সংগীত ও শারীরিক শিক্ষার শিক্ষক নিয়োগ বাতিল: এটা ভুল সিদ্ধান্ত
Published: 5th, November 2025 GMT
প্রাথমিক শিক্ষার্থীদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশের জন্য খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ জরুরি। মনস্তত্ত্ব যাঁরা বোঝেন, তাঁরা এটা স্বীকার করবেন। সারা বিশ্বেই প্রাথমিক শিক্ষায় এটি গুরুত্ব দেওয়া হয়।
আমাদের দেশে সংগীত ও শারীরিক শিক্ষার জন্য আলাদা শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া যায়নি, যথেষ্ট বিনিয়োগও করা হয়নি। ২০২০ সালে নীতিগতভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল—সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সংগীত ও শারীরিক শিক্ষা বিষয়ের শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হবে। প্রতিটি বিদ্যালয়ে হয়তো তা সম্ভব হবে না, তাই কয়েকটি বিদ্যালয় নিয়ে গুচ্ছভিত্তিক (ক্লাস্টার) নিয়োগের পরিকল্পনা করা হয়। এতে শিক্ষকেরা গুচ্ছভুক্ত বিদ্যালয়গুলোতে ঘুরে ঘুরে নিয়মিত শিক্ষকদের সঙ্গে মিলিতভাবে শিশুদের খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক চর্চায় উৎসাহ দিতে পারবেন।
২০২০ সালের সিদ্ধান্ত অনুসারে দীর্ঘ সময় পর গত ২৮ আগস্ট ‘সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় শিক্ষক নিয়োগ বিধিমালা, ২০২৫’-এর প্রজ্ঞাপন জারি হয়। সেখানে অন্যান্য বিষয়বস্তুর পাশাপাশি সংগীত ও শারীরিক শিক্ষা বিষয়ে শিক্ষক নিয়োগের সুযোগ রাখা হয়েছিল। এটি ছিল অত্যন্ত যুক্তিসংগত, প্রয়োজনীয় ও সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত।
কিন্তু কিছু আপত্তি ওঠার পর সরকার দ্রুত সিদ্ধান্তটি বাতিল করল। এটি অত্যন্ত অপ্রত্যাশিত এবং অসংগত। এটি মোটেই বলা যাবে না যে সারা দেশের সব সাধারণ মানুষ এই সিদ্ধান্তে আপত্তি জানিয়েছেন। শিশুরা খেলাধুলা করবে, গান শিখবে—আমার মনে হয় না সমাজের সাধারণ মানুষ তাতে আপত্তি করেন। কিছু মানুষ হয়তো আপত্তি করতে পারেন। তাতে সরকার এত বিচলিত হয়ে আগের সিদ্ধান্ত পাল্টে এটা বন্ধ করে দিল।
আমার মতে, এটি প্রাথমিক শিক্ষার জন্য, বিশেষ করে শিশুশিক্ষার ক্ষেত্রে একটি ভুল সিদ্ধান্ত। আমি আশা করব, সরকার এই সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসে বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করবে।
মনজুর আহমদ: ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক এবং সরকারের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার মানোন্নয়ন কমিটির সভাপতি
(মতামত লেখকের নিজস্ব)
.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
চীন যেভাবে বিদেশে স্বৈরাচারী শাসন ‘রপ্তানি’ করছে
কিরগিজস্তানে ২০২০ সালের অক্টোবরে পার্লামেন্ট নির্বাচনে অনিয়মের অভিযোগের পর রাজধানী বিশকেকে বিক্ষোভ শুরু হয়। ১৬টি রাজনৈতিক দলের মধ্যে মাত্র চারটি পার্লামেন্টে প্রবেশের জন্য নির্ধারিত ভোটসীমা পেরোতে সক্ষম হয়। এই চার দলের তিনটির সঙ্গে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট সোরনবাই জিনবেকভের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল।
কিরগিজস্তানের শক্তিশালী প্রতিবেশী দেশ চীন তখন এই অস্থিরতার প্রতিক্রিয়ায় বেশ সংযম দেখিয়েছে। তবে সংযম তারা দেখিয়েছে এমনভাবে, যা ইঙ্গিত দেয়, গণতন্ত্র রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি করতে পারে।
চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র হুয়া চুনইং বলেছেন, ‘চীন আন্তরিকভাবে আশা করে, কিরগিজস্তানের সব পক্ষ আইনের মাধ্যমে, সংলাপ ও পরামর্শের মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করবে এবং যত দ্রুত সম্ভব স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনবে।’
২০২২ সালের শুরুর দিকে কাজাখস্তানে বেসামরিক বিক্ষোভ দমনে সরকার যখন সহিংস পন্থা বেছে নেয়, তখন চীনের প্রতিক্রিয়া সম্পূর্ণ ভিন্ন ছিল। চীন প্রকাশ্যে কাজাখ প্রেসিডেন্ট কাসিম-জোমার্ত তোকায়েভকে সমর্থন জানায় এবং তাঁর দাবির সঙ্গে একমত হয়ে ঘোষণা দেয়, ‘বিদেশে প্রশিক্ষিত সন্ত্রাসীরা’ এই অস্থিরতার জন্য দায়ী।
তোকায়েভের কঠোর অবস্থানের কারণে শত শত মানুষের প্রাণহানি ঘটলেও চীন তাঁর প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন দেয়।
এখন প্রশ্ন হলো, তাহলে কেন চীন প্রতিবেশী দুই দেশে সংঘটিত দুই ধরনের গণ-অভ্যুত্থানে একটির ক্ষেত্রে সংযত ও অন্যটির ক্ষেত্রে দৃঢ় অবস্থান নিয়েছিল?
আমার সদ্য প্রকাশিত গবেষণা অনুযায়ী, আজকের বিশ্বে স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থা প্রচারের একটি বিস্তৃত প্যাটার্নে এর উত্তর লুকিয়ে আছে।
গবেষকেরা সাধারণত ধরে নেন, স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থাগুলো একধরনের সুসংগঠিত মতাদর্শ বিদেশে ‘রপ্তানি’ করতে চায়, যেমনটি সোভিয়েত ইউনিয়ন শীতল যুদ্ধের সময় কমিউনিজম প্রচারের ক্ষেত্রে করেছিল। তখন সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়েছিল, তারা বিশ্বব্যাপী কমিউনিজম বিস্তার করতে চায়। তারা একদলীয় শাসন ও কেন্দ্রীয় পরিকল্পনাকে এমন এক মডেল হিসেবে উপস্থাপন করেছিল, যা অন্য অনুগত সরকারগুলো গ্রহণ করতে পারে।
কিন্তু আজকের দিনে খুব কমসংখ্যক স্বৈরশাসকের একক মতাদর্শ আছে। তার বদলে, বেইজিংয়ের মতো দমনমূলক সরকারগুলো দেখাতে চায়, স্বৈরাচারী শাসনই বাস্তব জীবনের প্রশাসনিক সমস্যা বা রাজনৈতিক অস্থিরতার সবচেয়ে যুক্তিসংগত সমাধান; অর্থাৎ তারা স্বৈরাচারকে এমনভাবে উপস্থাপন করে, যেন এটি স্বাভাবিক ও কার্যকর শাসনব্যবস্থা।
এর পর থেকে কাজাখস্তানও তার স্বৈরাচারী পথে এগিয়ে চলেছে। উদাহরণস্বরূপ, ২০২৪ সালের এপ্রিলে সেখানে নতুন একটি গণমাধ্যম আইন কার্যকর হয়। এর মাধ্যমে তথ্য মন্ত্রণালয় বিদেশি গণমাধ্যম ও তাদের প্রতিনিধিদের স্বীকৃতি বাতিল করার ক্ষমতা পায়।আমি একে বলি ‘স্বৈরাচার বাণিজ্যিকীকরণ’। যেমন কোনো পণ্য ভোক্তার পরিপ্রেক্ষিত অনুযায়ী আলাদা উপায়ে বিপণন করা হয়, তেমনি চীনও বিভিন্ন দেশের স্থানীয় বাস্তবতার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ভিন্ন ভিন্ন উপায়ে স্বৈরাচারী চর্চাকে উৎসাহিত করে।
কিরগিজস্তান ও কাজাখস্তানের উদাহরণ এই গতিশীলতারই প্রতিফলন। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে স্বাধীন হওয়ার পর দীর্ঘদিন ধরে কিরগিজস্তানকে মধ্য এশিয়ার সবচেয়ে গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে দেখা হতো। সেখানে সক্রিয় রাজনৈতিক বিরোধী দল, প্রাণবন্ত নাগরিক সমাজ ও স্বাধীন সংবাদমাধ্যম ছিল।
এই পরিপ্রেক্ষিতে, চীন সেখানে যা করছে, তাকে আমি আমার গবেষণায় ‘রক্ষণাত্মক যুক্তি’ বলেছি। এর অর্থ হলো, চীন কিরগিজস্তানের রাজনৈতিক নেতাদের কাছে স্বৈরাচারী শাসনপদ্ধতিকে গণতান্ত্রিক অস্থিরতা রোধের সম্ভাব্য প্রতিরোধক হিসেবে উপস্থাপন করেছে। শেষ পর্যন্ত এই প্রক্রিয়া কিরগিজস্তানে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে এবং দেশটি ক্রমে আরও গভীরভাবে স্বৈরাচারিতার দিকে নেমে গেছে।
২০২০ সালের অস্থিরতার সময় চীনা কর্মকর্তারা ও রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম বারবার সতর্ক করেছিল যে রাজনৈতিক অস্থিরতা চলতে থাকলে কিরগিজস্তানের উন্নয়ন ব্যাহত হতে পারে।