জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় দেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা পুড়িয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু এর দায় চাপানো হয় আন্দোলনকারীদের ওপর। বিষয়টি জবানবন্দিতে উল্লেখ করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়া। তিনি আরও বলেন, গণ-অভ্যুত্থানের সময় আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে অনেক মিথ্যা মামলা করা হয় এবং ‘ব্লক রেইড’ দিয়ে তখন ব্যাপক ধরপাকড় করা হয়।

গণ-অভ্যুত্থানের সময় রাজধানীর চানখাঁরপুল এলাকায় ছয়জনকে গুলি করে হত্যার ঘটনায় করা মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ১৯তম সাক্ষী হিসেবে বৃহস্পতিবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১–এ জবানবন্দি দেন উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া শিক্ষার্থীদের প্ল্যাটফর্ম বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক ছিলেন তিনি।

জবানবন্দিতে উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ বলেন, ২০১৮ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলনেও তিনি সক্রিয়ভাবে অংশ নেন। এ আন্দোলনের কারণে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার কোটা পদ্ধতি বাতিল করতে বাধ্য হয়। ২০২৪ সালের ৫ জুন হাইকোর্টের এক রায়ে কোটা পদ্ধতি আবার ফিরে আসে। এর বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিকভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁরা মিছিল করেন। এরপর ১ জুলাই টানা আন্দোলন শুরু হয়।

জবানবন্দিতে আসিফ মাহমুদ এ আন্দোলনের বিভিন্ন দিনের বর্ণনা দেন। গত বছরের ১৯ জুলাইয়ের বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি বলেন, সেদিন রাতে ঢাকার গুলশানের নিকেতন এলাকা থেকে তাঁকে ডিবি পরিচয়ে তুলে নেওয়া হয়। সেখানে (যেখানে বন্দী ছিলেন) তাঁকে আন্দোলন প্রত্যাহারে একটি ভিডিও বার্তা দিতে চাপ দেওয়া হয়। তিনি রাজি না হলে তাঁকে ইনজেকশন দিয়ে অচেতন করে ফেলা হয়। ৫ আগস্টের (২০২৪ সাল) পরবর্তী সময়ে ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় আয়নাঘর পরিদর্শনে গিয়ে তিনি বুঝতে পারেন, এটি ছিল সেই জায়গা (যেখানে তাঁকে আটকে রাখা হয়েছিল)।

‘হত্যা করার নির্দেশ দেন শেখ হাসিনা’

আসিফ মাহমুদ জবানবন্দিতে বলেন, গত বছরের ২৬ জুলাই গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতাল থেকে সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম, আবু বাকের মজুমদার ও তাঁকে তুলে নেওয়া হয়। তাঁদের নেওয়া হয় ডিবি কার্যালয়। ২৭ জুলাই সমন্বয়ক হাসনাত আবদুল্লাহ ও সারজিস আলমকে এবং ২৮ জুলাই সমন্বয়ক নুসরাত তাবাসসুমকেও ডিবি কার্যালয়ে তুলে আনা হয়। তৎকালীন ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার মো.

হারুন অর রশীদ ও ডিবির রমনা বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) মো. হুমায়ুন কবীর আন্দোলন প্রত্যাহারের জন্য তাঁদের চাপ ও হুমকি দেন।

জবানবন্দিতে আসিফ মাহমুদ বলেন, শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খানের নির্দেশে তাঁদের তুলে আনার কথা বলেছিলেন ডিবির কর্মকর্তারা। আন্দোলন প্রত্যাহারে রাজি না হলে তাঁদের হত্যা করার জন্য তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের নির্দেশ ছিল। ডিবি কর্মকর্তারা (হারুন ও হুমায়ুন) আরও বলেছিলেন, তাঁরা দয়া করে সমন্বয়কদের বাঁচিয়ে রেখেছেন।

ডিবি কার্যালয়ে বন্দী অবস্থায় আমরণ অনশন শুরু করলে এবং শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে ১ আগস্ট তাঁদের (সমন্বয়কদের) মুক্তি দেওয়া হয় বলে জবানবন্দিতে উল্লেখ করেন আসিফ মাহমুদ।

‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি প্রসঙ্গে

গত বছরের ৪ আগস্ট শাহবাগে সমাবেশ ছিল উল্লেখ করে আসিফ মাহমুদ জবানবন্দিতে বলেন, সেদিন সন্ধ্যায় শাহবাগে তাঁদের সমাবেশস্থলে পুলিশ গুলি চালায় এবং সেখানে কমপক্ষে চারজন নিহত ও অসংখ্য আন্দোলনকারী ছাত্র-জনতা আহত হন মর্মে খবর পান। সেদিন বিকেলে ৫ আগস্ট সারা দেশে বিক্ষোভ ও ৬ আগস্ট ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। এ কর্মসূচি মোকাবিলায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, আওয়ামী লীগ (এখন কার্যক্রম নিষিদ্ধ) ও এর সহযোগী সংগঠন ব্যাপক প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে—এমন খবর তাঁরা জানতে পারেন। এ কারণে তিনি সমন্বয়কদের সঙ্গে আলোচনা করে দুই ঘণ্টার মধ্যে কর্মসূচি পরিবর্তন করে ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি ৬ আগস্টের পরিবর্তে ৫ আগস্ট পালনের আহ্বান জানিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি ভিডিও বার্তা প্রচার করেন।

৫ আগস্ট সমন্বয়ক আবু বাকের মজুমদার ও মোয়াজ্জেম হোসেনকে নিয়ে চানখাঁরপুল হয়ে শহীদ মিনারের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করেন বলে জবানবন্দিতে উল্লেখ করেন আসিফ মাহমুদ। তিনি বলেন, তাঁর সামনে পুলিশের গুলিতে দুই আন্দোলনকারী নিহত হন।

চানখাঁরপুলের মামলায় আসামি আটজন। তাঁদের মধ্যে ডিএমপির সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমান, সাবেক যুগ্ম কমিশনার সুদীপ কুমার চক্রবর্তী, রমনা অঞ্চলের সাবেক অতিরিক্ত উপকমিশনার শাহ্ আলম মো. আখতারুল ইসলাম ও রমনা অঞ্চলের সাবেক সহকারী কমিশনার মোহাম্মদ ইমরুল পলাতক। আর শাহবাগ থানার সাবেক পরিদর্শক আরশাদ হোসেন, সাবেক কনস্টেবল সুজন হোসেন, ইমাজ হোসেন ও মো. নাসিরুল ইসলাম গ্রেপ্তারের পর কারাগারে আছেন। তাঁদের গতকাল ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়।

বিচারপতি মো. গোলাম মর্তুজা মজুমদারের নেতৃত্বে তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১-এ মামলার বিচার হচ্ছে। ট্রাইব্যুনালের অপর দুই সদস্য হলেন বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ ও বিচারক মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী।

‘দল হিসেবে আওয়ামী লীগের বিচার হওয়া প্রয়োজন’

জবানবন্দি শেষে ট্রাইব্যুনাল প্রাঙ্গণে ব্রিফিংয়ে এক প্রশ্নের জবাবে উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়া বলেন, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় যে ধরনের হত্যাযজ্ঞ আওয়ামী লীগ চালিয়েছে, দল হিসেবে তাদের বিচার হওয়া প্রয়োজন। আওয়ামী লীগের সময়ের যাঁরা সুবিধাভোগী, তাঁরা নানাভাবে দলটিকে আবার পুনর্বাসন করার অপচেষ্টা বা ষড়যন্ত্র করছেন। কিন্তু দেড় সহস্রাধিক মানুষের মৃত্যু এবং প্রায় ৩০ হাজার মানুষ আহত হওয়ার পর বাংলাদেশের জনগণ কোনোভাবেই দলটিকে পুনর্বাসন করতে দেবে না।

আরেক প্রশ্নে উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ বলেন, যাঁরা গণহত্যার জন্য দায়ী এবং পলাতক আছেন, তাঁদের ফিরিয়ে আনার জন্য অন্তর্বর্তী সরকার সব ধরনের ব্যবস্থা নেবে। আইন অনুযায়ী এবং বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বন্দিবিনিময়ের যে চুক্তি বাংলাদেশের আছে, সে চুক্তি অনুযায়ী পলাতক আসামিদের ফিরিয়ে আনার জন্য যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: সমন বয়ক জ ল ই গণ ৫ আগস ট তৎক ল ন উপদ ষ ট র জন য সরক র আওয় ম

এছাড়াও পড়ুন:

যশোরে চাচাত ভাইকে হত্যার দায়ে ২ জনের মৃত্যুদণ্ড 

যশোরের ঝিকরগাছায় উপজেলায় চাচাত ভাইকে হত্যার দায়ে দুই ভাইয়ের মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দিয়েছেন আদালত। মৃতুদণ্ডের পাশাপাশি প্রত্যেককে ১০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়।

সোমবার (২৪ নভেম্বর) অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ পঞ্চম আদালতের বিচারক জুয়েল অধিকারী এ রায় ঘোষণা করেন।

আরো পড়ুন:

চট্টগ্রামে থানায় পুলিশ কর্মকর্তার ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার 

কুষ্টিয়ায় কৃষককে গুলি করে হত্যায় মামলা

দণ্ডপ্রাপ্তরা হলেন, ঝিকরগাছা উপজেলার শংকরপুর ইউনিয়নের ছোট পোদাউলিয়া গ্রামের দুই ভাই ওসমান ও আলী হোসেন। তারা মৃত ছবেদ আলী সরদারের ছেলে। একই সঙ্গে দণ্ডপ্রাপ্ত ওসমানের স্ত্রী খাদিজা খাতুনকে খালাস দেওয়া হয়েছে।

অতিরিক্ত পিপি আজিজুল ইসলাম এ তথ্য জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘‘হত্যা মামলায় দুই বছরের মাথায় রায় প্রদান নজিরবিহীন। সরকার পক্ষ রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছে।’’ আসামি পক্ষ দাবি করেছে, তারা ন্যায় বিচার পাননি এবং উচ্চ আদালতে আপিল করবেন।

আদালত ও মামলা সূত্রে জানা যায়, ছোট পোদাউলিয়া গ্রামের নুরুল হকের ছেলে কামরুল আমিনের সঙ্গে তার চাচাত ভাই ওসমান ও আলী হোসেনের জমি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে বিরোধ চলছিল। ২০২৩ সালের ৭ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় নিজের জমিতে সীমানা প্রাচীর নির্মাণকে কেন্দ্র করে কামরুলের সঙ্গে ওসমান ও আলী হোসেনের বাগবিতণ্ডা হয়। এক পর্যায়ে ওসমান ও আলী হোসেন বাড়ি থেকে ধারালো দা এনে কামরুল আমিনকে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে জখম করে। তাকে বাঁচাতে গিয়ে কামরুলের বড় ভাইয়ের স্ত্রী আনোয়ারা, ছোট ভাইয়ের স্ত্রী পারভীন ও ভাইপো আতাউর রহমানও হামলার শিকার হন। চারজনকে কুপিয়ে জখম করে তারা পালিয়ে যায়। 

পরে স্থানীয়রা তাদের উদ্ধার করে ঝিকরগাছা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যায়। সেখানে অবস্থার অবনতি হলে চারজনকেই যশোর ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালে পাঠানো হয়। হাসপাতালে আনার পর কামরুলের মৃত্যু হয়। আহত তিনজনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

এ ঘটনায় নিহত কামরুলের বাবা রুহুল আমিন সরদার তিনজনের বিরুদ্ধে ঝিকরগাছা থানায় মামলা দায়ের করেন। মামলাটি তদন্ত শেষে ২০২৪ সালের ৩ জুলাই ঝিকরগাছা থানার উপ-পরিদর্শক বনি ইসরাইল আদালতে চার্জশিট জমা দেন।

ঢাকা/রিটন/বকুল 

সম্পর্কিত নিবন্ধ