ডা. মিলন শহীদ হলো, গণতন্ত্র এল কি?
Published: 27th, November 2025 GMT
২৭ নভেম্বর। শহীদ ডা. শামসুল আলম খান মিলনের শাহাদাতদিবস। ১৯৯০ সালের এই দিনে আনুমানিক বেলা ১১টায় তৎকালীন স্বৈরশাসকের মদদপুষ্ট দুর্বৃত্তের ছোড়া একটি বুলেট টিএসসির প্রাঙ্গণে বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগারের কোনায় মিলনের জীবনপ্রদীপ নিভিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু আমার হৃদয়ে সেই শ্বাসরুদ্ধকর দিনটি আজও অম্লান, তা যেন চিরকাল অক্ষয় হয়ে থাকবে।
শহীদ মিলনের রক্তের বিনিময়ে জনগণের বহু কাঙ্ক্ষিত গণতান্ত্রিক ধারা প্রতিষ্ঠিত হলো। সাধারণ মানুষ উল্লাসভরে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে দেশে গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত করল। তারপর সংসদীয় গণতন্ত্রে দীর্ঘ ২৫ বছর নির্বাচনের মাধ্যমে দেশের বৃহৎ দুই রাজনৈতিক দল পালাবদল করে সরকার গঠন করেছে। লক্ষণীয়, প্রতিটি সরকারের আমলে সরকারি দলের একশ্রেণির রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ী দুর্নীতির মাধ্যমে অর্থ-সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছেন দেশে-বিদেশে। পাকিস্তান আমলে আমরা ২২ ব্যবসায়ী পরিবারের কথা জানতাম, দেশের অর্থ-সম্পদের বিরাট একটি অংশ যাদের কুক্ষিগত ছিল। স্বাধীন বাংলাদেশে শোনা যায় আজ ২২ হাজার পরিবারের কথা, যারা এমন অর্থ-সম্পদের মালিক হয়েছে।
শহীদ মিলন ছিল একজন বন্ধুবৎসল ও ব্যক্তিস্বার্থের ঊর্ধ্বে ওঠা নির্লোভ, সাহসী ও আপসহীন ত্যাগী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। স্কুলজীবন থেকেই সে অত্যন্ত মেধাবী ছিল। কিশোর বয়স থেকেই ও বুঝতে শিখেছিল, আমরা বাঙালিরা পাকিস্তানিদের দ্বারা নির্যাতিত, নিপীড়িত ও শোষিত এক জনগোষ্ঠী, যাদের বাক্স্বাধীনতা নেই।
মিলনের ডায়েরি লেখার অভ্যাস ছিল। তার কিশোর বয়সের লেখা ডায়েরির পাতায় একটি লেখা খুঁজে পেয়েছিলাম। তখন থেকেই সামাজিক কাজকর্মে আত্মনিয়োগ করার প্রবণতা ওর চরিত্রে প্রকাশ পেতে থাকে। তখন আমাদের বাসা ছিল মগবাজারের গ্রিন ওয়েতে। ওই সময়ে এলাকায় ‘প্রদীপ্ত সবুজ সংঘ’ নামে শিশু-কিশোরদের একটি সংগঠন ছিল। মিলনের দায়িত্ব ছিল প্রতি মাসে একটি দেয়ালপত্রিকা বের করা। মিলন নিজেও কিছু কিছু লিখত। তখন থেকেই ওর মধ্যে গড়ে ওঠে সাংগঠনিক দক্ষতা/ক্ষমতা, যা পরবর্তী রাজনৈতিক জীবনেও প্রতিফলিত হয়েছিল।
মিলন স্বপ্ন দেখেছিল, বুর্জোয়া-পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থার মূলোৎপাটন করে শ্রেণিহীন এক সমাজব্যবস্থা কায়েম করবে। রৌমারীর মতো প্রত্যন্ত অঞ্চলে চিকিৎসক হিসেবে কাজ করার অভিজ্ঞতা থেকে সে বলেছিল, ‘যাদের পেটে ভাত জোটে না, তাদের কী চিকিৎসা দেব? ওদের সব রোগের মূলে রয়েছে অপুষ্টি।’বই পড়া ও কেনার এক অদম্য নেশা ছিল ওর। টিফিনের পয়সা বাঁচিয়ে বই কিনত সে। রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার পর মিলন উপলব্ধি করেছিল, রাজনৈতিক শিক্ষা ছাড়া রাজনীতির আদর্শ বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। তাই ওর পড়ার ঘরটি নানা বইয়ের সম্ভারে ঠাসা ছিল। সেখানে ছিল বাংলাদেশের ইতিহাস, দর্শন, বিজ্ঞান, সাহিত্য, রাজনীতি, স্বাস্থ্য ও বিজ্ঞান বিষয়ের নানা পত্রিকা। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দ, সুকান্ত থেকে আরম্ভ করে মঁপাসা, চেকভ, তলস্তয়, বার্ট্রান্ড রাসেল, ম্যাক্সিম গোর্কি, এর্নেস্তো চে গুয়েভারা, লেনিন, মার্ক্স—এমন নানা লেখকের বইয়ে মিলনের ঘর ঠাসা ছিল।
মিলন স্বপ্ন দেখেছিল, বুর্জোয়া-পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থার মূলোৎপাটন করে শ্রেণিহীন এক সমাজব্যবস্থা কায়েম করবে। রৌমারীর মতো প্রত্যন্ত অঞ্চলে চিকিৎসক হিসেবে কাজ করার অভিজ্ঞতা থেকে সে বলেছিল, ‘যাদের পেটে ভাত জোটে না, তাদের কী চিকিৎসা দেব? ওদের সব রোগের মূলে রয়েছে অপুষ্টি।’
আরও পড়ুনশহীদ ডা.মিলনের আত্মত্যাগ ও অধরা গণতন্ত্র২৮ নভেম্বর ২০২০
স্পষ্টত, সমাজ আজ দুটি শ্রেণিতে বিভক্ত। এক শ্রেণি অগাধ সম্পত্তি ও বিত্তবৈভবের মালিক, আরেক শ্রেণি দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করছে, যাদের নিজস্ব বাসস্থান নেই। অস্বীকার করার উপায় নেই, এত কিছু সত্ত্বেও দেশ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ধীরে ধীরে এগিয়ে চলছে। অর্থনীতি, স্বাস্থ্যসেবা, কৃষি, খাদ্য উৎপাদন ইত্যাদি প্রতিটি ক্ষেত্রেই বাংলাদেশের উন্নতি বহির্বিশ্বের স্বীকৃতি পেয়েছে। অদম্য মনোবলের অধিকারী গ্রামের সাধারণ খেটে খাওয়া পরিশ্রমী লোকজন আজ বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।
ব্যক্তিস্বার্থ আর ক্ষমতালিপ্সার অশুভ শক্তির কাছে পরাজিত হলো মিলনের রক্তসিক্ত শুভ চেতনা। তাই গণতন্ত্র আজ নির্বাসিত। আর বিজ্ঞজনের কারও কারও মতে, শহীদ মিলনকে রাষ্ট্রীয়ভাবে যেভাবে মূল্যায়ন করা উচিত ছিল, তা করা হয়নি। যে গণতন্ত্রের জন্য মিলন জীবন দিল, সেই গণতন্ত্র যথাযথভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়নি বলেই দেশে আজ জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবাদের উদ্ভব হয়েছে। দেশের গণতান্ত্রিক কাঠামো দলীয়করণের জন্য জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার আজ ভূলুণ্ঠিত।
দেশের প্রতিটি সংকটময় মুহূর্তে আমাদের তরুণসমাজ গর্জে উঠেছে। ভাষা আন্দোলন থেকে স্বাধীনতার আন্দোলন, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন—প্রতিটি ক্ষেত্রে তারা ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে এসেছে, অন্যায় ও অবিচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে। আজও আমরা তরুণসমাজকে নিয়ে আশাবাদী। দেশ ও সমাজ আজ যখন দুর্নীতি, চাঁদাবাজি, নারীর প্রতি সহিংসতা, যৌন হয়রানি, সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ ও গুপ্তহত্যার কবলে নিমজ্জিত; ঠিক সেই মুহূর্তে আমরা তরুণসমাজকে নির্লিপ্ত দেখতে চাই না। আমরা জানি, তরুণেরা জাতির ভবিষ্যৎ এবং সমাজের প্রাণশক্তি। যে জাতির তরুণসমাজ ঝিমিয়ে পড়ে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হতে সাহসী ভূমিকা রাখতে পারে না, সে জাতি সামনে এগিয়ে যেতে পারে না।
এ পরিস্থিতিতে আমাদের স্বপ্নের বাংলাদেশকে জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসমুক্ত করতে হলে গণতান্ত্রিক ধারা অক্ষুণ্ন রেখে সমগ্র জাতিকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে। তবেই সব শহীদের স্বপ্ন সার্থক হবে এবং তাঁদের প্রতি আমরা যথার্থ শ্রদ্ধা দেখাতে পারব।
সেলিনা আখতার শহীদ ডা. মিলনের মা।
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: গণত ন ত র ক গণতন ত র র জন ত ক সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
হাসিনাকে ফেরত চেয়ে বাংলাদেশের দেওয়া চিঠি পরীক্ষা করে দেখছে ভারত: রণধীর জয়সওয়াল
ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ফেরত চেয়ে বাংলাদেশের দেওয়া চিঠি পরীক্ষা করে দেখছে ভারত। আজ বুধবার ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল রাজধানী নয়াদিল্লিতে সংবাদ ব্রিফিংয়ে এ কথা বলেছেন।
ব্রিফিংয়ে এক সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে জয়সওয়াল বলেন, ‘চলমান বিচারিক ও অভ্যন্তরীণ আইনি প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে অনুরোধটি (চিঠি) পরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে। আমরা শান্তি, গণতন্ত্র, অন্তর্ভুক্তি এবং স্থিতিশীলতাসহ বাংলাদেশের জনগণের সর্বোত্তম স্বার্থের বিষয়ে অঙ্গীকারবদ্ধ। এ লক্ষ্য অর্জনে আমরা অব্যাহতভাবে সব অংশীজনের সঙ্গে গঠনমূলকভাবে যুক্ত থাকব।’
নয়াদিল্লিকে দেওয়া চিঠির বিষয়ে আজ পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন বলেন, শেখ হাসিনাকে ফেরত চেয়ে পাঠানো চিঠির জবাব এখনো আসেনি। আজ দুপুরে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি এ খবর জানান।
কোন প্রক্রিয়ায় ভারতে চিঠি পাঠানো হয়েছে, সে প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা সাংবাদিকদের বলেন, ‘নোট ভারবাল (কূটনৈতিক পত্র) আমাদের মিশনের মাধ্যমে ওদের (ভারতের) পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। কোনো উত্তর আসেনি। এত তাড়াতাড়ি উত্তর আশাও করি না আমরা।’
গত বছর ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে ভারতে পালিয়ে যান শেখ হাসিনা। এরপর তাঁকে প্রত্যর্পণের অনুরোধ জানিয়ে বাংলাদেশ দুই দফায় চিঠি দিলেও সাড়া দেয়নি ভারত। এর মধ্যে ১৭ নভেম্বর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গত বছরের ওই আন্দোলনের সময় সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধে দোষী সাব্যস্ত করে শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানকে মৃত্যুদণ্ড দেন।
এরপর শেখ হাসিনাকে হস্তান্তরের জন্য ভারতকে তৃতীয়বারের মতো চিঠি দেয় বাংলাদেশ। চিঠিতে বলা হয়, বিস্তারিত বিচারিক প্রক্রিয়া শেষে ১৭ নভেম্বর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল রায় দিয়েছেন। আদালত মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে শেখ হাসিনাকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করেছেন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ দুই দেশের মধ্যে সই হওয়া প্রত্যর্পণ চুক্তি অনুযায়ী শেখ হাসিনাকে হস্তান্তরের জন্য ভারতকে আবার অনুরোধ জানাচ্ছে।
এই চিঠির কোনো জবাব নয়াদিল্লি না দিলেও শেখ হাসিনাকে মৃত্যুদণ্ড দিয়ে রায় ঘোষণার পর একটি বিবৃতি দিয়েছিল ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। তাতে বলা হয়েছিল, ‘নিকট প্রতিবেশী হিসেবে ভারত বাংলাদেশে শান্তি, গণতন্ত্র, অন্তর্ভুক্তি, স্থিতিশীলতাসহ বাংলাদেশের জনগণের সর্বোত্তম স্বার্থের বিষয়ে অঙ্গীকারবদ্ধ। এই লক্ষ্য অর্জনে আমরা সব সময় সব অংশীজনের সঙ্গে গঠনমূলকভাবে যুক্ত থাকব।’
আরও পড়ুনশেখ হাসিনাকে ফেরত চেয়ে দিল্লিকে লেখা চিঠির জবাব এখনো আসেনি: পররাষ্ট্র উপদেষ্টা২ ঘণ্টা আগে