সংঘাতে কতটা ভয় আর আতঙ্কে দিন কাটছে আরব ইসরায়েলিদের
Published: 20th, June 2025 GMT
‘আমার প্রচণ্ড রাগ হচ্ছিল’—বলছিলেন ৬৭ বছর বয়সী আরব ইসরায়েল কাসেম আবু আল-হিজা।
ইরানের ছোড়া একটা ক্ষেপণাস্ত্র গত শনিবার উত্তর ইসরায়েলের তামরা শহরে কাসেমের বাড়িতে আঘাত হেনেছিল। সিমেন্টের ছাদটা ভেঙে পড়েছিল ঘরের ভেতরেই।
ওই এক হামলাতেই কাসেমের পরিবারের চারজন নিহত হয়েছেন।
প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, বাড়ির ভেতর থেকে বই, জামাকাপড়, বাচ্চাদের খেলনা, আর দেহের টুকরা অংশগুলো উড়ে এসে রাস্তায় পড়েছিল।
নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে ছিলেন কাসেমের মেয়ে ৪৫ বছর বয়সী মানার খাতিব, দুই নাতনি ২০ বছরের শাদা আর ১৩ বছরের হালা আর তাদের ৪১ বছর বয়সী খালা মানাল খাতিব।
তাঁরা সবাই একই সঙ্গে বাড়ির ভেতরেই কংক্রিটের ঢালাই করা একটা ঘরে আশ্রয় নিয়েছিলেন। কিন্তু ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রটা সরাসরি এসে পড়েছিল ওই ঘরেই।
উত্তর ইসরায়েলের যে তামরা শহরে কাসেম ও তাঁর পরিবার থাকতেন, সেখানকার বেশির ভাগ বাসিন্দাই আরব।
ওই চারজনের মৃত্যুর কয়েক মিনিটের মধ্যেই অনলাইনে একটা ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে। তাতে দেখা যাচ্ছিল, ইরানি ক্ষেপণাস্ত্রটা মাথার ওপর দিয়ে উড়ে আসছে।
তামরা শহরের ওপরে যখন মিসাইলটা পড়ল, তখনই ভিডিওতে একটা গলা শোনা গেল, হিব্রুতে কেউ চিৎকার করে বলছে, ‘গ্রামে পড়েছে, গ্রামে পড়েছে।’
এরপর বেশ কয়েকজনকে একসঙ্গে হাততালি দিয়ে গান গাইতে শোনা যাচ্ছিল, ‘তোমাদের গ্রামটা পুড়ে যাক।’
ধরা গলায় কাসেম বলছিলেন, ‘আমার পরিবারে যা ঘটল, সেটা নিয়ে ওরা গান গাইছিল।’ তাঁকে তখন ঘিরে রেখেছিলেন আত্মীয়স্বজন।
ওই ভিডিওতে যে গানটা শোনা যাচ্ছিল, সেই ‘আরববিরোধী’ স্লোগান মাঝেমধ্যেই উগ্র জাতীয়তাবাদী ইহুদিরা গেয়ে থাকে। ওই ভিডিও ইসরায়েলে ভাইরাল হয়ে গেছে, তবে দেশের ভেতরেই ভিডিওটার প্রবল নিন্দাও হচ্ছে।
প্রেসিডেন্ট আইজ্যাক হারজোগ মন্তব্য করেছেন, ‘ভয়াবহ ও লজ্জাজনক।’
আরব ইসরায়েলিদের নেই সরকারি বাংকারওই ঘটনায় কাসেম ও তামরার বৃহত্তর আরব সমাজের ক্ষুব্ধ হওয়ার পেছনে আরও কারণ আছে।
শুধু ওই এলাকায় নয়, ইসরায়েলের অন্যান্য আরব–অধ্যুষিত এলাকায় প্রায় ৩৮ হাজার মানুষের জন্য কোনো সরকারি বাংকার নেই।
কাছাকাছি ইহুদি–অধ্যুষিত শহর কারমিয়েলের জনসংখ্যা প্রায় ৫৫ হাজার। সেখানে ১২৬টি সরকারি বাংকার রয়েছে।
বিষয়টি দেখলেই দুই এলাকার ফারাকটা চোখে পড়ার মতো। তামরার বাসিন্দারা দীর্ঘদিন ধরেই এই বৈষম্য নিয়ে সতর্ক করে যাচ্ছেন।
ইসরায়েলের উত্তরাঞ্চলীয় দেশটির তৃতীয় বৃহত্তম শহর হাইফা থেকে মাত্র ১০ কিলোমিটার পূর্ব দিকে তামরা শহরের অবস্থান। আবার লেবাননের সীমান্ত থেকে শহরটির দূরত্ব মাত্র ২৫ কিলোমিটার। তাই ইরান–সমর্থিত হিজবুল্লাহ গোষ্ঠীর ছোড়া রকেট এ শহরে আঘাত হানতেই পারে।
হিজবুল্লাহর ছোড়া একটি রকেটের আঘাতে গত বছরের অক্টোবরে এক নারী গুরুতর আহত হয়েছিলেন।
পুরো ইসরায়েলেই মোট জনসংখ্যার এক–চতুর্থাংশ উপযুক্ত বাংকারে আশ্রয় নেওয়ার সুযোগ পান না। তবে অ-ইহুদি এলাকায় সংখ্যাটা বেড়ে হয়ে যায় মোট বাসিন্দার প্রায় অর্ধেক। এ তথ্য ২০১৮ সালে দিয়েছিল ইসরায়েলের রাষ্ট্রীয় প্রধান হিসাবরক্ষকের দপ্তর।
চিন্তক প্রতিষ্ঠান ইসরায়েল ডেমোক্রেসি ইনস্টিটিউটের লিতাল পিলার বলছিলেন, অনেক দশক ধরে আরব–অধ্যুষিত এলাকার স্থানীয় কর্মকর্তারা নানা খাতেই কম সরকারি অনুদান পান। এসব খাতের মধ্যে রয়েছে বোমা বা রকেট হামলার মতো জরুরি প্রয়োজনের জন্য প্রস্তুতির খাত।
পিলার বলেন, আবার যেসব জায়গায় বাংকার আছে, সেগুলোর রক্ষণাবেক্ষণও খুব খারাপ, দীর্ঘদিন থাকার উপযুক্ত নয়।
বিবিসি বিষয়টি নিয়ে ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের মন্তব্য জানতে চেয়েছিল। তবে কোনো জবাব পাওয়া যায়নি।
ইসরায়েলের উত্তরাঞ্চলে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় বিধ্বস্ত তিনতলা ভবন। ১৫ জুন, তামরা.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ইসর য় ল র র ভ তর সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
চট্টগ্রামে থানা ঘেরাওয়ের পর ‘আসামি’ ছেড়ে দিল পুলিশ
চট্টগ্রামের চান্দগাঁও থানায় একটি চাঁদাবাজির মামলার আসামি হিসেবে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের এক নেতাকে গ্রেপ্তার করেছিল পুলিশ। তবে মামলার বাদী থানায় এসে জানিয়ে দেন, তিনি ওই ব্যক্তিকে চেনেন না। এরপর তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হয়।
ঘটনাটি ঘটেছে আজ শুক্রবার বেলা আড়াইটার দিকে। পুলিশ সূত্রে জানা য়ায় গতকাল বৃহস্পতিবার রাত ১১টার দিকে চান্দগাঁও থানা কমিটির সেক্রেটারি মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান মুঠোফোন হারিয়ে যাওয়ার বিষয়ে সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করতে থানায় এলে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাঁর নামে চাঁদাবাজির একটি মামলা এজাহারে ছিল।
এ খবর ছড়িয়ে পড়লে রাতেই ইসলামী আন্দোলনের নেতা-কর্মীরা থানায় জড়ো হন। আজ সকাল থেকে সংগঠনের সহযোগী সংগঠন যুব আন্দোলন ও শ্রমিক আন্দোলনের নেতা-কর্মীরাও থানার সামনে অবস্থান নেন। একপর্যায়ে মামলার বাদী মো. শিপন থানায় এসে বলেন, তিনি হাবিবুর রহমানকে চেনেন না। এরপর বেলা আড়াইটার দিকে হাবিবুরকে তাঁর জিম্মায় ছেড়ে দেয় পুলিশ।
চান্দগাঁও থানার ওই মামলায় বাদী গত বুধবার ১৭ জনের নাম উল্লেখ করে এজাহার দায়ের করেন। তাতে হাবিবুর রহমানের নাম ছিল ৫ নম্বরে।
চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের পাঁচলাইশ অঞ্চলের সহকারী কমিশনার মো. আরিফ হোসেন বলেন, ‘যে ভিডিওর ভিত্তিতে মামলা করা হয়েছে, সেখানে হাবিবুর রহমানের চেহারা দেখা যায়নি। বাদীও থানায় এসে বলেছে, সে হাবিবকে চেনে না। এ কারণে তাঁকে বাদীর জিম্মায় ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।’
আজ দুপুর ১২টার দিকে সরেজমিনে দেখা যায়, চান্দগাঁও থানার মূল ভবনের বাইরে অবস্থান নিয়ে স্লোগান দিচ্ছেন ইসলামী আন্দোলনের নেতা-কর্মীরা। তাঁরা হাবিবুর রহমানকে আদালতে পাঠানোর বিরোধিতা করেন। তাঁদের দাবি, উপযুক্ত প্রমাণ ছাড়াই তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এ সময় কেউ থানায় প্রবেশ করতে চাইলে পুলিশ সদস্যরা বাধা দেন। সাংবাদিক পরিচয় দেওয়ার পরও পরে আসতে বলা হয়। তখন কয়েকজন নেতা থানার ভেতরে ওসির কক্ষে অবস্থান করছিলেন।
বাইরে অবস্থানরত নেতা-কর্মীদের কয়েকজন বলেন, গত এপ্রিলে কাপ্তাই রাস্তার মাথা এলাকায় চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে ইসলামী আন্দোলনের নেতারা সমাবেশ করেন। এরপর চাঁদাবাজির ঘটনা বন্ধ হয়। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে ‘চাঁদাবাজির সঙ্গে জড়িত একটি পক্ষ’ হাবিবুর রহমানকে জড়িয়ে মামলা করে। তাঁদের দাবি, মামলার বাদী পক্ষই চাঁদাবাজির সঙ্গে জড়িত।
বেলা ১টার দিকে মামলার বাদী ও দুই সাক্ষী থানায় আসেন। সাংবাদিকেরা কথা বলার চেষ্টা করলেও তাঁরা কোনো মন্তব্য করেননি।
চান্দগাঁও থানার উপপরিদর্শক ও মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা কাজী মনিরুল করিম বলেন, ‘মামলায় হাবিবুর রহমানের নাম ছিল। তবে বাদী থানায় এসে জানিয়েছেন, তিনি তাঁকে চেনেন না। তাই বাদীর জিম্মায় তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।’
মামলার বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে, এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত ছয়জনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তাঁদের মধ্যে হাবিবুর রহমান ছাড়া বাকি পাঁচজনকে আজ আদালতে পাঠানো হয়েছে। তাঁরা হলেন মো. নয়ন (৩৫), মো. লোকমান (২৮), মো. ফয়সাল হোসেন (৩২), মো. শাহীন (২১) ও সনজিত নাথ (৪৯)। চান্দগাঁও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আফতাব উদ্দিন বিকেল ৫টার দিকে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তবে হাবিবুর রহমানকে ছেড়ে দেওয়ার বিষয়ে ওসির সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি।
এ ঘটনায় সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) চট্টগ্রামের সম্পাদক ও আইনজীবী আখতার কবীর চৌধুরী। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘যদি কেউ নিরপরাধ হয়, তা প্রমাণ হওয়ার জায়গা আদালত। থানা ঘেরাও করে কাউকে ছাড়িয়ে নেওয়া মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়। এটি একটি ভুল দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। এতে অন্য মামলার আসামিরাও সুযোগ নিতে পারে।’
আখতার কবীর বলেন, ‘আইন অনুযায়ী গ্রেপ্তারের পর কাউকে থানা থেকে ছাড়া হলে এর পেছনে যৌক্তিক কারণ থাকতে হয়, যেমন গুরুতর অসুস্থতা বা আদালতের নির্দেশ। একজনকে ছেড়ে দিলে বাকি পাঁচজনকে কেন আদালতে পাঠানো হলো, সেটি প্রশ্নবিদ্ধ। একই সঙ্গে ভুল এজাহার দেওয়ার জন্য বাদীর বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।’