বিদেশি বিনিয়োগ টানতে সরকার কিছু ক্ষেত্রে করছাড়ের শর্ত শিথিল করেছে। এখন থেকে অর্থনৈতিক অঞ্চল (ইজেড) ও হাই-টেক পার্কে বিদেশে ব্যবহার হয়েছে– এমন যন্ত্রপাতি এনে উৎপাদন কাজে ব্যবহার করলেও কর ছাড় বা অবকাশের সুবিধা পাবেন বিদেশি বিনিয়োগকারীরা। এতদিন এই সুবিধা ছিল না। প্রস্তাবিত ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে এই সুবিধা দেওয়া হয়েছে। 
বিদেশি বিনিয়োগ-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যে কোনো বিনিয়োগের ক্ষেত্রে অনেক বিষয় জড়িত। ফলে একটি ইতিবাচক সিদ্ধান্তে বিনিয়োগ বাড়বে না। বিশেষ করে দীর্ঘমেয়াদে নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা সবচেয়ে বেশি দরকার। 

বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে বেজা ও হাই-টেক পার্কের আওতাধীন প্রতিষ্ঠানগুলো ১২টি শর্ত পরিপালন সাপেক্ষে বিভিন্ন স্ল্যাবে ১০ বছরের জন্য কর অবকাশ সুবিধা পাচ্ছে। এ সুবিধার কারণে বিদেশিরা বিনিয়োগ করতে আসছেন। সাধারণত যেসব বিদেশি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে বিনিয়োগ করেন, তারা নিজ দেশের কারখানায় ব্যবহার হয়েছে অর্থাৎ পুরোনো যন্ত্রপাতি আনেন বেশির ভাগ ক্ষেত্রে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) শর্তমতে, ইজেড ও হাই-টেক পার্কে কর অবকাশের সুবিধা পেতে হলে উৎপাদনের জন্য নতুন যন্ত্রপাতি আনতে হয়। ইতোপূর্বে ব্যবহৃত কোনো যন্ত্রপাতি এনে পণ্য উৎপাদন করলে কর অবকাশের সুবিধা পাবে না। এ শর্তের কারণে বিদেশিরা বিনিয়োগে নিরুৎসাহিত হচ্ছিলেন। সেজন্য সরকার হাই-টেক পার্ক ও অর্থনৈতিক অঞ্চলে কর অবকাশের শর্ত শিথিলসহ বিদেশি বিনিয়োগ বাড়াতে নানা পরিকল্পনা করছে। ইতোমধ্যে বেশ কিছু বিদেশি বহুজাতিক কোম্পানি এসব জায়গায় বিনিয়োগ করেছে, আরও বহু কোম্পানি বিনিয়োগের অপেক্ষায় রয়েছে। এ পরিস্থিতিতে বিনিয়োগের শর্ত শিথিল করার জন্য এনবিআরকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। কারণ বিডার মূল দায়িত্ব হচ্ছে– নীতিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের মাধ্যমে বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ গড়ে তোলা এবং দেশি-বিদেশি শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে অর্থবহ সংযোগ সৃষ্টি করে শক্তিশালী বিনিয়োগ পাইপলাইন গঠন করা। 

জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সূত্রে জানা গেছে, বেজা ও হাই-টেক পার্কে কর অবকাশের সুবিধা পেতে যেসব শর্ত পরিপালন করতে হয় তার মধ্যে একটি শর্তে বলা আছে, কর অবকাশ সুবিধা পেতে হলে ‘ইতোপূর্বে পণ্য বা সেবা উৎপাদনে ব্যবহৃত হয়েছে এরূপ কোনো মেশিন ও যন্ত্রপাতি ইত্যাদি অর্থনৈতিক অঞ্চল ও হাই-টেক পার্কের কোনো শিল্প ইউনিট স্থাপনে ব্যবহার করা যাবে না।’ এই শর্তে আপত্তি ছিল বিদেশি ব্যবসায়ীদের। সেজন্য ২০২৪ সালের দুটি প্রজ্ঞাপনের এসআরওর একটি শর্তে সংশোধনী আনা হয়েছে। সংশোধনীতে ‘ইত:পূর্বে’ শব্দের আগে ‘বাংলাদেশ’ শব্দ যুক্ত করা হয়েছে। দুটি প্রজ্ঞাপনের একটি হলো হাই-টেক পার্কে বিনিয়োগে কর সুবিধা, অপরটি ইজেডে বিনিয়োগে কর সুবিধা। দুটি এসআরওতে দফা (ক) এর উপ-দফা (ই) সংশোধন করা হয়েছে। সংশোধনের পর শর্ত দাঁড়ায়– ‘বাংলাদেশে ইতোপূর্বে পণ্য বা সেবা উৎপাদনে ব্যবহৃত হয়েছে– এমন কোনো মেশিন, যন্ত্রপাতি ইত্যাদি ইজেড ও পার্কের কোনো শিল্প ইউনিট স্থাপনে ব্যবহার করা যাবে না।’ এর অর্থ হচ্ছে বাংলাদেশে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি পুনরায় ব্যবহার করলে করছাড়ের সুবিধা পাবে না। কিন্তু বিদেশে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি এনে উৎপাদন করলে কর ছাড়ের সুবিধা পাবে।  

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, দেশে বিনিয়োগের পরিবেশ তৈরি হওয়ায় এবং কর অবকাশ দেওয়ায় জাপানি বিনিয়োগকারী অর্থনৈতিক অঞ্চল ও হাই-টেক পার্কে বিনিয়োগ করছেন। অনেক বিনিয়োগকারী বিনিয়োগের আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। সেজন্য জাপানি বিনিয়োগকারীরা কর অবকাশের ক্ষেত্রে এই শর্তটি বিশেষ করে পুরোনো মেশিনারিজ আমদানির ক্ষেত্রে শর্ত শিথিলের জন্য বিডার কাছে বিভিন্ন সময় অনুরোধ করেছেন। পরে বিডার প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে এবার বাজেটে শর্তটি শিথিল করা হয়। অনেক বিদেশি বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানের তাদের দেশে বড় বড় কারখানা রয়েছে। শর্তের কারণে সেই দেশ থেকে বাংলাদেশে পুরোনো মেশিনারিজ আনতে পারেন না। একটি ফ্যাক্টরি স্থাপন করে সব নতুন মেশিনারিজ বসাতে গেলে বিপুল অর্থের প্রয়োজন হয়। বাংলাদেশে বিনিয়োগ করা কোম্পানি তাদের নিজ দেশের নিজ কোম্পানির ব্যবহৃত মেশিনারিজ এনে বাংলাদেশে স্থাপন করা কারখানায় ব্যবহার করলে তাদের খরচ কমে যায়। সেজন্য তারা শর্ত শিথিলের অনুরোধ করেছে। 
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এনবিআরের এক কর্মকর্তা সমকালকে বলেন, মূলত জাপানি ব্যবসায়ীরা এই ধরনের সুযোগ দেওয়ার জন্য বিডাকে অনুরোধ জানিয়েছিল। পরে বিডার প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে এই সুযোগ দেওয়া হয়েছে। এই শর্তটি শিথিল করার ফলে বহু বিদেশি প্রতিষ্ঠান সুযোগটি গ্রহণ করবে। তাতে বিনিয়োগ বাড়বে বলে আশা করেন তিনি।

অর্থনৈতিক অঞ্চলে ১০ বছরের কর অবকাশ
অর্থনৈতিক অঞ্চলে (ইজেড) নতুন বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ১০ বছরের জন্য কর অবকাশ সুবিধা দেওয়া হয়। ইজেডে ব্যবসার মাধ্যমে অর্জিত আয়ের ওপর ব্যবসা শুরুর তারিখ থেকে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় বছর শতভাগ করছাড় রয়েছে। চতুর্থ বছর আয়ের ওপর ৮০ শতাংশ, পঞ্চম বছর ৭০ শতাংশ, ষষ্ঠ বছর ৭০ শতাংশ, সপ্তম বছর ৫০ শতাংশ, অষ্টম বছর ৪০ শতাংশ, নবম বছর ৩০ শতাংশ ও ১০ম বছর ২০ শতাংশ হারে আয়কর দিতে হবে। এই অবকাশ সুবিধা পেতে হলে ১২টি শর্ত মানতে হবে।

হাই-টেক পার্কে ১০ বছরের করছাড় সুবিধা
হাই-টেক পার্কে পরিচালিত ব্যবসায়ের মাধ্যমে অর্জিত আয়ের ওপর ব্যবসায়িক কার্যক্রম শুরুর তারিখ থেকে প্রথম সাত বছর পর্যন্ত শতভাগ কর অবকাশ সুবিধা রয়েছে। এ ছাড়া অষ্টম থেকে ১০ম বছর পর্যন্ত ১০ শতাংশ হারে কর অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ তিন বছর বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানকে তাদের আয়ের ওপর ৩০ শতাংশ হারে কর দিতে হবে। তবে এই কর অবকাশ সুবিধা পেতে হলে ১২টি শর্ত মানতে হবে।

বিদেশি বিনিয়োগ পরিস্থিতি
বাংলাদেশে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) কমেছে বলে জানিয়েছে জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়নবিষয়ক সংস্থা আঙ্কটাড। গত বৃহস্পতিবার সংস্থাটির ‘ওয়ার্ল্ড ইনভেস্টমেন্ট রিপোর্ট-২০২৫’-এ বাংলাদেশে এফডিআই কমার পরিসংখ্যান তুলে ধরা হয়েছে। এতে বলা হয়, ২০২৪ সালে এফডিআই তার আগের বছরের চেয়ে ১৩ শতাংশ কমেছে। গত বছর নিট বা প্রকৃত এফডিআই এসেছে ১২৭ কোটি ডলার। আর ২০২৩ সালে নিট এফডিআই ছিল ১৪৬ কোটি ৪০ লাখ ডলার। 

বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের অক্টোবর থেকে এ বছরের মার্চ পর্যন্ত আট মাসে নিট বিদেশি বিনিয়োগ এসেছে মোট ৭৫ কোটি ৬ লাখ ডলার। এ ছাড়া বিডায় মোট ৭৩৯টি শিল্প প্রকল্প নিবন্ধিত হয়েছে। এর মধ্যে শতভাগ বিদেশি প্রকল্প রয়েছে ৬৬টি এবং যৌথ বিনিয়োগ রয়েছে ৬১টি। বেজা ১৬টি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জমি ইজারা চুক্তি সম্পাদন করেছে, যার মধ্যে শতভাগ বিদেশি প্রকল্প রয়েছে ৬টি এবং যৌথ বিনিয়োগ রয়েছে ৩টি। বাংলাদেশ রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকা কর্তৃপক্ষ (বেপজা) মোট ৩১টি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ইজারা চুক্তি করেছে। বিদেশি বিনিয়োগ বাড়াতে নানা ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। 

বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান চৌধুরী আশিক মাহমুদ বিন হারুন সম্প্রতি তাঁর ফেসবুক পোস্টে বিডার অগ্রগতি বিষয়ে বিস্তারিত তুলে ধরেন। এতে চৌধুরী আশিক মাহমুদ বিন হারুন বলেন, গত বছরের অক্টোবর থেকে চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত যে পরিমাণ বিনিয়োগ এসেছে সেটি তার আগের বছরের একই সময়ের প্রায় সমান। এতে বিডার কোনো অর্জন বা ব্যর্থতা নেই। এত বড় অস্থিতিশীল পরিস্থিতির পরে এত তাড়াতাড়ি বিদেশি বিনিয়োগের পরিমাণ আগের জায়গায় ফিরে গেছে তা আশার কথা বলে মনে করেন তিনি। তবে এর পেছনে মূল শক্তি রিজার্ভ বৃদ্ধি, এক্সচেঞ্জ রেট স্থিতিশীল থাকা ইত্যাদির অবদান রয়েছে বলে মনে করেন বিডার চেয়ারম্যান। 

বিনিয়োগকারীরা কী বলছেন
অর্থনৈতিক অঞ্চল ও হাই-টেক পার্কে বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে কর অবকাশের শর্ত শিথিল প্রসঙ্গে ফরেন ইনভেস্টরস চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফআইসিসিআই) সভাপতি জাভেদ আখতার সমকালকে বলেন, এই উদ্যোগটি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে অবশ্যই ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে। তবে একটি সিদ্ধান্ত নিলে হবে না। ব্যবসা পরিচালনার ক্ষেত্রে নানা সমস্যা আছে। বিশেষ করে বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে দীর্ঘমেয়াদি নীতি প্রণয়ন করতে হবে। ঘন ঘন নীতি বদলালে বিনিয়োগকারীরা ক্ষতির মুখে পড়েন, আস্থা হারান।      
জাভেদ আখতার বলেন, বিদেশি বিনিয়োগকারীরা ব্যবসা করে নির্বিঘ্নে তাদের মুনাফা ফেরত নেওয়ার নিশ্চয়তা চান। কিন্তু সরকার পরিবর্তন হলে যদি নীতি বদলায় তাহলে শুধু বিদেশি নয়, দেশি বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগও হুমকির মুখে পড়ে। 
তাঁর মতে, বিনিয়োগ বৃদ্ধি তথা ব্যবসা পরিচালনার জন্য ব্যবসায়িক পরিবেশ সৃষ্টি করা জরুরি। বিশেষ করে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা দরকার। কারণ বিনিয়োগকারীরা ঝুঁকি নিয়ে বিনিয়োগ করতে চাইবেন না। সেজন্য বিডা ও এনবিআরকে যৌথভাবে বিনিয়োগবান্ধব নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে ভূমিকা রাখতে হবে।

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: অবক শ র স ব ধ ব যবহ র কর ব ন য় গ কর ১০ বছর র শ থ ল কর পর স থ ত ব যবস য় ব যবহ ত হ র কর জন য ব স জন য র জন য করছ ড় ত বছর শতভ গ

এছাড়াও পড়ুন:

জাতীয় পার্টিতে নেতাদের বিরোধ, ডিগবাজি

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার পতনে ৫ আগস্টের পর জাতীয় পার্টি (জাপা) চাপে পড়ায় পূর্ববর্তী ভূমিকার দায় এড়াতে বিরোধে জড়িয়েছেন দলটির নেতারা। তাদের প্রায় সবাই আওয়ামী লীগ আমলের তিন বিতর্কিত নির্বাচনে এমপি হলেও পরিবর্তিত রাজনীতিতে ‘টিকতে’ দলের চেয়ারম্যান জি এম কাদেরকে সরাতে চাচ্ছেন। ফ্যাসিবাদের দোসর তকমামুক্ত হতে জাপায় নতুন নেতৃত্বের চেষ্টা করছেন তারা। এই তৎপরতায় দলের বাইরের ‘ইন্ধন’ও রয়েছে। 

জাপা সূত্র সমকালকে এসব তথ্য জানিয়েছে। দলটির ছয় জ্যেষ্ঠ নেতার সঙ্গে আলাপে জানা গেছে, তারা মনে করেন, শেখ হাসিনার শাসনামলের বিরোধীদলীয় নেতা জি এম কাদের নেতৃত্বে থাকলে জাপা টিকতে পারবে না। অভ্যুত্থানের ছাত্রনেতাদের বিরোধিতার কারণে সরকারের বৈঠক এবং সংস্কারে ডাক না পাওয়া জি এম কাদের যেভাবে আওয়ামী লীগের পক্ষে বলছেন, তাতে জাপার বিপদ বাড়ছে। তাই তাঁকে ঝেড়ে ফেলতে ডিগবাজি খেয়ে তৎপর হয়েছেন জাপার আওয়ামী লীগপন্থি হিসেবে পরিচিত নেতারা। 

জি এম কাদের ২৮ জুনের সম্মেলন স্থগিত করলেও জ্যেষ্ঠ নেতারা জানিয়েছেন, ওই দিন সম্মেলন হবেই। কাদের না এলে তাঁর অনুপস্থিতিতেই সম্মেলন হবে। নতুন নেতৃত্বও নির্বাচিত হবে সেদিন।

প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কর্মসূচি থাকায় ২৮ জুন চীন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রে দলের সম্মেলন করা সম্ভব নয়– কারণ দেখিয়ে ১৭ জুন জি এম কাদের সম্মেলন স্থগিতের সিদ্ধান্ত জানান।

যদিও তাঁর বিরোধীদের ভাষ্য, চীন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্র না পেলে প্রেসিডিয়ামের সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কাকরাইলে দলীয় কার্যালয়ের সামনের সড়কে সম্মেলন হবে। তবে এখনও চীন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্র ভাড়া পাওয়ার চেষ্টা চলছে। সম্মেলনের জন্য আগামীকাল রোববারের মধ্যে পুলিশ-প্রশাসনের অনুমতি পাওয়া যাবে জানিয়েছেন দলের চেয়ারম্যানবিরোধীরা।

এখনও জি এম কাদেরের অনুগত প্রেসিডিয়াম সদস্য ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটওয়ারী সমকালকে বলেন, গঠনতন্ত্র অনুযায়ী দলের চেয়ারম্যান সম্মেলনে সভাপতিত্ব করবেন। তিনি অনুপস্থিতি থাকলে সেই সম্মেলন অবৈধ হবে। 

জাপা নেতারা জানান, জি এম কাদেরকে সরাতে সামনে আনা হয়েছে দলের গঠনতন্ত্রের ২০(ক) ধারা। এ ধারার ফলে জাপা চেয়ারম্যান কারণ দর্শানো ছাড়াই দলের যে কাউকে পদ থেকে সরাতে পারেন, বহিষ্কার করতে পারেন। যে কাউকে যে কোনো পদ দিতে পারেন। এ জন্য তাঁর জবাবদিহিতা নেই।

১৯৮৬ সালে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ জাপা প্রতিষ্ঠা করার পর থেকেই এই ধারা রয়েছে দলের গঠনতন্ত্রে। এর ক্ষমতাবলে এরশাদের পর জি এম কাদেরও অনেক নেতাকে পদ দিয়েছেন, বহিষ্কার করেছেন। সম্মেলনে নির্বাচিত মহাসচিবকে সরিয়েছেন। 

এ ধারা বিলোপে একাট্টা হয়েছেন জাপার সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, কো-চেয়ারম্যান এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদার, মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নুসহ সাবেক ও বর্তমান জ্যেষ্ঠ নেতাদের বড় অংশ। তাদের প্রায় সবাই আওয়ামী লীগে বিতর্কিত নির্বাচনে এমপি-মন্ত্রী হয়েছেন। আনিসুল ইসলাম এবং রুহুল আমিন হাওলাদার ১৯৭৯ সালের নির্বাচনে বিএনপির এমপি ছিলেন।

জাপার চেয়ারম্যান হতে চাচ্ছেন আনিসুল ইসলাম মাহমুদ। মহাসচিব হতে চাচ্ছেন রুহুল আমিন হাওলাদার। ২০১৪ সালের নির্বাচন এরশাদ ও জি এম কাদের বর্জন করলেও রওশন এরশাদ ও আনিসুলের নেতৃত্বে জাপা অংশ নেয়। জাপা বিরোধী দলের আসনে বসলেও হাসিনা সরকারের মন্ত্রী হন আনিসুল ইসলাম। ২০১৮ সালেও তিনি এমপি হন। গত বছরের ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের পর বিরোধীদলীয় উপনেতা হয়েছিলেন। 

রুহুল আমিন হাওলাদার ২০১৪ এবং ২০২৪ সালে এমপি হয়েছেন। ২০১৩ সালে ছিলেন সর্বদলীয় সরকারের মন্ত্রী। মুজিবুল হক চুন্নু তিন নির্বাচনেই এমপি হয়েছেন। ২০১৪ সালে ছিলেন প্রতিমন্ত্রী। জি এম কাদেরের সঙ্গে বিরোধে রওশনের নেতৃত্বে পৃথক জাতীয় পার্টি গড়া কাজী ফিরোজ রশিদ এবং সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা ২০১৪ এবং ২০১৮ সালে এমপি হন। তারাও জি এম কাদেরকে নেতৃত্ব থেকে সরানোর তৎপরতায় যোগ দিয়েছেন।

বিরোধী দলের আসনে বসেও প্রায় সব ইস্যুতে সরকারের সুরে কথা বলে আওয়ামী লীগের আমলে গৃহপালিত বিরোধী দলের তকমা পাওয়া জাপার নেতাদের মধ্যে জি এম কাদের বাদে অন্যরা ৫ আগস্টের পর শেখ হাসিনার সমালোচনা করছেন।

কয়েক দিন ধরে গণমাধ্যমকে এড়িয়ে চলছেন জি এম কাদের। তবে তিনি একাধিকবার বলেছেন, যারা শেখ হাসিনার সময়ে সরকারের ক্ষমতা ব্যবহার করে জাপাকে যন্ত্রণা দিয়েছে, তারাও আবার তৎপর হয়েছে। তাদের লক্ষ্য নতুন ক্ষমতাধরদের খুশি করে আগামী নির্বাচনে কিছু একটা পাওয়া।

যদিও এসব বক্তব্যকে নাকচ করেছেন চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী হতে চাওয়া ব্যারিস্টার আনিসুল। তিনি বলেছেন, জি এম কাদের নিজে শেখ হাসিনার মন্ত্রী হয়েছেন। সরকারকে ব্যবহার করে বিরোধীদলীয় উপনেতা, নেতা হয়েছেন। তাঁর মুখে এসব কথা মানায় না।

চেয়ারম্যানকে ভারতের দোসর আখ্যা দিয়ে আনিসুল ইসলাম বলেছেন, জি এম কাদের একসময় বলেছেন, ভারত অনুমতি না দেওয়ায় তিনি সব কথা বলবেন না। এখন তিনি যেসব কথা বলেছেন আওয়ামী লীগের সমর্থনে, সেগুলো কি ভারতের অনুমোদনে বলছেন? তাঁর বিরুদ্ধে দলীয় চেয়ারম্যানের ক্ষমতার অব্যবহার হয়, আর্থিক কেলেঙ্কারিরও অভিযোগ রয়েছে।

এখনও জি এম কাদেরের সঙ্গে রয়েছেন বলে জানালেও মুজিবুল হক চুন্নু সমকালকে বলেন, সম্মেলন ২৮ জুন হবে কিনা জানি না। তবে প্রেসিডিয়ামের সভায় সিদ্ধান্ত হয়েছিল, ওইদিন চীন মৈত্রীতে বা কাকরাইলে সম্মেলন হবে। চীন মৈত্রী না পাওয়ায় কাকরাইলে সম্মেলন করা যেত। কিংবা প্রেসিডিয়ামের অনুমোদন নিয়ে সম্মেলন স্থগিত করা যেত। চেয়ারম্যান একক সিদ্ধান্তে সম্মেলন স্থগিত করায় কাজটি সুন্দর হয়নি। সম্মেলনে আনিসুল ইসলাম এবং রুহুল আমিন হাওলাদার একটি প্যানেল দিচ্ছেন। জি এম কাদেরের প্যানেল থেকে আমি মহাসচিব প্রার্থী হতে চাই। জি এম কাদের যদি সম্মেলন না করেন, তখন কোথায় যাব?

২০(ক) ধারা পরিবর্তনের দাবি জানিয়ে চুন্নু বলেন, জি এম কাদের গণতন্ত্রের কথা সবচেয়ে বেশি বলেন। তিনি গণতন্ত্রের চ্যাম্পিয়ন। কিন্তু ২০(ক) ধারাও রাখছেন। এ ধারা বলে তিনি যে কোনো সময়ে মহাসচিবকেও সরাতে পারেন। এত অনিশ্চয়তা নিয়ে রাজনীতি হয় না। তাই ধারাটি শিথিল করে প্রেসিডিয়ামের অনুমোদনে বহিষ্কার এবং পদ দেওয়ার নিয়ম করতে বলেছি।

জি এম কাদেরবিরোধীদের সূত্রের খবর, আনিসুল চেয়ারম্যান ও রুহুল আমিন মহাসচিব হবেন। চুন্নুকে নির্বাহী চেয়ারম্যান হওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান হবেন কাজী ফিরোজ রশীদ। তিনি এককালে এরশাদকে ছেড়ে জাপা ভেঙে বিএনপির জোটে গিয়েছিলেন। জাপা ভেঙে একই নামে দল করা আনোয়ার হোসেন মঞ্জুকে দলে ফিরিয়ে প্রধান পৃষ্ঠপোষক হওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। তিনিও শেখ হাসিনার মন্ত্রী ছিলেন। 

আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর বিষয়ে আনিসুল ইসলাম বলেছেন, তাঁকে সম্মেলনে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। তিনি উপস্থিত থাকবেন বলে আশা করছি। যারা অতীতে জাতীয় পার্টি থেকে চলে গেছেন, পৃথক দল করেছেন– তাদের সবাইকে ফিরিয়ে আনার প্রচেষ্টা রয়েছে। সৌজন্যতার অংশ হিসেবে বিএনপি এবং অন্য দলকে আমন্ত্রণ করা হবে।
সম্মেলনের সঙ্গে সরকার বা সরকারি সংস্থার যোগসূত্র নেই বলেও দাবি করেন আনিসুল ইসলাম। তবে জি এম কাদেরের অনুসারী এক প্রেসিডিয়াম সদস্য বলেন, যারা সম্মেলন চান তাদের সবাই ‘ডিপ স্টেটের’ নিয়ন্ত্রিত ছিলেন। তারা নতুন করে কিছু করছেন মানেই, রাষ্ট্রযন্ত্রের সমর্থনে করছেন। কিংবা ৫ আগস্ট-পরবর্তী মামলা থেকে বাঁচতে করছেন। আবার সবাই ধনাঢ্য ব্যবসায়ী হওয়ায় ব্যবসা রক্ষার স্বার্থেও তৎপর হতে পারেন।

সম্পর্কিত নিবন্ধ