বুধবার মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ঘোষণা দিয়েছিলেন, ইসরায়েল ও হামাস তাঁর মধ্যস্থতায় একটি শান্তিচুক্তির প্রথম ধাপে রাজি হয়েছে। এই চুক্তির লক্ষ্য হলো গাজায় যুদ্ধবিরতি প্রতিষ্ঠা করা এবং ইসরায়েলি বন্দী ও ফিলিস্তিনি কয়েদিদের মুক্তি দেওয়া।

গত সপ্তাহে ট্রাম্প যে ২০ দফা শান্তি প্রস্তাব প্রকাশ করেছিলেন, তার অংশ হিসেবে এ ঘোষণা এসেছে। ইসরায়েল, হামাস ও বিশ্বের অধিকাংশ দেশই পরিকল্পনাটিকে স্বাগত জানিয়েছে।

উল্লেখ্য, গাজায় ইসরায়েলি হামলায় এখন পর্যন্ত ৬৭ হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন। বহু আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন ও জাতিসংঘের একটি কমিশন এটিকে ‘গণহত্যামূলক যুদ্ধ’ হিসেবে বর্ণনা করেছে।

ইতোমধ্যে যুদ্ধবিরতির সম্মত হয়েছে ইসরায়েল ও হামাস।

কী ঘটেছে বুধবার

গতকাল বুধবার ট্রাম্প জানান, ইসরায়েল ও হামাস তাঁর প্রস্তাবিত যুদ্ধবিরতি পরিকল্পনার প্রথম ধাপে সম্মত হয়েছে। নিজের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ট্রুথ সোশ্যালে গ্রিনিচ মান সময় রাত ১১টা ১৭ মিনিটে তিনি লিখেছেন, ‘সব বন্দীকে খুব শিগগির মুক্তি দেওয়া হবে এবং চুক্তির অংশ হিসেবে ইসরায়েল তার সেনাদের একটি নির্ধারিত সীমারেখা পর্যন্ত সরিয়ে নেবে।’

এর কয়েক ঘণ্টা আগেই ট্রাম্প সাংবাদিকদের বলেছিলেন, এ পরিকল্পনা যাতে কার্যকর হয়, সে জন্য প্রয়োজনে তিনি সপ্তাহান্তেই মধ্যপ্রাচ্যে যেতে প্রস্তুত আছেন।

গত ২৯ সেপ্টেম্বর হোয়াইট হাউসে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সঙ্গে বৈঠকের পর ট্রাম্প প্রথম এই ২০ দফা শান্তি প্রস্তাব প্রকাশ করেন। সেখানে তিনি এটিকে ‘গাজা যুদ্ধ শেষের রোডম্যাপ’ হিসেবে তুলে ধরেন।

বুধবার হোয়াইট হাউসের এক অনুষ্ঠানে পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও যখন ট্রাম্পের হাতে একটি নোট দেন, তখন বিষয়টি আরও স্পষ্ট হয়। সেটি পড়ে ট্রাম্প সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমি এইমাত্র পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছ থেকে একটি নোট পেলাম। এতে লেখা আছে, আমরা মধ্যপ্রাচ্যে একটি চুক্তির খুব কাছাকাছি পৌঁছে গেছি এবং আমাকে দ্রুতই সেখানে যেতে হতে পারে।’

অনুষ্ঠান শেষে ট্রাম্প বলেন, ‘মধ্যপ্রাচ্যের কিছু সমস্যা সমাধানের জন্য আমাকে এখন যেতে হবে।’

একটি ছবিতে দেখা গেছে, সেই নোটে প্রেসিডেন্টকে ট্রুথ সোশ্যালে পোস্ট করার অনুমোদন দিতে বলা হয়েছিল, যেন তিনিই প্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে চুক্তির খবরটি ঘোষণা করতে পারেন।

আরও পড়ুনট্রাম্প ও ব্লেয়ার গাজায় আসলে কি করতে চান০৫ অক্টোবর ২০২৫ট্রাম্প ঠিক কী বলেছেন, তারা কী বিষয়ে একমত হয়েছে

ট্রাম্প তাঁর পোস্টে জানান—

* ইসরায়েল ও হামাস উভয়ই শান্তি পরিকল্পনার প্রথম ধাপে সই করেছে

* সব বন্দী খুব শিগগির মুক্তি পাবে

* ইসরায়েল সেনা প্রত্যাহার করবে একটি নির্ধারিত সীমারেখা পর্যন্ত

* এটি হবে ‘শক্ত ও টেকসই শান্তির প্রথম ধাপ’

* সব পক্ষকে ন্যায্যভাবে আচরণ করতে হবে

ওই পোস্টে ট্রাম্প কাতার, মিসর ও তুরস্কের মধ্যস্থতাকারীদের ধন্যবাদ জানিয়েছেন।

ট্রাম্পের এ ঘোষণাকে গাজা যুদ্ধের বিষয়ে তাঁর সবচেয়ে বড় সাফল্য হিসেবে দেখা হচ্ছে। আট মাস ধরে তিনি সংঘাতের অবসান ঘটাতে চেষ্টা করে আসছিলেন। নিজের পুনর্নির্বাচন প্রচারে ট্রাম্প গাজা যুদ্ধ শেষ করাকে অন্যতম অগ্রাধিকার হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন।

কী কী এখনো অনিশ্চিত

এই চুক্তি গাজা যুদ্ধের অবসানের আশার আলো জ্বালালেও এখনো বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় অমীমাংসিত রয়ে গেছে।

আল–জাজিরার জ্যেষ্ঠ রাজনৈতিক বিশ্লেষক মারওয়ান বিশারা জানান, ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে এখনো ‘কিছু গুরুতর মতবিরোধ’ রয়েছে। এখনো যে বিষয়গুলো চূড়ান্ত হয়নি, তা হলো—

* ইসরায়েলি সেনা প্রত্যাহারের সময়সূচি ও পরিধি

* যুদ্ধপরবর্তী গাজা প্রশাসনের গঠন

* হামাসের ভবিষ্যৎ অবস্থান।

বিশারা বলেন, ‘আপনি বলতে পারেন, এখন কেবল প্রাথমিক ধাপের প্রাথমিক অংশটাই এগোচ্ছে।’ তাঁর মতে, উভয় পক্ষই বন্দী-বন্দিবিনিময়ের বিষয়ে কিছু ‘মৌলিক নীতিতে’ সম্মত হয়েছে। তিনি আরও বলেন, ‘ট্রাম্পের পরিকল্পনা অনুযায়ী, হামাস বন্দীদের মুক্তি দেওয়ার পর যুদ্ধ শেষ হবে।’ কিন্তু ইসরায়েলের বক্তব্য হলো, ‘যুদ্ধ শেষ হবে কেবল তখনই, যখন হামাস সম্পূর্ণভাবে নিরস্ত্র হবে।’

বন্দী মুক্তি কবে হতে পারে

বুধবার ফক্স নিউজে শন হ্যানিটির সঙ্গে সাক্ষাৎকারে ট্রাম্প জানান, সোমবারই বন্দী মুক্তি শুরু হতে পারে, এর মধ্যে মৃতদেহও ফিরিয়ে দেওয়া হবে।

একজন হামাস কর্মকর্তার দাবি, ইসরায়েলি সরকার আনুষ্ঠানিক অনুমোদন দেওয়ার ৭২ ঘণ্টার মধ্যেই জীবিত বন্দীদের মুক্তি দেওয়া হবে।

অন্যদিকে ইসরায়েলি কর্মকর্তারা জানান, প্রক্রিয়াটি শনিবারই শুরু হতে পারে।

ট্রাম্প বলেছেন, তিনি বিশ্বাস করেন, ইরানও ‘পুরো শান্তি প্রক্রিয়ার অংশ’ হবে।

বর্তমানে গাজায় জীবিত প্রায় ২০ জন ইসরায়েলি বন্দী রয়েছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাস ও অন্যান্য ফিলিস্তিনি গোষ্ঠী যখন ইসরায়েলে হামলা চালায়, তখন তারা প্রায় ২৫০ জনকে বন্দী করে। সে হামলায় ১ হাজার ১০০ জনের বেশি মানুষ নিহত হয়েছিলেন।

আরও পড়ুনগাজা শাসনে ব্লেয়ারের কেন এত আগ্রহ১১ ঘণ্টা আগেইসরায়েলের প্রতিক্রিয়া

ট্রাম্পের ঘোষণার পর বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বলেছেন, ‘এটি ইসরায়েলের জন্য একটি মহান দিন।’ বুধবার রাতে দেওয়া বিবৃতিতে তিনি বলেন, ‘আমাদের জিম্মিদের মুক্ত করতে নিরলস পরিশ্রমের জন্য প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ও তাঁর দলকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই। ঈশ্বরের সাহায্যে আমরা একসঙ্গে আমাদের সব লক্ষ্য অর্জন করব এবং প্রতিবেশীদের সঙ্গে শান্তি আরও দৃঢ় করব।’

হামাসের প্রতিক্রিয়া

হামাস এক বিবৃতিতে জানায়, এ চুক্তিতে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে—

* গাজায় যুদ্ধের সম্পূর্ণ অবসান

* ইসরায়েলি বাহিনীর প্রত্যাহার

* মানবিক সহায়তার প্রবেশাধিকার

* বন্দিবিনিময়।

হামাস কাতার, মিসর, তুরস্ক ও ট্রাম্পকে মধ্যস্থতার জন্য ধন্যবাদ জানিয়েছে। তারা বলেছে, ‘চুক্তির শর্তগুলো যেন ইসরায়েলি দখলদার সরকার পুরোপুরি বাস্তবায়ন করে এবং কোনোভাবেই সময়ক্ষেপণ বা এড়ানোর সুযোগ না পায়।’

হামাস আরও বলেছে, ‘আমরা আমাদের গাজা, জেরুজালেম ও পশ্চিম তীরের বীর জনগণকে স্যালুট জানাই, যারা অভূতপূর্ব সাহস, মর্যাদা ও আত্মত্যাগ দেখিয়েছে।’

এরপর কী হবে

চুক্তি অনুমোদনের পর ইসরায়েলি সেনারা সরে আসবেন এবং ৭২ ঘণ্টা পর হামাস বন্দী মুক্তির প্রক্রিয়া শুরু করবে।

ট্রাম্প আগামী কয়েক দিনের মধ্যে মিসর সফরে যেতে পারেন। নেতানিয়াহু ইসরায়েলি পার্লামেন্টে ভাষণ দেওয়ার জন্য ট্রাম্পকে আমন্ত্রণ জানিয়ে রেখেছেন।

ট্রাম্পের পরিকল্পনার পরবর্তী ধাপে থাকবে ‘বোর্ড অব পিস’ নামের একটি আন্তর্জাতিক তত্ত্বাবধায়ক পরিষদ, যা যুদ্ধপরবর্তী গাজার প্রশাসন দেখবে। এই বোর্ডের নেতৃত্ব দেবেন ট্রাম্প নিজেই। সেখানে সদস্য হিসেবে থাকবেন অন্যান্য বিশ্বনেতা। তাঁদের মধ্যে সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ারও রয়েছেন।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ইসর য় ল ও হ ম স র প রথম ধ প র জন য প রস ত

এছাড়াও পড়ুন:

হামাস–ইসরায়েলের সংলাপকে স্বাগত জানাল বাংলাদেশ

ফিলিস্তিনের গাজায় যুদ্ধ বন্ধের লক্ষ্যে স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাস ও ইসরায়েলের মধ্যে চলমান সংলাপকে স্বাগত জানিয়েছে বাংলাদেশ। বৃহস্পতিবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ কথা জানানো হয়েছে।

বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বাংলাদেশ বিশ্বাস করে কূটনীতি এবং সংলাপই যেকোনো সংঘাত সমাধানের একমাত্র উপায়। এই মর্মান্তিক সংকটের অবসান ঘটাতে গুরুত্বপূর্ণ কূটনৈতিক উদ্যোগকে সহজতর করার জন্য অংশীদারদের প্রচেষ্টার প্রশংসা করেছে ঢাকা।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, বাংলাদেশ আশা করে, এই প্রক্রিয়াটি তাৎক্ষণিক যুদ্ধবিরতি, মানবিক সহায়তা প্রবেশ পুনরায় শুরু এবং গাজার জনগণের দুর্ভোগের অবসান ঘটাবে। বাংলাদেশ আরও আশা করে, সংলাপের মাধ্যমে গাজায় চলমান যুদ্ধের অবসান ঘটিয়ে এই কূটনৈতিক প্রক্রিয়া একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম ফিলিস্তিন রাষ্ট্র বাস্তবায়নের পথ প্রশস্ত করবে।

গাজায় শান্তি বজায় রাখতে এবং পুনর্গঠন প্রক্রিয়ায় অবদান রাখতে বাংলাদেশ প্রস্তুত বলে সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়। ১৯৬৭ সালের পূর্ববর্তী সীমান্তের অনুসরণে দ্বিরাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের প্রতি অটল সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করেছে ঢাকা। আর পূর্ব জেরুজালেম হবে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের রাজধানী।

উল্লেখ্য, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের শান্তি পরিকল্পনার প্রথম ধাপ বাস্তবায়নে গাজায় যুদ্ধবিরতি ও বন্দিবিনিময়ে সম্মত হয়েছে ইসরায়েল ও হামাস। বৃহস্পতিবার রাতে ইসরায়েলের মন্ত্রিসভায় পাস হলে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে গাজায় যুদ্ধবিরতি কার্যকর হবে বলে সরকারের মুখপাত্র জানিয়েছে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ