‘হার্ট অ্যাটাকে’ মৃত্যুর ১০ মাস পর গণঅভ্যুত্থানের শহীদ দাবি করে হত্যা মামলা, বেরোবি শিক্ষকসহ গ্রেপ্তার ২
Published: 20th, June 2025 GMT
ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে ‘হার্ট অ্যাটাক’-এ মারা যাওয়া ছমেস উদ্দিন (৬৫) হত্যা মামলায় বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক মাহমুদুল হককে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
বৃহস্পতিবার বিকেলে রংপুর নগরীর ধাপ এলাকার নিজ বাসা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে রংপুর মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট-১ম আদালতে নেওয়া হলে বিচারক মো.
বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক মাহমুদুল হকের বিরুদ্ধে হয়রানিমূলক মিথ্যা মামলা ও গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ সমাবেশের আয়োজন করা হয়েছে। সাধারণ শিক্ষার্থীদের ব্যানারে আজ শুক্রবার বাদ জুমা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান গেটে এই প্রতিবাদ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হবে।
মামলা সূত্রে জানা যায়, ২০২৪ সালের ২ আগস্ট তৎকালীন পুলিশ, প্রশাসন, আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীরা নগরীর রাধাকৃষ্ণপুর এলাকার মুদি দোকানী ছমেস উদ্দিনকে তার দোকানে এসে হুমকি দেয়। এসময় আওয়ামী লীগের অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীরা ছমেস উদ্দিনকে অস্ত্র দিয়ে আঘাত করে রক্তাক্ত করে। এতে তিনি অজ্ঞান হয়ে মাটিতে পড়ে গেলে পুলিশ ও আসামিরা তাকে রেখে পালিয়ে যায়। পরে পরিবারের সদস্যরা ছমেস উদ্দিনকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। এ ঘটনায় নিহতের স্ত্রী আমেনা বেগম বাদী হয়ে হাজীরহাট থানায় মামলা দায়ের করেন। এতে শিক্ষক মাহমুদুল হককে ৫৪ নম্বর আসামি করা হয়। তাকে বঙ্গবন্ধু পরিষদের কেন্দ্রীয় সহ-তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক হিসেবে দেখানো হয়েছে।
এদিকে, হার্ট অ্যাটাকে মারা যাওয়ার ১০ মাস পর দায়ের করা হত্যা মামলায় তদন্ত ছাড়াই শিক্ষককে গ্রেপ্তারের ঘটনায় বিভিন্ন মহলে মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে।
এর আগে, ১৬ জুন সোমবার একই মামলায় দেলওয়ার হোসেন নামে আরেক শিক্ষককে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠানো হয়। তিনি রাধাকৃষ্ণপুর ডিগ্রি কলেজের উপাধ্যক্ষ।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রংপুর নগরীর রাধাকৃষ্ণপুর এলাকায় হার্ট অ্যাটাকে মারা যাওয়া মুদি দোকানদার ছমেস উদ্দিনকে জুলাই আন্দোলনের যোদ্ধা বানিয়ে গত ৩ জুন হত্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে। মামলার এজাহারে ৫৪ জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। প্রধান আসামি করা হয়েছে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের এবং বাকি ৫২ জনই স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ-সংগঠনের নেতাকর্মীসহ সাধারণ মানুষ। এদের মধ্যে ওয়ার্ড বিএনপির সহ-সভাপতি জয়নাল আবেদীনকেও আসামি করা হয়। শুধু তাই নয়, জাতীয় বীর দেখিয়ে ১০ লাখ টাকার ফিক্সড ডিপোজিড আর ৫ লাখ টাকা জুলাই ফাউন্ডেশন থেকে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে ছমেস উদ্দিনের পরিবারের বিরুদ্ধে।
তবে জেলা প্রশাসন থেকে করা জুলাই আন্দোলনের শহীদদের তালিকায় ১৯ নম্বরে তার নাম রয়েছে। সেখানে উল্লেখ করা হয়, ‘স্থানীয় ছাত্রলীগ কর্মীর পরামর্শে পুলিশ বিভাগের একটি দল তার বাড়িতে প্রবেশ করলে তিনি পুলিশ ও ছাত্রলীগ কর্মীকে দেখে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে জ্ঞান হারান। পরবর্তীতে তাকে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে সেখানে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।’
স্থানীয়রা জানান, জুলাই আন্দোলনের সময় ২ আগস্ট মুদি দোকানদার ছমেস উদ্দিন দোকানে বসে থাকা অবস্থায় জামায়াত নেতা হাজী নাছির উদ্দিনকে পুলিশ আটক করতে ওই এলাকায় এলে ছমেস উদ্দিন ভয়ে দোকান থেকে নেমে দৌঁড় দেয়। কিছু দূর যাওয়ার পর রাস্তায় শুয়ে পড়ে জ্ঞান হারায়। স্বজন ও এলাকাবাসী তাকে উদ্ধার করে বাড়ির কাছে বেসরকারি প্রাইম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে এলে কর্তব্যরত চিকিৎসক জানান, তিনি হার্ট অ্যাটাকে মারা গেছেন।
ঘটনার ১০ মাস পর মামলা করার বিষয়ে এজাহারে উল্লেখ করেন ‘সে সময় পুলিশের ভয়ে মামলা করা হয়নি। পরে কাগজ সংগ্রহ করে মামলা করতে দেরি হয়েছে।’ মামলাটি দায়ের করার পর হাজিরহাট থানার ওসি আব্দুল আল মামুন শাহ মামলাটি নিজেই রেকর্ড করে তিনি নিজেই তদন্তকারী পুলিশ কর্মকর্তা হিসেবে মামলার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। মামলার বিষয়টি জানাজানি হলে নজিরেরহাট এলাকায় তোলপাড় শুরু হয়। ২ আগস্ট ওই এলাকায় এমন কোনো ঘটনা ঘটেনি। মুদি দোকানদার ছমেস উদ্দিন হার্ট অ্যাটাকে মারা যাওয়ার এতদিন পর কীভাবে তাকে হত্যা করার অভিযোগ ওঠে তা নিয়ে এলাকায় চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়।
এ বিষয়ে জানতে মামলার বাদী ছমেস উদ্দিনের স্ত্রী আমেনা বেগমের বাড়িতে গেলে তিনি বলেন, তার স্বামীকে ধরতে ২ আগস্ট পুলিশ এলে তিনি দোকান থেকে নেমে পালানোর চেষ্টা করে। একপর্যায়ে মাটিতে পড়ে জ্ঞান হারান। তাকে হাসপাতালে নেওয়া হলে ডাক্তার মৃত ঘোষণা করেন। তার শরীরে কোনো আঘাতের চিহ্ন ছিল না।
কেন হত্যা মামলা করলেন-প্রশ্নের উত্তরে বলেন, প্রশাসন তাকে ডেকে নিয়ে গিয়ে কাগজে সই করতে বলেছে, তিনি তাই করেছেন। তিনি কারও নামে হত্যা মামলা করেননি বলে জানান।
অপরদিকে মৃত ছমেস উদ্দনের ছেলে আশিকুর রহমান জানান, ঘটনার সময় সে রংপুরের বাইরে ছিল। তার বাবাকে পুলিশ ধরতে এলে তিনি দোকান থেকে নেমে পালানোর চেষ্টা করলে মাটিতে পড়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। যারা তার বাবাকে ধরতে এসেছিল তাদের বিচার দাবি করেন তিনি। তবে অকপটে স্বীকার করেন তার বাবা হার্ট অ্যাটাকে মারা গেছেন।
স্থানীয় ওয়ার্ড জামায়াতের আমির হাজী নাছির উদ্দিন বলেন, মূল ঘটনা হচ্ছে ২ আগস্ট তারিখে কয়েকজন পুলিশ আমাকে গ্রেপ্তার করার জন্য আমার বাসা ঘেরাও করে। ওই সময় মুদি দোকানদার ছমেস উদ্দিন ভয়ে দোকান থেকে নেমে পালানোর চেষ্টা করে, কিন্তু হার্ট অ্যাটাকে মারা গেছে। হার্ট অ্যাটাকে মারা যাওয়া মানুষ কীভাবে জাতীয় বীর হয়!
তিনি আরও বলেন, পুরো ঘটনা সাজানো। এই ঘটনাকে হত্যা মামলা হিসেবে দায়ের করা অন্যায়। নিরীহ মানুষকে আসামি করা হয়েছে বলে তিনি অভিযোগ করেন।
ছমেস উদ্দিন হত্যা মামলা দায়ের হওয়ার পর স্থানীয় সাধারণ মানুষকেও আসামি করা হয়েছে। এ মামলার আসামি মেহেদী হাসান ও আখতারুল ইসলামের স্বজন মমতাজ বেগম ও সালমা বেগম বলেন, ছমেস উদ্দিন হার্ট অ্যাটাকে মারা গেছে। এটাই শতভাগ সত্য। অথচ এ ঘটনাকে ঘিরে মিথ্যা হত্যা মামলা দায়ের করে তাদের স্বজনসহ এলাকার নিরীহ মানুষকে আসামি করা সম্পূর্ণ অন্যায়।
এ ব্যাপারে রংপুর মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক সামসুজ্জামান সামু জানান, ছমেস উদ্দিন হার্ট অ্যাটাকে মারা গেছেন। একজন হার্ট অ্যাটাকে মারা যাওয়া ব্যক্তি কীভাবে জাতীয় বীর হয়-আমি কল্পনাও করতে পারছি না। এ ঘটনায় ২৮ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপি নেতা জয়নালসহ স্থানীয় নিরীহ ব্যক্তির নামে হত্যা মামলা দায়ের করা সত্যিই দুঃখজনক।
তিনি আরও বলেন, ছমেস উদ্দিনের ময়নাতদন্তের রিপোর্ট কই? ১০ মাস পর মামলা করা হলো এখনও লাশ উত্তোলন করার ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না কেন? পুরো ঘটনা তদন্ত করা উচিত বলে মনে করেন তিনি।
২৮ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপি সভাপতি আলমগীর অভিযোগ করেন, নিরীহ লোকদের আসামি করে মামলা বাণিজ্য করা হচ্ছে।
ছমেস উদ্দিনের মরদেহ জানাজায় ইমামতি করা স্থানীয় মসজিদের ইমাম মমিনুল ইসলাম বলেন, আমি জানাজা পড়িয়েছি। তার শরীরে কোনো জখম দেখিনি। হার্ট অ্যাটাকে মারা যাওয়ার কথা শুনেছি। হত্যা করার কথা শুনিনি।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: গ র প ত র কর ১০ ম স পর দ য় র কর ২ আগস ট ন ত কর এল ক য় আওয় ম তদন ত ব এনপ
এছাড়াও পড়ুন:
জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সকল শক্তির ঐক্য অটুট রাখতে হবে: সংস্কৃতি উপদেষ্টা
সংস্কৃতি বিষয়ক উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী বলেছেন, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের চেতনাকে লালন-পালন এবং ধারণ করতে এ অভ্যুত্থানের সকল শক্তির ঐক্য অটুট রাখতে হবে। বিভেদ, বিদ্বেষ কিংবা বৈষম্যের সৃষ্টি হলে তা ফ্যাসিবাদের ফিরে আসার উপলক্ষ তৈরি করতে পারে।
শনিবার বিকেলে রাজধানীর বাংলা একাডেমির কবি শামসুর রাহমান মিলনায়তনে জুলাই গণঅভ্যুত্থান- বিক্ষুব্ধ কবি-লেখক সমাজের বর্ষপূর্তি অনুষ্ঠানে আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এ কথা বলেন।
সংস্কৃতি উপদেষ্টা বলেন, ‘‘জুলাই গণঅভ্যুত্থান ঘিরে একটি কালচারাল ন্যারেটিভ তৈরি করতে হবে, যা এর প্রেক্ষাপট, প্রয়োজনীয়তা ও প্রাসঙ্গিকতাকে অমলিন ও অটুট রাখার পাশাপাশি বাংলাদেশের মানুষের মনন ও বোধকে ঘিরে একটি সাংস্কৃতিক ধারা নির্মাণ করবে।’’
সভায় বক্তৃতা করেন গীতিকার শহীদুল্লাহ ফরায়েজী, কবি রায়হান জহির, ফারুক খান, তানজিম তানিম, কাজল রশীদ শাহীন, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের শহীদ আনাসের মা সানজিদা খান দীপ্তি প্রমুখ।
অনুষ্ঠানে জুলাই গণঅভ্যুত্থানে অবদানের জন্য কবিদের সম্মাননা প্রদান করা হয়।
ঢাকা/এএএম//