ভোরের আলোয় শুকিয়ে উঠছে কিছু ভেজা পলিথিন– রোদ, হাওয়া আর খাদিজা বেগমের নিরলস শ্রমে। এগুলো কুড়িয়ে আনা হয়েছে শহরের গলি থেকে, ডাস্টবিনের কোণ থেকে, কারও অবহেলার ফেলে দেওয়া জিনিস থেকে; যেটি কারও কাছে ছিল ফেলনা, সেটিই কারও কাছে স্বর্ণের মতো মূল্যবান। সেই প্লাস্টিক বিক্রি করে কেনা হয় শিশুর স্কুলের টিফিন, বা চালিয়ে নেওয়া হয় বাসার এক বেলার খাবার।
চট্টগ্রামের প্রতিদিনের ব্যস্ত নগরজীবনে এমন হাজারো গল্প বয়ে চলে টুকরো টুকরো প্লাস্টিকের মধ্য দিয়ে; যেখানে ‘বর্জ্য’ শব্দটা শুধু দূষণ নয়; বরং হয়ে ওঠে কোনো কোনো পরিবারের টিকে থাকার কৌশল, শ্রমের গল্প এবং বিকশিত হওয়ার সংগ্রাম।
শহরজুড়ে প্রতিদিন উৎপন্ন হয় প্রায় ২৫০ থেকে ৩০০ টন প্লাস্টিক বর্জ্য, যার একটি বড় অংশই সিঙ্গেল ইউজড প্লাস্টিক; একবার ব্যবহারের পরই ফেলে দেওয়া হয়। ফেলে দিলেই তো সবকিছু শেষ হয় না। বরং ঠিক তখনই শুরু হয় অন্য কারও জীবনের সংগ্রাম, আর কারও সম্ভাবনার নতুন এক যাত্রা।
বন্দর নগরীর একটি বর্জ্য পুনর্ব্যবহার কেন্দ্রে দেখা যায় ৬০ বছর বয়সী এক নারী–রহিমা বেগম; সম্মাননাপ্রাপ্ত একজন ওয়েস্ট পিকার। প্রতিদিন ভোরে বের হন ময়লার স্তূপে প্লাস্টিক খুঁজতে। তিনি মাসে গড়ে প্রায় পাঁচ মণ প্লাস্টিক সংগ্রহ করেন, যার বিক্রয়মূল্য প্রায় ১০ হাজার টাকা। এই আয়ে চলে তাঁর পরিবারের খরচ। রহিমার মতো আরও অসংখ্য নারী ও পুরুষ প্রতিদিনই নামেন এই অদৃশ্য অথচ অমূল্য সংগ্রামে।
এই সংগ্রহ করা প্লাস্টিক পড়ে থাকে না অকেজো বস্তু হয়ে। বরং প্রক্রিয়াজাত হয়ে তা তৈরি হয় নতুন পণ্য–টাইলস তৈরির উপকরণ, নির্মাণসামগ্রী, ইনস্যুলেশন, এমনকি ঘর সাজানোর সামগ্রী। পুরোনো বোতল বা মোড়কের টুকরো থেকে তৈরি হচ্ছে চেয়ার, প্যাকেজিং বাক্স কিংবা শিল্প গ্রানুলস–যেগুলো দেশের বাইরেও রপ্তানি হচ্ছে।
এটিই হলো ‘সার্কুলার ইকোনমি’– একটি অর্থনৈতিক মডেল; যেখানে ব্যবহারযোগ্য জিনিস একবার ব্যবহার করে ফেলে না দেওয়া হয়, বরং পুনর্ব্যবহার, মেরামত ও রূপান্তরের মাধ্যমে আবারও ব্যবহারচক্রে ফিরিয়ে আনা হয়। এই ব্যবস্থায় ‘বর্জ্য’ই হয়ে ওঠে সম্পদ। চট্টগ্রাম নগরী এখন এই ধারার এক উজ্জ্বল বাস্তব উদাহরণ; যেখানে ব্যবহৃত প্লাস্টিক রূপ নিচ্ছে নতুন পণ্যে, তৈরি করছে কর্মসংস্থান এবং কমাচ্ছে প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর চাপ।
বর্তমানে চট্টগ্রামে ১,০০০টিরও বেশি প্লাস্টিক বর্জ্য সংগ্রহকারী ভাঙারির দোকান বা ইউনিট সক্রিয় রয়েছে, যেখানে কাজ করছেন প্রায় ২০ হাজার মানুষ। এই দোকানগুলোই হয়ে উঠেছে পুনর্ব্যবহার ব্যবস্থার মূল সেতুবন্ধ, প্রতিদিন প্লাস্টিক সংগ্রহ, বিক্রয় ও সরবরাহ হচ্ছে রিসাইক্লিং কারখানায়। একটি বোতল, এক টুকরো মোড়ক কিংবা একটি ব্যাগ– সবকিছুরই এখন আলাদা বাজারমূল্য রয়েছে।
২০২৩ সালে চট্টগ্রাম থেকে রপ্তানি হওয়া রিসাইক্লিং পণ্যের দাম দাঁড়ায় প্রায় ৪৮ কোটি টাকা। ভারত, মালয়েশিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ বিভিন্ন দেশে এইসব সামগ্রীর চাহিদা বেড়ে চলেছে। ফলে, এক সময়কার ‘ফেলনা প্লাস্টিক’ আজ দেশের অর্থনীতির এক সম্ভাবনাময় খাতে পরিণত হয়েছে।
এই পুরো পরিবর্তনের পেছনে রয়েছে একটি সমন্বিত উদ্যোগ। ২০২২ সাল থেকে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক), বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ইপসা এবং ইউনিলিভার বাংলাদেশ একত্রে কাজ করছে প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনায়। তিন বছরে তারা ২৪ হাজার টন প্লাস্টিক বর্জ্য সংগ্রহ করেছে। পাশাপাশি, তিন হাজারের বেশি ওয়েস্ট পিকারকে প্রশিক্ষণ দিয়ে গড়ে তুলেছে দক্ষ জনবল, যারা এখন আরও নিরাপদ ও সম্মানজনক পরিবেশে কাজ করছেন।
চট্টগ্রাম আজ বাংলাদেশের জন্য একটি দৃষ্টান্ত; যেখানে প্লাস্টিক মানেই দূষণ নয়, বরং সঠিক ব্যবস্থাপনায় তা হয়ে উঠতে পারে জীবিকার উৎস, রপ্তানিযোগ্য পণ্য এবং একটি সবুজ, টেকসই অর্থনীতির ভিত্তি। এই শহর প্রমাণ করে দিয়েছে, যতই ফেলনা মনে হোক; টুকরো টুকরো প্লাস্টিকেও লুকিয়ে থাকতে পারে একটি পরিবারের আশ্রয়, একটি শহরের ভবিষ্যৎ, আর একটি পুনর্ব্যবহারযোগ্য পৃথিবীর স্বপ্ন। 

শিক্ষার্থী, দ্বিতীয় বর্ষ
ফরেস্ট্রি বিভাগ
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: প ল স ট ক বর জ য র ব যবহ র ব যবস থ স গ রহ

এছাড়াও পড়ুন:

থানা থেকে লুট হওয়া অস্ত্র অপরাধীদের হাতে

চট্টগ্রাম নগরে থানা-ফাঁড়ি থেকে লুট হওয়া অনেক আগ্নেয়াস্ত্র ও গুলি এখনো উদ্ধার হয়নি। এসব অস্ত্র-গুলি ডাকাতি, ছিনতাইসহ নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে ব্যবহৃত হচ্ছে। লুট হওয়া অস্ত্র কেনাবেচায় পুলিশেরও সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে।

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের দিন গত বছরের ৫ আগস্ট চট্টগ্রাম নগরের আটটি থানা ও আটটি ফাঁড়িতে হামলা ও অগ্নিসংযোগ করেন বিক্ষুব্ধ লোকজন। সে সময় ৮১৩টি আগ্নেয়াস্ত্র ও ৪৪ হাজার ৩২৪টি গুলি লুট হয়। পুলিশের একটি সূত্র বলছে, বেশির ভাগ অস্ত্র-গুলি এখনো উদ্ধার হয়নি।

জানতে চাইলে নগর পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার (গণমাধ্যম) মাহমুদা বেগম সুনির্দিষ্ট তথ্য দিতে পারেননি। তবে অস্ত্র উদ্ধারে অভিযান চলছে বলে জানান তিনি।

গত ২১ জুলাই নগরের চান্দগাঁওয়ে ‘সন্ত্রাসী’ ইসমাইল হোসেন ওরফে টেম্পো ও শহিদুল ইসলাম ওরফে বুইসার বাহিনীর মধ্যে গোলাগুলি হয়। পরে পুলিশ বহদ্দারহাট কাঁচাবাজার এলাকায় সন্ত্রাসী শহিদুলের আস্তানার সন্ধান পায়। সেখানে লুট হওয়া দুটি গুলি ও গুলির খোসা পাওয়া যায়।

চান্দগাঁও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আফতাব উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, শহিদুলের দখল করা একটি ফ্ল্যাট থেকে গুলি ও দেশি অস্ত্র উদ্ধার করা হয়। ফ্ল্যাটটি টর্চার সেল হিসেবে ব্যবহৃত হতো।

গত বছরের ২৯ আগস্ট নগরের বায়েজিদ-হাটহাজারী থানার সীমানাসংলগ্ন কুয়াইশ এলাকায় মাসুদ কায়সার ও মো. আনিস নামে দুই ব্যক্তিকে গুলি করে হত্যা করা হয়। ঘটনাস্থল থেকে পাঁচটি গুলির খোসা (শটগানের কার্তুজ) উদ্ধার করা হয়। সেগুলোও লুট করা গুলির খোসা বলে নিশ্চিত হয় পুলিশ।

নিহত আনিসের স্ত্রী শামিম আকতারের অভিযোগ, সন্ত্রাসী সাজ্জাদ পুলিশের গুলি ব্যবহার করে তাঁর স্বামীসহ দুজনকে খুন করেছেন। তবে সাজ্জাদ কারাগারে থাকায় তাঁর বক্তব্য জানা সম্ভব হয়নি।

এদিকে ৩ মার্চ সাতকানিয়ায় পিটুনিতে দুজনের মৃত্যুর পর ঘটনাস্থল থেকে পুলিশ যে পিস্তল উদ্ধার করে, সেটিও থানা থেকে লুট হওয়া।

১৭ এপ্রিল নগরের ডবলমুরিং থানার বারিক বিল্ডিং মোড় থেকে আরিফ হোসেন নামের এক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তাঁর আস্তানা থেকে একটি পিস্তল ও ৫০টি গুলি উদ্ধার করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদে আরিফ স্বীকার করেন, এসব অস্ত্র-গুলি থানা থেকে লুট করা। তিনি অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে ডাকাতি ও ছিনতাই করেন।

গত ২৫ জানুয়ারি ডবলমুরিং থানার ঝরনাপাড়ায় পুলিশ অভিযান চালিয়ে ১৬টি গুলি, ১টি রাবার বুলেটসহ তিনজনকে গ্রেপ্তার করে। এ ছাড়া ১৫ ফেব্রুয়ারি ডবলমুরিং থানার চৌমুহনী এলাকার চারিয়াপাড়ায় অভিযান চালিয়ে পুলিশ অস্ত্রসহ তিনজনকে গ্রেপ্তার করে। পুলিশ জানায়, এসব অভিযানে উদ্ধার হওয়া অস্ত্র-গুলি লুট হওয়া এবং গ্রেপ্তার ছয়জনই ছিনতাইকারী।

১৭ জুন নগরের মেরিন সড়ক থেকে পিস্তল-গুলিহ মো. রুবেল নামের একজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। পিস্তলটি থানা থেকে লুট হওয়া বলে পুলিশ নিশ্চিত করেছে। এদিকে পিস্তলটি বিক্রির সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে গত ২১ মার্চ মো. রিয়াদ নামের পুলিশের এক কনস্টেবলসহ ছয়জনকে পতেঙ্গা ও বাকলিয়া থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে রিয়াদসহ তিনজন আদালতে অস্ত্র কেনাবেচায় জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেন।

সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) চট্টগ্রামের সম্পাদক আখতার কবির চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, অস্ত্র, গুলি উদ্ধারে বিশেষ অভিযান পরিচালনা না করলে কিংবা মনোযোগ না দিলে জননিরাপত্তা এবং সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় শৃঙ্খলা হুমকির মুখে পড়বে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ