বাংলাদেশের পাটপণ্য আমদানির ওপর কাউন্টারভেলিং ডিউটি বা প্রতিকারমূলক শুল্ক বসাতে তদন্ত শুরু করেছে ভারতের বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রণালয়ের বাণিজ্য বিভাগ। নেপালের বিরুদ্ধেও একই তদন্ত করছে তারা। ভারতের পাটকল সমিতি (আইজেএমএ) এবং এ পি মেস্তা টোয়াইন মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (এজেএমএ) যৌথ আবেদনের পর বাংলাদেশ ও নেপালের পাটপণ্যের ওপর কাউন্টারভেলিং শুল্ক বসাতে গত ২৯ সেপ্টেম্বর এ বিষয়ে তদন্তের ঘোষণা দেয় বিভাগটি। ভারতের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে এই তদন্তের বিষয়টি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে জানানো হয়।

পাটপণ্যের ওপর কাউন্টারভেলিং শুল্ক আরোপের তদন্ত শুরু করা হলেও ২০১৮ সালে বাংলাদেশি একই পণ্যের ওপর অ্যান্টিডাম্পিং শুল্ক আরোপ করে ভারত সরকার। প্রথমে পাঁচ বছরের জন্য এই শুল্ক আরোপ করা হয়েছিল। ২০২৩ সালে সেটি আরও পাঁচ বছরের জন্য বাড়ানো হয়। তখন বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি হওয়া পাটপণ্যে ভিন্ন ভিন্ন হারে অ্যান্টিডাম্পিং শুল্ক আরোপ করা হয়। প্রতি টনে ৬ ডলার থেকে ৩৫২ ডলার পর্যন্ত অ্যান্টিডাম্পিং শুল্ক বসে। উৎপাদন মূল্যের তুলনায় কম দামে বাংলাদেশের পাটকলমালিকেরা ভারতে পাটপণ্য রপ্তানি করছেন, এমন অভিযোগে ২০১৫ সালে অ্যান্টিডাম্পিং শুল্ক আরোপের জন্য প্রথম তদন্ত শুরু করেছিল ভারতীয় কর্তৃপক্ষ।

নতুন করে শুল্ক আরোপের জন্য ভারতের তদন্তের উদ্যোগে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বাংলাদেশের বেসরকারি পাটকলমালিকেরা। তাঁরা বলছেন, বাংলাদেশের পাটপণ্যের অন্যতম বড় বাজার ভারত। এই বাজারে নিত্যনতুন শুল্ক ও অশুল্ক বাধার মুখে পড়তে হচ্ছে। নতুন করে আবার শুল্ক আরোপ করা হলে বাজারটিতে রপ্তানি আরও কমবে। তাতে অনেক পাটকল বন্ধ হয়ে যেতে পারে।

ভারত সরকার তাদের ব্যবসায়ীদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে একটি পর্যালোচনা শুরু করেছে। আমরা আমাদের পাটপণ্য রপ্তানিকারকদের যুক্ত করেছি। আমরা একটি পরামর্শ সভা আয়োজনের অনুরোধ করব।—মইনুল খান, চেয়ারম্যান, ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন

বাংলাদেশ জুট স্পিনার্স অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান তাপস প্রামাণিক প্রথম আলোকে বলেন, ভারতের ব্যবসায়ীদের দাবিগুলো অযৌক্তিক। নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে কাউন্টারভেলিং শুল্ক আরোপের তদন্ত শুরু করেছে ভারত। বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার প্রয়োজন সরকারের। তিনি আরও বলেন, বর্তমানে উভয় দেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক ভালো নয়। স্থলবন্দর দিয়ে পণ্য রপ্তানি বন্ধ। তাতে খরচ বেড়েছে। তার বাইরে শুল্ক ও অশুল্ক বাধা আছে। নতুন করে কাউন্টারভেলিং শুল্ক বসলে ব্যবসা আরও ক্ষতির মুখে পড়বে।

কাউন্টারভেলিং শুল্ক আরোপের তদন্ত শুরুর নোটিশে ভারতের বাণিজ্য বিভাগ বলেছে, আইজেএমএ এবং এজেএমএ বাংলাদেশ ও নেপাল থেকে পাটজাত পণ্য আমদানির ওপর কাউন্টারভেলিং শুল্ক আরোপের তদন্ত শুরু করতে সরকারের প্রতি অনুরোধ করে। বাণিজ্য সংগঠন দুটির অভিযোগ, বাংলাদেশ ও নেপাল থেকে পাটপণ্যের রপ্তানিকারকেরা সরকারের কাছ থেকে নগদ সহায়তাসহ বিভিন্ন ভর্তুকি পেয়ে থাকেন। এতে দেশ দুটি থেকে ভারতে পাটপণ্য আসা বেড়ে গেছে। ফলে ভারতের শিল্পকারখানার মুনাফা উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস পেয়েছে।

আইজেএমএ এবং এজেএমএর সদস্য আটটি পাটকল এ বিষয়ে অভিযোগ করলেও তারা বাংলাদেশ ও নেপাল থেকে কোনো পাটপণ্য আমদানি করেনি। তবে বাংলাদেশ ও নেপাল থেকে আমদানি হওয়া পাটপণ্যে তাদের উৎপাদিত পণ্যের সাদৃশ্য রয়েছে বলে অভিযোগ পাটকলগুলোর।

নতুন করে কাউন্টারভেলিং শুল্ক বসলে ভারতে আর পাটপণ্য রপ্তানি করা যাবে কি না, সন্দেহ। করোনাকালেও একবার দেশটি এ ধরনের শুল্ক আরোপের উদ্যোগ নিলে আমরা আমাদের যুক্তিতর্ক দিয়েছিলাম।—মোস্তফা আবিদ খান, সাবেক সদস্য, ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন

কাউন্টারভেলিং শুল্ক আরোপের তদন্তের অধীন পাটপণ্যের মধ্যে রয়েছে পাটের সুতা, স্যাকিং ব্যাগ ও কাপড়, হেসিয়ান ব্যাগ ও কাপড়। এ ছাড়া খনিজ বা উদ্ভিজ্জ তেলযুক্ত পাটপণ্য ও বহুমুখী পাটপণ্যও তদন্তের অধীন থাকবে। যদিও কম্বল, সাজসজ্জার কাপড়, হস্তশিল্প, কার্পেটের কাপড়, উপহার বা শৌখিন পণ্য তদন্তের আওতার বাইরে থাকবে। তদন্তের সময়কাল নির্ধারণ করা হয়েছে গত বছরের এপ্রিল থেকে চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত মোট ১২ মাস।

বাংলাদেশের পাটপণ্য রপ্তানিকারকেরা কী ধরনের ভর্তুকি পান, সে বিষয়ে তদন্তের নোটিশে বলা হয়, বাংলাদেশের রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকায় (ইপিজেডে) কারখানা লভ্যাংশ কর থেকে অব্যাহতি ও বাজারমূল্যের চেয়ে কম দামে বিদ্যুৎ পায়। তা ছাড়া অর্থনৈতিক অঞ্চলের কারখানাগুলো ১০ বছরের কর অবকাশ ও কাঁচামাল আমদানিতে আমদানি শুল্কে অব্যাহতি পায়। এ ছাড়া নগদ সহায়তা, মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানিতে শুল্ক ও ভ্যাট অব্যাহতি ইত্যাদি সুবিধা দেওয়া হয়।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তা জানান, কাউন্টারভেলিং শুল্ক আরোপের তদন্ত শুরুর আগে অভিযুক্ত দেশের সঙ্গে পরামর্শ সভা করতে হয়। ভারতের বাণিজ্য বিভাগ গত ১ সেপ্টেম্বর পরামর্শ সভা করার জন্য বাংলাদেশের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে অবহিত করে। মন্ত্রণালয় প্রস্তুতির জন্য দুই মাসের সময় চায়। তবে ভারতের বাণিজ্য বিভাগ সেই সময় দেয়নি। ভারতের তদন্ত শুরুর নোটিশে বলা হয়েছে, গত ১ সেপ্টেম্বরের পরামর্শ সভায় বাংলাদেশ ও নেপাল অংশ নেয়নি।

ভারতের ব্যবসায়ীদের দাবিগুলো অযৌক্তিক। নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে কাউন্টারভেলিং শুল্ক আরোপের তদন্ত শুরু করেছে ভারত। বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার প্রয়োজন সরকারের।—তাপস প্রামাণিক, চেয়ারম্যান, জুট স্পিনার্স অ্যাসোসিয়েশন

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের চেয়ারম্যান মইনুল খান গত সোমবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘ভারত সরকার এখন তদন্ত করছে। আমরা একটি পরামর্শ সভা আয়োজনের অনুরোধ করব। আমাদের রপ্তানিকারকদের সহায়তার জন্য কমিশনের একজন সদস্যের নেতৃত্বে একটি ডেস্ক চালু করা হয়েছে।’

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যানুযায়ী, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে মোট ৮২ কোটি ডলারের পাট ও পাটপণ্য রপ্তানি হয়। তার মধ্যে ৬৭ কোটি ডলারের পাটপণ্য রয়েছে। গত অর্থবছরে ভারতে রপ্তানি হয়েছে প্রায় সাড়ে আট কোটি ডলারের পাটপণ্য।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের সাবেক সদস্য মোস্তফা আবিদ খান গতকাল বুধবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘নতুন করে কাউন্টারভেলিং শুল্ক বসলে ভারতে আর পাটপণ্য রপ্তানি করা যাবে কি না সন্দেহ। করোনাকালেও একবার দেশটি এ ধরনের শুল্ক আরোপের উদ্যোগ নিলে দুই দেশের পরামর্শ সভায় আমরা আমাদের যুক্তি দিয়েছিলাম। তখন তারা আর তদন্তের পথে যায়নি। বর্তমানে দুই দেশের মধ্যের কূটনৈতিক সম্পর্ক যে জায়গায় পৌঁছেছে, তাতে বিষয়টি নিয়ে সরকারের এগোনো দুষ্কর হবে।’

অপর এক প্রশ্নের জবাবে মোস্তফা আবিদ খান আরও বলেন, অভিযোগের পিটিশন দেখে বাংলাদেশের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে প্রস্তুতি নিতে হবে। তবে তার জন্য অভিজ্ঞ লোকজন লাগবে। অবশ্যই বাংলাদেশের অভিযোগের বিরুদ্ধে যুক্তি দেখানোর জায়গা থাকবে বলে মনে করেন তিনি।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: শ ল ক আর প র তদন ত শ র ল দ শ র প টপণ য শ ল ক আর প কর র প টপণ য র শ ল ক বস সরক র র তদন ত র ত ন কর আম দ র র জন য সদস য ব ষয়ট আমদ ন ব যবস বছর র প রথম

এছাড়াও পড়ুন:

অর্থ আত্মসাতে ‘আওয়ামী লীগ-বিএনপি’ জোট

রাজধানীর আগারগাঁও বাজার বণিক সমবায় সমিতির বৈদ্যুতিক সংযোগের হিসাব নম্বর-১৭০০৪৯৯০ অনুযায়ী ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ১৬ লাখ ৫৯ হাজার ৮২৭ টাকার বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করা হয়েছে।

কিন্তু সমিতির ব্যবস্থাপনা কমিটি ওই অর্থবছরে বিদ্যুৎ বিল বাবদ ১৮ লাখ ৫৬ হাজার ৩৭৯ টাকা ব্যয় দেখিয়েছে। যা প্রকৃত পরিশোধের চেয়ে প্রায় দুই লাখ টাকা বেশি। সমিতির সদস্যদের অভিযোগ, অতিরিক্ত বিল দেখিয়ে কমিটির নেতারা ওই টাকা আত্মসাৎ করেছেন।

বিদ্যুৎ বিলের বাইরে নেতারা কুলখানি ও মিলাদ, আপ্যায়ন, প্রশাসনিক খরচ, অনুদান, সম্মানী ভাতা, মামলার খরচ, বিদ্যুতের মালামাল ক্রয় ও যাতায়াত বাবদ ব্যয় দেখিয়ে গত দুই অর্থবছরে অন্তত দেড় কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন। এ মর্মে সমিতির সদস্যরা জেলা সমবায় কর্মকর্তার কাছে লিখিত অভিযোগও দিয়েছেন। অনেক খাতে টাকা ব্যয় দেখানো হয়েছে, যেখানে সমিতির ব্যয়ের সুযোগ নেই এবং সদস্যদের অনুমোদনও নেওয়া হয়নি।

বিদ্যুৎ বিল বেশি দেখানোর সুযোগ নেই। কোনো কারণে অতিরিক্ত খরচ হলে তা সাপ্লিমেন্টারি হিসেবে দেখানো হয়েছে। বার্ষিক সাধারণ সভায় (এজিএম) যার অনুমোদন নেওয়া হয়েছে। তাঁর পাল্টা অভিযোগ, সমিতির চার সদস্যের একটি চক্র বিভিন্ন জায়গায় তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করছেন।সমিতির সভাপতি এ বি এম নুরুল হক চৌধুরী

সমিতির সদস্য রবিউল ইসলাম বলেন, বর্তমান কমিটির নেতারা ফ্যাসিস্ট সরকারের সময় থেকেই সাধারণ সদস্যদের টাকা আত্মসাৎ করছেন। প্রতিবাদ করলে সদস্যপদ বাতিল ও নানাভাবে অত্যাচার করা হয়। অতীতে এর মূলে ছিলেন কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগপন্থী নেতারা। বর্তমানে বিএনপিপন্থী নেতারা সক্রিয় এবং আওয়ামীপন্থীদের যোগসাজশে টাকা আত্মসাৎ চলছে।

২০২৩ সালের এপ্রিল থেকে সমিতির মার্কেট ভবনের নির্মাণকাজ চলছে নূরানী কনস্ট্রাকশন লিমিটেডের মাধ্যমে। ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের এক কর্মকর্তা জানান, প্রতিটি দোকানের আকার প্রায় ৭০ বর্গফুট বা তার বেশি। কিছু দোকান একত্রে বড় আকারে তৈরি হচ্ছে। নকশা অনুযায়ী, দুটি বেজমেন্টসহ ভবনটি ১৩ তলার। বেজমেন্ট-২–এ পার্কিং, বেজমেন্ট-১–এ কাঁচাবাজার এবং নিচতলা থেকে দোকান থাকবে। মোট সদস্যসংখ্যা ১ হাজার ৪৫৫টির বাইরে আরও অর্ধশত দোকান তৈরি হবে।

২০২৩-২৪ অর্থবছরে অতিরিক্ত প্রায় দুই লাখ টাকা বিদ্যুৎ বিলের বিষয়ে জানতে চাইলে সমিতির সভাপতি এ বি এম নুরুল হক চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, বিদ্যুৎ বিল বেশি দেখানোর সুযোগ নেই। কোনো কারণে অতিরিক্ত খরচ হলে তা সাপ্লিমেন্টারি হিসেবে দেখানো হয়েছে। বার্ষিক সাধারণ সভায় (এজিএম) যার অনুমোদন নেওয়া হয়েছে। তাঁর পাল্টা অভিযোগ, সমিতির চার সদস্যের একটি চক্র বিভিন্ন জায়গায় তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করছেন।

অভিযোগের বিষয়ে তদন্তের জন্য কর্মকর্তা নিয়োগ করা হয়েছে। প্রথম নিয়োগ করা কর্মকর্তাকে নিয়ে তাঁদের আপত্তির কারণে অন্য একজনকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।ঢাকা জেলার সমবায় কর্মকর্তা এইচ এম সহিদ-উজ-জামান ‘বিএনপি-আওয়ামী’ জোট

সাধারণ সদস্যদের টাকা আত্মসাতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতাদের যোগসাজশ রয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন সমিতির সদস্যরা। অতীতে কমিটিতে থাকা আওয়ামী লীগের পদধারী নেতারা নিজেদের প্রভাব খাটিয়ে সদস্যদের টাকা আত্মসাৎ করতেন। এখন এ কাজে তাঁদের প্রশ্রয় দিচ্ছেন, যোগসাজশ করছেন কমিটিতে থাকা বিএনপিপন্থী নেতারা। ফলে পটপরিবর্তনের পর সদস্যরা এসব নিয়ে প্রতিবাদ করেও কোনো প্রতিকার পাচ্ছেন না।

বাজারের বর্তমান কমিটি নেতারা ২০২৩ সালের মার্চে নির্বাচিত হয়েছেন। ওই সময় ঢাকা-১৩ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক, ২৮ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ফোরকান হোসেন এবং থানা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক মাসফিকুর রহমানের (উজ্জ্বল) প্রভাব ছিল। তাঁদের প্রভাবে সমিতির সভাপতি নির্বাচিত হন এ বি এম নুরুল হক চৌধুরী, যিনি শেরেবাংলা নগর থানা আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ। সাধারণ সম্পাদক আব্দুন নুর-শাহী এবং অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষক মামুন হোসেন ছিলেন থানা কমিটির সদস্য।

৫ আগস্ট আওয়ামী লীগের পতনের পর কমিটিতে থাকা বিএনপিপন্থী নেতারা সক্রিয় হন। এখন নেতৃত্ব দিচ্ছেন সহসভাপতি মো. নুরুজ্জামান। তাঁর ছেলে মো. মনিরুজ্জামান ২৭ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির শেরেবাংলা নগর ইউনিটের সাধারণ সম্পাদক। আছেন শেরেবাংলা নগর থানা বিএনপির আহ্বায়ক সদস্য সমিতির পরিচালক শাহ আলম। বিএনপিপন্থী আরও তিন পরিচালক—শাহাদাত হোসেন, আতাউল কবির ও আবু সাঈদও রয়েছেন।

প্রশ্রয় ও যোগসাজশের অভিযোগ অস্বীকার করছেন থানা বিএনপির আহ্বায়ক সদস্য পরিচালক শাহ আলম। তিনি বলেছেন, গত ১৬ বছর এতটাই নির্যাতিত হয়েছেন যে তিনি দেশেও থাকতে পারেননি। তাঁদের কাউকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দেননি, দেবেন না। অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে তাঁর কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই বলে দাবি করেন তিনি।

শেরেবাংলা নগর থানা আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ পদে থাকার বিষয়ে সমিতির সভাপতি এ বি এম নুরুল হক চৌধুরী বলেন, বাজারের স্বার্থে তৎকালীন সরকারের সঙ্গে লিয়াজোঁ রাখতেই ওই পদ গ্রহণ করেছিলেন। নির্বাচনে তাঁর বিপরীতে আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী প্রার্থী থাকায় সংসদ সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানকের সহযোগিতায় কোষাধ্যক্ষ পদে ছিলেন।

সদস্যদের অভিযোগ, অতীতে সমিতি থেকে কারও কুলখানির আয়োজন করা হয়েছে বলে সদস্যরা কেউ জানেন না। এ ছাড়া কুলখানি আয়োজন করবেন মৃত ব্যক্তির পরিবার, স্বজন ও সন্তানেরা। কোনো মিলাদ মাহফিলের বিষয়েও সদস্যরা জানেন না।কুলখানি, মিলাদ, অনুদানে ব্যয়

বর্তমান ব্যবস্থাপনা কমিটির নেতারা কুলখানি, মিলাদ মাহফিল ও অনুদান বাবদ সমিতির টাকার ব্যয় দেখিয়েছেন। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ওই খাতে ৬ লাখ ৩৩ হাজার টাকা ব্যয় দেখানো হয়েছে। আর ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ১৩ লাখ টাকা। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সমিতি থেকে অনুদান দেওয়া হয় প্রায় সাড়ে তিন লাখ টাকা। আর ২০২৪-২৫–এ খাতে বরাদ্দ ছিল ছয় লাখ টাকা।

সদস্যদের অভিযোগ, অতীতে সমিতি থেকে কারও কুলখানির আয়োজন করা হয়েছে বলে সদস্যরা কেউ জানেন না। এ ছাড়া কুলখানি আয়োজন করবেন মৃত ব্যক্তির পরিবার, স্বজন ও সন্তানেরা। কোনো মিলাদ মাহফিলের বিষয়েও সদস্যরা জানেন না। মিলাদ-কুলখানিতে অর্থ ব্যয়ের জন্য সদস্যরা অনুমোদনও দেননি। তাই ওই সব খাতে সদস্যদের আমানতের টাকা ব্যয়ের সুযোগ নেই। সদস্যদের টাকা আত্মসাৎ করেই ওই তিন খাতে ব্যয় দেখিয়েছেন সমিতির নেতারা।

অভিযোগকারী আরেক সদস্য ইসফাকুল কবির চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, কমিটির নেতারা সদস্যদের উপস্থিতির স্বাক্ষরকে প্রস্তাব অনুমোদনের স্বাক্ষর দেখিয়ে ভুয়া প্রতিবেদন দিয়েছেন। আসলে অধিকাংশ সদস্য আত্মসাতের বাজেট সমর্থন করেননি।

ছয় খাতের ব্যয় নিয়েও আপত্তি

সদস্যদের অভিযোগ, ব্যবস্থাপনা কমিটির নেতারা ছয় খাতে অস্বাভাবিক ব্যয় দেখিয়েছেন। খাতগুলো হলো আপ্যায়ন, প্রশাসনিক, সম্মানী ভাতা, মজুরি, মামলা পরিচালনা ও যাতায়াত। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এসব খাতে ব্যয় দেখানো হয়েছে প্রায় ২২ লাখ টাকা। এর মধ্যে সম্মানী ভাতায় ৬ লাখ ৯৪ হাজার, আপ্যায়নে ৬ লাখ ৩৬ হাজার এবং প্রশাসনিক খরচে ৫ লাখ ২২ হাজার টাকা। কর্মচারীদের নিয়মিত বেতন-বোনাস দেওয়ার পরও আলাদা করে মজুরি বাবদ দেড় লাখ ও যাতায়াতে ১ লাখ ২২ হাজার টাকা দেখানো হয়েছে। অথচ সমিতির কাজের প্রয়োজনে সর্বোচ্চ এক-দুই কিলোমিটার দূরের সংশ্লিষ্ট সমবায় কিংবা গণপূর্তের কার্যালয়ে যাওয়া লাগে।

অভিযোগকারীরা বলেন, ২০২৩ সালের এপ্রিল থেকে নতুন মার্কেট ভবনের নির্মাণকাজ শুরুর পর সব দায়িত্ব গণপূর্ত ও ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের। সদস্যরা কিস্তিতে সেই টাকা পরিশোধ করছেন। তাই আপ্যায়ন কিংবা প্রশাসনিক খরচ ঠিকাদারের বহন করার কথা। এসব খাতে দেখানো বিপুল ব্যয় মূলত আত্মসাৎ করা হয়েছে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে ওই ছয় খাতে আগের তুলনায় প্রায় তিন গুণ বেশি, অর্থাৎ ৫৭ লাখ টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এর মধ্যে সম্মানী ভাতায় ২০ লাখ এবং আপ্যায়ন ও মামলা খরচে ১০ লাখ করে বরাদ্দ রাখা হয়েছে।

অভিযোগের বিষয়ে তদন্তের জন্য কর্মকর্তা নিয়োগ করা হয়েছে। প্রথম নিয়োগ করা কর্মকর্তাকে নিয়ে তাঁদের আপত্তির কারণে অন্য একজনকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।ঢাকা জেলার সমবায় কর্মকর্তা এইচ এম সহিদ-উজ-জামান তদন্ত চলছে

সদস্যদের অভিযোগের তদন্ত প্রতিবেদন ৬ অক্টোবর দেওয়ার কথা ছিল। দায়িত্বপ্রাপ্ত ঢাকা জেলা সমবায় কার্যালয়ের পরিদর্শক জাহাঙ্গীর কবির জানান, তাঁর অসুস্থতার কারণে আরেকজন কর্মকর্তা কাজটি করেছিলেন। পরবর্তী সময়ে ওই কর্মকর্তাকে দায়িত্ব থেকে সরানো হলে তিনি নতুনভাবে কাজ শুরু করেছেন। সমিতির ব্যবস্থাপনা কমিটির কাছে আয়-ব্যয়ের সব তথ্য চাওয়া হয়েছে। তথ্য পেলে সেগুলো যাচাই করে প্রতিবেদন দেওয়া হবে।

ঢাকা জেলার সমবায় কর্মকর্তা এইচ এম সহিদ-উজ-জামান প্রথম আলোকে বলেন, অভিযোগের বিষয়ে তদন্তের জন্য কর্মকর্তা নিয়োগ করা হয়েছে। প্রথম নিয়োগ করা কর্মকর্তাকে নিয়ে তাঁদের আপত্তির কারণে অন্য একজনকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ