বিশ্ববিদ্যালয় শেষ মানেই কি শিক্ষার্থীর শেখার শেষ
Published: 27th, September 2025 GMT
প্রতিবছর পৃথিবীর নানা প্রান্তে হাজারো তরুণ-তরুণী বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা শেষ করে জীবনের নতুন অধ্যায়ে পা রাখেন। বাংলাদেশেও এর ব্যতিক্রম নয়। বর্তমানে দেশে প্রায় ৪৭ লাখ ৫৬ হাজার শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষায় যুক্ত আছেন।
বৈশ্বিক পটভূমিতে বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা ২৬ কোটি ৪০ লাখের বেশি, যার মধ্যে বাংলাদেশে শিক্ষার্থীর অংশ প্রায় ১ দশমিক ৮০ শতাংশ।
এ সংখ্যা শুধু পরিসংখ্যান নয়; বরং আমাদের তরুণ প্রজন্মের উচ্চশিক্ষার প্রতি বাড়তে থাকা আগ্রহ ও সম্ভাবনার প্রতিফলন। যদিও সম্প্রতি একটি প্রতিবেদন বলছে যে দেশের প্রায় ৮ লাখ ৮৫ হাজার স্নাতকোত্তর করা তরুণ বেকারত্বের সমস্যায় ভুগছেন।
তবে এটা ঠিক যে বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি পেরিয়ে বাস্তব জীবনের পথে হাঁটা সহজ নয়। কর্মজীবনের প্রতিযোগিতামূলক বাস্তবতায় টিকে থাকতে চাই স্পষ্ট পরিকল্পনা, সঠিক দক্ষতা আর মানসিক দৃঢ়তা।
বিশ্বজুড়ে শিক্ষার্থীরা যে বিষয়গুলোতে মনোযোগী হচ্ছে, বাংলাদেশি তরুণদেরও সেদিকে নজর দেওয়া জরুরি। পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ দিক তুলে ধরা হলো—
আরও পড়ুনবিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররাজনীতির কেমন সংস্কার প্রয়োজন১৪ আগস্ট ২০২৫ক্যারিয়ার পরিকল্পনা ও পেশাজীবনে প্রবেশগ্র্যাজুয়েশন শেষে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো সঠিক ক্যারিয়ার বেছে নেওয়া। অস্ট্রেলিয়া ও কানাডার মতো দেশে শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই ক্যারিয়ার কাউন্সেলিং ও ইন্টার্নশিপের সুযোগ পায়। এতে বাস্তব জীবনে প্রস্তুতি নেওয়া সহজ হয়।
বাংলাদেশেও এ ধারা শুরু হয়েছে, তবে এটি হতে হবে আরও কাঠামোবদ্ধ ও কার্যকর।
শিক্ষার্থীরা যদি শুরুতেই নিজের আগ্রহ, দক্ষতা ও বাজারের চাহিদা মিলিয়ে স্পষ্ট লক্ষ্য নির্ধারণ করে, তবে বিভ্রান্তি কমবে।
এর জন্য দরকার—শ্রমবাজারের বাস্তবতা বোঝা, ইন্টার্নশিপ ও চাকরির প্রস্তুতি নেওয়া, হালনাগাদ জীবনবৃত্তান্ত তৈরি করা, লিংকডইনের মতো প্রফেশনাল সাইটে প্রোফাইল সাজানো এবং অভিজ্ঞ শিক্ষকের পরামর্শ নেওয়া।
আরও পড়ুনবিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগে লিখিত পরীক্ষার যৌক্তিকতা কতটুকু০১ আগস্ট ২০২৫শেখার ধারাবাহিকতা বজায় রাখাডিগ্রি মানেই শেখার ইতি নয়; বরং নতুন যাত্রার সূচনা। যুক্তরাষ্ট্র ও দক্ষিণ কোরিয়ার শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরও অনলাইন কোর্স ও সার্টিফিকেটের মাধ্যমে নিজেদের দক্ষতা বাড়ায়। বাংলাদেশের তরুণদেরও এ অভ্যাস গড়ে তোলা জরুরি।
তারা প্রোগ্রামিং, গ্রাফিক ডিজাইন, ডেটা অ্যানালাইসিসের মতো আধুনিক দক্ষতা অর্জন করতে পারে, অনলাইন কর্মশালা ও কোর্সে অংশ নিতে পারে, ইংরেজি দক্ষতা বাড়াতে পারে—সঙ্গে চাই নতুন ভাষা শেখার উদ্যোগ।
চীনা, জাপানি বা জার্মান ভাষা ভবিষ্যতে বাড়তি সুবিধা এনে দিতে পারে। পাশাপাশি নিয়মিত পড়াশোনার অভ্যাসও খুব জরুরি।
আরও পড়ুনবিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা শুরু হলে আর শেষ হতে চায় না কেন১২ মার্চ ২০২৫নেটওয়ার্ক ও সামাজিক দায়িত্ববিশ্ববিদ্যালয় শেষে সম্পর্ক ও নেটওয়ার্ক তৈরি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জার্মানিতে অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যালামনাই নেটওয়ার্ক শিক্ষার্থীদের ক্যারিয়ার গঠনে বড় ভূমিকা রাখে। বাংলাদেশেও কিছু প্রতিষ্ঠান সক্রিয় অ্যালামনাই নেটওয়ার্ক চালু করেছে, তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তা কার্যকর নয়।
তরুণদের উচিত, সহপাঠী ও শিক্ষকদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা, পেশাজীবীদের সঙ্গে পরিচিত হওয়া, ক্লাব ও স্বেচ্ছাসেবামূলক কাজে যুক্ত থাকা। এতে শুধু ব্যক্তিগত নয়, সামাজিক উন্নয়নেও অবদান রাখা সম্ভব। একই সঙ্গে ইতিবাচক ভাবমূর্তি ও আত্মবিশ্বাস গড়ে ওঠে।
বিশ্ববিদ্যালয়জীবন শেষ মানেই শেখা বা বেড়ে ওঠা শেষ নয়। বরং এখান থেকেই শুরু হয় জীবনের প্রকৃত যাত্রা। সঠিক পরিকল্পনা, দক্ষতা উন্নয়ন, সামাজিক নেটওয়ার্ক, আর্থিক সচেতনতা এবং মানসিক বিকাশ—এই পাঁচটি দিককে গুরুত্ব দিলে তরুণ প্রজন্ম কেবল নিজেদের ভবিষ্যৎই নয়, সমাজ ও দেশকেও এগিয়ে নিতে পারবে। বিশ্বের নানা দেশের তরুণদের উদাহরণ আমাদের মনে করিয়ে দেয়—বিশ্ববিদ্যালয়ের পরের জীবন আসলে সম্ভাবনায় ভরা এক নতুন অধ্যায়, যা কাজে লাগানোই এখন বড় চ্যালেঞ্জ।আর্থিক সচেতনতা ও আত্মনির্ভরশীলতাকর্মজীবনের শুরুতেই অর্থ ব্যবস্থাপনা শেখা খুব জরুরি। জাপান ও সিঙ্গাপুরের শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়জীবনেই সঞ্চয় ও বিনিয়োগের অভ্যাস গড়ে তোলেন, যা তাঁদের পরবর্তী জীবনে আর্থিক স্বাধীনতা দেয়।
বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদেরও এখন থেকেই আর্থিক শিক্ষায় মনোযোগী হতে হবে। আয়ের সঙ্গে সঞ্চয়ের অভ্যাস করা, বিনিয়োগের কৌশল শেখা, ঋণ ও ক্রেডিট ব্যবহারে সতর্ক থাকা এবং দীর্ঘমেয়াদি আর্থিক লক্ষ্য ঠিক করা—এসব অভ্যাস ভবিষ্যতের মজবুত ভিত্তি তৈরি করবে।
ব্যক্তিগত জীবন ও মানসিক উন্নয়নশুধু ক্যারিয়ার নয়, ব্যক্তিগত জীবনেও ভারসাম্য রাখা দরকার। ফিনল্যান্ডের তরুণেরা পড়াশোনা শেষে ভ্রমণ, শখ, স্বেচ্ছাসেবামূলক কাজের মাধ্যমে নিজেদের মানসিক উন্নয়ন ঘটান।
বাংলাদেশি তরুণদেরও এই জীবনদর্শন অনুসরণ করা প্রয়োজন। সুষম খাবার খাওয়া, নিয়মিত ব্যায়াম করা, শখ ও সৃজনশীল কাজে সময় দেওয়া, সময় ব্যবস্থাপনা রপ্ত করা এবং ইতিবাচক চিন্তা, নৈতিকতা ও মূল্যবোধ ধরে রাখা—এসব অভ্যাস মানসিক প্রশান্তি ও ব্যক্তিগত উন্নয়নে সহায়তা করে।
বিশ্ববিদ্যালয়জীবন শেষ মানেই শেখা বা বেড়ে ওঠা শেষ নয়। বরং এখান থেকেই শুরু হয় জীবনের প্রকৃত যাত্রা। সঠিক পরিকল্পনা, দক্ষতা উন্নয়ন, সামাজিক নেটওয়ার্ক, আর্থিক সচেতনতা এবং মানসিক বিকাশ—এই পাঁচটি দিককে গুরুত্ব দিলে তরুণ প্রজন্ম কেবল নিজেদের ভবিষ্যৎই নয়, সমাজ ও দেশকেও এগিয়ে নিতে পারবে।
বিশ্বের নানা দেশের তরুণদের উদাহরণ আমাদের মনে করিয়ে দেয়—বিশ্ববিদ্যালয়ের পরের জীবন আসলে সম্ভাবনায় ভরা এক নতুন অধ্যায়, যা কাজে লাগানোই এখন বড় চ্যালেঞ্জ।
এম এম মাহবুব হাসান, ব্যাংকার, উন্নয়ন গবেষক ও লেখক।
ই-মেইল: [email protected]
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ন টওয় র ক আর থ ক স জ বন র প য় র পর র তর ণ
এছাড়াও পড়ুন:
নানা আয়োজনে মোংলা বন্দরের প্লাটিনাম জয়ন্তী উদ্যাপন
প্রতিষ্ঠার ৭৫ বছর পূর্ণ করল দেশের দ্বিতীয় সমুদ্র বন্দর মোংলা। এ উপলক্ষে প্লাটিনাম জয়ন্তী উদ্যাপন করেছে বন্দর কর্তৃপক্ষ। আজ সোমবার দুপুর ১২টার দিকে বন্দরের প্রধান ফটকের সামনে বেলুন উড়িয়ে এই আয়োজনের উদ্বোধন করেন মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল শাহীন রহমান।
এর আগে মোংলা বন্দর দিবস উপলক্ষে বন্দর ভবনের সামনে থেকে একটি বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা বের করে বন্দর কর্তৃপক্ষ। পরে বন্দরের জেটির অভ্যন্তরে পবিত্র কোরআন তিলাওয়াত, গীতা ও বাইবেল পাঠের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আলোচনা সভা শুরু হয়। অনুষ্ঠানে বিশেষ অবদান ও বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে বন্দর ব্যবহারকারী ২৮টি প্রতিষ্ঠানকে সম্মাননা দেওয়া হয়। কাজের স্বীকৃতি হিসেবে সেরা কর্মীদেরও সম্মানিত করা হয়।
১৯৫০ সালের ১ ডিসেম্বর খুলনা জেলার চালনা এলাকায় যাত্রা শুরু হলেও ভৌগোলিক কারণে মাত্র তিন বছরের মাথায় বন্দরটির কার্যক্রম সরানো হয় বাগেরহাটের মোংলায়। মূলত ১৯৫০ সালের ১১ ডিসেম্বর ‘দ্য সিটি অব লিয়নস’ নামের ব্রিটিশ বাণিজ্যিক জাহাজের আগমনের মধ্য দিয়ে মোংলা বন্দরের কার্যক্রম শুরু হয়। সুন্দরবনের পশুর নদের জয়মনির ঘোল এলাকায় নোঙর করেছিল ওই জাহাজ।
৭৫ বছরের দীর্ঘ যাত্রায় নানা সংকটের মাঝেও দেশের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যে ভূমিকা রেখে চলেছে মোংলা বন্দর। নৌ, সড়ক ও রেলপথ অবকাঠামো তৈরি থাকায় দেশের বিভিন্ন প্রান্তে সহজে পণ্য পাঠানোর পাশাপাশি প্রতিবেশী ভারত, নেপাল ও ভুটানের জন্যও এই বন্দর ব্যবহার দারুণ সম্ভাবনাময়। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে মোংলা বন্দরকে এগিয়ে নিতে সব ধরনের উদ্যোগ নেওয়ার কথা জানিয়েছে বন্দর কর্তৃপক্ষ।
মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের ঊর্ধ্বতন উপব্যবস্থাপক মো. মাকরুজ্জামান বলেন, এটি প্রথমে একটি সরকারি অধিদপ্তর হিসেবে যাত্রা শুরু করে। ১৯৭৭ সালের মে মাসে ‘চালনা বন্দর কর্তৃপক্ষ’ নামে একটি স্বশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচিতি লাভ করে এই বন্দর। ১৯৮৭ সালের মার্চে নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ‘মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষ’।
বন্দর কর্তৃপক্ষ জানায়, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে মোংলা বন্দরের কার্গো হ্যান্ডলিং লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৮৮ লাখ ৮০ হাজার মেট্রিক টন। অর্থবছর শেষে ১ কোটি ৪ লাখ ১২ হাজার মেট্রিক টন কার্গো হ্যান্ডলিংয়ের মাধ্যমে লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের পাশাপাশি ১৫ লাখ ৩২ হাজার মেট্রিক টন বা ১৭.২৫ শতাংশ বেশি কার্গো হ্যান্ডলিং হয়েছে। কনটেইনার হ্যান্ডলিং হয়েছে ২১ হাজার ৪৫৬ টিইইউজ (টোয়েন্টি-ফুট ইকুইভ্যালেন্ট ইউনিটস)। কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়েও লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১ হাজার ৪৫৬ টিইইউজ বা ৭.২৮ শতাংশ বেশি হ্যান্ডলিং হয়েছে। ৩৪৩ কোটি ৩০ লাখ টাকা রাজস্ব আয়ের মধ্য দিয়ে গত অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ২.৮৩ শতাংশ বেশি আয় করেছে বন্দর কর্তৃপক্ষ। এতে বন্দরের নিট মুনাফা হয় ৬২ কোটি ১০ লখ টাকা।
অনুষ্ঠানে মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল শাহীন রহমান বলেন, চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে বন্দরে জাহাজ এসেছে ৩৫৬টি। কনটেইনার হ্যান্ডলিং হয়েছে ১৩ হাজার ৮৫৪ টিইইউজ এবং গাড়ি আমদানি ৪ হাজার ১৩৯টি। এ ছাড়া বিভিন্ন ধরনের পণ্য আমদানি-রপ্তানি হয়েছে ৪৪ লাখ টন। আধুনিক যন্ত্রপাতি সংগ্রহের ফলে প্রথমবারের মতো প্রতি ঘণ্টায় ২৪টির বেশি কনটেইনার হ্যান্ডলিং করা সম্ভব হচ্ছে। পার্শ্ববর্তী প্রতিবেশী দেশে ট্রানজিট পণ্য মোংলা বন্দরের মাধ্যমে আমদানি-রপ্তানির সুদূরপ্রসারী সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। মোংলা বন্দর ব্যবহার করে স্থল, নৌ ও রেলপথের মাধ্যমে রাজশাহী, রংপুর ও বরিশাল বিভাগের পণ্য পরিবহন সহজ ও দ্রুততর হয়েছে।
দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের প্রাণপ্রবাহ এ বন্দর কর্মসংস্থান সৃষ্টির পাশাপাশি বিভিন্ন পণ্য রপ্তানির মাধ্যমে দেশের চলমান অর্থনীতিতে বিশেষ ভূমিকা রেখে আসছে। মোংলা বন্দরকে আরও আধুনিক ও বিশ্বমানের করে গড়ে তোলার জন্য বেশ কিছু প্রকল্প চলমান।