সংবিধানের বিধান যা-ই থাকুক না কেন, প্রয়োজনীয় সংশোধন সাপেক্ষে সংবিধানের বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে। বাংলাদেশের সংবিধানের মূল ভিত্তি সমতা ও বৈষম্যহীনতা হলেও এখনো এটি বাস্তব জীবনে প্রতিফলিত হয়নি। মঙ্গলবার বিকেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আর সি মজুমদার অডিটরিয়ামে ‘সাংবিধানিক অধিকার ও প্রতিকার: ধারাবাহিকতা, সংশোধন ও সম্ভাবনা’ শীর্ষক আলোচনায় বক্তারা এসব কথা বলেছেন।

সমতা, বাক্স্বাধীনতাসহ সংবিধানে সংরক্ষিত মৌলিক অধিকার বাস্তবায়ন, প্রয়োজনীয় সংশোধন ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা নিয়ে এই আলোচনা সভার আয়োজন করে লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট)। তাদের পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এসব তথ্য জানানো হয়।

আলোচনায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের প্রভাষক সাইমী ওয়াদুদ বলেন, সংবিধানের সমতা ও বৈষম্যহীনতার নীতিকে বাস্তবায়নের জন্য উচ্চ আদালতের একাধিক ঐতিহাসিক রায় রয়েছে। সাম্প্রতিক গণ–অভ্যুত্থানের অন্যতম লক্ষ্য ছিল বৈষম্যহীন রাষ্ট্র গঠন। কিন্তু সমতা, বৈষম্যহীনতা ও সমঅধিকার নিয়ে আলোচনা এলেই এখনো সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গিতে আটকে থাকি।

আইনবিদ ও লেখক মিল্লাত হোসেন বলেন, সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৭ অনুযায়ী সংবিধানই রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন হলেও বাস্তবে ব্যক্তিগত আইন অনেক ক্ষেত্রে তার ওপরে প্রাধান্য পাচ্ছে। এতে আইনের দৃষ্টিতে সমতা প্রতিষ্ঠা সম্ভব হচ্ছে না। তাঁর মতে, অনুচ্ছেদ ২৭-এ সব নাগরিকের সমানাধিকারের কথা বলা হলেও আদিবাসী, দলিত ও অন্যান্য প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সত্তা রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পায়নি। তিনি বলেন, এমন একটি রাষ্ট্র কল্পনা করতে হবে, যেখানে প্রত্যেকে নিজের পরিচয়ে গর্বিত হতে পারে।

স্বাস্থ্য অধিকার নিয়ে বক্তব্য দেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার রাশনা ইমাম। তিনি বলেন, স্বাস্থ্য অধিকার এখনো মৌলিক অধিকারের মর্যাদা না পেলেও আদালতের রায়ে জীবনের অধিকারের অংশ হিসেবে এটি স্বীকৃতি পেয়েছে।

গ্রেপ্তার ও আটক–সংক্রান্ত সাংবিধানিক সুরক্ষা বিষয়ে আইনজীবী ও মানবাধিকারকর্মী কাজী জাহেদ ইকবাল বলেন, সংবিধানের দিকনির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ও ৬৪ ধারা এবং বিশেষ ক্ষমতা আইনের কারণে সাংঘর্ষিক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। উচ্চ আদালতের রায় থাকা সত্ত্বেও বাস্তবায়নের ঘাটতি আছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন। তাঁর মতে, স্বাধীনতার পর থেকে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সনদের সঙ্গে বাংলাদেশের আইন কতটা সামঞ্জস্যপূর্ণ, তা নতুন করে পর্যালোচনার সময় এসেছে।

চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা এবং বাক্স্বাধীনতা সম্পর্কে লেখক ও সংবিধান সংস্কার কমিশনের সদস্য ফিরোজ আহমেদ বলেন, ১৯৭২ সালের সংবিধান ছিল ব্যক্তিকেন্দ্রিক ক্ষমতার প্রতিফলন, যেখানে একটি দলকে একচেটিয়া ক্ষমতা প্রদানের প্রবণতা দেখা যায়। অনুচ্ছেদ ৭০-এর বিধান আসলে নাগরিক ও সংসদ সদস্যদের চিন্তা ও বাক্‌স্বাধীনতাকে সীমিত করেছে। এই অনুচ্ছেদ সংসদ সদস্যদের বিবেক ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে খর্ব করে, ফলে কাঠামোগতভাবে এমন এক ক্ষমতার ভারসাম্য তৈরি হয় যেখানে শেষ পর্যন্ত ক্ষমতাবানের প্রভাবই টিকে থাকে।

বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী এবং সংবিধান সংস্কার কমিশনের সদস্য শরীফ ভুইয়া বলেন, সংবিধানে ক্ষমতার কাঠামোর তুলনায় জনগণের সামাজিক নিরাপত্তা ও অধিকারের আলোচনা এখনো অত্যন্ত সীমিত। বর্তমানে উচ্চ আদালতে চলমান ১১৬ অনুচ্ছেদ এবং ত্রয়োদশ ও পঞ্চদশ সংশোধনী সম্পর্কিত মামলাগুলো অধিকার প্রশ্নের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তাই রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার তুলনায় আদালত নির্ভর সংস্কারই এখন বেশি বিশ্বাসযোগ্য।

মুক্ত আলোচনায় ন্যায্যতা, সমতা, সংসদ সদস্যের বাক্স্বাধীনতা, জলবায়ু পরিবর্তন এবং সে–সংক্রান্ত অধিকার, ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণ, সংবিধানের ভাষাকে সহজবোধ্য করার কথা উঠে আসে।

পরিশেষে সংবিধানে উল্লেখিত মূলনীতি এবং মৌলিক অধিকারসমূহ জনগণের বোধগম্য উপায়ে প্রচারের উদ্যোগ নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে ব্লাস্টের অবৈতনিক নির্বাহী পরিচালক এবং সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী সারা হোসেন এ সভার সমাপনী ঘোষণা করেন।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: স ব ধ নত অন চ ছ দ আইনজ ব ক ষমত সদস য র আইন

এছাড়াও পড়ুন:

অপরাধ আমলে নেওয়ায় দুই বছরের সময়সীমার বিধান প্রশ্নে রুল

বাল্যবিবাহ নিরোধ আইনের একটি ধারা প্রশ্নে রুল দিয়েছেন হাইকোর্ট। ধারাটিতে অপরাধ আমলে নেওয়ায় দুই বছরের সময়সীমা উল্লেখ রয়েছে। এক রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে বিচারপতি কাজী জিনাত হক ও বিচারপতি আইনুন নাহার সিদ্দিকার সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ আজ রোববার এ রুল দেন।

২০১৭ সালে বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন প্রণয়ন করা হয়। আইনের ১৮ ধারায় অপরাধ আমলে নেওয়ার সময়সীমা সম্পর্কে বলা হয়েছে। ধারাটি বলছে, অপরাধ সংঘটিত হওয়ার দুই বছরের মধ্যে অভিযোগ করা না হলে আদালত ওই অপরাধ আমলে গ্রহণ করবে না।

ওই ধারার বৈধতা নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ইশরাত হাসান গত মাসের শেষ দিকে রিটটি করেন। আদালতে রিটের পক্ষে তিনি নিজেই শুনানি করেন। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল নূর মুহাম্মদ আজমী।

রুলে অপরাধের অভিযোগ আমলে নেওয়ায় দুই বছরের সময়সীমা আরোপ–সংক্রান্ত বাল্যবিবাহ নিরোধ আইনের ১৮ ধারা কেন অসাংবিধানিক ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চাওয়া হয়েছে। আইন মন্ত্রণালয়ের দুই সচিব, নারী ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব এবং স্বরাষ্ট্রসচিবকে চার সপ্তাহের মধ্যে রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে।

রুলের বিষয়টি জানিয়ে আবেদনকারী আইনজীবী ইশরাত হাসান প্রথম আলোকে বলেন, বাল্যবিবাহের ক্ষেত্রে সারা বিশ্বে বাংলাদেশ তৃতীয় এবং দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ শীর্ষে বলে ইউনিসেফের প্রতিবেদনে এসেছে। আইনের ১৮ ধারায় সময়সীমা উল্লেখ করে দুই বছরের মধ্যে মামলা না করতে পারলে কোনো আদালত অপরাধ আমলে গ্রহণ করতে পারবে না বলা হয়েছে। অর্থাৎ বিচার করতে পারবে না। যে মেয়েটির ১১–১২ বছরে বিয়ে হয় তারপক্ষে দুই বছরের মধ্যে মামলা করা সব সময় সম্ভব না–ও হতে পারে। তখন সে নিজেই শিশু। দুই বছর পর আদালত বিচার করতে পারবে না এবং সময়সীমা আইনে বেঁধে দেওয়া সংবিধানের ২৭, ৩১ ও ৩২ অনুচ্ছেদের পরিপন্থী—এমন সব যুক্তিতে রিটটি করা হয়।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • তত্ত্বাবধায়কব্যবস্থা বাতিল: সংক্ষিপ্ত ও পূর্ণাঙ্গ রায়ে অসংগতি তুলে ধরে আপিল মঞ্জুরের আরজি
  • গোষ্ঠীস্বার্থে ড্যাপ সংশোধন হলে ঢাকার বাসযোগ্যতা আরও সংকটে পড়বে
  • আইনজীবীর ভূমিকায় নুসরাত ফারিয়া
  • জাবির সহকারী অধ্যাপক ড. নাহরিনের বিরুদ্ধে জামায়াত নেতার মামলা
  • ঢাকা ওয়াসার এমডি পদে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির কার্যক্রম স্থগিত
  • পঞ্চদশ সংশোধনী সম্পূর্ণ বাতিল চেয়ে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে লিভ টু আপিল
  • সন্ত্রাসবিরোধী আইনের মামলায় ক্যাসিনো–কাণ্ডের সেলিম প্রধান রিমান্ডে
  • সন্দিগ্ধ আসামি হিসেবে দেশ টিভির আরিফ ও নাসার নজরুলকে গ্রেপ্তার দেখানো হলো
  • অপরাধ আমলে নেওয়ায় দুই বছরের সময়সীমার বিধান প্রশ্নে রুল