হেফাজতে থাকা আসামির বক্তব্য: সাংবাদিকতা, দায়িত্ববোধ ও কিছু প্রশ্ন
Published: 24th, November 2025 GMT
কিছু কিছু পেশা আছে, যেখানে শপথ নেওয়ার পর পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে হয়। যেমন ওকালতি, সাংবাদিকতা, ডাক্তারি ইত্যাদি। সাংবাদিকতা পেশা জনমানুষের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত; ভুল ও ব্যত্যয়ের কারণে সহজেই কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। তাই শপথের বিধান রয়েছে, যেন পেশাগত নীতি-নৈতিকতা থেকে কোনোরূপ বিচ্যুতি না ঘটে।
বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্মের আগে থেকে শুরু করে মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং পরবর্তীকালে যতগুলো বাঁক বদল করা ঐতিহাসিক ঘটনাপ্রবাহ হয়েছে, তার সব কটিতেই সাংবাদিকদের অনন্য ভূমিকা রয়েছে। বর্তমানে প্রযুক্তির উৎকর্ষের সঙ্গে সংবাদ সংগ্রহ সহজলভ্য হয়েছে। তবে পেশাগত মান ও দায়বদ্ধতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। সংবাদপত্র, তথা সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা অতীব গুরুত্বপূর্ণ; তবে তা দায়বদ্ধতার জায়গাটি অস্বীকার করে নয়।
প্রেস কাউন্সিল অ্যাক্ট, ১৯৭৪-এর ১১(বি) ধারার ক্ষমতাবলে প্রণীত ‘সাংবাদিকদের জন্য আচরণবিধি, ১৯৯৩ (২০০২ পর্যন্ত সংশোধিত)’–এর পরিশিষ্টে একটি শপথনামা রয়েছে, যা প্রত্যেক সাংবাদিককে পাঠ করে স্বাক্ষর করতে হয়। কিন্তু এই শপথনামা সম্পর্কে বেশির ভাগ সাংবাদিক ওয়াকিবহাল নন। এমনকি অনেকে আচরণবিধি পড়ার সুযোগও পাননি; আর পড়লেও পালনের বিষয়ে উদাসীন।
সাম্প্রতিক একটি ঘটনায় সাংবাদিকদের পেশাগত দায়বদ্ধতার প্রশ্নটি আবার উঠেছে। রাজশাহীতে একজন বিচারকের সন্তানকে হত্যা ও স্ত্রীকে আহত করার পর পুলিশের হেফাজতে থাকা আসামির বক্তব্য ধারণ ও দায়িত্বহীনভাবে তা প্রচার করা হয়েছে।
বিচারকের সন্তান যেখানে হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে এবং স্ত্রী গুরুতর জখম হয়ে চিকিৎসাধীন রয়েছেন, সেখানে ধৃত ব্যক্তির বক্তব্যে নিন্দনীয়ভাবে ভিকটিম ব্লেমিং করা হয়েছে এবং নীতি–নৈতিকতা বিবেচনায় না নিয়ে প্রচার করা হয়েছে।
রাজশাহীর ঘটনায় অনলাইন থেকে মূলধারার অনেক সংবাদমাধ্যম সাংবাদিকতার আচরণবিধি ও উচ্চ আদালতের আইনগত নির্দেশনা পালনে সচেষ্ট হয়নি। প্রশ্ন উঠতে পারে, সাংবাদিক তো যেকোনো উৎস থেকে খবর সংগ্রহ করতে পারেন। হ্যাঁ, পারেন; তবে তারও মানদণ্ড নির্ধারিত আছে।উন্নত দেশগুলোয় সহিংস ঘটনায় ভিকটিমের পরিচয় গোপন করা হয়। আমাদের দেশের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০–সহ বেশ কিছু আইনে ভিকটিমের পরিচয় প্রকাশ নিষিদ্ধ। এখন হরহামেশাই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ভিকটিম, আসামিকে নিয়ে ব্রিফিং করে। এ ধরনের মিডিয়া ট্রায়াল আইনে স্বীকৃত নয়। আদালত কর্তৃক বিচারের আগেই মিডিয়া কর্তৃক সৃষ্ট জনমতভিত্তিক ধারণা (মিডিয়া ট্রায়াল) মারাত্মক ঋণাত্মক প্রভাব রয়েছে। অথচ এমন মিডিয়া ট্রায়াল উচ্চ আদালতের নির্দেশনার লঙ্ঘন [আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নি বনাম রাষ্ট্র (৩৯ বিএলডি ৪৭০)]।
রাজশাহীর ঘটনায় অনলাইন থেকে মূলধারার অনেক সংবাদমাধ্যম সাংবাদিকতার আচরণবিধি ও উচ্চ আদালতের আইনগত নির্দেশনা পালনে সচেষ্ট হয়নি। প্রশ্ন উঠতে পারে, সাংবাদিক তো যেকোনো উৎস থেকে খবর সংগ্রহ করতে পারেন। হ্যাঁ, পারেন; তবে তারও মানদণ্ড নির্ধারিত আছে।
একজন আসামি, যিনি পুলিশ হেফাজতে আছেন, তাঁর বক্তব্য নেওয়ার আইনত কোনো সুযোগ নেই। আর কোনো নারীকে জড়িয়ে ছবিসহ মুখরোচক গল্প প্রচার করা সাংবাদিকতা আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন (আচরণবিধি ১৩/২৩)। ঘটনার আগে জিডি থাকায় এবং তারপর হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হওয়ায় বিষয়টি বিচারাধীন, আর বিচারাধীন বিষয়ে বিচারকে প্রভাবিত করতে পারে—এমন কিছু প্রকাশ বা প্রচার সাংবাদিকতার আচরণবিধির আরেকটি লঙ্ঘন (আচরণবিধি ১৬)।
ঘটনার সপ্তাহখানেক আগেই আসামির কাছ থেকে জীবননাশের হুমকি পাওয়ায় নিরাপত্তাহীনতার কথা উল্লেখ করে ভিকটিম সিলেটে জিডি করেছিলেন। ঘটনার দিন দুপুরেও রাজশাহীতে ভিকটিম থানায় গিয়ে এমন আশঙ্কার কথা পুলিশকে জানিয়েছিলেন। জিডি থাকা সত্ত্বেও ভিকটিম পরিবারের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পুলিশের ব্যর্থতা তুলে না ধরে ভিকটিম ব্লেমিংকে উসকে দিয়ে সংবাদমাধ্যম কতটা দায়িত্বশীলতা দেখিয়েছে—সে প্রশ্ন তোলা যায়।
এখন অফলাইন–অনলাইন সাংবাদিকতার নানা মাধ্যম হয়েছে; কিন্তু পেশাগত মানদণ্ড মানার যেন কোনো বালাই নেই। ২০২৫ সালের শুরুর দিকে প্রেস অ্যাক্রেডেনশিয়াল নীতিমালা প্রণীত হয়েছে, যেখানে কোড অব কনডাক্ট ভাঙলে পেশাগত শাস্তিমূলক পদক্ষেপ নেওয়ার বিধান আছে। যারা নিয়ম মানছে না, তাদের বিরুদ্ধে প্রেস কাউন্সিল যেন প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়। সেই সঙ্গে সাংবাদিকদের পেশাগত প্রশিক্ষণ থাকা জরুরি। নইলে সাংবাদিকতার পেশাগত মান নিম্নমুখী হওয়ার যৌক্তিক আশঙ্কা বাড়বে।
মো.
জিয়াউর রহমান এমফিল ফেলো, ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজ
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: আচরণব ধ ব দ কত র র প শ গত ঘটন য়
এছাড়াও পড়ুন:
হেফাজতে থাকা আসামির বক্তব্য: সাংবাদিকতা, দায়িত্ববোধ ও কিছু প্রশ্ন
কিছু কিছু পেশা আছে, যেখানে শপথ নেওয়ার পর পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে হয়। যেমন ওকালতি, সাংবাদিকতা, ডাক্তারি ইত্যাদি। সাংবাদিকতা পেশা জনমানুষের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত; ভুল ও ব্যত্যয়ের কারণে সহজেই কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। তাই শপথের বিধান রয়েছে, যেন পেশাগত নীতি-নৈতিকতা থেকে কোনোরূপ বিচ্যুতি না ঘটে।
বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্মের আগে থেকে শুরু করে মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং পরবর্তীকালে যতগুলো বাঁক বদল করা ঐতিহাসিক ঘটনাপ্রবাহ হয়েছে, তার সব কটিতেই সাংবাদিকদের অনন্য ভূমিকা রয়েছে। বর্তমানে প্রযুক্তির উৎকর্ষের সঙ্গে সংবাদ সংগ্রহ সহজলভ্য হয়েছে। তবে পেশাগত মান ও দায়বদ্ধতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। সংবাদপত্র, তথা সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা অতীব গুরুত্বপূর্ণ; তবে তা দায়বদ্ধতার জায়গাটি অস্বীকার করে নয়।
প্রেস কাউন্সিল অ্যাক্ট, ১৯৭৪-এর ১১(বি) ধারার ক্ষমতাবলে প্রণীত ‘সাংবাদিকদের জন্য আচরণবিধি, ১৯৯৩ (২০০২ পর্যন্ত সংশোধিত)’–এর পরিশিষ্টে একটি শপথনামা রয়েছে, যা প্রত্যেক সাংবাদিককে পাঠ করে স্বাক্ষর করতে হয়। কিন্তু এই শপথনামা সম্পর্কে বেশির ভাগ সাংবাদিক ওয়াকিবহাল নন। এমনকি অনেকে আচরণবিধি পড়ার সুযোগও পাননি; আর পড়লেও পালনের বিষয়ে উদাসীন।
সাম্প্রতিক একটি ঘটনায় সাংবাদিকদের পেশাগত দায়বদ্ধতার প্রশ্নটি আবার উঠেছে। রাজশাহীতে একজন বিচারকের সন্তানকে হত্যা ও স্ত্রীকে আহত করার পর পুলিশের হেফাজতে থাকা আসামির বক্তব্য ধারণ ও দায়িত্বহীনভাবে তা প্রচার করা হয়েছে।
বিচারকের সন্তান যেখানে হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে এবং স্ত্রী গুরুতর জখম হয়ে চিকিৎসাধীন রয়েছেন, সেখানে ধৃত ব্যক্তির বক্তব্যে নিন্দনীয়ভাবে ভিকটিম ব্লেমিং করা হয়েছে এবং নীতি–নৈতিকতা বিবেচনায় না নিয়ে প্রচার করা হয়েছে।
রাজশাহীর ঘটনায় অনলাইন থেকে মূলধারার অনেক সংবাদমাধ্যম সাংবাদিকতার আচরণবিধি ও উচ্চ আদালতের আইনগত নির্দেশনা পালনে সচেষ্ট হয়নি। প্রশ্ন উঠতে পারে, সাংবাদিক তো যেকোনো উৎস থেকে খবর সংগ্রহ করতে পারেন। হ্যাঁ, পারেন; তবে তারও মানদণ্ড নির্ধারিত আছে।উন্নত দেশগুলোয় সহিংস ঘটনায় ভিকটিমের পরিচয় গোপন করা হয়। আমাদের দেশের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০–সহ বেশ কিছু আইনে ভিকটিমের পরিচয় প্রকাশ নিষিদ্ধ। এখন হরহামেশাই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ভিকটিম, আসামিকে নিয়ে ব্রিফিং করে। এ ধরনের মিডিয়া ট্রায়াল আইনে স্বীকৃত নয়। আদালত কর্তৃক বিচারের আগেই মিডিয়া কর্তৃক সৃষ্ট জনমতভিত্তিক ধারণা (মিডিয়া ট্রায়াল) মারাত্মক ঋণাত্মক প্রভাব রয়েছে। অথচ এমন মিডিয়া ট্রায়াল উচ্চ আদালতের নির্দেশনার লঙ্ঘন [আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নি বনাম রাষ্ট্র (৩৯ বিএলডি ৪৭০)]।
রাজশাহীর ঘটনায় অনলাইন থেকে মূলধারার অনেক সংবাদমাধ্যম সাংবাদিকতার আচরণবিধি ও উচ্চ আদালতের আইনগত নির্দেশনা পালনে সচেষ্ট হয়নি। প্রশ্ন উঠতে পারে, সাংবাদিক তো যেকোনো উৎস থেকে খবর সংগ্রহ করতে পারেন। হ্যাঁ, পারেন; তবে তারও মানদণ্ড নির্ধারিত আছে।
একজন আসামি, যিনি পুলিশ হেফাজতে আছেন, তাঁর বক্তব্য নেওয়ার আইনত কোনো সুযোগ নেই। আর কোনো নারীকে জড়িয়ে ছবিসহ মুখরোচক গল্প প্রচার করা সাংবাদিকতা আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন (আচরণবিধি ১৩/২৩)। ঘটনার আগে জিডি থাকায় এবং তারপর হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হওয়ায় বিষয়টি বিচারাধীন, আর বিচারাধীন বিষয়ে বিচারকে প্রভাবিত করতে পারে—এমন কিছু প্রকাশ বা প্রচার সাংবাদিকতার আচরণবিধির আরেকটি লঙ্ঘন (আচরণবিধি ১৬)।
ঘটনার সপ্তাহখানেক আগেই আসামির কাছ থেকে জীবননাশের হুমকি পাওয়ায় নিরাপত্তাহীনতার কথা উল্লেখ করে ভিকটিম সিলেটে জিডি করেছিলেন। ঘটনার দিন দুপুরেও রাজশাহীতে ভিকটিম থানায় গিয়ে এমন আশঙ্কার কথা পুলিশকে জানিয়েছিলেন। জিডি থাকা সত্ত্বেও ভিকটিম পরিবারের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পুলিশের ব্যর্থতা তুলে না ধরে ভিকটিম ব্লেমিংকে উসকে দিয়ে সংবাদমাধ্যম কতটা দায়িত্বশীলতা দেখিয়েছে—সে প্রশ্ন তোলা যায়।
এখন অফলাইন–অনলাইন সাংবাদিকতার নানা মাধ্যম হয়েছে; কিন্তু পেশাগত মানদণ্ড মানার যেন কোনো বালাই নেই। ২০২৫ সালের শুরুর দিকে প্রেস অ্যাক্রেডেনশিয়াল নীতিমালা প্রণীত হয়েছে, যেখানে কোড অব কনডাক্ট ভাঙলে পেশাগত শাস্তিমূলক পদক্ষেপ নেওয়ার বিধান আছে। যারা নিয়ম মানছে না, তাদের বিরুদ্ধে প্রেস কাউন্সিল যেন প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়। সেই সঙ্গে সাংবাদিকদের পেশাগত প্রশিক্ষণ থাকা জরুরি। নইলে সাংবাদিকতার পেশাগত মান নিম্নমুখী হওয়ার যৌক্তিক আশঙ্কা বাড়বে।
মো. জিয়াউর রহমান এমফিল ফেলো, ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজ