গণভোট কবে, তা সরকারের ওপর ছেড়ে দিতে চায় ঐকমত্য কমিশন
Published: 9th, October 2025 GMT
রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতভেদ থাকায় জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নে গণভোট কি সংসদ নির্বাচনের দিনে হবে, নাকি এর আগে হবে, এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কিছু নিজেদের সুপারিশে রাখতে চাইছে না জাতীয় ঐকমত্য কমিশন।
গণভোটের সময়ের বিষয়টি অন্তর্বর্তী সরকারের সিদ্ধান্তের ওপর ছেড়ে দেওয়ার চিন্তা রয়েছে বলে কমিশন সূত্রে জানা গেছে; যদিও এ নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত এখনো হয়নি।
রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ধারাবাহিক আলোচনার পর কমিশন আজ বৃহস্পতিবার নিজেরা বৈঠক করে জানিয়েছে, আগামী ১৫ অক্টোবর জুলাই জাতীয় সনদ স্বাক্ষর হবে। তার আগে আগামী রোববার নাগাদ সনদ বাস্তবায়নের উপায় নিয়ে সরকারের কাছে সুপারিশ দেওয়া হবে।
কমিশন সূত্র জানায়, রাজনৈতিক দলগুলোকেও এই সুপারিশ দেওয়া হবে। তবে বাস্তবায়নের উপায় নিয়ে এখন পর্যন্ত সুপারিশ চূড়ান্ত হয়নি। সময় ও পথ পদ্ধতি নিয়ে মতভিন্নতা থাকলেও গণভোটের বিষয়ে রাজনৈতিক মতৈক্য হওয়ার বাস্তবায়নের পদ্ধতি হিসেবে এটাকেই প্রাধান্য দিচ্ছে কমিশন। এ ক্ষেত্রে অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি, অধ্যাপক ও আইনজীবীদের সমন্বয়ে গঠিত বিশেষজ্ঞ প্যানেল যে মতামত দিয়েছে, সেটাকে ভিত্তি ধরছে কমিশন। এখানে কিছু বিষয় প্রয়োজনে আরও সুনির্দিষ্ট ও বিস্তারিত আকারে দেওয়া হবে।
গণভোট নিয়ে ঐকমত্য থাকলেও তার ভিত্তি, সময় ও পদ্ধতি নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মতবিরোধ আছে। শেষ পর্যন্ত কমিশনের সুপারিশ সব দল মেনে নেবে কি না, তা–ও পরিষ্কার নয়। বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তারা আগে দেখতে চায় সুপারিশে কী থাকে। বিশেষ করে গণভোটের সময় ও ভিন্নমত থাকা প্রস্তাবগুলোর বাস্তবায়ন পদ্ধতি নিয়ে কমিশনের সুপারিশে কী থাকছে, তা দেখে দলগুলো সিদ্ধান্ত নেবে।
এর আগে বিশেষজ্ঞ প্যানেল জাতীয় নির্বাচনের সঙ্গে একই দিনে গণভোট আয়োজনের পক্ষে মত দিয়েছিল। তবে গতকাল বুধবার রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনায় ঐকমত্য কমিশন বিশেষজ্ঞদের যে মতামত তুলে ধরে, সেখানে গণভোটের সময়ের বিষয়ে কিছু বলা হয়নি।
ঐকমত্য কমিশন মনে করে, জাতীয় নির্বাচনের দিন একই সঙ্গে ভোট করার যেমন সুবিধা–অসুবিধা আছে, তেমনি আগে করারও সুবিধা–অসুবিধা আছে। গণভোট আয়োজন করবে নির্বাচন কমিশন। এখানে নির্বাচন কমিশনের সক্ষমতার বিষয় আছে। একই সঙ্গে দুটি ভোট করলে একাধিক ব্যালট থাকবে। সে ক্ষেত্রে ভোট গ্রহণে বেশি সময় লাগবে। এটি সামাল দেওয়া যাবে কি না, এটা ভালো বলতে পারবে নির্বাচন কমিশন। নির্বাচন আয়োজনে সার্বিক সহায়তা করতে হবে সরকারকে।
কমিশন সূত্র জানায়, তাই নির্বাচন কমিশন ও সরকার আলোচনা করে গণভোটের যৌক্তিক সময় ঠিক করতে পারে। ঐকমত্য কমিশন যদি ভোটের সুনির্দিষ্ট সময় বলে দেয়, তাহলে তা সরকার ও নির্বাচন কমিশনের ওপর একধরনের চাপ বলে মনে হতে পারে।
এ বিষয়ে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আগামী ১৫ অক্টোবর জুলাই জাতীয় সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠান হবে। এর আগেই কমিশন জুলাই সনদের বাস্তবায়নের উপায় সুপারিশ সরকারের কাছে জমা দেবে। সেখানে বাস্তবায়নের উপায় সম্পর্কে বিস্তারিত থাকবে।’
বিএনপিসহ কয়েকটি দল জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিন একই সঙ্গে গণভোটের পক্ষে। অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টিসহ (এনসিপি) কয়েকটি দল চায় জাতীয় নির্বাচনের আগেই গণভোট হোক। গণভোটের প্রশ্ন কী থাকবে, ভিন্নমত থাকা প্রস্তাবগুলোর বাস্তবায়ন কীভাবে হবে—এসব প্রশ্নেও মতভিন্নতা আছে।
শুরু থেকেই বিএনপি বলে আসছে, জুলাই সনদ নিয়ে সংবিধান আদেশ জারি করা যাবে না, সনদকে সংবিধানের ওপরে স্থান দেওয়া যাবে না। দলটি বলছে, আদেশ নয় বরং জুলাই সনদ নিয়ে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করা যায়। তার ভিত্তিতে গণভোটের জন্য একটি নতুন অধ্যাদেশ করে গণভোট করা যায়। আর যেসব সিদ্ধান্তে দলগুলোর ভিন্নমত আছে, সেগুলো সনদের উল্লেখ থাকবে। সনদের অঙ্গীকারনামায় একটি অঙ্গীকার এভাবে যুক্ত করা হবে যে ভিন্নমতগুলো দলগুলো নির্বাচনী ইশতাহারে উল্লেখ করবে।
জামায়াতে ইসলামী ও এনসিপি চায়, সংস্কার টেকসই করতে সংবিধান আদেশ না হলেও জুলাই বাস্তবায়ন আদেশ জারি করে তার ভিত্তিতে গণভোট করতে হবে। আগামী জাতীয় সংসদকে দ্বৈত ভূমিকা পালনের ক্ষমতা দিতে হবে। ভিন্নমত থাকা প্রস্তাবগুলোও সনদে থাকতে হবে।
সংবিধান-সম্পর্কিত প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়নে বিশেষজ্ঞরা কয়েকটি ধাপের কথা বলেছেন। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বাস্তবায়নের উপায় নিয়ে সুপারিশ তৈরি করার ক্ষেত্রে কমিশন বিশেষজ্ঞদের এই মতামতকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিচ্ছে। কমিশনও মনে করে, গণভোট করতে হলে এর আগে একটি বিশেষ আদেশ জারি করতে হবে। তার ভিত্তিতে গণভোট হবে। এ ছাড়া সংস্কারকে টেকসই করতে আগামী সংসদকে দ্বৈত ভূমিকা পালনের (সংবিধান সংস্কার পরিষদ ও জাতীয় সংসদ) ক্ষমতা দিতে হবে এবং কত দিনের মধ্যে সংবিধান-সংস্কার করা হবে, তা নির্ধারণ করে দিতে হবে। এ বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দিয়ে বাস্তবায়নের সুপারিশ চূড়ান্ত করবে ঐকমত্য কমিশন।
যেসব প্রস্তাবে ভিন্নমত আছে, সেগুলো মৌলিক সংস্কার প্রস্তাব। কমিশনও শুরু থেকে এগুলোকে গুরুত্ব দিয়ে আসছে। ঐকমত্য কমিশন সূত্র জানায়, এখন পর্যন্ত তারা মনে করছে গণভোটে প্রশ্ন হতে পারে—জুলাই সনদ বাস্তবায়ন চান কি না? এ ক্ষেত্রে দুটি প্রশ্ন রাখার চিন্তা করা হচ্ছে। একটিতে থাকবে—যেগুলোয় ঐকমত্য আছে, সেগুলোর বাস্তবায়ন চান কি না? আরেকটিতে থাকবে—ভিন্নমত থাকা প্রস্তাবগুলোর বাস্তবায়ন চান কি না?
আরও পড়ুন জুলাই সনদ স্বাক্ষরিত হবে ১৫ অক্টোবর২ ঘণ্টা আগেছয়টি সংস্কার কমিশনের ৮৪টি সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে তৈরি হচ্ছে জুলাই জাতীয় সনদ। এর খসড়া চূড়ান্ত হলেও বাস্তবায়ন পদ্ধতি নিয়ে ঐকমত্য না হওয়ায় তা ঝুলে ছিল এত দিন। অবশ্য বাস্তবায়নের উপায় সনদের অংশ হবে না।
আরও পড়ুনজুলাই সনদ বাস্তবায়ন: একমত হয়নি দলগুলো, সুপারিশ দেবে কমিশন ১০ ঘণ্টা আগে.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: জ ল ই জ ত য় সনদ ভ ন নমত থ ক জ ল ই সনদ প রস ত ব গণভ ট র সরক র র গণভ ট ক ভ ট কর সনদ র র ওপর
এছাড়াও পড়ুন:
ঐকমত্য কমিশনের বিরুদ্ধে আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগ নেই
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বিরুদ্ধে কোনো আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগ নেই বলে দাবি করেছেন কমিশনের সাবেক সহসভাপতি এবং সদ্য নিয়োগ পাওয়া প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী অধ্যাপক আলী রীয়াজ। তিনি বলেছেন, ‘আর্থিক দুর্নীতির প্রশ্নটা আপনি (প্রশ্নকর্তা) তুলেছেন, সেটি তথ্যগতভাবে ভুল। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বিরুদ্ধে কোনো আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগ নেই। কোনো বিশেষ ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান যদি কোনো মিথ্যাচার করে থাকে, তার দায়িত্ব তাকেই নিতে হবে।’
বে অব বেঙ্গল কনভারসেশন সম্মেলনের একটি পর্বে বক্তব্য দেওয়ার পর সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে অধ্যাপক আলী রীয়াজ এ কথাগুলো বলেন। আজ রোববার রাজধানীর একটি হোটেলে এ সম্মেলনের আয়োজন করে সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজ (সিজিএস)।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বিরুদ্ধে আর্থিক অসংগতির বিষয়ে জানতে চাইলে আলী রীয়াজ বলেন, ‘জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের পক্ষ থেকে সুস্পষ্টভাবে টাকার হিসাব দেওয়া হয়েছে। সরকারের বরাদ্দকৃত সাত কোটি টাকার মধ্যে দুই কোটি টাকার কম খরচ করা হয়েছে এবং কীভাবে খরচ করা হয়েছে, সেটা চিফ অ্যাডভাইজারের (প্রধান উপদেষ্টা) অফিস থেকে এবং কমিশনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে।’
অভিযোগকে মিথ্যাচার উল্লেখ করে কমিশনের সাবেক এই সহসভাপতি বলেন, ‘আপনি যে মিথ্যাচারটা রিপিট (পুনরাবৃত্তি) করেছেন, সেটার জন্য আপনাকে আমি আরেকবার শুধু স্মরণ করিয়ে দেব, যেকোনো তথ্যের সর্বশেষ ভাষ্যটি লক্ষ করা খুব জরুরি। কেননা যে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান বা সংগঠন যাঁরা এই প্রশ্ন তুলেছিলেন, তাঁরা কিন্তু এই হিসাবের পরে আর কোনো কথা বলেননি।’
এ ছাড়া আলী রীয়াজের কাছে জানতে চাওয়া হয় জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর অভিযোগের বিষয়ে। জবাবে তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ কেন, এমন পাল্টা প্রশ্ন তুলে তিনি একে মতপ্রকাশের সুযোগ সৃষ্টি বলে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, ‘দেশটার খানিকটা হলো কথাবার্তা বলার, চর্চার একটা সুযোগ তৈরি হয়েছে। যেকোনো রকম কাজ করলে তাদের সমালোচিত হওয়াটাই স্বাভাবিক। ৩০টির বেশি রাজনৈতিক দলের মধ্যে আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়ে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন একটি জাতীয় সনদ তৈরি করতে পেরেছে। এবং সেগুলো বাস্তবায়নের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। আমরা করছি।’
জনগণের সমর্থনে ভবিষ্যতে বাংলাদেশে বিভিন্নভাবে কাঠামোগত এবং সাংবিধানিক সংস্কার সম্ভব হবে—এমন আশাবাদ জানিয়ে আলী রীয়াজ বলেন, ‘ফলে যদি কেউ মনে করেন যে সংস্কারের প্রশ্নটি ইতিমধ্যে মারা গেছে এবং যাঁরা অবিচ্যুয়ারি লিখতে চান, তাঁরা লিখতে পারেন। কারণ, অবিচ্যুয়ারি লেখার অভ্যাস তাঁদের আছে এবং অন্যরা অবিচ্যুয়ারি লিখতে পারেন।’
‘বাংলাদেশের একটা ঐতিহাসিক সুযোগ তৈরি হয়েছে’ এবং তা অব্যাহত থাকবে বলে মনে করেন অধ্যাপক আলী রীয়াজ। তিনি বলেন, ‘আমি জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের পক্ষ থেকে যখন জুলাই জাতীয় সনদ স্বাক্ষরিত হয়, সেই অনুষ্ঠানে সুস্পষ্টভাবে বলেছিলাম যে একটি দলিল দিয়ে আসলে সমস্ত রকম সংস্কার সম্ভব নয়। এটি সূচনা মাত্র এবং জাতীয় সনদের যে শিরোনাম করা হয়েছে, সেটা হচ্ছে—ভবিষ্যতের পথরেখা। আশা করি, সেটা আপনাদের সবারই নজরে থাকবে।’
এর আগে সম্মেলনে অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, দক্ষিণ এশিয়ায় অনেক দেশেই ক্ষমতাসীনেরা নিজেদের ক্ষমতাকে সুসংহত করতে রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করেছে। কর্তৃত্ববাদীরা অর্থনৈতিক উন্নয়ন করলেও গণতন্ত্র ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে না পারায় বাংলাদেশে গণ-অভ্যুত্থান হয়েছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
অধ্যাপক আলী রীয়াজ মনে করেন, সরকারের মাধ্যমে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি হচ্ছে অথবা রাষ্ট্রগুলো দমনমূলক হয়ে উঠছে। তিনি বলেন, নজরদারির ক্ষমতা বৃদ্ধি করে সরকার সংকটকে টিকিয়ে রাখছে। আবার তার বিপরীতে প্রায়ই রাষ্ট্র নিজেও বহিরাগত শক্তির চাপে ভীষণভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে বলেও উল্লেখ করেন তিনি। এ ছাড়া তাঁর বক্তব্যে উঠে আসে সমসাময়িক বাংলাদেশ ও দক্ষিণ এশিয়াসহ বৈশ্বিক পরিস্থিতি।