জেলা প্রশাসক (ডিসি) হিসেবে পদায়ন পেয়ে গত সরকারের আমলে বেপরোয়া দুর্নীতি ও অনিয়মে জড়িয়ে পড়েছিলেন কোনো কোনো উপসচিব। কোটি কোটি টাকার দুর্নীতির অভিযোগ উঠলেও সরকারের শীর্ষ মহলের প্রশ্রয়ে পার পেয়ে গেছেন তারা। ন্যূনতম তদন্তও হয়নি। আবার কারও কারও দুর্নীতি তদন্তের নামে দেওয়া হয়েছিল ধামাচাপা। চাকরির মেয়াদ শেষের দিকে তাদের প্রায় সবাই প্রশাসনের শীর্ষস্থানীয় পদ সচিব ও সিনিয়র সচিব হিসেবে পদোন্নতি পেয়েছেন।

কোটি কোটি টাকার দুর্নীতি, সরকারি সম্পত্তি বেদখলে সহায়তা, নিয়োগের ক্ষেত্রে ঘুষ গ্রহণ, ভূমি অধিগ্রহণের অর্থ আত্মসাৎ, ভ্রাম্যমাণ আদালতের অপব্যবহার থেকে শুরু করে নারী কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে পড়েন ডিসিদের কেউ কেউ। তাদের কারণে জনপ্রশাসনের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে। এসব কর্মকর্তার আমলনামা খুঁজতে এখন মাঠে নেমেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ও জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থা। 
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, আওয়ামী লীগ সরকারের সময় ডিসি পদে দায়িত্ব পালনকারী ১২০ জন কর্মকর্তার দুর্নীতি তদন্তে সম্প্রতি দুদক ও জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থাকে চারটি চিঠি দিয়েছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। এর মধ্যে একটি তালিকায় বাধ্যতামূলক অবসর দেওয়া পাঁচজন অতিরিক্ত সচিব, একটি তালিকায় আটজন সাবেক বিভাগীয় কমিশনার, আরেকটি তালিকায় ৪৩ জন সাবেক ডিসি, অন্য তালিকায় ৬৪ জন সাবেক ডিসি রয়েছেন।

পৃথক চিঠিতে এসব কর্মকর্তার বিষয়ে বর্তমানে দুর্নীতি-সংক্রান্ত কোনো অভিযোগ বা বিষয় তদন্তাধীন আছে কিনা, থাকলে এর তথ্য, না থাকলে দুর্নীতি-সংক্রান্ত বিষয়ে অনুসন্ধান করে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ এবং এ-সংক্রান্ত তথ্যসহ জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে হালনাগাদ প্রতিবেদন পাঠানোর জন্য দুদক চেয়ারম্যানকে অনুরোধ করেছে মন্ত্রণালয়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড.

মোখলেস উর রহমান সমকালকে বলেন, ‘ডিসি তো বটেই, আওয়ামী লীগ আমলে আরও যেসব কর্মকর্তা বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে যুক্ত ছিলেন তাদের সবার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

একাধিক সূত্রে জানা গেছে, মানিকগঞ্জের সাবেক ডিসি রেহেনা আকতারের বিরুদ্ধে দায়িত্ব পালনকালে বালুমহাল থেকে মোটা অঙ্কের কমিশন আদায় এবং লোকাল রিলেশন্স (এলআর) ফান্ডের নামে কোটি কোটি টাকা নেওয়ার অভিযোগ উঠেছিল। বালুমহাল ইজারা থেকে ৫% কমিশন হিসাবে কয়েক কোটি টাকা নিয়েছেন তিনি। রেহেনা আকতার ২০২৩ সালের ২৪ জুলাই মানিকগঞ্জে যোগদান করেন। জানা যায়, গত ৩০ মে মানিকগঞ্জে ৭টি বালুমহাল ২১ কোটি ৪৩ লাখ ৮১ হাজার ৬১১ টাকা মূল্যে ইজারা দেওয়া হয়। সেই বালুমহালের কার্যাদেশ আটকে রেখে ইজারাদারদের কাছ থেকে ৫ শতাংশ কমিশন আদায় করেন ডিসি। এর আগে ২০২৩ সালে এসব বালুমহাল থেকে ৩ শতাংশ কমিশন নেন। এই কমিশন বাণিজ্যে ডিসি রেহেনা আকতারের সহকারী (সিএ) শরীফ এবং অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) শাখার সিএ বজলু জড়িত ছিলেন বলে জানা গেছে। এ ছাড়া বিভিন্ন হাট-ঘাট ইজারা, লঞ্চ-বাস-ট্রাকসহ পরিবহন সংগঠন, ইটভাটা, জলমহালসহ বিভিন্ন ক্রয় কমিটি থেকে কমিশন নিয়েছেন এই ডিসি। বিভিন্ন চাকরির নিয়োগেও বিপুল টাকা ঘুষ নিয়েছেন। তবে এসব অভিযোগের কোনো তদন্ত করেনি সরকার। সাবেক ছাত্রলীগ নেত্রী রেহেনা ডিসি থাকাকালে স্থানীয় এমপিদের সঙ্গে মিলে টেন্ডারবাজি ও ঘুষ-দুর্নীতিতে জড়িত ছিলেন। 

বড় ধরনের দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে চট্টগ্রামের সাবেক ডিসি আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামানের বিরুদ্ধেও। গত জানুয়ারিতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে চট্টগ্রামের বৈষম্যবিরোধী সাংবাদিক ঐক্যের পাঠানো অভিযোগপত্রে বলা হয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্রলীগ নেতা ফখরুজ্জামানকে ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের জন্য ২০২২ সালের ডিসেম্বরে চট্টগ্রামে ডিসি হিসেবে পাঠানো হয়। ভোটারবিহীন নির্বাচন আয়োজনে নির্বাচন কমিশনকে সরাসরি সহায়তা দিয়েছেন তিনি। এ ছাড়া আর্থিক অনিয়ম-দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েন। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের অনৈতিক কাজে ব্যবহার করেন।

আরেক প্রভাবশালী ডিসি মুকেশ চন্দ্র বিশ্বাস ছিলেন ঠাকুরগাঁওয়ে। যত্রতত্র ঘুষ গ্রহণ, কর্মচারীদের হয়রানিসহ তাঁর বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ করেন ডিসি অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। তাদের লিখিত অভিযোগ তদন্ত করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের মাঠ প্রশাসন শাখা। অভিযোগে ওঠে মুকেশ চন্দ্র যোগদানের পর থেকে ডিসি কার্যালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিভিন্নভাবে হয়রানি করেছেন। হয়রানি থেকে মুক্তি পাওয়ার একমাত্র পথ তাঁর স্ত্রী বিউটি বিশ্বাসের হাতে টাকা তুলে দেওয়া। ডিসির স্ত্রীর কথামতো কেউ কাজ না করলে তাঁকে হয়রানি করা হয়।
আরেক ডিসি রুহুল আমিন ছিলেন কক্সবাজারে। সেখানে মহেশখালীর মাতারবাড়ীর কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ প্রকল্পের প্রায় ২০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেন তিনি। এ-সংক্রান্ত মামলায় তিনি এখন কারাগারে। গত ২৩ জানুয়ারি রুহুল আমিন, সাবেক জেলা ও দায়রা জজ সাদিকুল ইসলাম তালুকদারসহ পাঁচজনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন আদালত।
দুদকের মামলায় কারাগারে রয়েছেন যশোরের সাবেক ডিসি মুহিবুল হকও। এই দাপুটে আমলা গত সরকারের আমলে হয়েছিলেন সচিবও। গত বছরের ২০ নভেম্বর রাত ১১টার দিকে রাজধানীর মহাখালীর ডিওএইচএস থেকে তাঁকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। যুবদল নেতা শামীম হত্যার ঘটনায় পল্টন থানার মামলায় পরদিন তাঁকে কারাগারে পাঠানো হয়। এর পর তাঁকে দুদকের মামলাসহ কয়েকটি মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়।

দুর্নীতিতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত ছিলেন রাজশাহীর সাবেক ডিসি আবদুল জলিলও। তাঁর বিরুদ্ধে নিয়োগে অনিয়ম দুর্নীতির অভিযোগে তদন্ত শুরু হয়েছে। নিয়োগ বাণিজ্যে জড়িয়ে তিনি কোটি কোটি টাকা কামিয়েছেন। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের নির্দেশে রাজশাহীর অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার ইমতিয়াজ হোসেন তদন্ত করেন। তবে তদন্তে তাঁকে বাঁচিয়ে দেওয়া হয়।
২০১৬ সালে নরসিংদীর ডিসি ছিলেন আবু হেনা মোরশেদ জামান। সে সময় নরসিংদী জেলা শিল্পকলা একাডেমি মিলনায়তনে ভূমি, গ্যাস, পাসপোর্ট, বিআরটিএ, সদর হাসপাতালসহ ১০টি সেবা খাতে অনিয়ম ও দুর্নীতি নিয়ে দুদকের এক গণশুনানিতে ডিসির বিরুদ্ধে একের পর এক অভিযোগ তোলেন উপস্থিত লোকজন। ভুক্তভোগীদের শান্ত করতে গণশুনানি মঞ্চেই আবু হেনা মোরশেদ জামানের বিরুদ্ধে অনুসন্ধানের ঘোষণা দেন দুদকের সেই সময়ের কমিশনার ড. নাসির উদ্দীন আহমেদ। গণশুনানিতে জেলা প্রশাসকের বিরুদ্ধে জেলা সদরের অস্তিত্বহীন ক্যান্ডেল লাইট স্কুল অ্যান্ড কলেজের নামে কম দামে ৮৫ শতাংশ জমি বরাদ্দ দেওয়ার অভিযোগ তুলে ধরেন সংশ্লিষ্টরা। ২০ থেকে ৩০ কোটি টাকা দামের পুকুর শ্রেণির ওই জমিকে ভিটে শ্রেণি উল্লেখ করে বরাদ্দ দেওয়ার প্রক্রিয়া করা হয়। এ ছাড়া অভিযোগ করা হয় জাতীয়ভাবে বেগম রোকেয়া পদক দেওয়ার ক্ষেত্রে নরসিংদী জেলার কোনো নারীর নাম প্রস্তাব না করে ক্ষমতার অপব্যবহার করে চট্টগ্রাম এলাকার বাসিন্দা তাঁর মা দিল আফরোজের নাম প্রস্তাব করেছিলেন। 

২০১৮ সালে সরকারি তহবিলের ১৪ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ ওঠে কিশোরগঞ্জের সাবেক ডিসি মো. আজিমুদ্দিন বিশ্বাসের বিরুদ্ধে। সাবেক ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তা (এলএও) সেতাফুল ইসলাম ১৬৪ ধারায় ডিসির বিরুদ্ধে জবানবন্দি দেন আদালতে। স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে সেতাফুল ইসলাম জানিয়েছেন, জেলা প্রশাসক ও অতিরিক্ত জেলা প্রশাসকের (রাজস্ব) কথামতো তারা দু’জনসহ  কয়েকজন কর্মকর্তার যোগসাজশে তিনি টাকা আত্মসাৎ করেছেন এবং এই  টাকার বেশির ভাগ অন্যরা নিয়ে গেছেন।
২০১৩ সালে সুনামগঞ্জের ডিসি মুহাম্মদ ইয়ামিন চৌধুরীর বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগে আদালতে মামলা করেন দুই ব্যক্তি। এই কর্মকর্তারও কিছুই হয়নি। 

তদন্তের নামে অভিযোগ ধামাচাপা
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দাপুটে একাধিক ডিসির বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উঠলেও তদন্তের নামে অভিযোগগুলো ধামাচাপা দেওয়া হয়। বরিশালের সাবেক ডিসি ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সময়ে তাঁর কার্যালয়ে সংযুক্ত যুগ্ম সচিব মনির হোসেনের বিরুদ্ধে অভিযোগ বরিশাল বিভাগীয় কমিশনারকে তদন্ত করতে চিঠি দেওয়া হয়। গাজীপুরের সাবেক জেলা প্রশাসক এ এ আলম, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক বেগম ফারজানা মান্নানের বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্ত করেন ঢাকা বিভাগীয় কমিশনার। নরসিংদীর সাবেক ডিসি আবু হেনা মোর্শেদ জামানের বিরুদ্ধেও তদন্ত করেন ঢাকা বিভাগের কমিশনার। কিশোরগঞ্জের সাবেক ডিসি সিদ্দিকুর রহমানের বিরুদ্ধেও দুর্নীতির তদন্ত করেন এই কমিশনার। বান্দরবান পার্বত্য জেলার ডিসি দিলীপ কুমার বণিকের বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্ত করেন চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার। গাইবান্ধার সাবেক জেলা প্রশাসক আব্দুস সামাদের বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় (স্মারক নম্বর-৪৮৭) এবং রংপুরের জেলা প্রশাসক মুহাম্মদ ওয়াহিদুজ্জামানের বিরুদ্ধে তদন্ত করতে দেওয়া হয়েছিল রংপুর বিভাগীয় কমিশনারকে। টাঙ্গাইল ও কুড়িগ্রামের সাবেক ডিসি নুরুল ইসলামের বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্ত করেন রংপুর বিভাগীয় কমিশনার। জয়পুরহাটের সাবেক জেলা প্রশাসক মো. আ. রহিমের বিরুদ্ধে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় (স্মারক নম্বর-২২৭) রাজশাহী বিভাগীয় কমিশনারকে তদন্ত করতে দেওয়া হয়। লালমনিরহাটের সাবেক ডিসি হাবিবুর রহমানের বিরুদ্ধে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় (স্মারক নম্বর-২২৪) রংপুর বিভাগীয় কমিশনারকে তদন্তের দায়িত্ব দেয়। চট্টগ্রামের সাবেক ডিসি সামসুল আরেফিন, সাবেক অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক আব্দুল জলিল এবং লক্ষ্মীপুরের সাবেক ডিসি এ কে এম টিপু সুলতানের বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয় চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনারকে। সিলেটের সাবেক ডিসি জয়নাল আবেদীনের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ (স্মারক নম্বর-১৭৩) তদন্ত করেন সিলেট বিভাগীয় কমিশনার। অনুসন্ধানে জানা গেছে, এসব তদন্তের প্রতিটিতে সংশ্লিষ্ট ডিসিদের রেহাই দেওয়া হয়। পরে তারা ঊর্ধ্বতন পদে পদোন্নতিও বাগিয়ে নেন।

সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার জরুরি
দুর্নীতি প্রসঙ্গে জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ সাবেক সচিব এ কে এম আবদুল আউয়াল মজুমদার সমকালকে বলেন, ডিসি মাঠ প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদ। এ পদে দায়িত্ব পালনকালীন বিধিবিধানের বাইরে গিয়ে কাজ করলে বা অনিয়ম-দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়লে এর সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার হওয়া জরুরি। তা না হলে মাঠ প্রশাসনে ভুল বার্তা যাবে, অন্যরাও দুর্নীতিতে উৎসাহিত হবেন। বিলম্ব হলেও তদন্ত হতে বাধা নেই। তবে শুধু ডিসিদের দুর্নীতি নিয়ে তদন্ত হবে কেন? অন্য ক্যাডারের কর্মকর্তাদেরও দুর্নীতির তদন্ত হতে হবে। তিনি বলেন, ‘আমার ধারণা, টাকার অঙ্কে দুর্নীতির ব্যাপকতা অন্য ক্যাডারের কর্মকর্তাদেরও কম হবে না। তাই সব ক্যাডারের কর্মকর্তাদেরই দুর্নীতির বিচার হওয়া জরুরি।’


 

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: র কর মকর ত দ র কর মকর ত র তদন ত কর ন তদন ত র ল ইসল ম ব যবহ র ন ত করত সরক র র গ রহণ র আমল হয়র ন

এছাড়াও পড়ুন:

শ্রমিক অধিকার, আন্দোলন ও শ্রম সংস্কারের প্রস্তাবনার বাস্তবতা

মে দিবস শুধু একটি তারিখ নয়, এটি শ্রমজীবী মানুষের শতবর্ষব্যাপী সংগ্রাম, আত্মত্যাগ ও অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রতীক। ১৮৮৬ সালে শিকাগো শহরে শ্রমঘণ্টা নির্ধারণের দাবিতে আন্দোলনরত শ্রমিকদের রক্তে রঞ্জিত হয়েছিল দিনটি। আজ পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই দিনটি পালিত হয় শ্রমিকদের অধিকার ও মর্যাদার প্রতীক হিসেবে। বাংলাদেশেও মে দিবস পালিত হয় আনুষ্ঠানিকতা ও প্রতীকী উদ্‌যাপনের ভেতর দিয়ে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, দেশের শ্রমিকশ্রেণির জীবনমান, অধিকার ও কর্মপরিবেশ এখনো কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে পৌঁছায়নি। এই প্রবন্ধে মে দিবসের তাৎপর্য, বাংলাদেশের শ্রমিকদের বর্তমান অবস্থান, শ্রমিক আন্দোলনের ধারা ও শ্রম সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবের বাস্তবতা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে।

বাংলাদেশের শ্রমিকশ্রেণি: পরিসংখ্যান ও বাস্তবতা

বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বৃহৎ অবদান রাখা সত্ত্বেও শ্রমিকেরা চূড়ান্ত পর্যায়ের অবহেলা ও বঞ্চনার শিকার। দেশের প্রায় ছয় কোটি শ্রমজীবী মানুষের মধ্যে একটি বড় অংশ পোশাক কারখানা, নির্মাণ, পরিবহন, কৃষি ও সেবা খাতে যুক্ত। অনেকেই অনানুষ্ঠানিক খাতে কাজ করেন, যেখানে নেই কোনো সুনির্দিষ্ট চাকরির নিরাপত্তা, নেই শ্রমিককল্যাণ সুবিধা এবং নেই সংগঠনের অধিকার।

বিশেষ করে তৈরি পোশাক খাত, যেখানে প্রায় ৪০ লাখ শ্রমিক কাজ করেন, দেশের রপ্তানি আয়ের প্রায় ৮০ শতাংশ আসে এখান থেকে। কিন্তু এ খাতের শ্রমিকদের অধিকাংশই পান না যথোপযুক্ত মজুরি। নিরাপদ কর্মপরিবেশের অভাবে প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটে, যেমন রানা প্লাজা ধস কিংবা তাজরীন ফ্যাশনসের আগুন।

শ্রমিকসংগঠন ও আন্দোলনের ধারা

বাংলাদেশে শ্রমিক আন্দোলনের একটি ঐতিহাসিক ঐতিহ্য রয়েছে। পাকিস্তান আমলে শ্রমিকেরা বিভিন্ন আন্দোলনের মাধ্যমে শ্রমঘণ্টা নির্ধারণ, মজুরি বৃদ্ধির দাবি আদায় করেছিলেন। স্বাধীনতা–পরবর্তীকালে শ্রমিক ইউনিয়নগুলোর ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ হলেও পরবর্তী সময়ে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রভাব, সুবিধাবাদী নেতৃত্ব ও বিভক্তি শ্রমিক সংগঠনগুলোকে দুর্বল করে দেয়।

বর্তমানে শ্রমিক আন্দোলনের ক্ষেত্রে দুটি চিত্র স্পষ্ট—একদিকে কিছু আন্তরিক ও ত্যাগী শ্রমিকনেতা শ্রমিকদের অধিকার আদায়ে লড়ছেন; অন্যদিকে কিছু নেতার ব্যক্তিস্বার্থ ও রাজনৈতিক যোগসূত্র আন্দোলনকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলেছে। এ কারণে শ্রমিকদের প্রকৃত স্বার্থ উপেক্ষিত থেকে যাচ্ছে এবং অনেক ক্ষেত্রেই শ্রমিকেরা আস্থা হারাচ্ছেন সংগঠনের প্রতি।

সরকার ও শ্রমিকনীতি

বাংলাদেশ সরকার শ্রমনীতি প্রণয়নের মধ্য দিয়ে শ্রমিকদের অধিকার রক্ষা ও কর্মপরিবেশ উন্নয়নের অঙ্গীকার করলেও বাস্তবে তা অনেক সময়েই কার্যকর হয় না। আইএলও কনভেনশন অনুযায়ী, শ্রমিকদের সংগঠিত হওয়ার, মজুরি নিয়ে দর-কষাকষি করার অধিকার থাকলেও বহু ক্ষেত্রে এই অধিকার চর্চা করতে গিয়ে শ্রমিকেরা হয়রানির শিকার হন।

অনেক মালিক প্রতিষ্ঠানে ট্রেড ইউনিয়ন গঠনকে ভয় পান। অনেক ক্ষেত্রে শ্রমিকদের সংগঠনের চেষ্টা দমন করতে তাঁদের ছাঁটাই করা হয়, ভয়ভীতি দেখানো হয়; এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে হয়রানি, হামলা বা মামলা দেওয়া হয়। আর তাই শ্রমিকেরা সংগঠিত হওয়ার আগে দশবার ভাবেন।

শ্রম সংস্কার কমিশনের প্রস্তাব: আশার আলো নাকি প্রতীকী পদক্ষেপ?

সম্প্রতি গঠিত শ্রম সংস্কার কমিশন বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাবনা দিয়েছে, যা বাস্তবায়িত হলে শ্রমিকদের জীবনমানে ইতিবাচক পরিবর্তন আসতে পারে। কমিশনের প্রস্তাবনার মধ্যে রয়েছে–

১. তিন বছর পরপর জাতীয় মজুরি নির্ধারণ করা, ২. বার্ষিক মূল্যস্ফীতির ভিত্তিতে মজুরি সমন্বয়, ৩. সময়মতো বেতন না দিলে ক্ষতিপূরণ, ৪. শ্রমিকদের জন্য আপৎকালীন তহবিল গঠন, ৫. ট্রেড ইউনিয়ন গঠনের শর্ত শিথিল, ৬. আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে কর্মী নিয়োগ বন্ধ, ৭. মাতৃত্বকালীন ছুটি ছয় মাসে উন্নীত করা, ৮. শ্রম আদালতকে আধুনিকায়ন ও সংস্কার ও ৯. শ্রম আইন সংশোধনের মাধ্যমে ট্রাইব্যুনালের ক্ষমতা বাড়ানো।

এই প্রস্তাবগুলো অনেকাংশেই সময়োপযোগী ও শ্রমিকবান্ধব। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এ প্রস্তাব বাস্তবায়নে সরকার কতটা আন্তরিক? অতীত অভিজ্ঞতা বলে, নীতিগত সিদ্ধান্ত অনেক সময়ই মাঠপর্যায়ে এসে বাস্তবায়িত হয় না। আইন থাকলেও তার প্রয়োগ দুর্বল থাকে। আবার মালিকদের সংগঠন যেকোনো সংস্কারমূলক পদক্ষেপকে ব্যাহত করতে সক্রিয় থাকে।

শ্রম সংস্কারের চ্যালেঞ্জ

প্রথমত, শ্রমিকদের সংগঠিত হওয়ার অধিকার নিশ্চিত না হলে কোনো সংস্কারই বাস্তব ফল দেবে না। দ্বিতীয়ত, শ্রম আদালতের ধীরগতি, মামলার জট ও রায় কার্যকর না হওয়া শ্রমিকদের ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত করে। তৃতীয়ত, শ্রম আইন প্রয়োগে যাঁরা দায়িত্বে আছেন, যেমন শ্রম পরিদর্শক বা প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষ— তাঁদের প্রশিক্ষণ, জনবল ও নিরপেক্ষতা অনেক সময়েই প্রশ্নবিদ্ধ।

এ ছাড়া নারী কর্মীদের জন্য নিরাপদ কর্মপরিবেশ, মাতৃত্বকালীন ছুটি, যৌন হয়রানিবিরোধী কার্যকর ব্যবস্থা এখনো অনেক প্রতিষ্ঠানে অনুপস্থিত। ট্রেড ইউনিয়নের নেতৃত্বেও নারীর অংশগ্রহণ খুবই সীমিত, যা একটি দুঃখজনক বাস্তবতা।

আশাবাদ ও করণীয়

তবু শ্রম সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবগুলো যদি আন্তরিকতার সঙ্গে বাস্তবায়ন করা যায়, তাহলে শ্রমিকদের সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত হতে পারে। এ জন্য দরকার রাজনৈতিক সদিচ্ছা, প্রশাসনিক দক্ষতা এবং মালিক-শ্রমিক অংশীদারত্বের ভিত্তিতে একটি স্বচ্ছ ও কার্যকর কাঠামো গঠন।

সরকারকে অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে, যেন কোনো শ্রমিককে সংগঠন গঠনের জন্য হেনস্তার শিকার না হতে হয়। ট্রেড ইউনিয়নগুলোকে প্রয়োজন আত্মসমালোচনা ও গণতান্ত্রিক সংস্কার। নেতৃত্বে প্রগতিশীল, শ্রমিকবান্ধব ও দূরদর্শী ব্যক্তিদের আনতে হবে। শ্রমিকদের সচেতনতা বাড়াতে প্রশিক্ষণ ও অধিকারবিষয়ক প্রচার চালাতে হবে।

সর্বোপরি, মালিক শ্রেণিকে বোঝাতে হবে যে শ্রমিকদের কল্যাণ শুধু নৈতিক দায়িত্ব নয়, অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার পূর্বশর্তও বটে। একটি কর্মিবান্ধব পরিবেশ কর্মক্ষমতা ও উৎপাদনশীলতা বাড়ায়, যা শেষ পর্যন্ত মালিকেরও লাভ।

উপসংহার

মে দিবসের চেতনা আমাদের শিক্ষা দেয় যে শ্রমিকের অধিকার কোনো দয়া নয়, এটি তাঁর প্রাপ্য। এই চেতনাকে ধারণ করে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। কেবল মে দিবসে ব্যানার, শোভাযাত্রা বা আনুষ্ঠানিকতা নয়, শ্রমিকের ন্যায্য মজুরি, নিরাপদ কর্মপরিবেশ, সংগঠনের অধিকার ও সামাজিক মর্যাদা নিশ্চিত করাই হোক আমাদের মূল অঙ্গীকার।

শ্রম সংস্কার কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নের মাধ্যমে আমরা যদি শ্রমিকদের উন্নত জীবনের ভিত্তি তৈরি করতে পারি, তবেই মে দিবস হবে অর্থবহ; আর বাংলাদেশ একটি মানবিক, ন্যায্য ও অন্তর্ভুক্তিমূলক রাষ্ট্রে পরিণত হবে।

সাহিদা পারভীন শিখা সাধারণ সম্পাদক জাতীয় নারী শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র

সম্পর্কিত নিবন্ধ