স্বৈরাচার ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে অভূতপূর্ব এক জাগরণ
Published: 5th, August 2025 GMT
চব্বিশের গণ–অভ্যুত্থান বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে শুধু একটি তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ার ফল নয়; বরং এটি ছিল দীর্ঘকাল ধরে সমাজে জমে ওঠা বঞ্চনা, বৈষম্য ও স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে এক বিশাল গণবিস্ফোরণ।
এ সময় দেশের উত্তর থেকে দক্ষিণ, নগর থেকে গ্রাম পর্যন্ত হাজার হাজার তরুণ-তরুণী, ছাত্র-ছাত্রী, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, শ্রমিক, পেশাজীবী এবং সাধারণ মানুষ প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে এসেছিলেন। তাঁদের কণ্ঠে ধ্বনিত হয়েছিল প্রতিবাদের স্লোগান, চোখেমুখে ছিল নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রত্যয় আর হৃদয়ে বহমান ছিল একটি ন্যায়ভিত্তিক সমাজের স্বপ্ন;একটি বৈষম্যহীন, গণতান্ত্রিক ও মানবিক রাষ্ট্রের আকাঙ্ক্ষা।
২.এই আন্দোলনের মর্মমূলে নিহিত ছিল দুটি শব্দ: ‘বৈষম্যহীন’ ও ‘স্বৈরাচারমুক্ত’। শব্দ দুটি নিছক স্লোগানের শব্দ ছিল না; বরং তার পেছনে ছিল দশকের পর দশক ধরে জমা হওয়া এক নিঃশব্দ আর্তনাদ, যা এ প্রজন্মের মুখে এসে উচ্চারিত হলো বিদ্রোহের ভাষায়। এই দ্বৈত দাবির মধ্যে প্রতিধ্বনিত হয়েছে সেই জনমানস, যাদের প্রাত্যহিক জীবনের বাস্তবতা হয়ে উঠেছিল বৈষম্যমূলক অর্থনীতি, রাজনৈতিক নিপীড়ন এবং ন্যায়বিচারহীন রাষ্ট্রব্যবস্থার নির্মমতার শিকার হওয়া।
বিখ্যাত চিন্তাবিদ ফ্রানৎস ফানোঁ ভাষায়, যখন উপনিবেশ বা দমনমূলক রাষ্ট্রব্যবস্থা একটি জনগোষ্ঠীর আশা ও স্বপ্নকে দাবিয়ে রাখে, তখন সেই জনগোষ্ঠী বিদ্রোহকেই জীবনের স্বাভাবিক পথ হিসেবে বেছে নেয়। চব্বিশের বাংলাদেশ যেন ফানোঁর সেই কথারই প্রতিফলন।
আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানে গণ–আন্দোলনকে প্রায়ই রাজনৈতিক পুনর্জাগরণের সূচক হিসেবে দেখা হয়। এই প্রেক্ষাপটে চব্বিশের গণ–অভ্যুত্থান ছিল একপ্রকার নৈতিক প্রতিরোধ, যা শুধুই ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে ছিল না, বরং তা ছিল একটি নতুন ধরনের সমাজ গঠনের স্বপ্নে উদ্বুদ্ধ হয়ে ওঠা বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর সম্মিলিত আকাঙ্ক্ষা। এ গণ–অভ্যুত্থান প্রশ্ন তোলে পূর্ববর্তী শাসকদের বৈধতা নিয়ে, তেমনি নতুন ভবিষ্যতের প্রতি দায়বদ্ধতাও সৃষ্টি করে।
এই আন্দোলন তাই শুধু একটি রাজনৈতিক ঘটনাই ছিল না; এটি ছিল একটি সমাজ-সাংস্কৃতিক গতিধারার নতুন বাঁক; যেখানে একটি নতুন প্রজন্ম তার অতীতের সব ব্যর্থতার দায়ভার ঝেড়ে ফেলে আত্মনিয়ন্ত্রণ ও আত্মমর্যাদার দাবিতে আত্মপ্রকাশ করে। এটি ছিল ইতিহাসের সেই ক্ষণ, যখন বহু শোষিত, নিঃস্ব ও ‘অপমানিত’ মানুষ একযোগে বলেছিলেন, ‘আর নয়, যথেষ্ট হয়েছে’।
বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রথম দৃশ্যমান প্রতিবাদ শুরু হয়েছিল তরুণ প্রজন্মের হাত ধরে; বিশেষত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ছিলেন এই আন্দোলনের সূচক ও চালিকাশক্তি। বাংলাদেশের ইতিহাসে দেখা যায়, সামাজিক অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রায়ই ছাত্রসমাজই প্রথম আওয়াজ তোলে; এমনটা আমরা দেখেছি ১৯৬৯ সালের গণ–অভ্যুত্থান এবং ১৯৯০-এর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে। চব্বিশেও এর ব্যতিক্রম হয়নি।
এবারের গণ-অভ্যুত্থানের ভিত্তিভূমি ছিল পূর্ববর্তী সময়ের তুলনায় অনেক বেশি জটিল ও বহুমাত্রিক। এটা শুধু ক্ষমতার পরিবর্তনের প্রশ্ন ছিল না; বরং এর গভীরে ছিল রাষ্ট্রক্ষমতার অপব্যবহার ও রাজনৈতিক আনুগত্যকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা বৈষম্য, যা ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর মানবিক মর্যাদাকে প্রতিনিয়ত আঘাত করছিল।
সরকারি চাকরিতে দলীয়করণ, উচ্চশিক্ষায় রাজনৈতিক আনুগত্যকে প্রাধান্য দেওয়া, কোটা ব্যবস্থার নামে একপক্ষীয় সুবিধা বণ্টন এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অধিকারকে অবহেলা করার মাধ্যমে তৈরি হচ্ছিল একটি পক্ষপাতদুষ্ট ও অনৈতিক রাষ্ট্রকাঠামো।
মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবারের প্রতি রাষ্ট্রের দায়িত্ব থাকা স্বাভাবিক হলেও যখন সেই দায়িত্ব কৃতজ্ঞতার গণ্ডি পেরিয়ে একচোখা সুযোগসন্ধানী ব্যবস্থায় পরিণত হয়, তখন তা বৈষম্যের রূপ পরিগ্রহ করে। আন্দোলনকারীদের মধ্যে অনেকেই প্রশ্ন তুলেছিলেন—যদি রাষ্ট্রের প্রতে৵ক নাগরিক সমান মর্যাদার অধিকারী হন, তবে কেন জন্মপরিচয়, রাজনৈতিক পরিচয় কিংবা সামাজিক অবস্থান অনুযায়ী তাঁর শিক্ষার অধিকার বা চাকরির সুযোগ নির্ধারিত হবে?
জন রলসের ন্যায়বিচারের তত্ত্বের (থিওরি অব জাস্টিস) কথা স্মরণ করতে পারি; তিনি বলেন, একটি ন্যায্য সমাজ গঠনের জন্য সবচেয়ে দুর্বল এবং সুবিধাবঞ্চিত শ্রেণির স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিতে হবে; কিন্তু তা হতে হবে সর্বজনীন নীতির আলোকে, পক্ষপাতহীনভাবে। চব্বিশের ছাত্ররা যেন রলসের এই নৈতিক দর্শনকেই বাস্তবে প্রতিফলিত করতে চেয়েছিলেন। তাঁরা শুধু নিজেদের স্বার্থে নয়; বরং পুরো সমাজব্যবস্থার ভেতরকার বৈষম্যের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলেছিলেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণ থেকে উৎসারিত এই বিদ্রোহ তাই নিছক রাজনৈতিক নয়; এটি ছিল একধরনের নৈতিক অভ্যুত্থান। এখানে আত্মকেন্দ্রিক স্বার্থের চেয়ে বৃহত্তর সামাজিক ন্যায়বিচারের প্রশ্ন প্রাধান্য পেয়েছে। তরুণদের চোখে ধরা পড়েছে যে ন্যায় প্রতিষ্ঠা ছাড়া উন্নয়ন কেবল একটি পরিসংখ্যানগত ছলনা। সেই উপলব্ধি থেকেই তাঁরা নিজেদের ক্লাসরুমের সীমানা ছাড়িয়ে রাজপথে এসে দাঁড়িয়েছিলেন; মানবিক মর্যাদা, সমতা ও সুবিচারের দাবিতে দৃপ্তকণ্ঠে উচ্চারণ করেছিলেন, ‘এই বৈষম্য করা চলবে না।’
৩.ছাত্রদের ন্যায্য দাবি উপেক্ষা করে সরকার যখন কঠোর ও দমনমূলক অবস্থান নেয়, তখন আন্দোলন একটি নতুন মোড় নেয়। এটি হয়ে ওঠে কেবল একটি দাবিদাওয়া–নির্ভর প্রতিবাদ নয়; বরং এক স্বৈরতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে সর্বস্তরের জনগণের সুতীব্র প্রতিরোধ। এ আন্দোলনের গন্তব্য ছিল না কেবল আর্থিক বা প্রাতিষ্ঠানিক বৈষম্যের অবসান; বরং এর লক্ষ্য ছিল সেই রাষ্ট্রীয় মানসিকতা ও কাঠামোর বিরুদ্ধাচরণ, যেখানে জনতার চেয়ে ক্ষমতাই মুখ্য, যেখানে নাগরিক অধিকার নয়; বরং আনুগত্যই একমাত্র গ্রহণযোগ্যতা।
স্বৈরাচার এখানে কোনো ব্যক্তিনির্ভর ‘অভিশাপ’ নয়; বরং একটি প্রতিষ্ঠানিক রূপান্তর, একপ্রকার শাসনতান্ত্রিক অন্ধকার, যার মূল চিহ্ন হলো ক্ষমতার এককেন্দ্রিকতা, ভিন্নমতের দমন এবং গণতান্ত্রিক কাঠামোর স্থলে কর্তৃত্ববাদী নিয়ন্ত্রণ। প্লেটোর ‘দ্য রিপাবলিক’-এ স্বৈরতন্ত্রের উৎপত্তি সম্পর্কে বলা হয়েছে, যখন জনগণের নিরাপত্তার নামে একটি শাসক ক্রমে ক্ষমতা কুক্ষিগত করে, তখন ধীরে ধীরে গণতন্ত্র সরে গিয়ে জন্ম নেয় স্বৈরাচার। চব্বিশের আন্দোলন যেন এই রূপান্তরের প্রক্রিয়াকে বুঝে নিয়ে তার বিরুদ্ধে সময়োচিত ও নৈতিক অবস্থান গ্রহণ করেছিল।
আলবেয়ার কামু বলেছিলেন, ‘একটি শৃঙ্খলিত বিশ্বের সঙ্গে মোকাবিলা করার একমাত্র উপায় হলো এতটাই সম্পূর্ণ মুক্ত হওয়া যে তোমার অস্তিত্বই বিদ্রোহের ঘটনার মতো হয়ে উঠবে।’ চব্বিশের চেতনা আমাদের সেই স্বাধীন সত্তা হয়ে ওঠারই ডাক দেয়। এটি এক প্রজন্মের বিবেক, এক জাতির আত্মমর্যাদা এবং ভবিষ্যতের প্রতি এক প্রতিশ্রুতি, যেখানে কেউই যেন নীরব দর্শক না থাকেন; বরং সবাই হয়ে উঠুক অন্যায়ের বিরুদ্ধে একেকটি জীবন্ত প্রতিবাদ।তরুণদের প্রতিরোধে ফুটে উঠেছিল প্রতীকী ও সাংস্কৃতিক প্রতিবাদের এক নতুন ভাষা। কখনো তা ছিল দেয়ালে আঁকা কবিতায়, কখনো তা ছিল হাতে লেখা পোস্টারে, কখনো প্ল্যাকার্ডে লেখা একটিমাত্র বাক্যে ধরা পড়ত গোটা রাষ্ট্রযন্ত্রের গণবিচ্ছিন্নতার ছবি।
এসব অভিব্যক্তি ছিল সরাসরি রাষ্ট্রের ছায়াতলে শাসক শ্রেণির দমননীতি ও গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণের বিরুদ্ধে এক সাংস্কৃতিক ও মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধের অস্ত্র। তরুণদের একেকটি প্রশ্ন যেন রাষ্ট্রব্যবস্থার অন্তর্নিহিত সংকটকে উন্মোচন করছিল; কেন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো নিয়ন্ত্রিত হয়ে ওঠে? কেন সাংবাদিকদের কণ্ঠরোধ করতে হয়? কেন মুক্তবুদ্ধির চর্চা রাষ্ট্রের কাছে হুমকি হয়ে দাঁড়ায়? এ প্রশ্নগুলো শুধু প্রশাসনকে নয়; বরং গোটা সমাজকেই আত্মসমালোচনার মুখে দাঁড় করিয়েছিল।
সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়াতে গিয়ে নবপ্রজন্ম যে আত্মদায়বদ্ধতার পরিচয় দিয়েছে, তা নিছক নৈতিক অবস্থান নয়; বরং ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ বাঁকে এসে রক্তাক্ত প্রতিরোধের মাধ্যমে তারা ভবিষ্যতের পথচিহ্ন এঁকে দিয়েছে। চব্বিশের আন্দোলন তাই কেবল একটি রাজনৈতিক মোড় নয়, এটি ছিল
এক গণজাগরণ, যা তরুণদের বিবেক ও চেতনার গভীরতম স্তর থেকে উৎসারিত। ‘স্বৈরাচার পতনের এক দফা’—এই উচ্চারণ ছাত্র-জনতার মুখে প্রতিধ্বনিত হয়ে উঠেছিল এক সম্মিলিত সংগ্রামের শপথে। এ ছিল রাষ্ট্রযন্ত্রের আড়ালে বাসা বাঁধা স্বৈরশাসক ও জনগণের মধ্যকার বৈরী সম্পর্কের বিরুদ্ধে একটি মৌলিক প্রতিবাদ, যেখানে তরুণেরা হয়ে উঠেছিলেন পরিবর্তনের কারিগর।
অভূতপূর্ব গণজাগরণে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর বিজয় উদ্যাপন। ৫ আগস্ট ২০২৪, সংসদ ভবন এলাকায়উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ব যবস থ র ক অবস থ ন র ষ ট রব র জন ত ক ছ ল একট প রজন ম জনগ ষ ঠ ছ ল এক জ গরণ ক ষমত
এছাড়াও পড়ুন:
মনোনয়ন-বাণিজ্য বন্ধের ভয়ে পিআর ঠেকাতে চায়
জুলাই সনদের ভিত্তিতে এবং সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে (পিআর) নির্বাচনের দাবিতে রাজধানীর পর গতকাল শুক্রবার বিভাগীয় শহরগুলোতে বিক্ষোভ ও সমাবেশ করেছে জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলনসহ কয়েকটি দল। সমাবেশে দলগুলোর নেতারা বলেন, মনোনয়ন-বাণিজ্য বন্ধ হয়ে যাবে, এই ভয়ে কোনো কোনো দল পিআর পদ্ধতি ঠেকাতে চায়।
পূর্বঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী গতকাল ঢাকার বাইরে রংপুর, রাজশাহী, সিলেট, ময়মনসিংহ, খুলনা, বরিশাল ও চট্টগ্রামে অভিন্ন কর্মসূচি পালন করে এসব দল।
এর মধ্যে রংপুরের পাবলিক লাইব্রেরি মাঠে জামায়াতে ইসলামী আয়োজিত বিক্ষোভ সমাবেশে প্রধান অতিথি ছিলেন দলের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার। তিনি বলেন, গায়ের জোরে দেশ শাসনের দিন শেষ হয়ে গেছে। তাঁর দাবি, নির্বাচনে যারা কোটি কোটি টাকার মনোনয়ন-বাণিজ্য করতে পারবে না, তারাই পিআর পদ্ধতি ঠেকাতে চায়।
গোলাম পরওয়ার বলেন, বিএনপি পিআর মানতে চায় না। সাংবিধানিক পদগুলোতে প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছামাফিক নিয়োগ বাদ দিতে আলাদা নিয়োগ কর্তৃপক্ষ হবে, সব জায়গায় এটা তারা মানতে চায় না। এসব গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় তারা আপত্তি করছে। পিআর তারা এই জন্য মানতে চায় না, কারণ যখন দলকে নির্বাচিত করা হয়, তখন ব্যক্তির কোনো স্বার্থ থাকে না। এতে কোনো ব্যক্তি কালোটাকা, মাস্তানি, পেশিশক্তি দেখিয়ে নির্বাচনে কারচুপি করতে কেন যাবে?
জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল বলেন, গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারগুলো বাস্তবায়ন না করে যদি বিদ্যমান রাষ্ট্রকাঠামোতে আবার নির্বাচন হয়, আরেকটি হাসিনার জন্ম হবে। আরেকটি ফ্যাসিবাদের জন্ম হবে। বাংলার মানুষ তা হতে দেবে না।
রংপুর মহানগর জামায়াতের আমির এ টি এম আজম খানের সভাপতিত্বে সমাবেশ আরও বক্তব্য দেন মহানগরের সাবেক আমির মাহবুবার রহমান, জেলা জামায়াতের আমির গোলাম রব্বানী প্রমুখ।
জুলাই সনদের ভিত্তিতে আগামী ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন আয়োজনসহ কয়েকটি অভিন্ন দাবিতে জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, খেলাফত মজলিস, বাংলাদেশ নেজামে ইসলাম পার্টি ও জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি (জাগপা) তিন দিনের বিক্ষোভ সমাবেশের কর্মসূচি ঘোষণা করে। উল্লেখযোগ্য দাবিগুলো হলো আগামী নির্বাচনে সংসদের উভয় কক্ষে পিআর পদ্ধতি চালু করা; অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করা; ফ্যাসিবাদী সরকারের সব জুলুম-নির্যাতন, গণহত্যা ও দুর্নীতির বিচার দৃশ্যমান করা এবং স্বৈরাচারের দোসর জাতীয় পার্টি ও ১৪ দলের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা। এসব দাবিতে গত বৃহস্পতিবার ঢাকায় কর্মসূচির পর গতকাল বিভাগীয় শহরগুলোতে বিক্ষোভ সমাবেশ হয়। ২৬ সেপ্টেম্বর সারা দেশের সব জেলা-উপজেলায় এই কর্মসূচি হবে।
গতকাল জামায়াত ও ইসলামী আন্দোলন সব বিভাগীয় শহরে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করলেও বাকি পাঁচটি দলের সবাইকে সব জায়গায় কর্মসূচি করতে দেখা যায়নি। এর মধ্যে খেলাফত মজলিস ও বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস কয়েকটি বিভাগে কর্মসূচি পালন করেছে।
৭১ শতাংশ মানুষ পিআরের পক্ষেবরিশাল মহানগর জামায়াত আয়োজিত সমাবেশে প্রধান অতিথি ছিলেন দলের কেন্দ্রীয় নায়েবে আমির মুজিবুর রহমান। তিনি বলেন, দেশের ৭১ শতাংশ মানুষ এর পক্ষে রায় দিয়েছে। প্রয়োজন হলে গণভোট দিয়েও পরীক্ষা করতে পারেন।
বরিশাল ফজলুল হক অ্যাভিনিউতে এই সমাবেশ শেষে বিক্ষোভ মিছিল করেন জামায়াতের নেতা-কর্মীরা।
ইসলামী আন্দোলনের বরিশাল জেলা ও মহানগর শাখা সমাবেশ করে নগরের সদর রোডের অশ্বিনী কুমার হল চত্বরে। পরে তারা মিছিল বের করে। সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন বরিশাল মহানগর শাখার সভাপতি মো. লোকমান হাকীম।
দেশকে বিপদের দিকে নিয়ে যাচ্ছেচট্টগ্রামের আন্দরকিল্লা শাহি জামে মসজিদ প্রাঙ্গণে সমাবেশ করে জামায়াত। সমাবেশে প্রধান অতিথি ছিলেন দলের কেন্দ্রীয় সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল রফিকুল ইসলাম খান। তিনি বলেন, ‘অনেকেই বলেন অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস সাহেব একটি রাজনৈতিক দলের পকেটে ঢুকে গেছেন। এটা আমরা বিশ্বাস করতে চাই না। তবে আমরা বিশ্বাস করি, তাঁর আশপাশের লোকজন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে। তাঁরা এ দেশকে বিপদের দিকে নিয়ে যাচ্ছেন।’
বিশেষ অতিথির বক্তৃতায় জামায়াতের চট্টগ্রাম অঞ্চলের পরিচালক মুহাম্মাদ শাহজাহান ডাকসু নির্বাচনের কথা উল্লেখ করে বলেন, এই ধারাবাহিকতায় আগামী জাতীয় নির্বাচনে জামায়াতে ইসলামী সরকার গঠনের মতো আসনে বিজয়ী হবে। জামায়াতে ইসলামী সরকারি দল হবে। বিএনপিকে বিরোধী দলে যেতে হবে।
চট্টগ্রাম মহানগর জামায়াতের ভারপ্রাপ্ত আমির মুহাম্মদ নজরুল ইসলামের সভাপতিত্বে সমাবেশে আরও বক্তব্য দেন দলটির নগর শাখার সেক্রেটারি মুহাম্মদ নুরুল আমিন, সাংগঠনিক সম্পাদক শামসুজ্জামান হেলালী প্রমুখ। সমাবেশ শেষে একটি বিক্ষোভ মিছিল বের করা হয়।
জনগণ তাদের পিআর বোঝাবেময়মনসিংহে পৃথক সমাবেশ ও মিছিল করে জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন, খেলাফত মজলিস ও বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস।
শহরের রেলওয়ে কৃষ্ণচূড়া চত্বরে জামায়াতের সমাবেশে দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সহকারী সেক্রেটারি এহসানুল মাহবুব জুবায়ের বলেন, একটি দল কথায় কথায় বলে, পিআর বোঝে না। আগেও তারা তত্ত্বাবধায়ক সরকার বুঝত না। জনগণ তাদের বুঝিয়েছে। জনগণ এবারও তাদের পিআর বোঝাবে। পিআর ছাড়া নির্বাচন হবে না।
সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন ময়মনসিংহ মহানগর জামায়াতের আমির কামরুল আহসান। আরও বক্তব্য দেন কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের সদস্য মঞ্জুরুল ইসলাম ভূঁইয়া, জেলা জামায়াতের আমির আবদুল করিম প্রমুখ।
জুমার নামাজের পর ময়মনসিংহের বড় মসজিদের সামনে সমাবেশের পর বিক্ষোভ মিছিল করে ইসলামী আন্দোলন। একই সময়ে টাউন হল মোড় থেকে বিক্ষোভ মিছিল বের করে খেলাফত মজলিস। বাদ আসর নগরের বড় মসজিদের সামনে থেকে বিক্ষোভ সমাবেশ করে বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস।
প্রয়োজনে আরেকটি গণ-অভ্যুত্থানগতকাল দুপুরে রাজশাহীর সাহেববাজার জিরো পয়েন্টে পথসভা করে ইসলামী আন্দোলন। বিকেলে বড় মসজিদের সামনে সমাবেশ করে জামায়াত।
ইসলামী আন্দোলনের পথসভায় দলের রাজশাহী জেলা সভাপতি মুরশিদ আলম ফারুকীসহ নেতারা বলেন, প্রয়োজনে আরেকটি গণ-অভ্যুত্থান হবে। পিআর ছাড়া কোনো নির্বাচন হবে না।
জামায়াতের সমাবেশে দলের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, আলোচনায় সমাধান হচ্ছে না বলে তাঁরা আন্দোলনে নেমেছেন।
মহানগর জামায়াতের আমির কেরামত আলীর সভাপতিত্বে সমাবেশে আরও উপস্থিত ছিলেন মহানগরের নায়েবে আমির আবু মোহাম্মদ সেলিম, রাজশাহী সদর আসনে জামায়াতের সম্ভাব্য প্রার্থী মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর, জেলা আমির আবদুল খালেক প্রমুখ।
জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি দিনখুলনা নিউমার্কেট বাইতুন নুর চত্বরে ইসলামী আন্দোলন ও ডাকবাংলা সোনালী ব্যাংক চত্বরে জামায়াত সমাবেশ করে। পরে দুটি দল পৃথক বিক্ষোভ মিছিল বের করে বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে।
জামায়াতের সমাবেশে দলের কেন্দ্রীয় প্রচার বিভাগের সেক্রেটারি মতিউর রহমান আকন্দ নির্বাচনের আগে জুলাই হত্যার বিচার দৃশ্যমান করার দাবি জানান। তিনি অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্দেশে বলেন, জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি দিন। সাংবিধানিক অর্ডার জারি করুন। গণভোট দিন। ফ্যাসিবাদের কার্যক্রম স্থগিত করুন।
জামায়াতের খুলনা মহানগর আমির মাহফুজুর রহমানের সভাপতিত্বে সমাবেশে উপস্থিত ছিলেন দলের খুলনা অঞ্চলের পরিচালক আবদুল খালেক, সহকারী পরিচালক আবুল কালাম আজাদ, খুলনা জেলা আমির এমরান হুসাইন প্রমুখ।
ইসলামী আন্দোলনের সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন দলের খুলনা মহানগর সভাপতি মুফতি আমানুল্লাহ। বক্তব্য দেন জেলা সভাপতি আবদুল্লাহ ইমরানসহ দলের অন্য নেতারা।
কোনো কোনো দল দখল, চাঁদাবাজিতে লিপ্তগতকাল দুপুরে সিলেটের বন্দরবাজার এলাকায় ইসলামী আন্দোলন এবং ধোপাদিঘীরপাড় এলাকায় খেলাফত মজলিস বিক্ষোভ মিছিল বের করে। বিকেলে নগরের রেজিস্টারি মাঠে সমাবেশ করে জামায়াত।
জামায়াতের সমাবেশে প্রধান অতিথি ছিলেন দলের কেন্দ্রীয় সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এ এইচ এম হামিদুর রহমান আযাদ। তিনি বলেন, ফ্যাসিবাদের শাসনামলে যা ঘটেছে, বর্তমানেও তা ঘটছে। কোনো কোনো দল নিজের দলের ওপর কোনো নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারছে না। তারা দখল, চাঁদাবাজি, সন্ত্রাসে লিপ্ত।
সিলেট মহানগর জামায়াতের আমির মুহাম্মদ ফখরুল ইসলামের সভাপতিত্বে আরও বক্তব্য দেন জেলা আমির হাবিবুর রহমান, সেক্রেটারি জয়নাল আবেদিন, মহানগর সেক্রেটারি মোহাম্মদ শাহজাহান আলী প্রমুখ। সমাবেশ শেষে বিক্ষোভ মিছিল বের করা হয়।