অপেক্ষমাণ স্বজন ও প্রতিবেশীরা। আজ শনিবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে বরগুনা সদর উপজেলার ৭ নম্বর ঢলুয়া ইউনিয়নের ইসলামপুর গ্রামে.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: হত য ক ণ ড পর ব র ইসল ম বরগ ন স বজন

এছাড়াও পড়ুন:

পিলখানা হত্যাকাণ্ড: জড়িতদের নাম প্রকাশ ও আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি স্বজনদের

পিলখানায় নৃশংস হত্যাকাণ্ডের ঘটনা তদন্তে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত জাতীয় স্বাধীন তদন্ত কমিশন প্রধান উপদেষ্টার কাছে প্রতিবেদন জমা দেওয়ায় সন্তুষ্টির কথা জানিয়েছেন নিহত সেনা কর্মকর্তাদের স্বজনেরা। তবে ওই ঘটনায় সম্পৃক্তদের সবার নাম প্রকাশ না করায় হতাশ তাঁরা।

সম্পূর্ণ প্রতিবেদন প্রকাশ করার পাশাপাশি দোষী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে দ্রুত আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন নিহত সেনা কর্মকর্তাদের স্বজনেরা।

আজ সোমবার রাজধানীর রাওয়া ক্লাবে ‘বিডিআর তদন্ত কমিশনের রিপোর্ট প্রকাশে শহীদ পরিবারের মতপ্রকাশ’ শিরোনামে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। সেখানেই নিহত সেনা কর্মকর্তাদের স্বজনেরা এসব কথা বলেছেন।

নিহত সেনা কর্মকর্তাদের স্বজনেরা অভিযোগ করেন, সরকার পরিবর্তনের পর থেকে তাঁরা সাক্ষ্য দিতে গিয়ে নানামুখী সামাজিক ও অনলাইন হয়রানির শিকার হয়েছেন। তাঁরা এখন নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন বলেও জানান।

ঢাকার পিলখানায় নৃশংস হত্যাকাণ্ডের ঘটনা তদন্তে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত জাতীয় স্বাধীন তদন্ত কমিশন গতকাল রোববার বিকেলে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে তাদের প্রতিবেদন জমা দেয়।

২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিডিআর) (বর্তমানে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ-বিজিবি) সদর দপ্তরে নৃশংস এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ১১ মাস ধরে তদন্ত করে প্রতিবেদন তৈরি করে এই কমিশন। প্রধান উপদেষ্টার কাছে প্রতিবেদন জমা দেওয়ার পর সন্ধ্যায় সায়েন্স ল্যাবরেটরির বিআরআইসিএম নতুন ভবনে সংবাদ সম্মেলন করে তদন্ত কমিশন।

কমিশনের সভাপতি মেজর জেনারেল (অব.) আ ল ম ফজলুর রহমান সংবাদ সম্মেলনে তদন্ত প্রতিবেদনের বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরেন। প্রতিবেদন জমা দেওয়ার এক দিন পর আজ নিহত সেনা কর্মকর্তাদের স্বজনেরা সংবাদ সম্মেলন করলেন।

সংবাদ সম্মেলনে লেফটেন্যান্ট কর্নেল লুৎফর রহমান খানের মেয়ে ডা. ফাবলিহা বুশরা বলেন, কমিশনের প্রধান জেনারেল ফজলুর রহমান গতকাল বলেছেন, প্রতিবেদনটি ‘ক্ল্যাসিফায়েড’ নয় এবং পরে জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে। শহীদ পরিবারের আহ্বান, প্রক্রিয়াটিতে বিলম্ব না করে দ্রুত বিচার বিভাগে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ পাঠানো, সম্ভাব্য অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা, যেমন ট্রাভেল ব্যান নিশ্চিত করা এবং তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করা।

ফাবলিহা বুশরা আরও বলেন, ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জনের প্রাণহানি শুধুই একটি পরিবারের ট্র্যাজেডি নয়, এটি জাতিগত বিপর্যয়। করদাতাদের অর্থে সংগঠিত রাষ্ট্রীয় বাহিনীকে ব্যবহার করে সার্বভৌমত্বকে ক্ষতিগ্রস্ত করার যে ষড়যন্ত্র ঘটেছে, তার সত্য জানার অধিকার দেশের প্রতিটি নাগরিকের আছে।

পিলখানায় হত্যার শিকার কর্নেল কুদরত ইলাহীর সন্তান আইনজীবী সাকিব রহমান সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘কমিশন খুব স্পষ্টভাবে বলেছেন, কিছু কিছু নাম, যেগুলো তাঁরা পেয়েছেন, তাঁরা এই মুহূর্তে সেগুলোই প্রকাশ করতে পারবেন না। সেটার যৌক্তিকতাটা আমরা কিছুটা বুঝি। তবে আমার মনে হয় না যে এটাকে অজুহাত দেখিয়ে অনেক দিন ধরে সেই নাম প্রকাশ হবে না। সেটা কোনোভাবে আমরা মেনে নেব না।’ তিনি আরও বলেন, ‘যত দ্রুত সম্ভব সব ব্যক্তি—সামরিক ও বেসামরিক সবার বিরুদ্ধে যেন অ্যারেস্ট ওয়ারেন্ট জারি করা হয় এবং তারা যেন অ্যারেস্ট হয়। যদি রিপোর্টটা পাবলিক না হয়, আমরা আশঙ্কা করি, যেসব মানুষের নাম এসেছে, তারা ধরা-ছোঁয়ার বাইরে চলে যাবে।’

শেখ হাসিনা ভারতের স্বার্থে আর নিজের ক্ষমতাধর স্বার্থে জঘন্যতম হত্যাকাণ্ড বাস্তবায়ন করেছেন বলে উল্লেখ করেন পিলখানায় হত্যার শিকার বিডিআরের তৎকালীন মহাপরিচালক (ডিজি) মেজর জেনারেল শাকিল আহমেদের ছেলে রাকিন আহমেদ ভূঁইয়া। তিনি বলেন, মীর জাফরদের বিচার করা না হলে কিন্তু ভবিষ্যতে আরেকটা পিলখানা হত্যাকাণ্ড করার সুযোগ রয়েছে।

পিলখানায় হত্যার শিকার কেন্দ্রীয় সুবেদার মেজর নুরুল ইসলামের ছেলে আশরাফুল আলম হান্নান বলেন, ‘এই রিপোর্টের পরে আমরা শুধু শহীদ পরিবার নয়, এ দেশের সব জনগণ এখন একেবারে সুনির্দিষ্ট করে বলতে পারবে যে এই হত্যাকাণ্ড কারা ঘটিয়েছে। এটা আমাদের এই সময়ের জন্য সবচেয়ে বড় অর্জন। যে এ দেশের মানুষ একেবারে সুনির্দিষ্ট করে বলবে যে আওয়ামী লীগ এই হত্যাকাণ্ড করেছে। শেখ হাসিনা এই হত্যাকাণ্ড করেছে। ভারত এর সঙ্গে জড়িত ছিল। এখন আমাদের আর কোনো ভীতিতে থাকতে হবে না। আর আমি সরকারের কাছে দাবি করব, এই যে রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়েছে, এটি যেন দ্রুত সময়ে ওয়েবসাইটে দেওয়া হয়।’

সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য দেন পিলখানায় হত্যার শিকার কর্নেল মুজিবুল হকের ছেলে মুহিব হক এবং মেজর কাজী মোসাদ্দেক হোসেনের মেয়ে কাজী নাজিয়া তাবাসসুম।

আরও পড়ুনবিডিআর হত্যাকাণ্ডে আওয়ামী লীগ দলগতভাবে জড়িত১৯ ঘণ্টা আগে

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • পিলখানা হত্যাকাণ্ড: জড়িতদের নাম প্রকাশ ও আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি স্বজনদের