মুক্তিযুদ্ধের বয়ানে জামায়াতের সমস্যা
Published: 30th, January 2025 GMT
মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী একবার বলেছিলেন, ‘নীল নদের পানি যেমন নীল নয়; জামায়াতের ইসলামও ইসলাম নয়।’ ধান ভানতে শিবের গীতের মতো মনে হলেও সম্প্রতি ইসলামী ছাত্রশিবিরের প্রকাশনায় মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে যে ‘বয়ান’ পাওয়া গেল, তার জবাব দিতে গিয়ে মজলুম জননেতা ভাসানীর বক্তব্য শুরুতেই উল্লেখ করলাম।
ইসলামী ছাত্রশিবিরের মাসিক প্রকাশনা ‘ছাত্র সংবাদ’-এর এক প্রবন্ধে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে যে বক্তব্য ছাপা হয়েছে, তাতে স্পষ্ট– এটি বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতি কটাক্ষ। প্রকাশনাটির ডিসেম্বর সংখ্যায় প্রকাশিত ওই প্রবন্ধে ‘মুসলিমরা না বুঝে মুক্তিযুদ্ধে জড়িয়েছিল’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। তাতে বলা হয়, ‘সে সময়ে অনেক মুসলিম না বুঝে মুক্তিযুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিল, এটা তাদের ব্যর্থতা ও অদূরদর্শিতা ছিল। আল্লাহ তাদের ক্ষমা করুন।’ এ নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে বিতর্কের ঝড় ওঠার পরে ছাত্রশিবিরের পক্ষ থেকে এটাকে শুরুতে ‘লেখকের দায়’ বলে বর্ণনা করা হয়। অন্যদিকে প্রবন্ধের লেখক বলেছেন, গবেষণার ভিত্তিতে তিনি সঠিক লিখেছেন। লেখা প্রত্যাহার নিয়ে ভাবছেন না। তবে সব শেষ এ প্রসঙ্গে পত্রিকাটির নিজস্ব ফেসবুক পেজে বলা হয়, ‘ছাত্র সংবাদ ডিসেম্বর ২০২৪ সংখ্যায় যুগে যুগে স্বৈরাচার ও তাদের করুণ পরিণতি শিরোনামে প্রকাশিত একটি লেখার কয়েকটি লাইন নিয়ে সম্প্রতি বিতর্ক তৈরি হওয়ায় উক্ত লেখাটি পত্রিকা থেকে প্রত্যাহার করে নেওয়া হলো। অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে প্রকাশিত এই লেখার জন্য সম্পাদকমণ্ডলীর পক্ষ থেকে আমরা দুঃখ প্রকাশ করছি।’
পুরো ঘটনায় লক্ষণীয় বিষয় হলো, প্রথমে মিথ্যাকে ইতিহাস বলে উল্লেখ করা, পরে বিতর্কের মুখে লেখা প্রত্যাহার করে নিলেও ছাত্রশিবির একাত্তরে নিজেদের পূর্বসূরিদের কৃতকর্মের জন্য ভুল স্বীকার করেনি। ক্ষমাও চায়নি। কেবল লেখা প্রকাশকে অনাকাঙ্ক্ষিত হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
দেশের বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় এটাকে দুইভাবে দেখা যায়। প্রথমত, ৫ আগস্টের পরে মাঠের বেশ কিছু কর্মসূচি দিয়ে দীর্ঘদিন পরে শিবির প্রকাশ্যে এসেছে। মুক্তিযুদ্ধ প্রশ্নে বিতর্কে জড়িয়ে তাই নিজেদের অতীত টেনে আনার মধ্য দিয়ে নতুন করে চাপে পড়তে চাইছে না। দ্বিতীয়ত, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে জামায়াতের ভালো সম্পর্ক রয়েছে– এমন প্রচারণা যাতে বাধাগ্রস্ত না হয়, সে বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া হলো মূলত লেখাটি প্রত্যাহার করার মধ্য দিয়ে।
তবে সরকারে থাকা ছাত্র প্রতিনিধি অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা মাহফুজ আলম ফেসবুক পোস্টে যেভাবে বলেছেন, ‘মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশের জন্মকে স্বীকার করেই এ দেশে রাজনীতি করতে হবে’; তাতে জোটগত রাজনৈতিক সুবিধা পাওয়ার বিষয়ে এক ধরনের হুমকিতে পড়ল জামায়াত।
একাত্তর প্রশ্নে জামায়াতে ইসলামীর ভূমিকা ও বর্তমান মূল্যায়ন শুধু তাদের ছাত্র সংগঠনের প্রকাশনা থেকে লেখা প্রত্যাহার দিয়ে বিবেচনা করা যাবে না। বিশেষ করে দলটির প্রধান ডা.
আমরা যেমন জানি, একাত্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করে পাকিস্তানের পক্ষ নিয়েছিল জামায়াত। দলটির তৎকালীন নেতারা শান্তি কমিটিতে ছিলেন। জামায়াত নেতাকর্মী রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনীতেও ছিলেন। তবে জামায়াত বারবারই বলে আসছে, একাত্তরে দলটি ‘অখণ্ড পাকিস্তান’-এর পক্ষে থাকলেও নেতাকর্মীর কেউ বাঙালি নিধন এবং যুদ্ধাপরাধে জড়িত ছিলেন না। জামায়াতের ভূমিকা ছিল রাজনৈতিক। এখন তাহলে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে, একাত্তরে জামায়াতের রাজনৈতিক ভূমিকাটা আসলে কী ছিল? সেটা কি বাংলাদেশের পক্ষে ছিল? যদি বাংলাদেশের পক্ষে না থাকে, তাহলে দলটি এখন ক্ষমা চাইবে না কেন?
একাত্তরে যারা জন্মগ্রহণ করেননি, যারা একাত্তরে জামায়াতের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না, তারা চাইলেই কিন্তু জামায়াতের একাত্তরের দায় থেকে মুক্তি পেতে পারেন। ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল ছিলেন। জামায়াতের মধ্যে উদারপন্থি বিবেচনা করা হতো তাঁকে। ২০১৯ সালের শুরুর দিকে তিনি দল থেকে পদত্যাগ করেছিলেন। তার পর তিনি যে সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়েছিলেন, তাতে বলেছিলেন, জামায়াত ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করার জন্য জনগণের কাছে ক্ষমা চায়নি। মুক্তিযুদ্ধে জামায়াতের ভূমিকা সম্পর্কে দায়দায়িত্ব গ্রহণ করে ক্ষমা চাওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন তিনি।
ব্যারিস্টার রাজ্জাকের পদত্যাগে অনুপ্রাণিত হয়ে সেই সময়ে জামায়াতে ইসলামী থেকে পদত্যাগ করেছিলেন দিনাজপুরের খানসামা উপজেলার ভেড়ভেড়ী ইউনিয়ন জামায়াতের সাধারণ সম্পাদক মো. বখতিয়ার উদ্দিন। তিনি বলেছিলেন, জামায়াতে ইসলামী থেকে ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাকের পদত্যাগের খবরে ‘ভুল’ ভেঙেছে তাঁর। সেই ‘ভুল’ শোধরাতেই বখতিয়ার উদ্দিন পদত্যাগপত্র পাঠিয়েছিলেন। পদত্যাগপত্রে বখতিয়ার লিখেছেন, স্বাধীনতার অনেক পরে ১৯৭৭ সালে তাঁর জন্ম। ১৯৯০ সালে তিনি জামায়াতে যোগদান করেন। তিনি ইসলামী ছাত্রশিবিরের নীলফামারী জেলা সংগঠনের সভাপতি ছিলেন (প্রথম আলো, ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৯)।
ব্যারিস্টার রাজ্জাক যেমন জামায়াতের কেন্দ্রীয় নেতা ছিলেন, তেমনি দিনাজপুরের বখতিয়ার তৃণমূলের সংগঠক ছিলেন। এই দুটি পদত্যাগের মূল সুর কিন্তু একই ছিল– ভুল স্বীকার ও ক্ষমা প্রার্থনা। কিন্তু জামায়াত কেন তা স্বীকার করছে না? দলটির সারাদেশে ছড়িয়ে থাকা সমর্থক যারা রয়েছেন, তাদের একটি ভুল রাজনীতিতে দীক্ষা দিয়ে কোন গন্তব্যে পৌঁছাতে চান তারা?
মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের নেতৃত্ব থেকে বাদ দেওয়া, নতুন নামে দল গঠন করাসহ কিছু কর্মপন্থা নিয়ে জামায়াতের ভেতরে একটি অংশ সক্রিয় বলে শোনা যায়। তৎপর রয়েছে কট্টরপন্থি অংশও। একটি অংশ একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতার ঐতিহাসিক লজ্জা থেকে মুক্ত হতে চায়। নতুন কর্মী-সমর্থক টানতে দলটি কি নিজেকে লজ্জা থেকে মুক্ত করতে উদ্যোগী হবে না?
একাত্তরে জামায়াত দেশে গ্রহণযোগ্যতা পায়নি; ঘৃণার পাত্র হয়ে গিয়েছিল। ’৮০ কিংবা ’৯০ দশকে যে জন্ম নিয়েছে এবং জামায়াতের রাজনীতি করতে চায়, সে কেন জামায়াতের একাত্তরের বোঝা বহন করবে? কোনো দেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করে কেউ সে দেশের নেতৃত্ব দিয়েছেন– এ রকম ইতিহাস পৃথিবীর কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না। সেটা জর্জ ওয়াশিংটনের আমেরিকা কিংবা ভারতীয় উপমহাদেশ– কোথাও এমন নজির নেই। তাকাতে পারি শ্রীলঙ্কা ও মালয়েশিয়ার ইতিহাসের দিকেও। নিজ দেশের জন্মের বিরোধিতা করা জামায়াত তাই কতদূর যাবে– সেটা সহজেই অনুমান করা যায়।
এহ্সান মাহমুদ: সহকারী সম্পাদক, সমকাল; কথাসাহিত্যিক
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: র জন ত ক পদত য গ ইসল ম
এছাড়াও পড়ুন:
লবণ শ্রমিকদের নুন আনতে পান্তা ফুরায়
“প্রতিদিন সকাল ৬টা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত মাঠে কাজ করি। লবণ তুলি, বস্তা ভরি। কিন্তু যে মজুরি পাই, তা দিয়ে এক বেলার চাল-ডালও কেনা যায় না। লবণ চাষের কাজ করলেও আমাদের নুন আনতে পান্তা ফুরায়।”
এ কথা কক্সবাজারের কুতুবদিয়া উপজেলার তাবলেরচর এলাকার লবণ শ্রমিক জাহেদ আলমের। হাজারো লবণ শ্রমিক দিনভর কড়া রোদে ঘাম ঝরালেও মিলছে না ন্যায্য মজুরি। নিদারুণ কষ্টে দিনাতিপাত করছেন জাহেদ আলমের মতো শত শত লবণ শ্রমিক।
উত্তর ধুরুংয়ের লবণ চাষি রশীদ আহমদ বলেন, “এবার সাড়ে ৫ কানি জমিতে লবণ চাষ করেছি। এই বছর আবহাওয়া ভালো ছিল, উৎপাদনও হয়েছে। কিন্তু দাম পড়ে যাওয়ায় আমরা লোকসানে যাচ্ছি। প্রতিমণ লবণের উৎপাদন খরচ পড়ে ৩৫০ টাকার মতো, অথচ বিক্রি হচ্ছে ১৮০-১৮৫ টাকায়। এই লোকসান শ্রমিকদের মজুরিতেও প্রভাব পড়েছে।”
তিনি জানান, মজুরি দিতে না পারায় একদিকে শ্রমিকরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন, অন্যদিকে চাষিরাও হতাশ হয়ে পড়ছেন।
আরমান হোসেন নামে আরেক শ্রমিক বলেন, “লবণের কাজ করেই জীবিকা নির্বাহ করে আসছি। লবণের দাম কম পেলেই চাষিরা আমাদের পারিশ্রমিকের ওপর লোকসান চাপিয়ে দেয়। এতে আমরা ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হই। এই অনিয়ম দূর হোক।”
চাষিরা বলছেন, একদিকে জমির ইজারা, পলিথিন, লবণ পরিবহন, শ্রমিক মজুরি-সব খরচ বেড়েছে। অন্যদিকে বাজারে সিন্ডিকেট করে দাম নামিয়ে দেওয়া হয়েছে। ফলে প্রতি মণ লবণে তারা ১৭০ টাকার মতো লোকসান গুণছেন। এই লোকসানের কারণে লবণ শ্রমিকরাও দিশেহারা হয়ে পড়ছেন।
লেমশীখালীর চাষি বেলাল উদ্দিন আকাশ বলেন, ‘‘গত বছর এই সময় প্রতি মণ লবণ বিক্রি করেছি ৪৫০ টাকায়। এখন পাই ১৮৫ টাকা। এতে শ্রমিকের মজুরি দিতেও আমরা হিমশিম খাচ্ছি।”
চাষি আবুল বশর ও সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘‘সিন্ডিকেট করেই দাম নামিয়ে দেওয়া হচ্ছে যাতে লবণ উৎপাদন কমে যায়। পরে বিদেশ থেকে লবণ আমদানি করার সুযোগ তৈরি হয়। অথচ এতে মাঠের হাজারো শ্রমিকের জীবিকা হুমকির মুখে পড়ছে।”
মহেশখালী লবণ চাষি ঐক্য সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি শাহাব উদ্দিন বলেন, ‘‘মজুরি না পেয়ে অনেক শ্রমিক লবণের মাঠ ছাড়ছেন। এইভাবে চলতে থাকলে শ্রমিক সংকট হবে।”
বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের (বিসিক) কক্সবাজার লবণশিল্প উন্নয়ন প্রকল্পের উপ-মহাব্যবস্থাপক মো. জাফর ইকবাল ভূঁইয়া বলেন, “চাষিদের ন্যায্য দাম না পাওয়ার কারণে উৎপাদনে অনীহা দেখা দিচ্ছে। এর ফলে শ্রমিকদেরও চাহিদা কমে যাচ্ছে। বাজারে দাম কমে যাওয়ার পেছনের কারণ খতিয়ে দেখা হচ্ছে।”
বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের (বিসিক) তথ্য অনুযায়ী, চলতি মৌসুমে কক্সবাজার জেলার সদর, কুতুবদিয়া, মহেশখালী, পেকুয়া, চকরিয়া, ঈদগাঁও, টেকনাফ এবং চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলায় প্রায় ৬৮ হাজার একর জমিতে লবণ চাষ হচ্ছে। গত ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত এসব অঞ্চলে উৎপাদিত হয়েছে ১ লাখ ৩৫ হাজার মেট্রিক টন লবণ। মৌসুম শেষে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ২৬ লাখ ১০ হাজার মেট্রিক টন, যা দেশের বার্ষিক চাহিদার সমান।