জীবনানন্দ দাশ এ রকম কবি ছিলেন না যে তার কবিতা আস্বাদন করার জন্য জীবনী কিংবা আত্মজীবনীর সাহায্য নিতে হয়। তবু দু’একটি বিষয়ে তার ব্যক্তিজীবন ও আত্মদর্শন প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে। এর একটি হলো ‘আট বছর আগের একদিন’ কবিতায় প্রতিফলিত মানুষের আত্মহননেচ্ছা। একবার আলোচনাক্রমে কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী মন্তব্য করেছিলেন যে ‘জীবনানন্দ দাশের আত্মঘাতী ক্লান্তি থেকে কবি রামেন্দ্র দেশমুখ্য মুক্ত’। ‘আট বছর আগের একদিন’ কবিতাটির নিরিখেই তিনি জীবনানন্দ’র বিরূদ্ধে ‘আত্মঘাতী ক্লান্তি’র অভিযোগ এনেছিলেন।
জীবনানন্দ দাশ এহেন অভিমত উপেক্ষা ক’রে লিখেছিলেন, ‘আত্মঘাতী ক্লান্তি’ আমার কবিতার প্রধান আবহাওয়া নয়, কোনোদিনই ছিল বলে মনে পড়ে না।’ তিরি আরও লিখেছিলেন, ‘কবিতাটি সাবজেকটিভ নয়, একটা ড্রামাটিক রিপ্রেজেন্টেশন মাত্র; কবিতাটি পড়লেই তা বোঝা যায়। হ্যামলেট, কিং লিয়ার বা ম্যাকবেথের ‘আত্মঘাতী ক্লান্তি’র সঙ্গে শেক্সপিয়রের যা সম্পর্ক, ও কবিতার ক্লান্তির সঙ্গে লেখকের সম্পর্কটুকুও সেই রকম। কবিতাটিতে সাবজেক্টিভ নোট শেষের দিকে ফুটেছে; কিন্তু সে তো লাশ-কাটা ঘরের ক্লান্তির বাইরে─অনেক দূরে─প্রকৃতির প্রাচুর্য ও ইতিহাসের প্রাণশক্তির সঙ্গে একাত্ম ক’রে আনন্দিত ক’রে রেখেছে কবিকে।’ তিনি অভিযোগের সুরে লিখেছিলেন, ‘নীরেনবাবু লাশ-কাটা ঘরের নায়ককে নায়কের স্রষ্টার সঙ্গে ওতপ্রোত ক’রে না জড়িয়ে কবিতাটি আস্বাদ করতে পারেন না মনে হয়।’
‘আট বছর আগের একদিন’ লিখেছিলেন ১৯৩৫ সালে। অন্য দিকে অবস্থার বিপাকে ১৯৪৭-৪৮ সালের দিনপঞ্জীর খাতায় জীবনানন্দের আত্মহননেচ্ছা বারংবার উচ্চারিত হয়েছে। তবু জীবনানন্দকে হতাশায় নিমজ্জিত কবি ব’লে মনে হতে পারে এরকম কবিতা খুঁজে পাওয়া দুষ্কর।
২.
এই দীর্ঘ ভূমিকা এ জন্যে যে ‘বনলতা সেন’ কবিতাটি প্রসঙ্গে আবার জীবনানন্দের ব্যক্তিজীবনের অতলে নাক গলাতে হচ্ছে। আবার সেই বিখ্যাত প্রশ্ন নিয়ে পড়তে হচ্ছে ‘কে এই বনলতা সেন’ যা ১৯৪০ এর দশক থেকে কবিতারসিকদের ভাবিয়ে এসেছে। জীবনানন্দের মতো আমাদেরও প্রতীতি এ কবিতার রসাস্বদনের জন্য বনলতা সেনের পরিচয় জানার কোনো প্রয়োজন নেই: ‘অন্য খোঁজে কী দরকার?’
বাংলা কবিতায় কাল্পনিক নারীচরিত্র ব্যবহারের প্রবণতা সৃষ্টির জন্য প্রখ্যাত সাহিত্যিক সজনীকান্ত দাস জীবনানন্দকেই দায়ী করেছিলেন। “কবিতা” পত্রিকার চৈত্র ১৩৪৩ সংখ্যায় প্রকাশিত ‘বেড়াল’ কবিতাটির আলোচনা প্রসঙ্গে তাঁর মন্তব্য, “এই প্রতিভাবান কবিদের আর একটি কৌশল─কবিতা লিখিতে লিখিতে অকস্মাৎ অকারণে এক-একজন ভদ্রলোকের মেয়ের নাম করিয়া আমাদিগকে উৎসুক ও উৎসাহিত করিয়া তোলেন। ‘ইকনমিক্স’ লিখিতে লিখিতে শ্রীযুক্ত বুদ্ধদেব বসু অকারণে ‘রানি’কে টানিয়া আনিয়াছেন, জাতক-এ শ্রীজ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র ‘সুরমা’ নামীয়া একটি ভদ্রমহিলাকে অত্যন্ত লজ্জা দিয়াছেন; এবং ‘বসন্তের গান’-এ শ্রীসমর সেন ‘মালতী রায়’ নামক কোনও কামিনীর ‘নরম শরীর’ লইয়া যাহা করিবার নয় তাহাই করিয়াছেন। ইহার সূত্রপাত হইয়াছে নাটোরের ‘বনলতা সেন’কে লইয়া।...”
জীবনানন্দ’র কাল্পনিক নারীদের আমরা চিনি: নানা নামে তারা জীবনানন্দের কবিতায় এসেছে। নানাভাবে নারীকে উপস্থাপন করেছেন জীবনানন্দ তাঁর কবিতায়। ‘সুরঞ্জনা’ কবিতায় লিখেছেন: ‘সুরঞ্জনা, আজও তুমি আমাদের পৃথিবীতে আছ/ পৃথিবীর বয়সিনী তুমি এক মেয়ের মতন/ কালো চোখ মেলে ঐ নীলিমা দেখেছ/ গ্রীক-হিন্দু-ফিনিশিয় নিয়মের রূঢ় আয়োজন শুনেছ ফেনিল শব্দে তিলোত্তমা-নগরীর গায়ে/ কী চেয়েছে? কী পেয়েছে?-গিয়েছে হারায়ে।’
‘লোকেন বোসের জর্নাল’ কবিতায় লিখেছেন: ‘সুজাতাকে ভালোবাসতাম আমিÑ/ এখনো কি ভালোবাসি?/ সেটা অবসরে ভাববার কথা,/ অবসর তবু নেই; / তবু একদিন হেমন্ত এলে অবকাশ পাওয়া যাবে; / এখন শেল্ফে চার্বাক ফ্রয়েড প্লেটো পাভ্লভ্ ভাবে / সুজাতাকে আমি ভালোবাসি কি না।’
লিখেছেন: ‘শ্যামলী, তোমার মুখ সেকালের শক্তির মতন।’ লিখেছেন: ‘সবিতা, মানুষজন্ম আমরা পেয়েছি মনে হয় কোনো এক বসন্তের রাতে।’ আরো লিখেছেন, ‘মনে পরে কবেকার পাড়াগাঁর অরুণিমা সান্যালের মুখ’ এবং ‘হীরের প্রদীপ জ্বেলে শেফালিকা বোস যেন হাসে হিজল ডালের পিছে অগণন বনের আকাশে’।
‘বনলতা সেন’ কবিতাটি প্রসঙ্গে প্রথম প্রশ্নটি হচ্ছে: বনলতা সেন কি ‘সুরঞ্জনা’, ‘শ্যামলী’, ‘সুজাতা’, ‘অরুণিমা সান্যাল’, ‘সুচেতনা’, ‘সরোজিনী’ প্রমুখের মতো আরেকজন কল্পিত নারী?
৩.
ভারতের জাতীয় গ্রন্থ কেন্দ্রে কবি জীবনানন্দ দাশের যে ৪৮টি কবিতার পাণ্ডুলিপির খাতা সংরক্ষিত আছে তার মধ্যে ৮ সংখ্যক খাতার সম্মুখ পৃষ্ঠায় কবির নিজের হাতে লেখা নেই কখন এবং কোথায় কবিতাগুলি রচিতহয়েছিল, নেই তার স্বাক্ষর। এ খাতাতেই রয়েছে ‘বনলতা সেন’। নানাদিক বিবেচনা ক’রে অনুমান করা হয়েছে এ কবিতাগুলি ১৯৩৪-এ লেখা। ভূমেন্দ্র গুহ, সুচরিতা দাশ বা অন্য কেউ─ হতে পারে তিনি গ্রন্থাগারের কোনো বিবেচক কর্মচারী─বড় অক্ষরে লিখে রেখেছেন: “কবিতা (৮) ১৯৩৪”।
জীবনানন্দ দাশ ‘বনলতা সেন’ কবিতাটি প্রকাশ করেছিলেন কবি বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত “কবিতা” পত্রিকার পৌষ, ১৩৪২ সংখ্যায় (১৯৩৫ খ্রিষ্টাব্দের ডিসেম্বরে প্রকাশিত)। সাত বছর পর ১৯৪২ সালের ডিসেম্বর মাসে (১৩৪৯) ক্ষুদ্রায়তন কাব্যগ্রন্থ “বনলতা সেন” প্রকাশিত হয়। এটি জীবানানন্দর তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ। ‘বনলতা সেন’ এ কাব্যের প্রথম কবিতা হিসাবে গ্রন্থর্ভূত হয়েছিল। অন্য ১১টি কবিতা হলো: ‘কুড়ি বছর পরে’, ‘ঘাস’, ‘হাওয়ার রাত’, ‘আমি যদি হতাম’, ‘হায় চিল’, ‘বুনোহাঁস’, ‘শঙ্খমালা’, ‘নগ্ন নির্জ্জন হাত’, ‘শিকার, ‘হরিণেরা’ এবং ‘বিড়াল’।
বনলতা সেন যদি কল্পনার নারী না-হয়ে বাস্তবের কোনো নারী হয়ে থাকেন, তবে তার সঙ্গে জীবনানন্দ দাশের পরিচয় হয়েছিল ১৯৩৪ এর আগে, কোনো এক সন্ধ্যাবেলায়।
৪.
গোপালচন্দ্র রায়ের জন্ম ১৯১৬ সালে। তিনি জীবনানন্দ’র প্রথম জীবনীকারদের মধ্যে সর্বাগ্রেগণ্য। তার ‘জীবনানন্দ’ গ্রন্থটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৭১ সালে (১৩৭৮)। মাসিক ‘ভারতবর্ষ’ পত্রিকার সহ-সম্পাদক ছিলেন। ১৯৫৩ সালের শুরুর দিকে জীবনানন্দ দাশের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। ডায়মণ্ড হারবার ফকির চাঁদ কলেজে ইংরেজির অধ্যাপক পদে চাকুরীর জন্য আবেদন করেছিলেন জীবনানন্দ দাশ। তাকে ইন্টারভিউ দিতে ডাকা হয়। সেদিন সিলেকশন বোর্ডের সদস্য হিসাবে গোপালচন্দ্র রায় উপস্থিত ছিলেন। তিনি ছিলেন জীবনানন্দ’র কবিতার একনিষ্ঠ পাঠক ও ভক্ত। তার হস্তক্ষেপে জীবনানন্দের চাকরি হয়ে যায়। ১৮৩, ল্যান্সডাউন রোড থেকে ডায়মণ্ড হারবার─অনেক দূরের পথ। শেষ পর্যন্ত জীবনানন্দ’র পক্ষে এ কলেজে চাকুরী করা হয়ে ওঠেনি। কিন্তু তিনি জেনে গিয়েছিলেন যে গোপালচন্দ্র তার পরম হিতৈষীদের একজন। হাওড়া গার্লস কলেজের অধ্যক্ষ বিজয়কৃষ্ণ ভট্টাচার্য গোপালচন্দ্র রায়ের বিশেষ পরিচিত ছিলেন। তার সুপারিশে হাওড়া গার্লস কলেজের ইংরেজি বিভাগের প্রধান হিসেবে জীবনানন্দ দাশের চাকুরী হয়ে যায়। ১৯৫৩ সালের ১লা জুলাই তিনি এ কলেজে যোগ দেন। মৃত্যু অবধি এ কলেজেই তিনি কাজ করেছেন।
অন্যান্য অনেকের মতো বনলতা সেনকে নিয়ে গোপালচন্দ্র রায়ের কৌতূহল ছিল। তিনি লিখেছেন, ‘এই কবিতাটি নিয়ে আমি একদিন জীবনানন্দকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম বনলতা নামে তার পরিচিতা কোনো মহিলা ছিল বা আছে কি-না। উত্তরে সেদিন তিনি কিছু না বলে শুধু মুচকি মুচকি হেসেছিলেন।’
কবি-পত্নী লাবণ্য দাশ মনে করতেন তিনিই কবিতায় উল্লেখিত বনলতা সেন─তিনিই কবিকে দু’ দণ্ডের শান্তি দিয়েছিলেন!
প্রথিতযশা অর্থনীতিবিদ ও চিন্তক ড. আকবর আলী খান ভেবেছিলেন: ‘বনলতা সেন’ কবিতায় নাটোর শহরের নামোল্লেখের সূত্রানুসন্ধান করা দরকার। শেষপর্যন্ত তিনি প্রস্তাব করেছিলেন নাটোর শহরে বনলতা সেন নামে একজন গণিকা ছিলেন যার সঙ্গে জীবনানন্দ দাশের সাক্ষাৎ হয়েছিল। এই প্রস্তাবের জন্য আকবর আলী খানকে অনেক গঞ্জনা সহ্য করতে হয়েছিল। তবে পরবর্তীকালে বর্তমান লেখকের কাছে তিনি বলেছিলেন: ‘বনলতা সেন একজন গণিকা ছিলেন তা প্রতিপন্ন করা আমার উদ্দেশ্য ছিল না। তবে ‘দু দণ্ডের শান্তি’ একটি বিশেষ ইঙ্গিতবহ শব্দসমষ্টি ব’লে মনে করা অন্যায্য হবে না।’
‘দু দণ্ডের শান্তি’ যে বিশেষ ইঙ্গিতবহন ক’রে সে বিষয়ে অনেকেই একমত। প্রশ্ন হচ্ছে: জীবনানন্দ কি দু দণ্ডের শান্তির প্রত্যাশী ছিলেন? গণিকাগমন কি দু দণ্ডের শান্তি?
‘সহজ’ শিরোনামীয় কবিতায় জীবনানন্দ লিখেছিলেন:
নিঃসঙ্গ বুকের গানে
নিশীথের বাতাসের মতো
একদিন এসেছিলে,
দিয়েছিলে এক রাত্রি দিতে পারে যত।
কে সেই নারী যিনি এক রাত্রিতে যতটুকু পারা যায় ততটুকু দিয়েছিলেন জীবনানন্দকে? হয়তো তার প্রকৃত নাম বনলতা সেন নয়, হয়তো তিনি নাটোরের কেউ নন─অন্য কোনো ঠিকানার অধিবাসিনী। কিন্তু তিনি রক্তমাংসের বাস্তব মানবী, যার সঙ্গে জীবনানন্দের ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল। জীবনানন্দ তার প্রেমে পড়েননি। প্রেমে পড়বার সুযোগ ছিল না। কিন্তু তার তৃষ্ণা মিটেছিল। এ ক্ষণিকের সান্নিধ্য ‘বনলতা সেন’ কবিতাটি লেখার আগে: ১৯৩৪ সালের আগে। এ সময় জীবনানন্দ বেকার। বরিশালে থাকছেন। আবার কলকাতায়ও যাচ্ছেন ও থাকছেন।
এই নারী কি কাকা অতুলানন্দ দাশের কিশোরী কন্যা শোভনা দেবী?
৫.
১৯৪৮ সালে লেখা দিনলিপিতে তিনি চার শ্রেণীর নারীর কথা উল্লেখ করেছেন─হেরোডিয়াসের কন্যারা, বনলতা সেন, কাল্পনিক নারী এবং বাসে দেখা কামিনীরা─যাদের কথা অবিস্মরণীয়। জীবনানন্দের জীবনে বনলতা সেন অবিস্মরণীয় এক নারী।
যৌবনের শুরু থেকেই যাদের ভালবাসা তিনি কামনা করতেন ডায়রীতে তাদের দুজনের নাম পাওয়া যায়। একজনকে চিহ্নিত করা হয়েছে ইংরেজি বর্ণমালায় ‘জেওয়াই’ লিখে, অন্যজনকে চিহ্নিত করা হয়েছে ওয়াই (কখনও বিওয়াই) লিখে। ভূমেন্দ্র গুহ আমাদের জানিয়ে গেছেন এই ওয়াই আর কেউ নয়, কাকা অতুলানন্দ দাশের কন্যা শোভনা যার ডাক নাম বেবী (বিএবিওয়াই)। ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে লাবণ্য দাশকে বিয়ের আগেই এই বালিকার প্রতি জীবনানন্দ গভীর অনুরাগ অনুভব করেছিলেন। একটি উপন্যাসে শচী নামেও তাকে দেখতে পাওয়া যায়। শোভনাকে (ওয়াই) নিয়ে জীবনানন্দের অনুরাগ উন্নীত হয়েছিল নিগূঢ় প্রেমে; লাবণ্য দাশের সঙ্গে দাম্পত্য জীবন আদৌ সুখকর না-হওয়ায় এই প্রেম ক্রমশঃ একপ্রকার অভিভূতিতে পর্যবসিত হয়েছিল। বিয়ে পরবর্তীকালে, ১৯৩০-এর মার্চের ১০ তারিখে দিনলিপিতে লিখেছেন: ‘─Dreams about Y : hwo difficult to crush & smother associations & seek an anodzne in L. : yet I am to do! : the harrowings of morns ─’এখানে ওয়াই হলো শোভনা বা বেবী এবং এল হলো স্ত্রী লাবণ্য।
কিন্তু জেওয়াই-এর পরিচয় আজও অনশ্চিত রয়ে গেছে। ১৯৪৭ সালের দিনলিপিতে জীবনানন্দ আক্ষেপ ক’রে লিখেছেন, জেওয়াই-এর কথা স্মরণ করে অবিরল স্বকাম তাকে দ্রুত বার্ধক্যের পথে নিয়ে গেছে। এই জেওয়াই কি জয়শ্রী সেন যার কথা আমরা শুনেছি? প্রদ্যুম্ন মিত্র জানিয়েছেন: নাটোরের মেয়ে জয়শ্রী সেনের বিয়ে হয়েছিল বরিশালে। পরে তিনি কলকাতায় স্থায়ী হয়েছিলেন।
জেওয়াই এবং ওয়াইকে হেরোডিয়াসের কন্যা হিসেবে উল্লেখ করেছেন জীবনানন্দ। এ দু’জনকে নিয়ে তার অভিভূতি ছিল। এরা দু’জন তার অনতিক্রম্য মানসিক যন্ত্রণার গভীর সূত্র।
হেরোডিয়াসের (সার্কা খৃষ্টপূর্ব ১৫ থেকে ৩৯ খৃস্টাব্দ) কন্যা ছিল একজন, বাইবেলে (নিউ টেস্টামেণ্ট) তার নাম অনুল্লেখিত। কিন্তু মানুষ তাকে সালোমে ব’লে চিহ্নিত করেছে। সেইন্ট জনের হত্যায় সালোমের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। জীবনানন্দের সালোমে দুইজন─একজন ওয়াই অর্থাৎ বেবী বা শোভনা। অপরজন জেওয়াই (ঔু)। জেওয়াই প্রকৃতপক্ষে কে তা জানা না গেলেও ঘনিষ্ঠ কেউ─যার নিয়মিত আসাযাওয়া ছিল ল্যান্সডাইন রোডের বাসায়। এদের সঙ্গে সাক্ষাৎ ঘটে গেলে কবির জীবন আরও তিক্ত হয়ে ওঠে: মরে যেতে ইচ্ছে করে। একদিন রাতে ঘুমোতে যাওয়ার আগে জীবনানন্দ তাঁর জীবনের পরিব্যাপ্ত হতাশার আটটি কারণ উল্লেখ করেছেন; যার মধ্যে একটি হলো নারী─যাদের মধ্যে হেরোডিয়াসের কন্যারা অন্যতম।
জীবানানন্দ স্মরণ করেছেন হেরোডিয়াসের কন্যাদের সঙ্গে সম্পর্ক কত না নিষ্ফলা এবং অর্থহীন, অথচ একদিন এরা তার মন ও চেতনা দখল ক’রে রেখেছিল: আগের বছর সেপ্টেম্বর কি অক্টোবরের এক রাত্রিতে যখন অন্য সবাই ঘুমিয়ে পড়েছিল সোফার ওপরে বসে জেওয়াই স্টাইনবেক পড়তে পড়তে এক সময় উঠে গেল। জেওয়াই উঠে যাওয়ার পর ওর কথা ভেবে হস্তমৈথুন করেছিলেন। জীবনানন্দ অনুতাপ ক’রে লিখেছেন, ‘আজ জানুয়ারী এবং ফেব্রুয়ারীর প্রেক্ষাপটে কত না অপচয় বলে মনে হয়।’
জীবনানন্দ’র ১৮৩ ল্যান্সডাউন রোডের বাসায় জেওয়াই আসে কিন্তু কখনও স্বামী (বা ছেলেকে) সঙ্গে না-নিয়ে আসে না। কিন্তু কেন সে একা আসে? জীবনানন্দ’র প্রতি সেই পুরোনো শীতলতা দেখিয়ে পাগলের মতো সে বারবার ছোট ভাই ভেবুলের (অশোকানন্দ) কথা শুধাতেই থাকে।─হেরোডিয়াসের কন্যাদের কারণে মাঝে মাঝে তার জীবন বিষিয়ে ওঠে। তিনি অসহায় বোধ করেন।
কবিতায় উল্লেখিত বনলতা সেন কোনো কল্পিত নারী নন। তিনি বাস্তবের শোভনা (বেবী) বা জয়শ্রী নন। তিনি লাবণ্য দাশ নন। তিনি অন্য কেউ।
৬.
জীবনের প্রৌঢ় প্রহরে একটি কবিতায় জীবনানন্দ দাশ তিনি লিখেছেন:
কোনো কোনো অঘ্রানের পথে পায়চারি করা শান্ত মানুষের
হৃদয়ের পথে ছাড়া মৃতেরা কোথাও নেই বলে মনে হয়
তাহলে মৃত্যুর আগে আলো অন্ন আকাশ নারীকে
কিছুটা সুস্থিরভাবে পেলে ভালো হত। (‘১৯৪৬-৪৭’)
আমাদের মনে হয় মৃত্যুর আগে অন্ন-নারী কোনোটিই জীবনানন্দ’র ভাগ্যে জোটেনি। বনলতা সেনকে তিনি পেয়েছিলেন, অল্প সময়ের জন্য হলেও। সেই মিলন অমিলন সুখস্মৃতি হিসেবে জীবনানন্দ লালন করেছেন।
স্বকাম তথা হস্তমৈথুনকে জীবনানন্দ তার দিনপঞ্জীতে কখনও কখনও করাপশান ব’লে উল্লেখ করেছেন। বিবাহিত জীবন সত্বেও স্বাভাবিক যৌনাকাক্সক্ষা পূরণ করেছেন স্বকমের মাধ্যমে। স্বকামের মধ্য দিয়ে যে যৌনতৃপ্তি ঘটে তা নারীসঙ্গমের বিকল্প হতে পারে না। সক্ষম পুরুষ নারীসঙ্গ কামনা করে। জীবনানন্দ দাশের শারীরবৃত্তি এর ব্যতিক্রম ছিল না। অথচ তার দাম্পত্য জীবনের গোড়ার দিকেই জীবনানন্দ একা হয়ে গিয়েছিলেন কারণ স্ত্রী লাবণ্য দাশের সঙ্গে তার স্বাভাবিক দাম্পত্য গড়ে ওঠেনি। ফলে স্বকামই ছিল তার যৌনসন্তুষ্টি লাভের একমাত্র পথ।
যারা জীবনানন্দকে দেবতূল্য ব’লে মনে করেন তাদের বিরূদ্ধে দাঁড়িয়ে আছে জীবনানন্দর আত্মকথন। দিনপঞ্জীতে তিনি অবারিত করেছেন তার যৌনাকাক্সক্ষার স্বরূপ এবং অভিজ্ঞতার পরিধি।
দিনপঞ্জী থেকে আমরা জানি তিনি বিয়ের আগে, দিল্লী থাকার সময় নারীসঙ্গের জন্য পতিতালয়ে গিয়েছিলেন। বিবাহ বহির্ভূত নারীসঙ্গ নিয়ে তারা কোনো ইনহিবিশন ছিল না। এমনকি পতিতাগমনের আকাঙ্খাও তার নীতিবোধের কাছে পরাজিত হয়ে যায় নি। বদল্যেরের তন্নিষ্ঠ পাঠকের জন্য তা অস্বাভাবিক কিছু নয়। আমরা জানি ১৯৪০ দশকের শেষভাগে তিনি কখনও কাউকে কিছু না ব’লে, ব্রজমোহন কলেজের প্রিন্সিপাল বা সহকর্মী কাউকে না-জানিয়ে ৩-৪ দিনের জন্য বরিশাল থেকে উধাও হয়ে যেতেন। ফিরে আসার পর প্রশ্ন করলে জবাব না দিয়ে মুচকি হাসতেন। রহস্যময় সেই হাসি।
যখন তার বয়স পঞ্চাশ তখন যৌনমিলনের জন্য উদগ্রীব ছিলেন। দিনপঞ্জীতে জীবনের অচরিতার্থতার কারণ উল্লেখ করতে গিয়ে তিনি আক্ষেপের সুরে লিখেছেন: ‘নারী নেই, ভালোবাসা নেই।’ বাসে চড়তে এ রকম অনেক নারী তিনি দেখেছেন যাদের ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে পাওয়া সম্ভব; কিন্তু তাদের সঙ্গে পরিচিত হওয়া এবং সম্পর্ক গড়ে তোলার পথ তার জানা ছিল না।─উপরন্তু তার যৌবনে ভাঁটার টান। পকেটের অবস্থাও ভালো নয়। অর্থের বিনিময়ে দু’ দণ্ডের শান্তি কেনা হয়ে ওঠে না আর।
হেরোডিয়াসের কন্যারা আসে, থাকে, চ’লে যায়। জেওয়াই কেন একা আসে না? কোনো কোনো জীবনানন্দের ইচ্ছে ক’রে তিনিও ওদের কারো বাসায় গিয়ে কিছু সময় কাটিয়ে আসেন। কিন্তু তার মন হয় আগের রাতে আত্মমৈথুনের কারণে তার চেহারা খারাপ হয়ে গেছে। যাওয়ার চিন্তা তিনি বাদ দিয়ে দেন। ডায়েরীতে লেখেন: ‘এমন যদি কোনো নারীকে পেতাম যার কাছে নিয়মিত যাওয়া যায় এবং সময় কাটানো যায়, তবে ওদের (জেওয়াই. ওয়াই) আমি মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতাম: কিন্তু কোথায় সেই নারী? বাসের ভীড়ে এদের আমি অনেক দেখি কিন্তু কীভাবে যোগাযোগ করবো?’ জীবনানন্দের জীবনে আর কোনো বনলতা সেন দেখা দেয়নি। v
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ত হয় ছ ল কর ছ ল ন জ বন র র জ বন আম দ র র পর চ ন কর ছ ত জ বন ত র পর র জন য স বক ম প রথম একদ ন স মরণ
এছাড়াও পড়ুন:
মহানবী (সা.)–এর ইন্তেকালের পরে শাসন নিয়ে যা ঘটেছে
মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর সিরাত বা জীবনী শুধু ইসলামের ইতিহাসের একটি অধ্যায় নয়, বরং এটি একটি স্বতন্ত্র জ্ঞানশাখা, যার কেন্দ্রে রয়েছেন তিনি এবং তাঁর যুগের ঘটনাবলি, মূল্যবোধ, নীতি, মুজিজা এবং সম্পর্ক।
নবীজির সিরাত প্রতিষ্ঠিত কোরআন, হাদিস এবং সাহাবিদের জীবনাচরণের আলোকে। তবে এই জীবনী নিয়ে বিভিন্ন সময়ে ভ্রান্ত ব্যাখ্যা এবং তথ্য বিকৃতির ঘটনা ঘটেছে, যা ইসলামের প্রকৃত চিত্রকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।
প্রামাণিক উৎসমহানবী (সা.)–এর জীবন সম্পর্কে অধ্যয়নের সবচেয়ে প্রামাণিক উৎস হলো কোরআন মাজিদ। কোরআনে তাঁর জীবনের বিভিন্ন পর্যায়, তাঁর রিসালাত, হিজরত, যুদ্ধ এবং তাঁর মানবিক গুণাবলি সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, সুরা মুহাম্মদে তাঁর নাম উল্লেখ করা হয়েছে (আয়াত: ২)।
সুরা আলে ইমরানেও এসেছে (আয়াত: ১৪৪), সুরা আহজাবে তাঁকে ‘খাতামুন নাবিয়্যিন’ বা নবীদের সিলমোহর (মানে শেষ নবী) বলা হয়ে (আয়াত: ৪০) এবং সুরা ফাতহে তাঁকে বলা হয়েছে ‘আল্লাহর রাসুল’ (আয়াত: ২৯)।
মহানবীর সিরাত নিয়ে কিছু ব্যাখ্যা ও রচনা ঐতিহাসিক সত্য থেকে বিচ্যুত হয়েছে, যা ইসলামের প্রকৃত চিত্রকে বিকৃত করেছে। এই বিকৃতিগুলো ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় হয়েছে, কখনো অতিরঞ্জিত বর্ণনা বা ভুল ব্যাখ্যার মাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে।এ ছাড়া চরিত্র, কাজ, অবস্থান সম্পর্কে বহু আয়াত আছে কোরআনে।
হাদিস গ্রন্থগুলোও সিরাতের একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস। ইমাম মালিকের মুয়াত্তা, সহিহ বুখারি, সহিহ মুসলিম, সুনানে আবু দাউদ, সুনানে ইবনে মাজা, সুনানে তিরমিজি এবং সুনানে নাসাইতে তাঁর বাণী, কাজ ও সম্মতির বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে এবং সিরাতের বিভিন্ন দিক তুলে ধরা হয়েছে।
এই গ্রন্থগুলোর সনদ (বর্ণনা পরম্পরা ও বিষয়বস্তু যাচাইয়ের জন্য মুহাদ্দিসগণ কঠোর মানদণ্ড প্রয়োগ করেছেন, যা ‘জার্হ ও তাদিল’ নামে পরিচিত।
এ ছাড়া ইবনে ইসহাকের সিরাতু রাসুলিল্লাহ সিরাতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থগুলোর একটি, ইবনে হিশাম, যার একটি সংক্ষিপ্ত সংস্করণ প্রকাশ করেছেন এবং আস-সুহাইলি তা নিয়ে আর-রওদুল উনুফ নামে একটি ব্যাখ্যা রচনা করেছেন।
এ ছাড়া ইবনে শিহাব জুহরি ও মুসা ইবনে উকবার মাগাজি মহানবী (সা.) রাসুলুল্লাহর নির্ভরযোগ্য জীবনীগ্রন্থ। কাজি ইয়াজের আশ-শিফা বি তা’রিফ হুকুকিল মুস্তফা তাঁর গুণাবলি ও অধিকারের ওপর বিশদ আলোচনা করেছে, যা পূর্ব ও পশ্চিমের পণ্ডিতদের কাছে ব্যাপকভাবে সমাদৃত।
আরও পড়ুনমহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)–এর জীবনী রচনার হাজার বছর১১ নভেম্বর ২০২০ভ্রান্ত ব্যাখ্যা ও তথ্য বিকৃতিমহানবীর সিরাত নিয়ে কিছু ব্যাখ্যা ও রচনা ঐতিহাসিক সত্য থেকে বিচ্যুত হয়েছে, যা ইসলামের প্রকৃত চিত্রকে বিকৃত করেছে। এই বিকৃতিগুলো ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় হয়েছে, কখনো অতিরঞ্জিত বর্ণনা বা ভুল ব্যাখ্যার মাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে।
মহানবীর মৃত্যুর পূর্বে তাঁর অসুস্থতার লক্ষণ প্রকাশ পায় হজ্জাতুল বিদা বা বিদায় হজের সময়। তিনি আরাফাতে দাঁড়িয়ে বলেন, ‘আমার কাছ থেকে তোমাদের হজের রীতি গ্রহণ করো। কারণ, এ বছরের পর আমি হয়তো আর হজ করতে পারব না।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ১,২৯৭)
সুরা নাসর অবতীর্ণ হলে তিনি বলেন, ‘এটি আমার মৃত্যুর ঘোষণা।’ (ইবনে কাসির, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ৫/২০৮, দারুল ফিকর, বৈরুত, ১৯৮৮)
আমি এখনো খায়বারে খাওয়া বিষাক্ত খাবারের যন্ত্রণা অনুভব করছি, এখন এর সময় এসেছে যে আমার শিরা ছিঁড়ে যাবে।সহিহ বুখারি, হাদিস: ৪৪২৮রাসুল (সা.) মসজিদে দাঁড়িয়ে বলেন, ‘আল্লাহ তাঁর একজন বান্দাকে দুনিয়া ও আল্লাহর নৈকট্যের মধ্যে পছন্দ করতে বলেছেন, আর সেই বান্দা আল্লাহর নৈকট্য পছন্দ করেছেন।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৬,৫০৪)
তাঁর অসুস্থতার সময় তিনি আয়েশা (রা.)-এর ঘরে থাকতে পছন্দ করেন। আয়েশা বলেন, ‘তিনি জান্নাতুল বাকি (কবরস্থান) থেকে ফিরে এসে আমাকে মাথাব্যথায় কাতর দেখে বললেন, “বরং আমি বলি, হায় আমার মাথা”!’ (মুহাম্মদ ইবনে ইসহাক, সিরাতু রাসুলিল্লাহ, পৃ. ৬৭৮, দারুল মা’রিফা, বৈরুত, ১৯৭৮)
তিনি তীব্র জ্বরে ভুগছিলেন এবং বলেন, ‘আমি এখনো খায়বারে খাওয়া বিষাক্ত খাবারের যন্ত্রণা অনুভব করছি, এখন এর সময় এসেছে যে আমার শ ছিঁড়ে যাবে’ (সহিহ আল-বুখারি, হাদিস: ৪৪২৮)। তিনি নির্দেশ দেন সাতটি মশকের পানি তাঁর ওপর ঢালার জন্য, যা তাঁর জ্বর কমাতে সাহায্য করে। (ইবনে হিশাম, সিরাতুন নবী, ২/৬৪২, দারুল কুতুবিল ইলমিয়া, বৈরুত, ১৯৯৮)
১১ হিজরির ১২ রবিউল আউয়াল, সোমবার (৭ জুন, ৬৩২ খ্রিষ্টাব্দ) তিনি মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর পূর্বে তিনি আয়েশা (রা.)–এর ঘর থেকে মসজিদে উঁকি দিয়ে মুসল্লিদের দিকে তাকিয়ে হাসেন এবং বলেন, ‘হে আল্লাহ, আমাকে মৃত্যুর যন্ত্রণায় সাহায্য করো।’ (আবু বকর আল-বাইহাকি, দালাইলুন নুবুওয়া, ৭/২৪৪, দারুল কুতুবিল ইলমিয়া, বৈরুত, ১৯৮৫)
তাঁর মৃত্যুর পর আবু বকর (রা.) ঘোষণা দেন, ‘যে মুহাম্মদের ইবাদত করত, সে জানুক, মুহাম্মদ মারা গেছেন। আর যে আল্লাহর ইবাদত করে, সে জানুক আল্লাহ চিরজীবী, তিনি মরেন না।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ১২৪১)
আরও পড়ুননবীজি (সা.)–র কোন জীবনী পড়বেন২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫খিলাফতের প্রতিষ্ঠা: সাকিফা বনু সায়েদামহানবী (সা.)–এর মৃত্যুর পর ‘সাকিফা বনু সায়েদা’য় সাহাবিরা খিলাফত নির্বাচনের জন্য সমবেত হন। আনসাররা সাদ ইবন উবাদার নেতৃত্বে দাবি করেন যে তারা ইসলামের প্রথম দিন থেকে রাসুলকে সমর্থন করেছেন, তাই তাদের মধ্য থেকে আমির নির্বাচিত হওয়া উচিত।
আবু বকর (রা.) মুহাজিরদের পক্ষে বলেন, ‘কুরাইশরা ইসলামে প্রথম ইমান এনেছে এবং তারা আরবের মধ্যে সবচেয়ে সম্মানিত গোত্র। আমি তোমাদের জন্য উমর বা আবু উবাইদাহর মধ্যে একজনকে প্রস্তাব করছি।’ (ইবনে হিশাম, সিরাতুন নবী, ২/৫৬, দারুল কুতুবিল ইলমিয়া, বৈরুত, ১৯৯৮)
আনসাররা প্রস্তাব করেন, ‘একজন আমির মুহাজিরদের থেকে এবং একজন আনসারদের থেকে হবে।’ তবে এই প্রস্তাব ঐক্য রক্ষার জন্য প্রত্যাখ্যাত হয়। উমর ইবনে খাত্তাব আবু বকরের হাত ধরে বায়আত করেন এবং আনসাররাও তাঁকে সমর্থন দেন। (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৬,৮৩০)
আমি তোমাদের নেতা নির্বাচিত হয়েছি, কিন্তু আমি তোমাদের মধ্যে সর্বোৎকৃষ্ট নই। যদি ভালো করি, আমাকে সাহায্য করো; আর যদি ভুল করি, আমাকে সংশোধন করো।হজরত আবু বকর (রা.)পরদিন মসজিদে সাধারণ বায়আত অনুষ্ঠিত হয়। আবু বকর (রা.) বলেন, ‘আমি তোমাদের নেতা নির্বাচিত হয়েছি, কিন্তু আমি তোমাদের মধ্যে সর্বোৎকৃষ্ট নই। আমি যদি ভালো করি, আমাকে সাহায্য করো; আর যদি ভুল করি, আমাকে সংশোধন করো।’ (ইবনে হিশাম, সিরাতুন নবী, ২/৬৫৮, দারুল কুতুবিল ইলমিয়া, বৈরুত, ১৯৯৮)
কয়েকজন সাহাবি, যেমন আলী (রা.) এবং জুবাইর ইবন আওয়াম, ফাতিমা (রা.)-এর ঘরে মহানবীর দাফনের প্রস্তুতি নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন, তাই সাকিফায় উপস্থিত ছিলেন না। কেউ কেউ মনে করেন, খিলাফতের জন্য আলী (রা.) বা আব্বাস ইবন আবদুল মুত্তালিব উপযুক্ত ছিলেন।
তবে মহানবী কাউকে স্পষ্টভাবে খলিফা মনোনয়ন করেননি। তিনি বলেছিলেন, ‘আমাকে কাগজ দাও, আমি তোমাদের জন্য এমন কিছু লিখে দেব, যার পর তোমরা পথভ্রষ্ট হবে না।’ কিন্তু উমর বলেন, ‘নবীজি এখন প্রবল যন্ত্রণায় ভুগছেন, (তাকে বিরক্ত করব না) আমাদের জন্য কোরআনই যথেষ্ট।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ১১৪)।
রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় মহানবীর ভূমিকা‘আবু বকর (রা.) ইসলামি রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন’ বলে হালা ওয়ার্দি যে দাবি করেছেন, তা ঐতিহাসিক তথ্যের সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ।
মহানবী (সা.) নিজেই ইসলামি রাষ্ট্রের ভিত্তি স্থাপন করেন। তিনি মদিনায় একটি জাতি গঠন করেন, যারা কোরআনের নির্দেশনা অনুসরণ করে ঐক্যবদ্ধ হয়। কোরআনে বলা হয়েছে, ‘তোমরা সবাই আল্লাহর রজ্জুকে দৃঢ়ভাবে ধরো এবং বিচ্ছিন্ন হোয়ো না।’ (সুরা আলে ইমরান, আয়াত: ১০৩)
তিনি মদিনা সনদ প্রণয়ন করেন, যা মুসলিম ও অমুসলিমদের মধ্যে সম্পর্ক ব্যাখ্যা করে। (ইবনে হিশাম, সিরাতুন নবী, ১/৫০১, দারুল কুতুবিল ইলমিয়া, বৈরুত, ১৯৯৮)
তিনি বিভিন্ন গোত্রের সঙ্গে চুক্তি, যুদ্ধে নেতৃত্ব এবং রাষ্ট্রদূত প্রেরণের মাধ্যমে রাষ্ট্রের কাঠামো গড়ে তোলেন। যেমন রোমের সম্রাট হেরাক্লিয়াস, পারস্যের কিসরা এবং মিসরের মুকাউকিসের কাছে পত্র প্রেরণ করেন, যা তাঁর রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের প্রতীক। (ইবনে কাসির, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ৪/২৬৯, দারুল ফিকর, বৈরুত, ১৯৮৮)
তিনি রাষ্ট্র পরিচালনায় ন্যায়বিচার ও শুরার নীতি প্রয়োগ করেন। কোরআনে বলা হয়েছে, ‘মানুষের মধ্যে ন্যায়বিচারের সঙ্গে রায় দাও।’ (সুরা সাদ, আয়াত: ২৬)
মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘যদি ফাতিমা বিনতে মুহাম্মদ চুরি করত, আমি তার হাত কেটে দিতাম।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৬,৭৮৭)।
তিনি শুরার বাস্তবায়ন করেন, কেননা কোরআন বলেছে, ‘তাদের সঙ্গে পরামর্শ করো।’ (সুরা আলে ইমরান, আয়াত: ১৫৯)
তিনি বলেন, ‘আমি একজন মানুষ। ধর্মীয় বিষয়ে আমার নির্দেশ গ্রহণ করো, কিন্তু পার্থিব বিষয়ে তোমরা আমার চেয়ে বেশি জানো।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২,৩৬৩)
হালা ওয়ার্দির গ্রন্থের মতো অনেক গ্রন্থ বাজারে পাওয়া যায়, যা ঐতিহাসিক তথ্যের অপব্যাখ্যা করে এবং তাঁর মৃত্যু ও খিলাফত নিয়ে ভ্রান্ত ধারণা প্রচার করে।শেষ কথামহানবীর ‘সিরাত’ ইসলামের ইতিহাস ও মূল্যবোধের একটি জীবন্ত দলিল। কোরআন, হাদিস এবং প্রামাণিক সিরাত গ্রন্থগুলো তাঁর জীবনের সঠিক চিত্র তুলে ধরেছে। তবে হালা ওয়ার্দির গ্রন্থের মতো অনেক গ্রন্থ বাজারে পাওয়া যায়, যা ঐতিহাসিক তথ্যের অপব্যাখ্যা করে এবং তাঁর মৃত্যু ও খিলাফত নিয়ে ভ্রান্ত ধারণা প্রচার করে।
মহানবী (সা.) ইসলামি রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন, যিনি ন্যায়বিচার, শুরা এবং ঐক্যের ভিত্তিতে এটি গড়ে তুলেছিলেন। তাঁর মৃত্যু ও খিলাফত নির্বাচনের ঘটনাগুলো তাঁর প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রের ধারাবাহিকতা নিশ্চিত করেছে। এই সিরাত আমাদের শিক্ষা দেয় যে সত্য ও ন্যায়ের পথে অবিচল থাকা এবং ঐক্যের মাধ্যমে সমাজ গঠন করা সম্ভব।
সূত্র: আল-মালুম আন আল-জাদওয়াল আত-তারিখি লি-সিরাতির রাসুল
আরও পড়ুনমহানবী (সা.)–এর জন্মকালের অলৌকিক ঘটনাবলি১৯ ঘণ্টা আগে