জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে কক্সবাজারের টেকনাফ উপকূলীয় অঞ্চলের কৃষিজমিতে দিন দিন বাড়ছে লবণাক্ততার মাত্রা। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি ও অস্বাভাবিক জোয়ারের চাপে খাল পথে লবণাক্ত পানি প্রবেশ করায় নষ্ট হয়ে যাচ্ছে ধান, পান, শাক-সবজিসহ নানা ফসল। এতে ক্ষতির মুখে পড়েছেন হাজারো কৃষক। 

তবে কৃষি বিভাগের পরামর্শে অনেকে লবণ সহিষ্ণু জাতের ফসল চাষ করে ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছেন। 

সরেজমিনে ঘুরে টেকনাফের উপকূলীয় বাহারছড়া ইউনিয়নের কৃষকদের টুপটাপ বৃষ্টি আর হাঁটু পর্যন্ত কাদায় ডুবে কৃষি জমিতে কাজ করতে দেখা গেল। তাদের কেউ ধানের বীজতলা বানাচ্ছেন, কেউ কর্ষণ করা জমিতে মাটি সমান করছেন, আবার কেউ ঝুঁকে ধানের চারা রোপণ করছেন। চারপাশে বৃষ্টির শব্দ আর কৃষকের হাঁকডাকে তৈরি হয়েছে এক অনন্য কর্মযজ্ঞ। তবে সবার চোখেমুখে লুকানো দুশ্চিন্তা আর ভয়। এটি জোয়ারের সঙ্গে প্রবেশ করা লবণাক্ত পানির ভয়।

উত্তর শিলখালী এলাকার কৃষক মীর কাসেম দীর্ঘদিন ধরে ধান চাষ করে আসছেন। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে লবণাক্ত পানির কারণে তার জমির ফসলহানি কয়েকগুণ বেড়ে গেছে। তিনি বলেন, “দীর্ঘদিন ধরে মৌসুমী ধান চাষ করে সংসারের সব খরচ মিটিয়ে আসছি। কিন্তু এখন জোয়ারের সময় খাল দিয়ে লবণাক্ত পানি ঢুকে জমি ভরে যায়। আগে লবণাক্ততার মাত্রা তুলনামূলক কম ছিল, এখন তা অনেক বেশি। এতে চাষাবাদে বড় ধরনের ক্ষতি হচ্ছে।”

অনেকের মতো একই এলাকার মোহাম্মদ আলম ও মোহাম্মদ হাসনও কৃষি নিয়ে উদ্বিগ্ন। তারা দেখাচ্ছিলেন- তাদের জমি একেবারেই মেরিন ড্রাইভ সংলগ্ন। সামান্য জোয়ারেরই তাদের জমিতে লবণ পানি প্রবেশ করে ভরে যায়। 

মোহাম্মদ হাসন বলেন, “আমাদের জমিগুলো সমুদ্রের একেবারে পাশে হওয়ায় জোয়ারের সঙ্গে লবণাক্ত পানি ঢুকে ফসল ডুবিয়ে দেয়। এতে ধান গাছ মরে যায়। পরে কৃষি কর্মকর্তার পরামর্শে প্রয়োজনীয় ওষুধ ব্যবহার করি, কখনো কাজ হয়, আবার কখনো হয় না। শেষ পর্যন্ত লবণ সহিষ্ণু জাতের ধান, যেমন ভারতীয় পাইজাম ও ব্রি-৪৯ চাষ শুরু করেছি। এখন ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছি।”

প্রবীণ কৃষক জাগের হোসেন বলেন, “হাজার হাজার টাকা খরচ করে ধান চাষ করি, কিন্তু জোয়ারের সঙ্গে লবণের পানি ঢুকে সব ফসল নষ্ট হয়ে যায়। তখন আবার কৃষি কর্মকর্তার পরামর্শে নতুন করে জমি চাষ করতে হয়। ক্ষতি পোষাতে বছরে দুই-তিনবার ধান কিনতে হয়। এতে সংসারের চাহিদা মেটানো কঠিন হয়ে পড়েছে।”

টেকনাফ সদর ইউনিয়নের হাবিরছড়া এলাকার আলী আহামদ বলেন, “আমি আগে জানতাম না লবণাক্ত জমিতে কী ফসল চাষ করতে হয়। কৃষি কর্মকর্তার কাছ থেকে জেনে আশায় বুক বেঁধে মাঠে নেমেছি। নিশ্চয়ই এবার হতাশ হব না, এই আশায় ঝড় বৃষ্টিতে মাঠে কাজ করে যাচ্ছি।”
 
স্থানীয় শিক্ষক বেলাল উদ্দিন বলেন, “উপকূলীয় অঞ্চলে জোয়ারের লবণাক্ত পানি প্রবেশ করে ফসল নষ্ট হচ্ছে। অনেক কৃষক জানেন না লবণাক্ততার মধ্যে কোন ফসল চাষ করতে হয়। আমরা মনে করি খালের মুখে স্লুইজ গেট বসালে লবণাক্ত পানি প্রবেশ অনেকটাই বন্ধ হবে। তখন হয়তো আরও বেশি জমিতে ভালো ফসল চাষ সম্ভব হবে।”

টেকনাফ উপজেলা কৃষি অফিসের তথ্য অনুযায়ী, লবণাক্ততার প্রভাবে গত তিন বছরে উপকূলীয় অঞ্চলে প্রায় ৪৩ হেক্টর জমির ধান ও শাকসবজি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এতে ফসল উৎপাদন কমে গেছে, যার ফলে স্থানীয় কৃষকদের আয় হ্রাস পেয়েছে এবং বাজারে কৃষিপণ্যের সরবরাহও কমেছে। ফলশ্রুতিতে কৃষকের ঋণের বোঝা বেড়েছে এবং কর্মসংস্থানের সুযোগও সীমিত হয়ে পড়েছে।

টেকনাফ উপজেলার শামলাপুর ব্লকের উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা মোস্তাক উদ্দিন রাইজিংবিডি’কে বলেন, “জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ও জোয়ারের চাপ বেড়েছে, যার ফলে উপকূলের মাটিতে লবণাক্ততা ক্রমেই বাড়ছে। অমাবস্যা ও পূর্ণিমার সময় খালপথে লবণাক্ত পানি প্রবেশ করে ফসলি জমি ডুবিয়ে দিচ্ছে, এতে আমন ও আউশ ধানের বীজতলাও নষ্ট হয়ে গেছে। এই পরিস্থিতিতে আমরা কৃষকদের লবণ সহিষ্ণু ফসল চাষের পরামর্শ দিচ্ছি। জমিতে জৈব সার, ডলোচোন ও পটাশ সারের পরিমাণ বাড়িয়ে এবং ইউরিয়া সার কম ব্যবহার করলে ক্ষতি অনেকটা কমানো সম্ভব। আমরা নিয়মিত প্রশিক্ষণ, উন্নত বীজ ও প্রযুক্তিগত সহায়তা দিয়ে যাচ্ছি। পাশাপাশি খালে স্লুইজ গেট স্থাপন করা গেলে লবণাক্ততার সমস্যা আরও কার্যকরভাবে নিয়ন্ত্রণে আসবে।”

টেকনাফ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা হুমায়ুন কবির রাইজিংবিডিকে বলেন, “জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে টেকনাফের কৃষি খাত বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়েছে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি ও লবণাক্ত পানির অনুপ্রবেশে বহু আবাদি জমি অকৃষিযোগ্য হয়ে পড়ছে। গত কয়েক বছরে ঘূর্ণিঝড় ইয়াস, চিত্রাং, হামুন ও মোকা ফসল উৎপাদনে মারাত্মক প্রভাব ফেলেছে। শুধু ২০২২-২৩ অর্থবছরেই লবণাক্ত পানির কারণে ২৩ হেক্টর জমির ফসল সম্পূর্ণ নষ্ট হয়েছে এবং ২০২৪ সালে আরও ২০ হেক্টর জমির ফসল আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। খরা, অনিয়মিত বৃষ্টি ও সেচ সংকট উৎপাদন ব্যয় বাড়িয়ে দিয়েছে এবং সবজি চাষ কমিয়ে দিয়েছে। আমরা কৃষকদের লবণাক্ত সহনশীল ধানের জাত- বিআর-২৩, ব্রিধান-৪০, ৪১, ৫৩, ৫৪, ৭৩ ও ৭৮ এবং সবজি চাষে উৎসাহিত করছি। একই সঙ্গে ক্ষয়ক্ষতি কমাতে বিভিন্ন অভিযোজনমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করছি।”

কক্সবাজার কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক ড.

বিমল কুমার প্রামানিক রাইজিংবিডি’কে বলেন, “গত বছর কক্সবাজারে বিভিন্ন দুর্যোগে প্রায় এক হাজার হেক্টর কৃষিজমি নষ্ট হয়েছিল। এ বছর তুলনামূলকভাবে ক্ষতি কম হলেও কিছু এলাকায় জোয়ারের লবণাক্ত পানি আবাদি জমিতে প্রবেশ করে ফসল নষ্ট করেছে। বিশেষ করে সেন্টমার্টিনসহ উপকূলীয় অঞ্চলে আবহাওয়াজনিত কারণে লবণাক্ত পানির প্রভাবে ধান ও শাকসবজির পাতা হলুদ হয়ে গেছে। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের আমরা সার প্রয়োগ, পরিষ্কার মিঠা পানির সেচ, এবং মৌসুমভেদে লবণ সহনশীল জাতের ধান চাষের পরামর্শ দিচ্ছি। আমন মৌসুমে ব্রিধান-৫৪, ৭৩ ও ৭৮ এবং অন্যান্য মৌসুমে ব্রিধান-৪৮, ৯৮, ১০৬ ও ৬৭ জাতের ধান চাষে কৃষকরা ভালো ফল পাচ্ছেন ও অনেকেই ক্ষতি কাটিয়ে লাভের মুখ দেখছেন।”

তিনি আরও বলেন, “যেসব খাল বা ছড়া দিয়ে লবণাক্ত পানি জমিতে প্রবেশ করে, সেখানে স্লুইজ গেট বা উঁচু করে বেড়িবাঁধ স্থাপন করা গেলে কৃষিজমিতে লবণের পানি প্রবেশ বন্ধ হবে। এতে কৃষকদের দুঃখ অনেকটা লাঘব হবে।”

জলবায়ু বিশেষজ্ঞদের মতে, উপকূলীয় অঞ্চলে লবণাক্ততা মোকাবেলায় সমন্বিত পদক্ষেপ প্রয়োজন- যেমন, পানি নিয়ন্ত্রণ অবকাঠামো নির্মাণ, লবণ সহিষ্ণু ফসল উদ্ভাবন, কৃষকদের প্রশিক্ষণ এবং বাজারে সহজে পণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা।

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে টেকনাফের উপকূলীয় কৃষিজমিতে লবণাক্ততার মাত্রা ক্রমেই বাড়ছে, ফলে ফসল উৎপাদনে নেমেছে বড় ধস। কৃষি বিভাগের পরামর্শে কিছু কৃষক লবণ সহিষ্ণু জাতের ফসল চাষ করে ঘুরে দাঁড়ালেও, অধিকাংশই এখনও জানেন না কোন ফসল বা কীভাবে চাষ করলে ক্ষতি কমানো সম্ভব। 

স্থানীয়দের মতে, খালের মুখে স্লুইজ গেট স্থাপন করা গেলে লবণাক্ত পানির অনুপ্রবেশ রোধ হবে, আর তাতেই রক্ষা পাবে উপকূলের উর্বর জমি ও কৃষকের জীবিকা।

ঢাকা/এস

উৎস: Risingbd

কীওয়ার্ড: চ কর চ কর লবণ ক ত প ন র স ল ইজ গ ট কর মকর ত উপক ল য় ক ষকদ র র পর ম র লবণ জলব য় র ফসল

এছাড়াও পড়ুন:

রিজার্ভ চুরির অর্থ উদ্ধারে ঢাকার আদালতের আদেশ

বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির ঘটনায় ফিলিপাইনের রিজাল কমার্শিয়াল ব্যাংকিং করপোরেশনে (আরসিবিসি) থাকা ৮১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বাজেয়াপ্ত করে ফেরত আনার আদেশ দিয়েছেন ঢাকার একটি আদালত। পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গত বৃহস্পতিবার ঢাকার মহানগর জ্যেষ্ঠ বিশেষ জজ আদালত এ আদেশ দেন।

গতকাল রোববার রাজধানীর মালিবাগে সিআইডির সদর দপ্তরে এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানানো হয়।

সংবাদ সম্মেলনে সিআইডির প্রধান অতিরিক্ত আইজিপি মো. ছিবগাত উল্লাহ বলেন, প্রায় ৯ বছর আগে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে সাইবার জালিয়াতির মাধ্যমে চুরি হওয়া ৮১ মিলিয়ন ডলার (৮ কোটি ১০ হাজার ডলার) বাজেয়াপ্তের নির্দেশ দিয়েছেন ঢাকা মহানগর জ্যেষ্ঠ বিশেষ জজ মো. সাব্বির ফয়েজ। ফিলিপাইনের আরসিবিসি ব্যাংক পাচারে জড়িত ছিল বলে সিআইডির আবেদনের ভিত্তিতে আদালত এ নির্দেশ দেন।

ছিবগাত উল্লাহ বলেন, রিজার্ভ চুরির ঘটনার মধ্যে শ্রীলঙ্কা থেকে দুই কোটি ডলার ফেরত আসে। আর আরসিবিসির মাধ্যমে ২০১৬ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি মাত্র ৬৮ হাজার ডলার ফেরত পায় বাংলাদেশ। প্রায় ১৪ মিলিয়ন ডলার অন্য উদ্যোগে ফেরত আসে। এখন আরসিবিসির কাছে পুরো ৮১ মিলিয়ন ডলারই ফেরত চাওয়া হচ্ছে, যেটা আদালত বাজেয়াপ্ত করার আদেশ দিয়েছেন।

আরসিবিসির বিরুদ্ধে নিউ ইয়র্কের আদালতে করা মামলার বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে সিআইডি প্রধান বলেন, এর সঙ্গে সিআইডির কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। সিআইডির কাছে যে মামলা আছে, সে ব্যাপারে কাজ চলছে। সমাপ্তির পথে, খুব দ্রুতই মামলার অভিযোগপত্র দেওয়া হবে।

আদালতের আদেশে বলা হয়, তদন্তে সংগৃহীত তথ্যপ্রমাণ এবং ফিলিপাইন সরকারের পাঠানো মিউচুয়াল লিগ্যাল অ্যাসিস্ট্যান্স রিকোয়েস্ট (এমএলএআর) পর্যালোচনা করে প্রমাণিত হয়েছে যে বাংলাদেশ ব্যাংকের নিউইয়র্কের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকে রক্ষিত বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে হ্যাকাররা অবৈধভাবে ৮১ মিলিয়ন ডলার সরিয়ে ফিলিপাইনের আরসিবিসি ব্যাংকের বিভিন্ন হিসাবে স্থানান্তর করেছিল।

সংবাদ সম্মেলনে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিশেষ প্রসিকিউটর এহসানুল হক সমাজী বলেন, আদালতের আদেশ কার্যকর করতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে আদেশের কপি (অনুলিপি) পাঠানো হয়েছে। প্রশাসনিক প্রক্রিয়া শেষে টাকা দেশে ফেরত আসবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।

২০১৬ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি দিবাগত রাতে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব নিউইয়র্কে (ফেড) থাকা বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে ১০ কোটি ১০ লাখ মার্কিন ডলার চুরি হয়। রিজার্ভ থেকে অর্থ চুরির তথ্য ১ দিন পর জানতে পারলেও বাংলাদেশ ব্যাংক তা ২৪ দিন গোপন রাখে। ৩৩তম দিনে বাংলাদেশ ব্যাংক বিষয়টি তৎকালীন অর্থমন্ত্রীকে আনুষ্ঠানিকভাবে জানায়।

সিআইডির ভাষ্য, জাতিসংঘের কনভেনশন অ্যাগেইনস্ট ট্রান্সন্যাশনাল অর্গানাইজড ক্রাইম (ইউএনটিওসি), ফিলিপাইনের আইন এবং ফিন্যান্সিয়াল অ্যাকশন টাস্কফোর্সের (এফএটিএফ) নির্দেশনার আলোকে এবং সর্বশেষ আদালতের নির্দেশের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ সরকার এখন ফিলিপাইনের সরকারের কাছ থেকে এই অর্থ ফেরত আনার ব্যবস্থা করবে।

সুইফট সিস্টেম ব্যবহার করে ৩৫টি ভুয়া বার্তা (মেসেজ) পাঠিয়ে ফেডে রাখা বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব থেকে ১০ কোটি ১০ লাখ ডলার চুরি হয়। এর মধ্যে একটি মেসেজের মাধ্যমে শ্রীলঙ্কায় একটি ‘ভুয়া’ এনজিওর নামে ২০ মিলিয়ন ডলার সরিয়ে নেওয়া হলেও বানান ভুলের কারণে সন্দেহ হওয়ায় শেষ মুহূর্তে তা আটকে যায়। বাকি চারটি মেসেজের মাধ্যমে ৮ কোটি ১০ লাখ ডলার সরিয়ে নেওয়া হয় ফিলিপাইনের মাকাতি শহরে রিজল কমার্শিয়াল ব্যাংকের জুপিটার স্ট্রিট শাখায় ‘ভুয়া তথ্য’ দিয়ে খোলা চারটি অ্যাকাউন্টে।

অল্প সময়ের মধ্যে ওই অর্থ ব্যাংক থেকে তুলে নেওয়া হয়, ফিলরেম মানি রেমিট্যান্স কোম্পানির মাধ্যমে স্থানীয় মুদ্রা পেসোর আকারে সেই অর্থ চলে যায় তিনটি ক্যাসিনোর কাছে। এর মধ্যে একটি ক্যাসিনোর মালিকের কাছ থেকে দেড় কোটি ডলার উদ্ধার করে বাংলাদেশ সরকারকে বুঝিয়ে দেওয়া হলেও বাকি অর্থ উদ্ধারে তেমন কোনো অগ্রগতি হচ্ছিল না। জুয়ার টেবিলে হাতবদল হয়ে ওই টাকা শেষ পর্যন্ত কোথায় গেছে, তারও কোনো হদিস মিলছিল না।

২০২০ সালের ২৭ মে ২০ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে করা ওই মামলায় অর্থ রূপান্তর, চুরি, আত্মসাতের অভিযোগে রিজার্ভের অর্থ চুরির ঘটনায় আরসিবিসির বিরুদ্ধে নিউ ইয়র্কের আদালতে মামলা করে বাংলাদেশ ব্যাংক। গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে ওই মামলা চালিয়ে নেওয়ার অনুমতি দেন নিউইয়র্কের আদালত। তবে ব্যক্তিগত এখতিয়ার না থাকায় চারজন বিবাদীকে মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।

এদিকে ফিলিপাইনের কেন্দ্রীয় ব্যাংক মুদ্রা পাচার ঠেকাতে ব্যর্থ হওয়ায় ১ কোটি ৯১ লাখ ডলার জরিমানা করে আরসিবিসিকে। ওই সময় করা এক মামলায় ফিলিপাইনের আদালত ২০১৯ সালে আরসিবিসির শাখা ব্যবস্থাপক মায়া সান্তোস দেগিতোকে মুদ্রা পাচারের আট দফা অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত করেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের করা মামলায়ও তাঁকে আসামি করা হয়।

রিজার্ভ চুরির ঘটনায় বাংলাদেশেও একটি মামলা করা হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের অ্যাকাউন্টস অ্যান্ড বাজেটিং বিভাগের যুগ্ম পরিচালক জুবায়ের বিন হুদা ২০১৬ সালের ১৫ মার্চ মতিঝিল থানায় মামলাটি করেন। মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন এবং তথ্য ও প্রযুক্তি আইনে দায়ের করা ওই মামলায় সরাসরি কাউকে আসামি করা হয়নি।

এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির ঘটনা পর্যালোচনায় অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত কমিটির সময় গত ৮ জুলাই আরও তিন মাস বাড়ানো হয়েছে। সে অনুযায়ী চলতি সেপ্টেম্বরের ৩০ তারিখের মধ্যে পর্যালোচনা কমিটির সুপারিশ দেওয়ার কথা।

এর আগে গত ১১ মার্চ আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুলকে প্রধান করে ছয় সদস্যের পর্যালোচনা কমিটি করে সরকার। এ কমিটিকে রিজার্ভ চুরির ঘটনার তদন্তকাজের অগ্রগতি, এ-সংক্রান্ত সরকারি অন্যান্য পদক্ষেপের পর্যালোচনা, এ ঘটনার দায়দায়িত্ব নির্ধারণ এবং এর পুনরাবৃত্তি রোধে প্রয়োজনীয় সুপারিশ দেওয়ার কথা বলা হয়েছিল। এ জন্য ওই কমিটিকে তিন মাস সময় দেওয়া হয়। নির্ধারিত সময় শেষ হয়ে যাওয়ায় পরে আরও তিন মাস সময় বাড়ানো হয়।

পর্যালোচনা কমিটির সদস্যরা হলেন জ্বালানি উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান; ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর, বিমান বাংলাদেশে এয়ারলাইনসের পরিচালক আলী আশফাক ও রূপালী ব্যাংকের চেয়ারম্যান নজরুল হুদা।

সম্পর্কিত নিবন্ধ