লবণ সহিষ্ণু ফসল চাষে ঘুরে দাঁড়াচ্ছেন উপকূলের কৃষকরা
Published: 7th, August 2025 GMT
জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে কক্সবাজারের টেকনাফ উপকূলীয় অঞ্চলের কৃষিজমিতে দিন দিন বাড়ছে লবণাক্ততার মাত্রা। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি ও অস্বাভাবিক জোয়ারের চাপে খাল পথে লবণাক্ত পানি প্রবেশ করায় নষ্ট হয়ে যাচ্ছে ধান, পান, শাক-সবজিসহ নানা ফসল। এতে ক্ষতির মুখে পড়েছেন হাজারো কৃষক।
তবে কৃষি বিভাগের পরামর্শে অনেকে লবণ সহিষ্ণু জাতের ফসল চাষ করে ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছেন।
সরেজমিনে ঘুরে টেকনাফের উপকূলীয় বাহারছড়া ইউনিয়নের কৃষকদের টুপটাপ বৃষ্টি আর হাঁটু পর্যন্ত কাদায় ডুবে কৃষি জমিতে কাজ করতে দেখা গেল। তাদের কেউ ধানের বীজতলা বানাচ্ছেন, কেউ কর্ষণ করা জমিতে মাটি সমান করছেন, আবার কেউ ঝুঁকে ধানের চারা রোপণ করছেন। চারপাশে বৃষ্টির শব্দ আর কৃষকের হাঁকডাকে তৈরি হয়েছে এক অনন্য কর্মযজ্ঞ। তবে সবার চোখেমুখে লুকানো দুশ্চিন্তা আর ভয়। এটি জোয়ারের সঙ্গে প্রবেশ করা লবণাক্ত পানির ভয়।
উত্তর শিলখালী এলাকার কৃষক মীর কাসেম দীর্ঘদিন ধরে ধান চাষ করে আসছেন। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে লবণাক্ত পানির কারণে তার জমির ফসলহানি কয়েকগুণ বেড়ে গেছে। তিনি বলেন, “দীর্ঘদিন ধরে মৌসুমী ধান চাষ করে সংসারের সব খরচ মিটিয়ে আসছি। কিন্তু এখন জোয়ারের সময় খাল দিয়ে লবণাক্ত পানি ঢুকে জমি ভরে যায়। আগে লবণাক্ততার মাত্রা তুলনামূলক কম ছিল, এখন তা অনেক বেশি। এতে চাষাবাদে বড় ধরনের ক্ষতি হচ্ছে।”
অনেকের মতো একই এলাকার মোহাম্মদ আলম ও মোহাম্মদ হাসনও কৃষি নিয়ে উদ্বিগ্ন। তারা দেখাচ্ছিলেন- তাদের জমি একেবারেই মেরিন ড্রাইভ সংলগ্ন। সামান্য জোয়ারেরই তাদের জমিতে লবণ পানি প্রবেশ করে ভরে যায়।
মোহাম্মদ হাসন বলেন, “আমাদের জমিগুলো সমুদ্রের একেবারে পাশে হওয়ায় জোয়ারের সঙ্গে লবণাক্ত পানি ঢুকে ফসল ডুবিয়ে দেয়। এতে ধান গাছ মরে যায়। পরে কৃষি কর্মকর্তার পরামর্শে প্রয়োজনীয় ওষুধ ব্যবহার করি, কখনো কাজ হয়, আবার কখনো হয় না। শেষ পর্যন্ত লবণ সহিষ্ণু জাতের ধান, যেমন ভারতীয় পাইজাম ও ব্রি-৪৯ চাষ শুরু করেছি। এখন ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছি।”
প্রবীণ কৃষক জাগের হোসেন বলেন, “হাজার হাজার টাকা খরচ করে ধান চাষ করি, কিন্তু জোয়ারের সঙ্গে লবণের পানি ঢুকে সব ফসল নষ্ট হয়ে যায়। তখন আবার কৃষি কর্মকর্তার পরামর্শে নতুন করে জমি চাষ করতে হয়। ক্ষতি পোষাতে বছরে দুই-তিনবার ধান কিনতে হয়। এতে সংসারের চাহিদা মেটানো কঠিন হয়ে পড়েছে।”
টেকনাফ সদর ইউনিয়নের হাবিরছড়া এলাকার আলী আহামদ বলেন, “আমি আগে জানতাম না লবণাক্ত জমিতে কী ফসল চাষ করতে হয়। কৃষি কর্মকর্তার কাছ থেকে জেনে আশায় বুক বেঁধে মাঠে নেমেছি। নিশ্চয়ই এবার হতাশ হব না, এই আশায় ঝড় বৃষ্টিতে মাঠে কাজ করে যাচ্ছি।”
স্থানীয় শিক্ষক বেলাল উদ্দিন বলেন, “উপকূলীয় অঞ্চলে জোয়ারের লবণাক্ত পানি প্রবেশ করে ফসল নষ্ট হচ্ছে। অনেক কৃষক জানেন না লবণাক্ততার মধ্যে কোন ফসল চাষ করতে হয়। আমরা মনে করি খালের মুখে স্লুইজ গেট বসালে লবণাক্ত পানি প্রবেশ অনেকটাই বন্ধ হবে। তখন হয়তো আরও বেশি জমিতে ভালো ফসল চাষ সম্ভব হবে।”
টেকনাফ উপজেলা কৃষি অফিসের তথ্য অনুযায়ী, লবণাক্ততার প্রভাবে গত তিন বছরে উপকূলীয় অঞ্চলে প্রায় ৪৩ হেক্টর জমির ধান ও শাকসবজি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এতে ফসল উৎপাদন কমে গেছে, যার ফলে স্থানীয় কৃষকদের আয় হ্রাস পেয়েছে এবং বাজারে কৃষিপণ্যের সরবরাহও কমেছে। ফলশ্রুতিতে কৃষকের ঋণের বোঝা বেড়েছে এবং কর্মসংস্থানের সুযোগও সীমিত হয়ে পড়েছে।
টেকনাফ উপজেলার শামলাপুর ব্লকের উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা মোস্তাক উদ্দিন রাইজিংবিডি’কে বলেন, “জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ও জোয়ারের চাপ বেড়েছে, যার ফলে উপকূলের মাটিতে লবণাক্ততা ক্রমেই বাড়ছে। অমাবস্যা ও পূর্ণিমার সময় খালপথে লবণাক্ত পানি প্রবেশ করে ফসলি জমি ডুবিয়ে দিচ্ছে, এতে আমন ও আউশ ধানের বীজতলাও নষ্ট হয়ে গেছে। এই পরিস্থিতিতে আমরা কৃষকদের লবণ সহিষ্ণু ফসল চাষের পরামর্শ দিচ্ছি। জমিতে জৈব সার, ডলোচোন ও পটাশ সারের পরিমাণ বাড়িয়ে এবং ইউরিয়া সার কম ব্যবহার করলে ক্ষতি অনেকটা কমানো সম্ভব। আমরা নিয়মিত প্রশিক্ষণ, উন্নত বীজ ও প্রযুক্তিগত সহায়তা দিয়ে যাচ্ছি। পাশাপাশি খালে স্লুইজ গেট স্থাপন করা গেলে লবণাক্ততার সমস্যা আরও কার্যকরভাবে নিয়ন্ত্রণে আসবে।”
টেকনাফ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা হুমায়ুন কবির রাইজিংবিডিকে বলেন, “জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে টেকনাফের কৃষি খাত বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়েছে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি ও লবণাক্ত পানির অনুপ্রবেশে বহু আবাদি জমি অকৃষিযোগ্য হয়ে পড়ছে। গত কয়েক বছরে ঘূর্ণিঝড় ইয়াস, চিত্রাং, হামুন ও মোকা ফসল উৎপাদনে মারাত্মক প্রভাব ফেলেছে। শুধু ২০২২-২৩ অর্থবছরেই লবণাক্ত পানির কারণে ২৩ হেক্টর জমির ফসল সম্পূর্ণ নষ্ট হয়েছে এবং ২০২৪ সালে আরও ২০ হেক্টর জমির ফসল আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। খরা, অনিয়মিত বৃষ্টি ও সেচ সংকট উৎপাদন ব্যয় বাড়িয়ে দিয়েছে এবং সবজি চাষ কমিয়ে দিয়েছে। আমরা কৃষকদের লবণাক্ত সহনশীল ধানের জাত- বিআর-২৩, ব্রিধান-৪০, ৪১, ৫৩, ৫৪, ৭৩ ও ৭৮ এবং সবজি চাষে উৎসাহিত করছি। একই সঙ্গে ক্ষয়ক্ষতি কমাতে বিভিন্ন অভিযোজনমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করছি।”
কক্সবাজার কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক ড.
তিনি আরও বলেন, “যেসব খাল বা ছড়া দিয়ে লবণাক্ত পানি জমিতে প্রবেশ করে, সেখানে স্লুইজ গেট বা উঁচু করে বেড়িবাঁধ স্থাপন করা গেলে কৃষিজমিতে লবণের পানি প্রবেশ বন্ধ হবে। এতে কৃষকদের দুঃখ অনেকটা লাঘব হবে।”
জলবায়ু বিশেষজ্ঞদের মতে, উপকূলীয় অঞ্চলে লবণাক্ততা মোকাবেলায় সমন্বিত পদক্ষেপ প্রয়োজন- যেমন, পানি নিয়ন্ত্রণ অবকাঠামো নির্মাণ, লবণ সহিষ্ণু ফসল উদ্ভাবন, কৃষকদের প্রশিক্ষণ এবং বাজারে সহজে পণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে টেকনাফের উপকূলীয় কৃষিজমিতে লবণাক্ততার মাত্রা ক্রমেই বাড়ছে, ফলে ফসল উৎপাদনে নেমেছে বড় ধস। কৃষি বিভাগের পরামর্শে কিছু কৃষক লবণ সহিষ্ণু জাতের ফসল চাষ করে ঘুরে দাঁড়ালেও, অধিকাংশই এখনও জানেন না কোন ফসল বা কীভাবে চাষ করলে ক্ষতি কমানো সম্ভব।
স্থানীয়দের মতে, খালের মুখে স্লুইজ গেট স্থাপন করা গেলে লবণাক্ত পানির অনুপ্রবেশ রোধ হবে, আর তাতেই রক্ষা পাবে উপকূলের উর্বর জমি ও কৃষকের জীবিকা।
ঢাকা/এস
উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর লবণ ক ত প ন র স ল ইজ গ ট কর মকর ত উপক ল য় ক ষকদ র র পর ম র লবণ জলব য় র ফসল
এছাড়াও পড়ুন:
সিলেটে ফুটসাল টুর্নামেন্টে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা, আটক ১
সিলেট ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের শিক্ষার্থীদের আয়োজিত ‘জুলাই স্মৃতি ফুটসাল টুর্নামেন্ট’–এ হামলার ঘটনা ঘটেছে। এতে কলেজের ১১ শিক্ষার্থীসহ অন্তত ১৫-১৬ জন আহত হয়েছেন। গতকাল বুধবার সন্ধ্যায় সিলেট নগরের বালুচর নয়াবাজার এলাকার কিংস ফুটসাল মাঠে এ ঘটনা ঘটে। এ সময় ঘটনাস্থল থেকে একজনকে আটক করেছে পুলিশ।
আহত শিক্ষার্থীরা অভিযোগ করেন, নিষিদ্ধঘোষিত ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা জয় বাংলা স্লোগান দিয়ে টুর্নামেন্ট চলাকালীন মাঠে হামলা চালান। তাঁদের দাবি, স্থানীয় ছাত্রলীগকর্মী মামুনের নেতৃত্বেই পরিকল্পিত এ হামলা হয়েছে।
শিক্ষার্থীরা বলেন, হামলাকারীদের মধ্যে একজনকে আটক করে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। আটক ব্যক্তি শিক্ষার্থীদের কাছে স্বীকার করেছেন, ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীদের নির্দেশেই তিনি হামলায় অংশ নিয়েছিলেন। এ ঘটনার প্রতিবাদে শিক্ষার্থীরা রাতেই ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করেন। হামলাকারীদের গ্রেপ্তার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে তাঁরা স্লোগান দেন।
স্থানীয় ও পুলিশ সূত্রে জানা যায়, সিলেট ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের শিক্ষার্থীরা জুলাই গণ-অভ্যুত্থান স্মরণে টুর্নামেন্টটি আয়োজন করে, যা শুরু হয় গত মঙ্গলবার থেকে। বালুচরের একটি ব্যক্তিমালিকানাধীন মাঠে খেলা চলাকালে গতকাল সন্ধ্যায় শিক্ষার্থীদের সঙ্গে স্থানীয় লোকজনের বাগ্বিতণ্ডা হয়। একপর্যায়ে তা মারামারিতে রূপ নেয়। আহতদের মধ্যে ১১ শিক্ষার্থী ও একজন স্থানীয় বাসিন্দা সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন।
সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার (গণমাধ্যম) মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম বলেন, হামলার ঘটনায় শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে অভিযোগ দেওয়া হবে বলে জানানো হয়েছে। এ ঘটনায় একজনকে আটক করা হয়েছে। খেলার মাঠ নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে মারামারির ঘটনা ঘটেছে। ছাত্রলীগ জড়িত থাকার অভিযোগ খতিয়ে দেখা হচ্ছে।