অভ্যাস বদলেই বাঁচবে পৃথিবী– প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা
Published: 22nd, June 2025 GMT
পৃথিবী আজ এক সংকটের মুখে দাঁড়িয়ে। আমাদের চারপাশে ছড়িয়ে থাকা প্লাস্টিক বোতল, শপিং ব্যাগ, চিপসের প্যাকেটসহ নানা সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিক দিন দিন ভয়াবহভাবে পরিবেশ দূষণ ও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণ হয়ে উঠছে। যদিও প্লাস্টিক আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অপরিহার্য অংশ, কিন্তু এর ব্যবহার ও ব্যবস্থাপনায় আমাদের অভ্যাসগত ভুলই এখন আমাদের গ্রহের জন্য চরম হুমকির কারণ।
প্লাস্টিক ও পলিথিনের নেতিবাচক পরিবেশগত প্রভাব আজ বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ। যে বস্তু শত শত বছরেও মাটিতে মিশে না, তা পোড়ালে তৈরি হয় ডাই-অক্সিন, কার্বন মনোক্সাইড ও কার্বন ডাইঅক্সাইডের মতো বিষাক্ত গ্যাস– যা জলবায়ু পরিবর্তন, বরফ গলা ও সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির জন্য দায়ী। দীর্ঘ সময় পর এই প্লাস্টিক ভেঙে পরিণত হয় মাইক্রোপ্লাস্টিকে, যার আকার ৫ মিলিমিটারেরও কম। গবেষণায় দেখা গেছে, এই ক্ষুদ্র কণা খাদ্যশৃঙ্খলের মাধ্যমে প্রবেশ করছে মানুষের শরীরে– ফুসফুস, অন্ত্র এমনকি মায়ের বুকের দুধেও মিলছে মাইক্রোপ্লাস্টিক। একই সঙ্গে প্লাস্টিক দূষণ প্রাণবৈচিত্র্য ধ্বংসেও ভূমিকা রাখছে।
এই সংকট থেকে উত্তরণের সবচেয়ে কার্যকর উপায় হলো প্লাস্টিক ও পলিথিনের পুনর্ব্যবহার। বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় ৪৫ হাজার কোটি টাকার প্লাস্টিক পণ্যের বাজার রয়েছে। অথচ ব্যবহৃত প্লাস্টিকের মাত্র ৩৬ শতাংশ পুনর্ব্যবহারযোগ্য হয়, ৩৯ শতাংশ চলে যায় ময়লার ভাগাড়ে, আর ২৫ শতাংশ ছড়িয়ে থাকে পরিবেশজুড়ে। বিশাল একটি অংশ রয়ে যায় সংগ্রহের বাইরে।
বিশেষত চট্টগ্রাম শহর এই সংকটের একটি বড় উদাহরণ। বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম নগরী চট্টগ্রামে প্রতিদিন জনসংখ্যা ও আর্থিক কর্মতৎপরতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে বর্জ্যের পরিমাণ। ২০২০ সালের হিসাবে শহরের জনসংখ্যা ৭০ লাখের বেশি। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের (চসিক) তথ্যমতে, প্রতিদিন প্রায় ৩ হাজার টন কঠিন বর্জ্য উৎপন্ন হয়, যার ৮.
যদিও সরকার ২০২৫ সালের মধ্যে ৫০ শতাংশ প্লাস্টিক পুনর্ব্যবহারের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে, ২০২০ সালে তা ছিল মাত্র ২০ শতাংশ। গবেষণা বলছে, ৩০ শতাংশ মানুষ নিয়মিত প্লাস্টিক পুনর্ব্যবহার করে, ৪৬ শতাংশ কখনও করে না, আর ১৩ শতাংশ একেবারেই সচেতন নয়।
এই অবস্থায় ‘প্লাস্টিক সার্কুলারিটি’ বা চক্রাকার অর্থনীতি হয়ে উঠেছে সম্ভাবনাময় পথ। এর মাধ্যমে ব্যবহৃত প্লাস্টিক পুনঃপ্রক্রিয়াজাত করে আবার ব্যবহারে ফিরিয়ে আনা যায়। এই লক্ষ্যে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক), ইউনিলিভার বাংলাদেশ ও ইপসা যৌথভাবে প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় পরিবেশবান্ধব মডেল গড়ে তুলছে।
২০২২ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রামে একবার ব্যবহারযোগ্য পলিথিন তেমনভাবে সংগ্রহ করা হতো না। তবে ইউনিলিভারের উদ্যোগে সে চিত্রে পরিবর্তন আসতে শুরু করে। পলিথিন সংগ্রহ ও পুনর্ব্যবহার প্রক্রিয়ার জন্য তখন গড়ে তোলা হয় একটি সংগঠিত সংগ্রহকারী নেটওয়ার্ক। এখন তিন হাজারের বেশি পলিথিন সংগ্রাহক সক্রিয়ভাবে কাজ করছেন, যাদের জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন ও আর্থিক অন্তর্ভুক্তির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে ব্যাংক হিসাব খোলা, সঞ্চয় বৃদ্ধি ও বীমা সুবিধার মাধ্যমে। ইতোমধ্যে ২৪ হাজার টন প্লাস্টিক বর্জ্য সংগ্রহ করে রিসাইক্লিংয়ের জন্য পাঠানো হয়েছে।
চট্টগ্রামে এখন উৎসবিন্দু থেকেই গৃহস্থালি ও প্লাস্টিক বর্জ্য আলাদা করে সংরক্ষণ করা হচ্ছে। সংগ্রাহকরা প্রতিদিন বাসাবাড়ি, খোলা জায়গা এবং বিভিন্ন উৎস থেকে প্লাস্টিক সংগ্রহ করেন। এই বর্জ্য ভাঙাড়ির দোকানে বিক্রি হয়, সেখান থেকে যায় রিসাইক্লারের কাছে। রিসাইক্লাররা তা প্রক্রিয়াজাত করে প্লাস্টিক পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানে বিক্রি করেন। এভাবেই গড়ে উঠেছে একটি চক্রাকার অর্থনৈতিক কাঠামো।
এই উদ্যোগের একটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো স্কুল অ্যাওয়ারনেস প্রোগ্রাম। চট্টগ্রামের ৪১টি ওয়ার্ডে বিভিন্ন স্কুলে শিক্ষার্থীদের পচনশীল ও অপচনশীল বর্জ্য আলাদা করার বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। শিশুদের মধ্যে এই অভ্যাস গড়ে উঠলে ভবিষ্যতে বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় একটি বড় পরিবর্তন আনা সম্ভব হবে।
এই সফলতা আরও বিস্তৃত করার জন্য প্রয়োজন গণসচেতনতা। ছোট ছোট অভ্যাসের পরিবর্তন যেমন– প্লাস্টিক কম ব্যবহার, আলাদা করে সংরক্ষণ, নিয়মিত সংগ্রাহকের কাছে হস্তান্তর; এই ছোট ছোট পদক্ষেপই হতে পারে একটি বড় পরিবর্তনের সূচনা।
অভ্যাস বদলেই বাঁচবে পৃথিবী। আমাদের সচেতন সিদ্ধান্তই পারে আমাদের শহর, নদী, প্রকৃতি এবং আগামী প্রজন্মের ভবিষ্যৎ রক্ষা করতে।
শিক্ষার্থী
যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, চতুর্থ বর্ষ
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: প ল স ট ক বর জ য প ল স ট ক বর জ য র ব যবহ র প রক র য় পর ব শ পল থ ন স গ রহ র জন য আম দ র
এছাড়াও পড়ুন:
বিশ্বে বাংলাদেশি শরণার্থী পাঁচ বছর ধরে বাড়ছে
বিশ্বের নানা দেশে বাংলাদেশের নাগরিকদের শরণার্থী হওয়ার সংখ্যা বেড়ে চলেছে। গত পাঁচ বছরে, অর্থাৎ ২০২০ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত প্রতিবছর বিশ্বের নানা প্রান্তে বাংলাদেশিদের শরণার্থী হওয়ার সংখ্যা বাড়ার হার ঊর্ধ্বমুখী। ২০২৪ সালে ২৮ হাজার ৪৭৩ জন বাংলাদেশি জাতিসংঘের কাছে শরণার্থী হিসেবে নিবন্ধিত হয়েছেন। একই বছর ১ লাখ ৮ হাজার ১৩১ বাংলাদেশি বিভিন্ন দেশে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করেছেন। বাংলাদেশিদের সিংহভাগই ইউরোপ ও আমেরিকা মহাদেশের দেশগুলোতে নিজেদের শরণার্থী ও রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থী হিসেবে নিবন্ধিত করেছেন।
জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) পরিসংখ্যান থেকে এ তথ্য পাওয়া গেছে।
পাঁচ বছর ধরে বাংলাদেশের লোকজনের শরণার্থী ও রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থী হওয়ার সংখ্যা ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। এসব বাংলাদেশি নিজেদের শরণার্থী ও রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থী হিসেবে ইউরোপের দেশ যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালির পাশাপাশি ফিনল্যান্ড, জর্জিয়া, সাইপ্রাস, বসনিয়া ও অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশগুলোতেও নিবন্ধন করেছেন। আর উত্তর আমেরিকা মহাদেশের দেশগুলোর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডার পাশাপাশি দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশের ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, বলিভিয়া, কোস্টারিকা, ইকুয়েডর, পাপুয়া নিউগিনির মতো দেশগুলোতে শরণার্থী ও রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থী হিসেবে নিবন্ধিত করেছেন। এশিয়ার মধ্যে জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, মালয়েশিয়া, হংকংয়ের পাশাপাশি অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডেও বাংলাদেশিরা নিবন্ধিত হয়েছেন। এমনকি ২০২৪ সালে পূর্ব আফ্রিকার দেশ সোমালিয়াতেও ৬ জন বাংলাদেশি নিজেকে শরণার্থী হিসেবে নিবন্ধিত করেছেন।
সরকারি কর্মকর্তাদের মতে, বাংলাদেশিদের সিংহভাগই উন্নত জীবনের আশায় ইউরোপ ও আমেরিকা মহাদেশের দেশগুলোতে পাড়ি জমিয়ে নিজেদের শরণার্থী ও রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থী হিসেবে নিবন্ধন করেছেন। শরণার্থী বা রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করতে গেলে নিজ দেশে জীবনের ঝুঁকি থাকতে হয়। আবেদনকারী বাংলাদেশিদের বেশির ভাগই ওই সময়কালে (২০২০–২৪) দেশে রাজনৈতিক পরিস্থিতির সুযোগ নিয়েছেন। তবে যাঁরা শরণার্থী হয়েছেন, তাঁদের একটি অংশ প্রকৃত অর্থে রাজনৈতিকভাবে নিপীড়নের শিকার হয়েছেন।
তবে জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার তথ্যে যে চিত্র উঠে এসেছে, তাতে দেখা যায়, এদের বেশির ভাগই সুযোগসন্ধানী বা পরিস্থিতিকে কাজে লাগিয়েছেন। ২০২৩ সালে ২৪ হাজার ১২৬ বাংলাদেশি জাতিসংঘের কাছে শরণার্থী হিসেবে নিবন্ধিত হয়েছেন। এ ছাড়া ২০২২ সালে ২৩ হাজার ৯৩৫ জন, ২০২১ সালে ২২ হাজার ৬৭২ জন এবং ২০২০ সালে ১৮ হাজার ৯৪৮ জন বাংলাদেশি নিজেদের শরণার্থী দাবি করে জাতিসংঘের কাছে আবেদন করেন। পাশাপাশি ২০১৯ সালে শরণার্থী হিসেবে জাতিসংঘের কাছে বাংলাদেশিদের আবেদনের সংখ্যা ছিল ২২ হাজার ৭৬৬, ২০১৮ সালে ২১ হাজার ২২ এবং ২০১৭ সালে ১৬ হাজার ৭৮০।
বিশেষজ্ঞদের মতে, সমাজে এক শ্রেণির তরুণদের ভেতরে যেকোনো পন্থায় বিদেশ যাওয়ার প্রবণতা তীব্র হয়েছে। আর এ সুযোগই নিচ্ছে মানব পাচারকারী চক্র। গত কয়েক বছর অব্যাহতভাবে ভূমধ্যসাগরের লিবিয়া, তিউনিসিয়া ও ইতালির উপকূল থেকে বাংলাদেশের নাগরিকদের মৃত্যুর খবর নিয়মিত ঘটনা। ইউরোপগামী পাচারের বিভিন্ন রুট থেকে প্রতিনিয়তই উদ্ধার করা হচ্ছে বাংলাদেশের নাগরিকদের। পাচারকারীদের খপ্পরে পড়ে সবশেষ ইউক্রেন–রাশিয়ার যুদ্ধে বাংলাদেশের লোকজনের অংশগ্রহণ সাম্প্রতিক সময়ের আলোচিত ঘটনা। ইউরোপে উন্নত ভবিষ্যতের আশায় দেশ ছেড়ে যাওয়া লোকজন নিজেদের গন্তব্য দেখছেন এখন যুদ্ধের মাঠে। মানব পাচারকারীরা ইউরোপগামী লোকজনকে পাচার করে রুশ বাহিনীতে যুক্ত হতে বাধ্য করছে।
২০২৩ সালে ৭৫ হাজার ৮৬৭ জন বাংলাদেশি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করেছেন। এ ছাড়া ২০২২ সালে ৬১ হাজার ২৯৮ জন, ২০২১ সালে ৬৫ হাজার ৪৯৫ এবং ২০২০ সালে ৬৪ হাজার ৬৩৬ জন বাংলাদেশি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়েছেন। এ ছাড়া ২০১৯ সালে ৬২ হাজার ৮৬০ জন এবং ২০১৮ সালে ৬২ হাজার ৮৬০ জন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করেছেন।
কূটনীতিকেরা বলছেন, রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থী ও শরণার্থী হিসেবে বিদেশে চলে যাওয়া ব্যক্তিদের বেশির ভাগই অর্থনৈতিক কারণে দেশ ছেড়েছেন। করোনা মহামারির সময় দেশে আয়ের সুযোগ কমে যাওয়া ও বৈধ পথে বিদেশে যাওয়া সংকুচিত হওয়ার পাশাপাশি ২০২৩ ও ২০২৪ সালে রাজনৈতিক সংঘাতময় পরিস্থিতিও এ প্রবণতা বাড়িয়েছে বলে তাঁদের মত।