Prothomalo:
2025-08-06@10:09:22 GMT

ইসলাম ও প্রযুক্তির ভারসাম্য

Published: 6th, August 2025 GMT

আধুনিক যুগে প্রযুক্তি আমাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে গভীর প্রভাব ফেলেছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা থেকে শুরু করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, ই-কমার্স থেকে টেলিমেডিসিন—প্রযুক্তি আমাদের জীবনযাত্রাকে সহজ করেছে, দূরত্ব কমিয়েছে এবং নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করেছে।

তবে এই দ্রুত পরিবর্তনের মধ্যে মুসলিম সমাজের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন উঠে আসে: কীভাবে আমরা আমাদের ইসলামি মূল্যবোধ ও ঐতিহ্যের সঙ্গে আপস না করে প্রযুক্তির সুবিধাগুলো গ্রহণ করব?

ইসলাম আমাদের শিক্ষা দেয় তাওয়াযুন বা ভারসাম্যের পথ, যার মাধ্যমে প্রযুক্তির উন্নতি গ্রহণ করতে পারি, কিন্তু নৈতিকতা ও সমাজের প্রতি দায়িত্বের প্রতিও সচেতন থাকতে হবে।

ইসলাম জ্ঞানের সন্ধান এবং সেই জ্ঞানের সুফল সবার কল্যাণে ব্যবহার করতে উৎসাহিত করে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘যাকে প্রজ্ঞা দেওয়া হয়েছে, তাকে দেওয়া হয়েছে প্রভূত কল্যাণ।’ (সুরা বাকারা, আয়াত: ২৬৯)

আমাদের প্রিয় নবী মুহাম্মদ (সা.

) বলেছেন, ‘সর্বোত্তম মানুষ তারা যারা মানবতার জন্য সবচেয়ে বেশি উপকার বয়ে আনে।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস: ২,৪১২)

এই শিক্ষার আলোকে প্রযুক্তি আমাদের জন্য একটি নেয়ামত হতে পারে, যদি আমরা এটিকে সঠিক নিয়তে এবং ইসলামি নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ব্যবহার করি। তবে প্রযুক্তির অপব্যবহার আমাদের ইমান, পারিবারিক সম্পর্ক এবং সমাজের প্রতি দায়িত্ব থেকে বিচ্যুত করতে পারে।

ইসলাম আমাদের শিক্ষা দেয় তাওয়াযুন বা ভারসাম্যের পথ, যার মাধ্যমে প্রযুক্তির উন্নতি গ্রহণ করতে পারি, কিন্তু নৈতিকতা ও সমাজের প্রতি দায়িত্বের বিষয়েও সচেতন থাকতে হবে।ইসলাম ও প্রযুক্তি: একটি ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ

ইসলামি সভ্যতা ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে জ্ঞান ও উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে অগ্রগামী ছিল। ইসলামের স্বর্ণযুগে (আট থেকে তেরো শতক) মুসলিম পণ্ডিতেরা চিকিৎসা, গণিত, জ্যোতির্বিদ্যা এবং প্রকৌশলের মতো ক্ষেত্রে অসাধারণ অবদান রেখেছেন। ইবনে সিনার কানুন ফি তিব (চিকিৎসাবিজ্ঞানের ক্যানন) এবং আল-খাওয়ারিজমির গাণিতিক গবেষণা পশ্চিমা বিশ্বের বিজ্ঞানের ভিত্তি তৈরি করেছিল (ইয়াহিয়া এমারিকানি, ইসলামিক সায়েন্স: অ্যান ইলাস্ট্রেটেড স্টাডি, ১৯৭৭, পৃ. ১২৫-১৩০, ওয়েস্টার্ন পাবলিকেশনস)

এই অগ্রগতি শুধু জ্ঞানের প্রতি ভালোবাসার ফল নয়, বরং আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন এবং মানবতার কল্যাণ সাধনের লক্ষ্যে পরিচালিত হয়েছিল।

আজকের প্রযুক্তিগত বিপ্লব ঐতিহাসিক এই চেতনারই একটি ধারাবাহিকতা। কিন্তু আধুনিক প্রযুক্তির দ্রুত বিস্তার এবং এর ব্যাপক প্রভাব আমাদের নতুন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি করেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম আমাদের পরিবার ও সম্প্রদায়ের সঙ্গে সংযোগ বাড়িয়েছে, কিন্তু এটি একই সঙ্গে হিংসা, গিবত এবং সময়ের অপচয়ের মতো সমস্যাও সৃষ্টি করতে পারে। নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি তার জিহ্বা ও গোপনাঙ্গের হিফাজত করে, আমি তার জন্য জান্নাতের নিশ্চয়তা দিচ্ছি।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৬,৪৭৪)

ডিজিটাল জগতে আমাদের কথা ও আচরণের প্রতি সতর্ক থাকা এই হাদিসের আলোকে আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।

আরও পড়ুনগণিতে ইবনে হাইমের অবদান২৩ জুলাই ২০২৫শরিয়াহর উদ্দেশ্য ও প্রযুক্তির ব্যবহার

ইসলামি শরিয়াহর উদ্দেশ্য (মাকাসিদ আশ-শরিয়াহ) আমাদের প্রযুক্তি ব্যবহারের জন্য একটি স্পষ্ট কাঠামো প্রদান করে। এই উদ্দেশ্যগুলো হলো: জীবন, দ্বীন, বুদ্ধি, সম্পত্তি এবং পরিবারের হিফাজত। যে প্রযুক্তি এই উদ্দেশ্যগুলো পূরণে সহায়তা করে, তা ইসলামে উৎসাহ দেওয়া হয়ছে। চিকিৎসাপ্রযুক্তি যেমন টেলিমেডিসিন বা উন্নত ডায়াগনস্টিক টুলস জীবন রক্ষায় ভূমিকা রাখে। কোরআন বলে, ‘যে কেউ একটি জীবন রক্ষা করে, সে যেন সমগ্র মানবজাতিকে রক্ষা করেছে।’ (সুরা মায়িদা, আয়াত: ৩২)

এই আয়াতের আলোকে, চিকিৎসাপ্রযুক্তি কেবল জায়েজ নয়, বরং এটি একটি উৎসাহযোগ্য আমল।

মুসলিম সেই ব্যক্তি, যার জিহ্বা ও হাত থেকে অন্য মুসলিম নিরাপদ থাকে।সহিহ মুসলিম, হাদিস: ৪১

অন্যদিকে শিক্ষাগত প্রযুক্তি, যেমন অনলাইন কোর্স বা ইসলামি জ্ঞানের প্ল্যাটফর্ম, আমাদের বুদ্ধি ও দ্বীনের হিফাজত করে। আজকাল, বিশ্বজুড়ে মুসলিমরা ইন্টারনেটের মাধ্যমে কোরআন তাফসির, হাদিস শিক্ষা এবং উলামার বক্তৃতা সহজেই পেতে পারে। এটি আমাদের ইমানকে শক্তিশালী করার একটি শক্তিশালী মাধ্যম। তবে প্রযুক্তির এই সুবিধাগুলো গ্রহণ করতে গিয়ে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে যেন এটি আমাদের আধ্যাত্মিকতা বা পারিবারিক সম্পর্কের ক্ষতি না করে।

ডিজিটাল নৈতিকতা ও ইসলামি মূল্যবোধ

ডিজিটাল যুগে নতুন নৈতিক চ্যালেঞ্জের উদ্ভব হয়েছে। গোপনীয়তার লঙ্ঘন, ভুল তথ্য ছড়ানো এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আসক্তি এমন কিছু সমস্যা, যা আমাদের ইসলামি নীতির আলোকে মোকাবিলা করতে হবে। ইসলাম আমাদের আমানাহ (বিশ্বস্ততা) এবং সিদক (সত্যবাদিতা) পালনের শিক্ষা দেয়। নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘মুসলিম সেই ব্যক্তি, যার জিহ্বা ও হাত থেকে অন্য মুসলিম নিরাপদ থাকে।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ৪১)

ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে এই নীতি আরও গুরুত্বপূর্ণ। আমরা যখন অনলাইনে কিছু পোস্ট করি বা শেয়ার করি, তখন তা সত্য, সম্মানজনক এবং কল্যাণকর হওয়া উচিত।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গিবত, অপমানজনক মন্তব্য বা মিথ্যা তথ্য ছড়ানো ইসলামি শিক্ষার বিরুদ্ধে। কোরআন আমাদের সতর্ক করে, ‘হে ইমানদারগণ! তোমরা অনেক অনুমান থেকে বিরত থাকো, কারণ কিছু অনুমান পাপ। আর তোমরা একে অপরের পেছনে ত্রুটি অনুসন্ধান করো না এবং গিবত করো না।’ (সুরা হুজুরাত, আয়াত: ১২)

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আমাদের উপস্থিতি আমাদের ইসলামি চরিত্রের প্রতিফলন হওয়া উচিত, যেখানে আমরা নম্রতা, সত্যবাদিতা এবং অন্যের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করব।

আরও পড়ুনমুসলিম সমাজকে বিজ্ঞানমুখী করার উপায়০২ আগস্ট ২০২৫প্রযুক্তির ইতিবাচক ব্যবহার

প্রযুক্তি যখন ইসলামি মূল্যবোধের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে ব্যবহৃত হয়, তখন তা মানবতার কল্যাণে একটি শক্তিশালী হাতিয়ার হয়ে ওঠে। উদাহরণস্বরূপ, জাকাত ও সদকার জন্য অনলাইন প্ল্যাটফর্ম দাতব্য কাজকে আরও সহজ ও কার্যকর করেছে। মুসলিমরা এখন বিশ্বের যেকোনো প্রান্তে দরিদ্র ও অভাবী মানুষের কাছে তাদের সাহায্য পৌঁছে দিতে পারে। নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা দান করো, এমনকি তা একটি খেজুর হলেও কারণ তা ক্ষুধা দূর করে এবং পাপকে মুছে দেয়, যেমন পানি আগুন নিভিয়ে দেয়।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস: ১,৮৪২)

তোমরা দান করো, এমনকি তা একটি খেজুর হলেও কারণ তা ক্ষুধা দূর করে এবং পাপকে মুছে দেয়, যেমন পানি আগুন নিভিয়ে দেয়।সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস: ১,৮৪২

প্রযুক্তি শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রে বিপ্লব এনেছে। অনলাইন ইসলামি শিক্ষা প্ল্যাটফর্ম মুসলিমদের জন্য কোরআন, হাদিস এবং ফিকহ শেখার সুযোগ তৈরি করেছে। টেলিমেডিসিন গ্রামীণ এলাকায় স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দিয়েছে, যা শরিয়াহর জীবন রক্ষার উদ্দেশ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। এসব উদাহরণ দেখায় যে প্রযুক্তি, যখন সঠিকভাবে ব্যবহৃত হয়, তখন আল্লাহর নিয়ামতের একটি মাধ্যম হয়ে ওঠে।

ভারসাম্য রক্ষার পথ

ইসলাম আমাদের শিক্ষা দেয় যে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ভারসাম্য রক্ষা করতে হবে। প্রযুক্তি ব্যবহারে আমাদের এই ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে যেন এটি আমাদের ইবাদত, পারিবারিক সম্পর্ক বা সমাজের প্রতি দায়িত্ব থেকে বিচ্যুত না করে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অতিরিক্ত সময় ব্যয় করা আমাদের নামাজ, কোরআন তিলাওয়াত বা পরিবারের সঙ্গে সময় কাটানোর ক্ষতি করতে পারে। নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘তোমাদের প্রত্যেকে একজন দায়িত্বপ্রাপ্ত এবং প্রত্যেকে তার দায়িত্বের জন্য জিজ্ঞাসিত হবে।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৮৯৩)

এই হাদিস আমাদের নিজের সময়, পরিবার এবং সম্প্রদায়ের প্রতি দায়িত্ব পালনের কথা মনে করিয়ে দেয়।

প্রযুক্তি ব্যবহারে আমাদের কিছু ব্যবহারিক পদক্ষেপ নিতে পারি। প্রথমত, আমরা প্রতিদিনের জন্য একটি সময়সূচি তৈরি করতে পারি, যেখানে ইবাদত, কাজ এবং প্রযুক্তি ব্যবহারের জন্য নির্দিষ্ট সময় নির্ধারিত থাকবে। দ্বিতীয়ত, আমরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কী শেয়ার করছি বা দেখছি, তা নিয়ে সচেতন থাকব। তৃতীয়ত, আমরা প্রযুক্তিকে কল্যাণকর কাজে ব্যবহার করব, যেমন ইসলামি জ্ঞান অর্জন, দান-সদকা বা সম্প্রদায়ের সেবা।

সারকথা

ইসলামি দৃষ্টিকোণ থেকে প্রযুক্তি একটি নেয়ামত, যদি আমরা এটিকে সঠিক নিয়তে এবং শরিয়াহর উদ্দেশ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ব্যবহার করি। আমাদের ঐতিহ্য আমাদের শিকড়ের সঙ্গে সংযুক্ত রাখে, আর প্রযুক্তি আমাদের সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ দেয়। এই দুইয়ের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করতে হলে আমাদের কোরআন, সুন্নাহ এবং উলামার নির্দেশনার প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকতে হবে।

আল্লাহ তাআলা আমাদের বলেন, ‘আমি তোমাদের জন্য পৃথিবীতে যা কিছু সৃষ্টি করেছি, তা তোমাদের সেবায় নিয়োজিত করেছি।’ (সুরা বাকারা, আয়াত: ২৯)

প্রযুক্তি এই নিয়ামতের একটি অংশ। আমাদের দায়িত্ব হলো এটিকে এমনভাবে ব্যবহার করা যেন এটি আমাদের ইমান, সম্প্রদায় এবং মানবতার কল্যাণে কাজ করে।

আরও পড়ুনইসলামি গবেষণায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা০৩ এপ্রিল ২০২৫

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ইসল ম আম দ র প ল য টফর ম ব যবহ র কর র জন য একট আম দ র শ ক ভ রস ম য র ব যবহ র ক র কল য ণ র ইসল ম ম নবত র পর ব র জ বন র আল ল হ বল ছ ন র আল ক গ রহণ ক রআন

এছাড়াও পড়ুন:

জেন-জি সাজপোশাকের কোন স্টাইল ফলো করছে

নিজেকে নিজের মতো করেই তৈরি করতে চান এখন কিশোর-তরুণেরা। আর কাজটা করতে গিয়ে নিখুঁত হওয়ার কোনো চেষ্টাই তাঁরা করছেন না। পরিবর্তে সাজে, পোশাকে, জীবনযাপনে বেছে নিচ্ছেন অকৃত্রিমতা। বিদেশি ফ্যাশনের মধ্যেই ধারণ করছেন দেশীয়পনা। আর সবার ওপরে রাখছেন নিজস্বতা। যা ভালো লাগে, তা–ই জীবনের সঙ্গে জুড়ে নিচ্ছেন মুক্তমনা এই কিশোর-তরুণেরা।

স্টাইলে প্রাধান্য পাচ্ছে আরাম

সম্পর্কিত নিবন্ধ