নকল বীজ, বৈরী আবহাওয়া ও সেচ সংকটের কারণে এবার লোকসানের মুখে পড়েছেন খুলনার কয়রার তরমুজ চাষিরা। ফলন ভালো না হওয়ায় ভরা মৌসুমেও অনেক চাষি ক্ষেত বিক্রি করতে পারেননি। অনেকে খরচের অর্ধেকও তুলতে পারেননি।
উপজেলা কৃষি দপ্তর সূত্রে জানা যায়, এবার উপজেলার সাতটি ইউনিয়নের মধ্যে চারটি ইউনিয়নে ৪ হাজার ৫০ হেক্টর জমিতে তরমুজ চাষাবাদ করেন সাড়ে ৪ হাজার চাষি। এর মধ্যে আমাদি ইউনিয়নে ২ হাজার ২০০’, বাগালি ইউনিয়নে ১ হাজার ১০, মহেশ্বরীপুরে ৮০০ ও মহারাজপুর ইউনিয়নে প্রথমবারের মতো ৪০ হেক্টর জমিতে তরমুজ চাষ করা হয়। এ বছর প্রতি হেক্টর জমিতে উৎপাদিত তরমুজের বিক্রয়মূল্য ৬ লাখ টাকা হিসাবে প্রায় ২৫০ কোটি টাকা লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়।
উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা নাইমুর রহমান জানান, সময়মতো বৃষ্টি না হওয়ায় এবং শেষ মুহূর্তে সেচ সংকটের কারণে অধিকাংশ ক্ষেতের তরমুজ আকারে ছোট হয়েছে। আবার অনেকেই বীজ কিনে প্রতারিত হওয়ায় সেসব ক্ষেতের গাছে ফলন আসেনি। এ কারণে এবার লক্ষ্যমাত্রার অর্ধেকও অর্জন সম্ভব হবে না।
আমাদি ইউনিয়নের মসজিদকুড় গ্রামের কৃষক জোবায়ের হোসেন বলেন, ‘প্রতিবছর তরমুজ চাষে লাভবান হলিও এবারই প্রথম চরমভাবে ধরা খাইছি। এবার মসজিদকুড় মৌজার ৪০ বিঘা জমিতে লাগানো তরমুজ ভালো দামে বিক্রি করতি পারলিও মহারাজপুর মৌজার ১২০ বিঘা জমিতে ২৫ লাখ টাকা লোকসান গুনতি হবে।’ তিনি জানান, জমিতে লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ায় গাছে কোনো ফল আসেনি। এ ছাড়া এবার চাষাবাদের শেষের দিকে এসে সেচ সংকট দেখা দেওয়ায় বেশি ক্ষতি হয়েছে।
একই গ্রামের তরমুজ চাষি জুলফিকার আলী এবার প্রথম তাঁর নিজের সাত বিঘা জমিতে তরমুজ চাষ করেছেন। এতে বিঘাপ্রতি খরচ হয়েছে ২৫ হাজার টাকার মতো। এর মধ্যে তিন বিঘা জমির তরমুজ বিক্রি করে দেড় লাখ টাকা পেয়েছেন। বাকি চার বিঘা জমির তরমুজ আকারে ছোট হওয়ায় ফড়িয়ারা কিনতে চাচ্ছেন না।
জুলফিকার বলেন, “ভারতীয় বীজ কিনে ধরা খাতি হয়েছে। বীজের প্যাকেটের গায়ে ‘আস্থা’ লেখা থাকলিও ভিতরে যে নকল বীজ দেওয়া হয়েছে, তা বুঝতি পারিনি। যে কারণে প্রায় ২ লাখ টাকা লোকসান গুনতি হবে।”
ধারদেনা করে এবার ১০ বিঘা জমিতে তরমুজ চাষ করেন মহেশ্বরীপুর গ্রামের কৃষক ইয়াছিন আলী। তাঁর ভাষ্য, ‘প্রথম দিকে গাছের চেহারা দেখে মনে শান্তি পাইছি। পরে আস্তে আস্তে গাছের পাতা শুকাতি থাকে। সেই সঙ্গে আমার বুকের ছাতিও শুকাতি থাকে। এ অবস্থায় কৃষি অফিসের পরামর্শ শুনে দুই-তিন গুণ খরচ কইরে দূর থেইকে পানি আইনে ক্ষেতে দিছি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত খরচের অর্ধেক টাকাও তুলতি পারলাম না।’ এখন সংসার চালাবেন কী দিয়ে আর ধারের টাকা শোধ করবেন কীভাবে– এ চিন্তায় তাঁর ঘুম আসে না।
বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, সবচেয়ে খারাপ অবস্থা মাহারাজপুর মৌজার তরমুজ চাষিদের। এ মৌজায় স্থানীয় ও বহিরাগত চাষিরা মিলে এবারই প্রথম তরমুজ চাষ করেন। এখানকার একটি বিলে ১২০ বিঘা জমিতে ১৫ কৃষক চাষাবাদ করেছেন। তারা প্রত্যেকেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।
মাহারাজপুর ইউনিয়ন উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা ফারুক হোসেন বলেন, এবার সময়মতো বৃষ্টি না হওয়ার কারণে মাটিতে লবণাক্ততা বেড়ে গেছে। যে কারণে গাছে ফলন আসার আগেই শুকিয়ে গেছে। এ ছাড়া ভারতীয় বীজের কারণেও অনেক কৃষক এবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।
কয়রার তরমুজ স্বাদে বেশি মিষ্টি হওয়ায় এখানকার তরমুজ কিনতে বহিরাগত ফড়িয়াদের আনাগোনা বেশি দেখা যায়। এবার অনেক ফড়িয়া তরমুজ না কিনে ফিরে গেছেন।
তরমুজের ব্যাপারী যশোরের রবিউল ইসলাম বলেন, বাজারে কয়রার তরমুজের চাহিদা বেশি। গতবার বিঘাপ্রতি ৮০ হাজার টাকা দরে তরমুজ কিনেছিলেন তিনি। এবার ফল আকারে ছোট হওয়ায় বিঘাপ্রতি ৩০ হাজার টাকায় কিনেছেন।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের উদ্ভিদ রোগতত্ত্ব বিভাগের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও বিভাগীয় প্রধান ড.
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: র তরম জ চ ষ প রথম হওয় য়
এছাড়াও পড়ুন:
খরাপ্রবণ বরেন্দ্র অঞ্চলে রেকর্ড বৃষ্টিতে ব্যাপক ক্ষতি
বরেন্দ্র অঞ্চলে বছরে বৃষ্টি হয় প্রায় ১,২০০ থেকে ১,৫০০ মিলিমিটার পর্যন্ত। বৃষ্টি কম হওয়ায় ভূ-গর্ভস্থ পানিও ক্রমাগত নিচে নামছে। ফলে দিনকে দিন অঞ্চলটি খরাপ্রবণ হয়ে উঠছে। তবে, গত শুক্রবার (৩১ অক্টোবর) রাতের স্মরণকালের ভারী বর্ষণে বরেন্দ্র অঞ্চলের অনেক এলাকা প্লাবিত হয়েছে। মাটির বাড়ি ধসে পড়ার পাশাপাশি পুকুরের মাছ ভেসে গেছে এবং মাঠের ধান শুয়ে পড়েছে।
রবিবার (২ নভেম্বর) সকালে রাজশাহীর কাঁকনহাট পৌরসভার দরগাপাড়া গ্রামে কৃষক জহিরুল ইসলাম নিজের জমির পাশে দাঁড়িয়ে বলেন, “মাঠের ৮০ ভাগ ধান শুয়ে পড়েছে। এই ধান তুইলতে লোকও পাওয়া যাবে না। সবাইকে একসঙ্গে ধান তুইলতে হবে। আমরা এবারের খুব ক্ষতির শিকার।”
আরো পড়ুন:
চাঁপাইনবাবগঞ্জে ভারী বর্ষণে ৪০০ পুকুর ভেসে গেছে
পদ্মা-মেঘনায় ঝাঁকে ঝাঁকে ধরা পড়ছে পাঙ্গাস
সরেজমিনে রাজশাহীর গোদাগাড়ী ও তানোরের বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে কৃষকের কথার সত্যতা পাওয়া গেছে।
বরেন্দ্র অঞ্চলের ফসলি মাঠ উঁচুনিচু সিঁড়ির মতো। দুই পাশ উঁচু হলেও মাঝের অংশ তুলনামূলক নিচু থাকে, যা স্থানীয়রা ‘কান্দর’ বলেন। এবার এই কান্দরগুলো তলিয়ে গিয়ে বিলের মতো হয়েছে। এসব জমিতে আমন ধান চাষ হয়েছে। কখনো কখনো বিলের ধান পানিতে ডুবলেও কান্দর কখনো ডুবে না। শুক্রবার রাতের বৃষ্টিতে সবই তলিয়েছে।
রাজশাহী আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগারের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রহিদুল ইসলাম বলেন, “গ্রামের দিকে খুব বৃষ্টি হয়েছে। তবে, শহরে আমরা মাত্র ১৫ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করেছি।”
এদিকে, বিলের পুকুরের মাছ ভেসে যাওয়ায় মানুষ দলবেঁধে মাছ ধরতে নেমেছেন। শনিবার (১ নভেম্বর) থেকেই মাছ ধরার মহোৎসব চলছে। পবা উপজেলার শুলিতলা ভিমারডাইং এলাকায় জোয়াখালি নদীতে অর্ধশতাধিক মানুষ মাছ ধরছিলেন।
ক্ষেত থেকে শুয়ে পড়া ধান কাটছেন এক কৃষক
আলোকছত্র গ্রামের কৃষক মো. মনিরুজ্জামান (৬৫) বলেন, “জাল ফেললেই বড় বড় মাছ পাওয়া যাচ্ছে। আমি আমার জীবনে এবার দ্বিতীয়বার উত্তরা পেলি দেখছি। সাধারণত নদীর স্রোত উত্তর দিকে যায়, কিন্তু এবার উত্তরেই এত বেশি বৃষ্টি হয়েছে যে পানি দক্ষিণে যাচ্ছে।”
বিলের মধ্যে খনন করা পুকুরগুলো পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় মাছচাষিরা বড় ক্ষতির মুখে পড়েছেন। গোদাগাড়ীর কালোসাঁকো বিলে চারটি পুকুরে মাছচাষ করতেন মারিফুল ইসলাম। তিনি জানান, প্রায় ৪ লাখ টাকার মাছ ভেসে গেছে। অন্তত ১৫ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে।
রিশিকুল ইউনিয়নের খড়িয়াকান্দি এলাকায় দুটি স্থানে পাকা রাস্তা প্লাবিত হয়ে একপাশ থেকে অন্যপাশে পানি যাচ্ছে। স্থানীয়রা সেখানে জাল দিয়ে মাছ ধরছেন। রাস্তার দুই পাশে শত শত বিঘা জমির ধান তলিয়ে গেছে। খড়িয়াকান্দি খালের পাশে ১০–১২টি বাড়ির মাটির দেয়াল ভেঙে পড়েছে।
মান্ডইল নলপুকুর গ্রামের বিশ্বনাথ সরেন জানান, তার বাড়ির দুটি ঘর ধসে পড়েছে।
জালে বড় মাছ উঠায় খুশি স্থানীয় এক বাসিন্দা
রিশিকুল এলাকার বাসিন্দা শরিফুল ইসলাম বলেন, “আমাদের এলাকায় এমন বন্যা হয়েছিল ১৯৮৬ সালে। তারপর এত বৃষ্টি ও বন্যা হয়নি। এবার প্রথম।”
এলাকাবাসী জানান, পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় রান্নাবান্না সম্ভব হচ্ছে না। স্বেচ্ছাসেবীরা খিচুড়ি রান্না করে বাড়ি বাড়ি বিতরণ করছেন। গোদাগাড়ীর কাঁকনহাট, আলোকছত্র হয়ে তানোরের সরনজাই ও কালীগঞ্জ এলাকায় মাঠের পর মাঠের ধান শুয়ে পড়েছে।
কালীগঞ্জের কৃষক সাবিয়ার রহমান বলেন, “আমার ১২ বিঘা জমির ধান শেষ। আধাপাকা ধান ঘরে তুলতেও লোক পাওয়া যাবে না।”
এবার মাঠ তলিয়ে যাওয়ায় আলু ও শীতকালীন সবজি চাষে বিলম্ব হবে। পার্শ্ববর্তী মোহনপুর ও বাগমারায় ধানের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। পানি ঢুকে যাওয়ায় পানবরজ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
দুই পাশের জমি প্লাবিত করে বৃষ্টির পানি সড়কে উঠেছে
শনিবার বাগমারার বাসুপাড়ায় নুর মোহম্মাদ নামের এক পানচাষির মৃত্যু হয়েছে। স্থানীয়দের ধারণা, বরজে পানি ঢুকে যাওয়ায় হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে তিনি মারা গিয়ে থাকতে পারেন।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মোহাম্মদ নাসির উদ্দিন দাবি করেছেন, “ক্ষয়ক্ষতি তেমন হয়নি।” তিনি বলেন, “৫০০ হেক্টর ধানের ক্ষতির প্রতিবেদন আমরা দিচ্ছি। ধান শুয়ে পড়লেই কিন্তু ক্ষতি হবে না। মাঠে যাচ্ছি, দেখছি।”
জেলা মৎস্য কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর আলম বলেন, “কিছু উপজেলা থেকে পুকুর ভেসে যাওয়ার খবর পেয়েছি। মাছ বেরিয়ে গেছে। এটি অপরিকল্পিত পুকুর খননের কারণে হয়েছে। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ জানার জন্য উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তাদের নির্দেশ দিয়েছি।”
ঢাকা/কেয়া/মাসুদ