রাজনৈতিক ক্ষমতা কাঁপিয়ে দিচ্ছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম!
Published: 19th, September 2025 GMT
একবিংশ শতাব্দীর রাজনৈতিক রূপান্তর বা সরকার পতন আন্দোলনে বড় শক্তি জোগাচ্ছে স্মার্টফোনের পর্দায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম।
এ মাধ্যম রাষ্ট্রশক্তির জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ, জনগণের প্রতিবাদ ও অংশগ্রহণের নতুন পরিসর। এক্স (সাবেক টুইটার), ফেসবুক, ইউটিউব, টিকটক, হোয়াটসঅ্যাপ কিংবা টেলিগ্রামের মতো ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম কেবল বিনোদন বা তথ্য আদান–প্রদানের মাধ্যম নয়, বরং বিশ্বজুড়ে সামাজিক ও রাজনৈতিক রূপান্তরের নিয়ামক।
মানব সভ্যতার ইতিহাসে রাজনৈতিক রূপান্তর কখনোই তাৎক্ষণিকভাবে বা স্বল্প সময়ে ঘটেনি। এক সময়ের বিপ্লব, গণ-আন্দোলন বা স্বাধীনতাসংগ্রাম—সবই ছিল দীর্ঘ প্রস্তুতি, সাংগঠনিক দৃঢ়তা ও মতাদর্শিক লড়াইয়ের ফল। বাংলাদেশের স্বাধিকার-স্বাধীনতাসংগ্রামে দীর্ঘ ২৩ বছর লেগেছে।
হয়তো এমন ডিজিটালঘন প্রতিবেশ থাকলে এত দীর্ঘসময় প্রয়োজন হতো না। একবিংশ শতাব্দীতে প্রযুক্তি, বিশেষত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, এই দীর্ঘ প্রক্রিয়াকে ভেঙে দিয়েছে।
আরও পড়ুনসামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এখন আর সত্য বলতে কিছু থাকবে না!১০ জানুয়ারি ২০২৫একটি ভিডিও, একটি পোস্ট বা একটি হ্যাশট্যাগ আজ রাজনীতির গতি নির্ধারণ করছে। নির্বাচন, আন্দোলন কিংবা রাষ্ট্রীয় নীতি বিতর্ক সবকিছুই ফেসবুক, এক্স ও ইউটিউবের দেয়ালে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
ডিজিটালঘন এই নতুন বাস্তবতায় একাধিক প্রশ্নও উঠেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম কি স্বৈরতন্ত্রের পতন ঘণ্টা বাজানো কিংবা গণতন্ত্রের নতুন হাতিয়ার? নাকি ক্ষণস্থায়ী বিক্ষোভ-উত্তেজনার উৎস মাত্র?
বিশ্বজুড়ে আরব বসন্ত থেকে শুরু করে ফ্রান্সের ‘ইয়েলো ভেস্ট’ আন্দোলন, এমনকি সাম্প্রতিক নেপালের সরকার পতন আন্দোলনে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম রাজনৈতিক রূপান্তরে নতুন মাত্রা বিনির্মাণ করেছে।
বিশেষ করে ক্ষীণ সময়ের আন্দোলনে নেপাল সরকারের পতন আজ অন্যান্য দেশের ক্ষমতাশীলের শিরা-ধমনিতেও প্রতিনিয়ত কাঁপিয়ে তুলছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম যা ‘নিউ মিডিয়া’, ‘মেগামিডিয়া’ ও ‘সুপারমিডিয়া’ নামে অভিহিত নির্ভর করে নেটিজেনদের নেটওয়ার্কিংয়ে।
তাই আজ প্রত্যেক নেটিজেনই আলাদা আলাদা মিডিয়া। নিজেই মিডিয়া, নিজেই মিডিয়ার মালিক। এসব কারণে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম আজ আলোচনা-গবেষণার কেন্দ্রবিন্দুতে।
আরও পড়ুনপরীক্ষা পেছানো নয়, ফেসবুক থেকে বেরিয়ে আসুক শিক্ষার্থীরা১৩ আগস্ট ২০২৩তথ্য-তত্ত্বে সামাজিকের ‘ম্যাজিক’ ক্ষমতা!সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ‘জাদুকরি’ কোনো ক্ষমতা রয়েছে কি না, তা জানতে প্রথাগত গণমাধ্যমের ক্ষমতা অনুধাবনের প্রয়োজন পড়ে।
১৪৫৫ সালে জোহানেস গুটেনবার্গ ছাপাখানা আবিষ্কার করেন। এই ছাপাখানার মাধ্যমেই বাইবেল সাধারণ মানুষের হাতে পৌঁছে যায়। ফলে ধর্মীয় কর্তৃত্ব (চার্চের একচেটিয়া ব্যাখ্যা) দুর্বল হয়ে পড়ে।
মার্টিন লুথারের নেতৃত্বে রিফর্মেশন আন্দোলন মূলত মুদ্রণযন্ত্রের কল্যাণে ছড়িয়ে পড়ে। অর্থাৎ গুটেনবার্গ প্রমাণ করেন গণমাধ্যম রাজনৈতিক-ধর্মীয় ক্ষমতাকে কাঁপিয়ে দিতে পারে। ১৭১৯ সালে সংবাদপত্রের উত্থান আন্দোলনের মূল হাতিয়ার হয়ে ওঠে।
১৭৮৯ সালের ফরাসি বিপ্লবের সময় প্রচারপত্র ও সংবাদপত্র রাজতন্ত্রকে চ্যালেঞ্জ করে। গণমাধ্যমের ক্ষমতা সবচেয়ে নাটকীয়ভাবে দেখা যায় ১৯৩০-এর দশকে।
আরও পড়ুনসামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, ভাইরাল সংস্কৃতি ও ডিজিটাল ট্রাইবালিজম০৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪জার্মানিতে হিটলার ও নাৎসি শাসন রেডিওকে রাষ্ট্রীয় প্রচারণার অস্ত্রে পরিণত করে। জোসেফ গোয়েবেলস ছিলেন সেই প্রোপাগান্ডা মেশিনের স্থপতি। একমুখী প্রচারণা কোটি মানুষের মনে জাতীয়তাবাদী উন্মাদনা তৈরি করে।
এ জন্য একই সময়ে আমেরিকায় ওরসন ওয়েলস-এর ‘ওয়ার অব দ্য ওয়ার্ল্ড’ (১৯৩৮) শীর্ষক রেডিও নাটক আতঙ্ক ছড়ায়। এই সময় গণমাধ্যম নিয়ে গবেষণায় ‘জাদুর টোটা তত্ত্ব’ (ম্যাজিক বুলেট থিওরি) উদ্ভাবিত হয়, যেখানে মনে করা হয় গণমাধ্যম সরাসরি মানুষের মনে প্রভাব ফেলে, যেমন ইনজেকশন দিলে শরীরে ওষুধ ঢোকে।
অর্থাৎ গণমাধ্যম সর্বশক্তিমান আর জনগণ অসহায় গ্রাহক। গণমাধ্যমের প্রভাব সরাসরি, শক্তিশালী ও তাৎক্ষণিক।
পরবর্তী সময় লাজারসফেল্ড, ব্যারেলসন ও গাউডেটের গবেষণা যা ‘পিপলস চয়েস নামক’ গ্রন্থে (১৯৪৪) প্রকাশিত হয়। তাঁরা দেখান যে গণমাধ্যমের প্রভাব এতটা শক্তিশালী নয়।
১৯৬০-৭০ দশকে এসব ধারণার আরও পরিবর্তন ঘটে, গণমাধ্যমের বার্তা বিচ্ছুরণ ও গ্রহণ প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন সামাজিক উপাদান যুক্ত হয়। মানুষ বার্তা ফিল্টার করে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, মতাদর্শ, শিক্ষা ও ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার মাধ্যমে তা ব্যাখ্যা করে। গণমাধ্যম প্রচার করলেই তা জনগণ যাচাই-বাছাই ছাড়া বিশ্বাস করেন না, হিসাব কষে গ্রহণ করে।
নব্বইয়ের দশকে ইন্টারনেট ওয়েভ ২.
একমুখী প্রচার দুর্বল হয়ে ওঠে। ‘ইন্টারঅ্যাকটিভ’ মাধ্যম ব্যবহার করে মানুষ নিজেই খবর তৈরি করছে, ছড়াচ্ছে, আন্দোলন করছে—এমনকি সরকারের পতনও ঘটাচ্ছে।
১৯৬২ সালে ‘দ্য স্ট্রাকচারাল ট্রান্সফরমেশন অব দ্য পাবলিক স্ফিয়ার’ গ্রন্থে ‘জনপরিসর’ (পাবলিক স্ফিয়ার) ধারণাটি দেন জার্মান দার্শনিক ইউর্গেন হাবারমাস। তাঁর এ জনপরিসর হলো এমন এক ক্ষেত্র, যেখানে নাগরিকেরা রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণমুক্ত স্বাধীনভাবে মিলিত হয়ে আলোচনা, বিতর্ক ও মতবিনিময় করতে পারেন।
বর্তমান যুগের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম মূলত: সেই জনপরিসরের ইন্টারনেট সংস্করণ বা রূপ, যা দ্রুত জনমত গঠনে কার্যকর।
আরও পড়ুনফেসবুক যাতে আপনাকে নিয়ন্ত্রণ না করে১৯ এপ্রিল ২০২৩সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের রাজনৈতিক শক্তি বুঝতে কয়েকটি তত্ত্ব গুরুত্বপূর্ণ। ২০০৬ সালে ইয়োখাই বেনকলার তাঁর ‘দ্য ওয়েলথ অব নেটওয়ার্ক’ গ্রন্থে বলেন, ইন্টারনেট গড়ে তুলেছে এক ‘নেটওয়ার্কড পাবলিক স্ফিয়ার’।
এই রাষ্ট্র বা প্রচলিত কেন্দ্রীভূত গণমাধ্যমের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ ভেঙে দিয়ে এই জনপরিসর সাধারণ মানুষ সরাসরি তথ্য উৎপাদন, প্রচার ও সংলাপ চালানোর সুযোগ করে দেয়। এমন নেটওয়ার্কে আন্দোলনকারীদের সহজে যুক্ত হয়ে সংবাদ প্রকাশ ও সংগঠনের প্রথাগত খরচ কমায়।
তুর্কি-আমেরিকান সমাজবিজ্ঞানী জেইনেপ তুফেক্তি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এবং রাজনৈতিক আন্দোলন নিয়ে কাজের জন্য বিশ্বব্যাপী খ্যাত। তাঁর ভাষ্য, নিউ মিডিয়া ক্ষমতার বয়ানে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
জেইনেপ তুফেক্তি তাঁর ‘টুইটার অ্যান্ড টিয়ার গ্যাস’ (২০১৭) গ্রন্থে বলেন, ডিজিটাল শক্তি আন্দোলন শুরু করলেও রাজনৈতিক প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো তৈরি করতে পারে না। দীর্ঘস্থায়ী পরিবর্তনে দরকার শক্ত কাঠামো ও নেতৃত্ব।
অফলাইনে সংগঠনের শক্তি না থাকলে দ্রুত ভেঙে পড়ে। অর্থাৎ তুফেক্তি দেখিয়েছেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম সরকার কাঁপাতে পারে কিন্তু রাষ্ট্র পুনর্গঠন করতে পারে কি না, সেটা এখনো প্রশ্নবিদ্ধ।
তবে যুগে যুগে গণমাধ্যমের ক্ষমতার রূপে রূপান্তর ঘটেছে কিন্তু প্রতিবারই রাজনীতিকে পাল্টে দিয়েছে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও বসন্তে বিশ্ব২০১১ সালে তিউনিসিয়ার এক ফল বিক্রেতার আত্মাহুতি মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। জন্ম নেয় আরব বসন্ত, যার ঢেউ মিসর, লিবিয়া, সিরিয়া থেকে ছড়িয়ে পড়ে সমগ্র আরব দুনিয়ায়।
তাহরির স্কয়ারে লাখো মানুষের জমায়েত মূলত ফেসবুক, এক্স আর ইউটিউবের নেটওয়ার্ক দিয়েই সম্ভব হয়েছিল। ২০১৩ সালে হাওয়ার্ড ও হুসেইন-এর গবেষণা দেখিয়েছে আরব বসন্তে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম জনসমাবেশ আর আন্তর্জাতিক সমর্থন জোগাতে মুখ্য ভূমিকা পালন করে।
তবে আন্দোলনের শেষটা হতাশাজনক। মিসরে আবারও সামরিক শাসন ফিরে আসে, লিবিয়া-সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ জেঁকে বসে।
২০১৪ সালে হংকংয়ে সরকারের প্রধান কার্যালয়ের সামনে বিক্ষোভরত শিক্ষার্থীদের ওপর পুলিশ মরিচের গুঁড়া, কাঁদানে গ্যাসের শেল ও জলকামান নিক্ষেপ করে। আন্দোলনকারীরা বাঁচতে ব্যবহার করেন ছাতা ও ভেজা তোয়ালে।
জনসমুদ্র হাজার হাজার ছাতার রঙে রঙিন হয়ে ওঠে। ছাতাই আন্দোলনটির মূল প্রতীক হয়। এ জন্য এটা ছাতা আন্দোলন নামেও খ্যাত। আর কৌশলগত অস্ত্র হিসেবে টেলিগ্রাম, এয়ারড্রপ, ও এনক্রিপটেড চ্যানেল ব্যবহার করেন আন্দোলনকারীরা।
পুলিশের অবস্থান, দ্রুত স্থান পরিবর্তন ও দমননীতি এড়িয়ে যায় এসব সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এখানে পুলিশ অ্যাকশন প্রতিরোধ ও কৌশল নির্ধারণেও কার্যকর।
আরও পড়ুনফেসবুক, ইউটিউব, টিকটক জগতে বিপ্লব ঘটে গেছে অগোচরে২৬ মার্চ ২০২৩২০১৮ সালে ফ্রান্সে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ফেসবুক গ্রুপ থেকে জন্ম নেয় ‘গিলে জোন’ বা ‘ইয়েলো ভেস্ট’ আন্দোলন। কয়েক সপ্তাহের মধ্যে তা ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে।
গবেষণা বলছে, এখানে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম কেবল সূচনা করেছে, কিন্তু আন্দোলন টেকসই হয়েছে অফলাইনে নাগরিকদের সক্রিয় অংশগ্রহণে। অনলাইন উত্তেজনা কেবল পথ দেখাতে পারে, কিন্তু আন্দোলনের আসল শক্তি গড়ে ওঠে রাজপথে।
অনলাইন থেকে জন্ম নেওয়া আন্দোলন টিকে থাকে অফলাইনের নেটওয়ার্কের ওপর ভর করে।
২০২০ সালে জর্জ ফ্লয়েড হত্যাকাণ্ড যুক্তরাষ্ট্রে বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনের ঝড় তোলে। কিন্তু আন্দোলনের আগুন ছড়িয়ে দেয় #BlackLivesMatter হ্যাশট্যাগ। এক্স, ফেসবুক, ইনস্টাগ্রামে কোটি কোটি মানুষ পোস্ট, ভিডিও ও প্রতিবাদের ছবি শেয়ার করেন। কয়েক দিনের মধ্যে বিশ্বজুড়ে সমর্থন তৈরি হয়।
আন্দোলন-সংগ্রাম এখন অনলাইন-অফলাইন যৌথ প্রযোজনা। বাংলাদেশের জুলাই আন্দোলন ছিল এমন-ই এক আন্দোলন, যেখানে একই সঙ্গে ব্যাপকভাবে রাজপথ দখল নিয়েছিল আন্দোলনকারীরা আর আরেক গোষ্ঠী সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সমর্থন জুগিয়েছে, নেটওয়ার্কিং করেছে।
সম্প্রতি নেপালে ঘটেছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নিয়ন্ত্রণের উল্টো ফল। ২০২৫ সালের শুরুতে নেপাল সরকার টিকটকসহ কয়েকটি মাধ্যম বন্ধ করে দেয়। সরকার যুক্তি দেখায় এসব প্ল্যাটফর্ম সামাজিক বিভাজন বাড়াচ্ছে।
কিন্তু এর উল্টো প্রভাব পড়ে। তরুণেরা বিক্ষুব্ধ হয়ে রাস্তায় নামে, সহিংসতা ও প্রাণহানি ঘটে। শেষ পর্যন্ত সরকার বাধ্য হয় নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করতে। কয়েক দিন আগে আবারও নেপাল ফেসবুকসহ ২৬টি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বন্ধ করে।
ভিপিএনসহ বিকল্প নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে তরুণেরা দেখিয়ে দিয়েছেন তাঁরা দমে যান না। সরকার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে বাধ্য হয় তা চালু করতে, কিন্তু তাতেও রক্ষা হয়নি। সরকারের পতন হয়।
২৪ জুলাই আন্দোলনে বাংলাদেশ সরকারও ইন্টারনেট বন্ধ করেছিল, কিন্তু তা বন্ধ রাখা যায়নি, শেষ পর্যন্ত পতন হয় সরকারের। রাষ্ট্রীয় সেন্সরশিপ প্রমাণ করেছে ডিজিটাল যুগে মানুষ নিজের কণ্ঠস্বর কেড়ে নেওয়া মানতে নারাজ।
কণ্ঠ রোধ করলে তা আরও বিস্ফোরিত হয়। সেন্সরশিপ সমাধান নয়, বরং সমস্যাকে জটিল করে। জুলাই আন্দোলনে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নিয়ে বড় কোনো গবেষণা হয়নি, তবে বাংলাদেশের ইউল্যাব, মালয়েশিয়ার লিংকন কলেজ ও শ্রীলঙ্কার কল্যাণ ইউনিভার্সিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনজন গবেষক পরিচালিত এক গবেষণায় জানা যায়, শেখ হাসিনা সরকার পরিবর্তনে গণ-আন্দোলন সংগঠিত করতে এর প্রভাব রয়েছে।
শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করেছেন ফেসবুক, মেসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপ ও টিকটক। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম সব পক্ষকে একত্র করে জনমত গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে, সরকারের পতনকে ত্বরান্বিত করেছে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক দ্বিমুখী তরবারিঅনলাইনের শক্তি রাজপথের আন্দোলনের সঙ্গে মিশলে স্থায়ী হতে পারে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে দ্বিমুখী তরবারি বলা যায়। দায়িত্বশীল নেতৃত্ব ও গণতান্ত্রিক কাঠামোর সঙ্গে মিলে এটি হতে পারে গণতন্ত্রের শক্তিশালী অনুঘটক।
তবে রাজনৈতিক প্রজ্ঞার অভাবে এটি হতে পারে ক্ষণস্থায়ী উচ্ছ্বাসের উর্বর ক্ষেত্র, যেখানে রূপান্তরের স্বপ্ন ভেঙে যায়। অর্থাৎ দ্বৈত বাস্তবতা কাজ করে; একদিকে নাগরিকদের কণ্ঠস্বরকে জোরালো করে, অন্যদিকে ভুয়া তথ্য ও বিভাজন রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাকে বিপন্ন করে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম রাজনৈতিক রূপান্তর দ্রুততর করেছে, গণতন্ত্রকে আরও মজবুত করছে, নাকি আরও অস্থিরতা বাড়াচ্ছে, সেই প্রশ্নের উত্তরও জানা প্রয়োজন। এ পর্যন্ত যত সরকারের পতন হয়েছে, তার পেছনে ওই সব সরকারই নিজেই পতনের অনুঘটক।
দুর্নীতি ও গণতন্ত্রের লেবাসে স্বৈরতন্ত্র প্রভৃতিই ওই সব পতনকে ত্বরান্বিত করেছে। স্বচ্ছ ও সুশাসন আশ্রিত-অনুসৃত সরকারের পতন কি এ পর্যন্ত হয়েছে? তাই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নিয়ে কয়েকটা সিদ্ধান্ত টানা যেতে পারে।
কণ্ঠ রোধ করলে তা আরও বিস্ফোরিত হয়। সেন্সরশিপ সমাধান নয়, বরং সমস্যাকে জটিল করে। জুলাই আন্দোলনে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নিয়ে বড় কোনো গবেষণা হয়নি, তবে বাংলাদেশের ইউল্যাব, মালয়েশিয়ার লিংকন কলেজ ও শ্রীলঙ্কার কল্যাণ ইউনিভার্সিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনজন গবেষক পরিচালিত এক গবেষণায় জানা যায়, শেখ হাসিনা সরকার পরিবর্তনে গণ-আন্দোলন সংগঠিত করতে এর প্রভাব রয়েছে। শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করেছেন ফেসবুক, মেসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপ ও টিকটক। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম সব পক্ষকে একত্র করে জনমত গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে, সরকারের পতনকে ত্বরান্বিত করেছে।প্রথমত, এটি আন্দোলনকে তাৎক্ষণিকভাবে উত্তেজিত করে কিন্তু রাজনৈতিক কাঠামো নির্মাণ করতে পারে না।
দ্বিতীয়ত, অনেক সময় রাষ্ট্র ও রাজনৈতিক গোষ্ঠীগুলোর ভুয়া তথ্য, অপতথ্য, মিথ্যাশ্রয়ী তথ্য, প্রোপাগান্ডা, ঘৃণা প্রভৃতি ছড়ানোর মাধ্যম হয়ে ওঠে।
তৃতীয়ত, এসব মাধ্যমের ওপর সরকারি নজরদারি বাড়ে, যা নাগরিক অধিকারের জন্যও হুমকি। আর চতুর্থত, প্ল্যাটফর্মের অ্যালগরিদম ভাইরাল কনটেন্টকে অগ্রাধিকার দেয় ফলে আবেগনির্ভর রাজনীতির চর্চা হয়।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ক্ষমতার কাঠামো, সরকার ও রাষ্ট্রশক্তিকে কাঁপানোর অন্যতম হাতিয়ার—এ কথা ঠিক কিন্তু সর্বশক্তিমান নয়।
তবে বাংলাদেশের মতো গণতান্ত্রিক উত্তরণের পথে থাকা দেশগুলোর রাষ্ট্র-সরকার অন্যদিকে নাগরিক কীভাবে এই নয়া যোগাযোগ যোগাযোগমাধ্যমকে ব্যবহার করবে, গণতন্ত্রকে মজবুত করার উপায় হিসেবে, নাকি ক্ষণস্থায়ী বিক্ষোভের হাতিয়ার হিসেবে -- এই প্রশ্নের সঠিক সমাধান খুবই জরুরি।
মাহমুদুল হক, শিক্ষক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর
ই-মেইল: [email protected]
*মতামত লেখকের নিজস্ব
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: সরক র র পতন প ল য টফর ম ব যবহ র কর সরক র র প গণতন ত র র ক ষমত ম ণ কর ফ সব ক অর থ ৎ র র জন গ রন থ র কর ন ব ত কর ব শ বব ন টওয ট কটক বসন ত গ রহণ
এছাড়াও পড়ুন:
হাত না মেলানো, বর্জনের হুমকি আর ম্যাচ রেফারির ক্ষমাপ্রার্থনা—এরপর সামনে কী
সন্ধ্যার পর দুবাইয়ের রাস্তায় ব্যস্ততা বেড়ে যায় বহুগুণ। পরশু সন্ধ্যায়ও যখন পাকিস্তান–সংযুক্ত আরব আমিরাত ম্যাচ নিয়ে ঘোর অনিশ্চয়তা, তখন সেটিই পাকিস্তান দলের সঙ্গে লিয়াজোঁ কর্মকর্তাকে জানিয়েছিল দুবাইয়ের পুলিশ। পরে প্রায় ৪০ মিনিটের পথ পাড়ি দিয়ে তারা মাঠে গেছে, ম্যাচও খেলেছে।
এক দল মাঠে এসেছে ঠিক সময়ে, অন্য দল ম্যাচ রেফারি নিয়ে সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় থেকে দেরিতে হোটেল ছাড়ায় ম্যাচ শুরু হয়েছে এক ঘণ্টা পর, এ রকম বিচিত্র ঘটনা সম্ভবত এশিয়া কাপের মতো টুর্নামেন্টেই কেবল কল্পনা করা যায়। অবশ্য এশিয়া কাপের অদ্ভুত কিছু করে দেখানোর ক্ষমতা নতুন কিছু নয়।
ভারত আর পাকিস্তান চিরবৈরী দুই প্রতিবেশী দেশ, যাদের প্রায় সব পর্যায়েই মুখ দেখাদেখি বন্ধ। গত মে মাসের রাজনৈতিক উত্তাপে খেলা বন্ধ করতে আদালতের শরণাপন্ন হওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। এমন দুটি দলকেও বারবার একসঙ্গে মাঠে নামিয়ে দিতে পারে এই টুর্নামেন্ট।
এবারের এশিয়া কাপ মুখোমুখি বসিয়েছে আদর্শিকভাবে বিপরীত মেরুতে থাকা সাবেক দুই পিসিবি সভাপতি নাজাম শেঠি আর রমিজ রাজাকেও। উদ্দেশ্যটা যে ছিল এক! অ্যান্ডি পাইক্রফটকে পাকিস্তানের ম্যাচে ম্যাচ রেফারি থাকতে না দেওয়া। পিসিবি ও এসিসির প্রধান মহসিন নাকভীর ডাকে সাড়ে দিয়ে তাঁরাও পরশু পরামর্শ সভায় বসেছিলেন লাহোরে।
লাহোরে বুধবার সংবাদ সম্মেলনে মহসিন নাকভি (মাঝে), নাজাম শেঠি (বাঁয়ে) ও রমিজ রাজা (ডানে)