স্মৃতি যদি প্রতারণা না করে, ১৯৯০ সালের গ্রীষ্মের সকালে আমি, জালাল আর গোবিন্দ কিছু আয়ের আশায় মৌয়াল রজব আলীর সঙ্গে উঠে পড়ি একটা ডিঙিনৌকায়। খোলপেটুয়া নদীর ওপর তখন এপ্রিলের সূর্য প্রস্তুতি নিচ্ছে পুরো অঞ্চলকে তপ্ত কড়াইয়ের ওপর সেদ্ধ করতে। এই চক্রান্ত আঁচ করতে পেরে আমরা খোলপেটুয়ার শীতল জলের ধমনি খোঁজ করতে থাকি। তারপর বিচক্ষণ রজব আলীর আঙুলের ইশারায় ঢুকে পড়ি সুন্দরবনের ভেতরে বয়ে যাওয়া সরু পুষ্পকাটি খালে। আমাদের নাকে ঢুকতে থাকে খলিশা ফুলের সুবাস। একসময় আমাদের নৌকা গতি হারিয়ে থেমে যায়। সামনে পথ দেখিয়ে এগিয়ে চলে রজব আলী।
যখন পুষ্পকাটি খাল পেছনে ফেলে সুন্দরবনের গহিনে অনেকটা এগিয়ে গিয়েছি, হঠাৎ রজব আলী তার তর্জনীর ইশারায় আমাদের থামিয়ে দেয়, থামিয়ে দেয় সময়কেও যেন।
ভাঙা চোয়াল আর ঘন জমাট দাড়ির নিচের রজব আলীর লম্বা নাক জোরে জোরে শ্বাস নিতে নিতে বাতাসের গভীরতা মাপে। সন্দেহপূর্ণ ভারী বাতাস টেনে নেয় এক নিশ্বাসে তার বৃহৎ সুচতুর ফুসফুসে। আটকে ফেলে হাড্ডিসার বুকের মধ্যে। রজব আলী এখন কেওড়াগাছের মতো স্থির, বাতাসের চাপে মৃদু শঙ্কিত আর অস্তিত্বহীন। তার তর্জনীর নির্দেশে আমরা যেন ঢুকে পড়ি বরফ-পানি খেলায়। ঘনীভূত ঠান্ডা শক্ত বরফ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ি আমি। জালালের দিকে আড়চোখে তাকাই। আমি ভালো করেই জানি, এটা একটা ধৈর্যের খেলা। হৃৎপিণ্ডের ধুকধুকানি নিয়ে গোবিন্দকে খুঁজি। ও একটা শীর্ণকায় বাইনগাছ জড়িয়ে থাকে ভঙ্গুর অবস্থায়। ওর বেলুন পেটের ওজনে পিষ্ট হয়ে ভেঙে পড়তে পারে বাইনগাছটা। যেকোনো মুহূর্তে ওকে পরিণত করতে পারে বরফ থেকে পানিতে।
রজব আলী তখনো সন্দেহের ভারী বাতাস চালিত করে যাচ্ছে তার রক্তের স্রোতে, শিরা-উপশিরায় আর দূরদর্শী মস্তিষ্কে। একটা লাঙলের ফলা পোড়ানো শেষে যেন নিষ্ক্রিয় হাঁপর হয়ে অলস পড়ে আছে তার চিন্তিত ফুসফুস।
কম্পাসের কাঁটার মতো অস্থির, কম্পমান রজব আলীর তর্জনী দুলছে। আমরা দেখতে থাকি কীভাবে তার বুকের মধ্যে জমতে থাকা ভয়ের ইঙ্গিত তার তর্জনীকে প্রভাবিত করতে থাকে।
এখন এই নির্জীব দশা থেকে মুক্ত হতে রজব আলীর তর্জনীই একমাত্র ভরসা। যেটা এই মুহূর্তে করে চলেছে নিরাপদ পথের সন্ধান। ভ্যাপসা গরমের মধ্যে বরফ হয়ে আমরা ঘামছি। একটা মাইন ডিটেকটরের মতো রজব আলীর তর্জনী নেমে যাচ্ছে কাদা-মাটিতে। অনুসরণ করে চলেছে তার হৃৎপিণ্ডের ধুকধুকানিকে, যেটা দ্রুত থেকে দ্রুততর হচ্ছে। বাইনগাছের নিচে তার কম্পাসের কাঁটা দুলতে দুলতে হঠাৎ থেমে গেছে।
রজব আলী এগিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নেয়। এই এগিয়ে যাওয়াকে জালাল এরপর বহু বছর ধরে আমার কাছে উল্লেখ করবে সবচেয়ে যুগান্তকারী পদক্ষেপ হিসেবে। আর আমরা দুজনই সব সময় একমত হব, রজব আলীর এই পদক্ষেপ সম্পন্ন করতে সূর্য অন্তত দুটি বিশাল মেঘের খণ্ডকে পার হতে দিয়েছিল তার আগুন মুখের ওপর দিয়ে। কিন্তু আমরা যখন সময়ের মাপকাঠিতে এই যুগান্তকারী পদক্ষেপ মাপব, তখন মতভেদ দেখা দেবে আমাদের মধ্যে।
এখন এই মুহূর্তে রজব আলী যখন স্থির, শঙ্কিত আর অস্তিত্বহীন হয়ে সবকিছুকে ফাঁকি দিয়ে তার প্রথম পদক্ষেপের প্রস্তুতি নিচ্ছে; আকাশে তখনো সূর্যের একার রাজত্ব। দুটো মেঘের খণ্ড যতক্ষণ না সূর্যকে অতিক্রম করছে, ততক্ষণ তো আমার বলার মতো আর কিছুই নেই এখন! সময় ক্ষেপণের জন্য আমার দাদি সায়েরা বানুর মতো তো আমি চতুর গল্পের ফাঁদে আপনাকে আটকে রাখতে পারব না!সায়েরা বানুকে এককথায় প্রকাশ করতে কেউ যদি আমাকে পরীক্ষার খাতায় বসিয়ে দেয়, এই প্রশ্নের উত্তরে, আমি কলমকে ফাঁকি দিয়ে, তার কালি একটুও খরচ হয়েছে কি না বুঝে ওঠার আগেই, লিখে ফেলতে পারব—দন্তহীন কচ্ছপ!
সে তখনো আমার শয্যাসঙ্গী হয়ে বেঁচে ছিল। আর আমাকে তার বিছানায় অনিচ্ছা সত্ত্বেও যেতে হতো। কারণ, আমাদের একমাত্র ঘরটাতে নাজুক দুটো প্রাণী—একটা শিশু ও একটা বৃদ্ধকে রাখার প্রয়োজন বোধ করেছিল আমার আব্বা আহাদ শেখ আর মা আমিরুন্নেসা। আমিরুন্নেসাকে তার স্বামীর এই ছোট ভূখণ্ডের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় তৎপর থাকতে হতো সব সময়। ঘরের চারপাশে বাইন আর গোলপাতার বেড়াটা ঠিকঠাক করে চলত দিনের পর দিন।
এই বেড়ার ভেতরে আমি আর দন্তহীন কচ্ছপ নির্বিঘ্নে আমাদের রেষারেষি চালিয়ে যেতে পারতাম। সে আমার সমস্ত অত্যাচার সত্ত্বেও কাছে ডাকত, একটা অহিংস সুরে, ‘সোনার কইতর.
জীবনের সবকিছু দেখে ফেলার পরও এই দন্তহীন কচ্ছপ তখনো কেন টিকে ছিল, তা আমার মাথায় ঢোকে না। এখানে বেঁচে থাকার একটা কারণও তো কখনো খুঁজে পাইনি আমি। একটা যুক্তিসংগত কারণ দরকার, না হলে কেন সে শুধু শুধু ঘরের ভাত ধ্বংস করবে! নাকি তার হাতে তখনো করার মতো কাজ বাকি ছিল? নাকি কোনো দুরভিসন্ধি আমাকে শয্যাসঙ্গী করার!
কিন্তু সে ছিল কৌশলী, সুচতুর। জানত একটা বজ্জাত ছেলেকে কীভাবে শয্যায় বশ করে আনতে হয়। কারণ, অন্ধকার নামলে ছেলেটার ভেতর শিথিলতা নামত। সে জানত, এখনই অহিংস দন্তহীন কচ্ছপের নিয়ন্ত্রণে চলে যাবে সবকিছু। একটা খেলা কখনোই এক পক্ষের নিয়ন্ত্রণে থাকে না সব সময়। আমাকে শায়েস্তা করার জন্য তার একটা শব্দই যথেষ্ট ছিল—‘বাঘ!’
আমার সমস্ত দিনের খরগোশের দুরন্তপনা, তাকে নাজেহালের যত ফন্দি—সবই উড়ে যেত নিমেষেই। আমি ঢুকে পড়তে চাইতাম তার কচ্ছপের খোলসের ভেতর। কিন্তু তার হাতে করার মতো যেহেতু আরও কাজ বাকি ছিল, সে আমাকে টেনে নিত তার বুকের কাছে, যেন সবকিছু ঠিক হয়ে গেছে, বাঘ বলে কোনো শব্দ নেই পৃথিবীতে।মনে পড়ে, সন্ধ্যার সেই সব অন্ধকারে কচ্ছপের গতিহীনতার চেয়ে গতিহীন হয়ে আমি দুরন্ত খরগোশ তার আঁচল ধরে ঢুকে যেতাম সুরক্ষিত কক্ষে—কচ্ছপের শয্যায়। যদিও সেই গতি ছিল রজব আলীর যুগান্তকারী পদক্ষেপের চেয়ে দ্রুত ও কম বিপজ্জনক।
আমি আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখতে পাচ্ছি প্রথম মেঘের খণ্ডটা সূর্যকে ঢেকে দিয়েছে। এতক্ষণে সময়ের এই অগ্রগতিতে আশাবাদী হয়ে যদি জানতে চান রজব আলীর পদক্ষেপ সম্পর্কে; আপনাকে আশাহত না করে বলব, সামনের ডান পায়ের গোড়ালিকে সে সফলভাবে মাটি থেকে তুলতে পেরেছে। মানে আমাকে আবার ফিরে যেতে হবে দন্তহীন কচ্ছপের শয্যায়!
সায়েরা বানুর শয্যায় (ঠিক যেভাবে সে দেখতে চায় আমাকে) একটা সোনার কবুতর হয়ে তার গা ঘেঁষে গুটিসুটি মেরে থাকতাম। প্যান্টের পকেট থেকে বের করে আনতাম আমার গুরুতর অপরাধ—তার গুলের কৌটাটা। সে তার সারাক্ষণ কাঁপতে থাকা হাত বাড়িয়ে দিত আমার দিকে। গুলের কৌটার নিকটবর্তী হতে থাকা হাতের সমান্তরালে তার শুকনো কিশমিশের মতো, অসহায়, শুষ্ক, মলিন, গোটানো ঠোঁট দুটো প্রসারিত হতো, যেন সারা দিন গুল না খেতে পারার অবসাদ থেকে সে মুক্তি দিচ্ছে তার মুখকে—সায়েরা বানু হাসছে, উন্মুক্ত হচ্ছে তার দন্তহীন পরিত্যক্ত অন্ধকার গুহার মুখগহ্বর! একরাতে আমি তাকে আবিষ্কার করেছিলাম কচ্ছপরূপে। সামনের কেরোসিনের ল্যাম্পের জ্বলন্ত শিখার আলো তার নুয়ে পড়া দেহের ভেতর প্রতিসরিত হতে ব্যর্থ হয়ে পেছনে দেয়ালের ওপর তাকে পরিণত করেছিল কচ্ছপে। বিশালাকার ছায়ার নিচে তখন শুয়ে ছিল সে, তার শয্যায়, যেন আলাদা করে ফেলছে সে নিজেকে শরীর থেকে। আমি আগুনের শিখাকে জ্বলতে দিলাম যতক্ষণ না শেষ কেরোসিনটুকু সলতে টেনে নিচ্ছে। বারান্দায় শুয়ে অর্ধঘুমন্ত আমিরুন্নেসা আমাকে তিরস্কার করে যাচ্ছিল, ‘লাটসাহেবের বাচ্চা, টেমি জ্বালায় রাখিছিস কিসির জন্যি?’ তার পাশে শুয়ে আহাদ শেখ, (নিশ্চিতভাবে আমার আব্বা) নাক ডেকে যাচ্ছিল এবং আমার পাশে তার মা (যে তার ছেলে, ছেলের বউ এবং দুনিয়ার সবার অগোচরে একটা কচ্ছপে পরিণত হয়েছে)। এই মা-ছেলে আমাদের মাতা-পুত্রের পাশে শুয়ে নিজেদের সম্পর্ককে জানান দিচ্ছিল। সায়েরা বানুর নাক দিয়ে বাতাস সুর তুলে চলে যাচ্ছিল তার ক্লান্ত ফুসফুসে আর আহাদ শেখ বাধ্য ছেলের মতো অনুসরণ করছিল তার মাকে! কচ্ছপের বিশালতা থেকে ধীরে ধীরে কুকড়িমুকড়ি ক্ষুদ্রকায় হতে থাকা সায়েরা বানুকে আলাদা করলে, সে ছিল আহাদ শেখের মমতাময়ী মা।
সময়কে আরও পেছনে টানার লোভ যদি সংবরণ করতে না পারি, তাহলে সায়েরা বানু তার নুয়ে পড়া দেহের ওপর অভিকর্ষ বলের চক্রান্তকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াবে! কচ্ছপ শরীর ঝেড়ে ফেলে পরিণত হবে যুবতীতে! কিন্তু আমি কত দূরই–বা এগোতে পারব! বড়জোর সেই কাঠের টুকরো পর্যন্ত, যেটা ভাটার টানে খোলপেটুয়ার বুকে ভেসে যাচ্ছিল চিৎকার করতে করতে।
যুবতী সায়েরা বানু তখন কোমরপানিতে, খোলপেটুয়ার পেটের ভেতর মাছ ধরায় ব্যস্ত। ‘তখন। ভাটা। লেগিছে।’ যেভাবে সে বারবার শুনিয়েছে আমাকে, প্রতিটা শব্দের শেষে দীর্ঘ বিরতি নিয়ে সমাপ্তির ইঙ্গিতে, (তার কণ্ঠনিঃসৃত প্রতিটা শব্দে পূর্ণচ্ছেদ বসানো ছাড়া কীই–বা করার থাকে!) হাতের মধ্যমাকে গুলের কৌটার মধ্যে প্রবেশ করাতে করাতে।
একটা ত্রিভুজকে পেছনে রেখে, গুমোট মেঘলা অন্ধকারাচ্ছন্ন দুপুরে, বঙ্গোপসাগরের দিকে হনহনিয়ে চলা স্রোতের বিপরীতে, একটা মাছরাঙার মতো প্রতীক্ষারত, ধ্যানমগ্ন, নিবিষ্ট সায়েরা বানু কচ্ছপের খোলসকে কয়েক যুগ পেছনে ফেলে খোলপেটুয়ার বুকে টেনে চলেছে তার হাতজাল।‘আকাশ। কিরাম। বুজে। আসতিছে।’ সুচতুর গল্পবাজ সায়েরা বানুর প্রতিটা পূর্ণচ্ছেদে আলাদা হওয়া শব্দকে আমলে নিলে, ওটা ছিল একটা বড়সড় ব্যাসের ঝড়ের পূর্বাভাস। যেটা সায়েরা বানুর অজান্তে ধেয়ে আসছিল ঘণ্টায় প্রায় ১০০ কিলোমিটার বেগে।
স্রোতের টানে চিংড়ি আর পারশে মাছের পোনা ধরা পড়ছিল তার ত্রিভুজ হাত জালে। খোলপেটুয়ার ঐশ্বর্যের বিচারে সায়েরা বানু যেসব সম্পদ এর পেট থেকে তুলে নিচ্ছিল তার কোমরের সঙ্গে দড়িতে বাঁধা হাঁড়িতে, তা ছিল যৎসামান্যই, যেন সে কোনো ধনীর প্রাচীর থেকে খসে পড়া মূল্যহীন পলেস্তারা কুড়িয়ে নিচ্ছে।
পারশে আর চিংড়ির আকৃতি ও হতাশাজনক বাজারমূল্য বোঝাতে সে বের করে এনেছিল গুল মাখানো লালায় ভেজা মধ্যমাকে তার দন্তহীন মুখগহ্বর থেকে। মধ্যমা থেকে ঘন লালা নেমে আসছিল একটা প্রশস্ত জায়গার খোঁজে হাতের তালুর দিকে। কিন্তু সারা দিনের কঠোর পরিশ্রমের পর অপ্রাপ্তির হতাশাকে উগরে দিতে মধ্যমাকে ব্যবহার করার প্রয়োজন ছিল তার। সে বুড়ো আঙুলকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল নিকোটিনে জারিত মধ্যমার দিকে। ঠিক মধ্যমার দ্বিতীয় গিরায় হতাশা ঝেড়ে দিয়েছিল সে, ‘এতটুকু।’ সায়েরা বানু সেই দুপুরের চিত্র যেন দেখতে পাচ্ছিল তার আঙুলের ডগায়।
আমার আব্বা আহাদ শেখ ডুমুরিয়া ঘাট পার হচ্ছিল তখন। আর দাদি তখনো হরিশখালী ঘাটের কাছে মাছ ধরে চলেছিল একমনে। আকাশের এমন গুমোট বিস্ফোরণোন্মুখ চেহারা সত্ত্বেও সে কোনো কিছুকে পাত্তা না দিয়ে খোলপেটুয়ার ভাটার বিপরীতে এগিয়ে যাচ্ছিল। আকাশে মেঘ জমতে জমতে যখন একেবারে অন্ধকার হয়ে উঠল, সায়েরা বানু ত্রিভুজটাকে বিশ্রাম দেওয়ার কথা ভাবল। এবং প্রথমবারের মতো পরিস্থিতিটা মাপার চেষ্টা করল সে। সোজা তাকাল ডুমুরিয়া ঘাটের দিকে, তারপর খোলপেটুয়ার বিপরীতে নীলডুমুরের দিকে। কিন্তু দৃষ্টিসীমাকে ক্ষীণ করে দেওয়া গুমোট মেঘাচ্ছন্ন খোলপেটুয়ার বুকে দাঁড়িয়ে সে ঠিক করতে পারল না হলদিমুনিয়াটা ঠিক কোন দিকে।
আরও একটা ত্রিভুজকে সঙ্গী করল সে। কোমরে হাত রেখে আকাশের দিকে তাকাল সায়েরা বানু।
দাদির সেই বয়সের দেহসৌষ্ঠব যদি উন্মোচন করতে চাই, তাহলে আমাকে বিস্তর জানতে হবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বস্তুর রূপান্তরের প্রক্রিয়া। ধরা যাক, সে ছিল চার ফুটের বড়সড় একটা পুতুল। যে পুতুলের উচ্চতা সত্ত্বেও উন্নত বুকের উদাসীনতায় কাবু করতে পারত গাবুরার পুরুষদের। যেমনটা তাকে দেখে হয়েছিল আমার দাদা জমির শেখ। কুঠারটা হাত থেকে পড়ে তার ডান পায়ের সব কটি আঙুল বিচ্ছিন্ন করে দেয় চোখের পলকে। দাদা তাকিয়ে দেখে হঠাৎ দুই দলে বিভক্ত হওয়া আঙুলের মাঝখানে গেঁথে আছে কুঠারটা। ফিনকি দিয়ে রক্ত ঝরানো আঙুলগুলো তার মনোযোগ আকর্ষণ করছে।
এই পুরো ব্যাপারটা সবাই দুর্ঘটনা মনে করলেও একজন জানত অন্য কিছু—আমার দাদি জমির শেখের এই বিপর্যয়কে দেখেছিল চালাকি হিসেবে। সে জানত তাকে কাবু করতে জমির শেখ তার বিশ্বস্ত কুঠারকে নিয়োজিত করেছিল। জমির শেখ চেয়েছিল সায়েরা বানু এক্ষুনি ছুটে আসুক বিচ্ছিন্ন আঙুলগুলোর কাছে, তার বুকের প্রতি আরও উদাসীন হয়ে, খোলপেটুয়ার ঢেউয়ের মতো কাঁপতে কাঁপতে।
আমার দাদি এই চালাকি বুঝতে পেরে অবিচল দাঁড়িয়ে ছিল যতক্ষণ না সে দেখল, জমির শেখ মাটিতে লুটিয়ে পড়েছে। সে এক দৌড়ে ছুটে গেল পাশের ঝোপের মধ্যে। তারপর সোনালি লতা নিয়ে হাজির হলো জমির শেখের পায়ের কাছে। তার দুই হাতের তালুর মধ্যে তখন সোনালি লতাগুলো প্রস্তুতি নিচ্ছিল মুমূর্ষের পাশে দাঁড়ানোর। সে লতাগুলো পিষে যাচ্ছিল যতক্ষণ না তা থেকে গাঢ় সবুজ রং নিঃসৃত হয়। একটানা মাড়াইকারী যন্ত্রের মতো সায়েরা বানুর হাতের তালু তৎপর হয়ে উঠেছিল। তারপর লতাগুলো চিপে চিপে গাঢ় সবুজ রস লাগিয়ে দিচ্ছিল প্রতিটা বিচ্ছিন্ন আঙুলের গোড়ায়।
আমার দাদা এই সুযোগ কোনোভাবে হাতছাড়া করতে চাইল না। সে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে জ্ঞান হারিয়ে ফেলল। তাকে ধরাধরি করে কাদাপানি থেকে শূন্যে তুলে নিল তার সঙ্গীরা। তারপর ছুটতে লাগল সায়েরা বানুর বাড়ির দিকে।
তিন দিন পর আমার দাদা সায়েরা বানুর বুকের উদাসীনতার উৎস খোঁজার অনুমতিপ্রাপ্ত হলো। শুধু এই জন্য নয় যে সে ছয় ফুট উচ্চতার সুঠাম, পেশিবহুল পুরুষ ছিল, কিংবা সমস্ত গাবুরায় তার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল গাছ কাটার দক্ষতা আর ভার উত্তোলনের জন্য। বরং তখন তার দরকার ছিল নিবিড় পরিচর্যার। তাই এক জোড়া শস্য মাড়াইকারী খাটো শক্ত হাতে তুলে দেওয়া হলো তাকে।রজব আলী তার প্রথম পদক্ষেপ সম্পন্ন করে ফেলেছে। সে বুড়ো আঙুলের ওপর এতক্ষণের সমস্ত ভরকে সমবণ্টন করেছে তার ডান পায়ের পাতার ওপর। আর যেমনটি মীমাংসিত সত্য, মেঘের দ্বিতীয় খণ্ড ঢেকে ফেলেছে সূর্যকে। তাই আমাকে আবার অতীতের সবকিছু ফেলে চলে আসতে হবে নিকটতম অতীতে, বরফ-পানি খেলায়।
রজব আলী তার তর্জনী নামিয়ে আনছে একটা নির্দিষ্ট গন্তব্যের দিকে। ঠিক গোবিন্দের ঝুকে থাকা বাইনগাছের নিচে। বরফ গোবিন্দ ঘামছে। কিন্তু আমাকে অভিশাপ দিচ্ছে সায়েরা বানু, কারণ আমি তাকে ফেলে এসেছি তার জীবনের দুই প্রান্ত উন্মুক্ত রেখে।
রজব আলী তর্জনীর সঙ্গে প্রসারিত করে ফেলেছে তার বুড়ো আঙুল, পরীক্ষা করছে কাদার ওপর পড়ে থাকা সদ্য ভীতিকর পদচিহ্ন।
ডুমুরিয়া ঘাট পার হয়ে স্রোতের টানে সায়েরা বানুর দিকে ধেয়ে আসছে কাঠের টুকরোর ওপর চিৎকাররত একটা বাচ্চা (নিশ্চিতভাবে আমার আব্বা)। এখনই সায়েরা বানুকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে সে আমার দাদি হবে কি না!
জমির শেখ পাঁচ আঙুল থেকে সরিয়ে ফেলেছে তার ওজন সায়েরা বানুর ওপর। দ্বিতীয় খণ্ড মেঘের শেষ প্রান্ত অতিক্রম করে যাচ্ছে সূর্যকে…।
আর আমাদের রজব আলীর সামনে পাশের হেতালের ঝোঁপ থেকে বের হয়ে দাঁড়িয়েছে একটা ডোরাকাটা বাঘ। দেখছে, কী বিচক্ষণভাবে রজব আলী পরীক্ষা করে চলেছে তার পদচিহ্ন!
রজব আলীর মর্মান্তিক মৃত্যুকে স্মরণ করতে গিয়ে গোবিন্দ, জালাল আর আমি বহু বছর ধরে এই তর্কে জড়িয়ে পড়ব যে তাকে বাঘে নিয়ে যাওয়ার পরও কে শেষ পর্যন্ত বরফ-পানি খেলায় বরফ হয়ে টিকে ছিল। এবং আমরা কখনোই এই বিষয়ে একমত হতে পারব না।
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: আম র দ দ প রস ত ত আহ দ শ খ পদক ষ প ব ইনগ ছ র জন য র র মত কর ছ ল র ভ তর আম দ র সমস ত র ওপর ত রপর সবক ছ
এছাড়াও পড়ুন:
যাত্রাবাড়ীতে নাতির শিলের আঘাতে নানির মৃত্যু
রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর ধলপুরে নাতির শিলের আঘাতে হাসিনা বেগম (৬৩) নামে এক বৃদ্ধা খুন হয়েছেন। এ ঘটনায় নাতি সাজেদুল হক সাজুকে (৩২) স্থানীয় লোকজন ধরে পুলিশে সোপর্দ করেছে।
রবিবার (২১ সেপ্টেম্বর) দুপুরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে হাসিনা বেগমের মরদেহ ময়নাতদন্তের জন্য পাঠানো হয়ছে।
মৃতার ভাতিজা আশরাফ আলী জানান, হাসিনা বেগমের স্বামী নুরুল ইসলাম ২০ বছর আগে মারা গেছেন। একমাত্র মেয়ে শ্বশুরবাড়িতে থাকেন। তিনি ধলপুরে একাই বসবাস করতেন এবং অন্যের বাসায় কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতেন।
তিনি আরও জানান, সাজেদুল হক সাজু বেকার। সে হাসিনার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলে। তাদের মধ্যে নানি-নাতির সম্পর্ক তৈরি হয়। শনিবার সকালে সাজু হঠাৎ ঘরে ঢুকে দরজা আটকে শিল দিয়ে হাসিনার মাথা ও শরীরের বিভিন্ন স্থানে আঘাত করে। এতে ঘটনাস্থলেই তিনি মারা যান। প্রতিবেশীরা বিষয়টি বুঝতে পেরে সাজেদুলকে ধরে পুলিশের সোপর্দ করে। পরে সে হত্যার কথা স্বীকার করে।
যাত্রাবাড়ী থানার উপপরিদর্শক শেখ মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম বলেন, ‘‘আমারা খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে গিয়ে মরদেহ উদ্ধার করি এবং সাজেদুলকে আটক করে নিয়ে এসেছি। প্রাথমিক তদন্তে জানা যায়, সাজেদুল হক সাজু একাই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। তবে এর কারণ এখনো জানা যায়নি।’’
ঢাকা/বুলবুল//