বিভাগীয় প্রধানের পদত্যাগের দাবিতে তড়িৎ প্রকৌশলের শিক্ষার্থীদের ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন
Published: 27th, November 2025 GMT
সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের তড়িৎ প্রকৌশল (ইইই) বিভাগের প্রধান ইফতে খাইরুল আমিনের পদত্যাগের দাবিতে টানা চার দিন ধরে ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন করছেন শিক্ষার্থীরা। দাবির মুখে তাঁকে সাময়িকভাবে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতিও দিয়েছে প্রশাসন। তবে স্থায়ী সমাধান না হওয়া পর্যন্ত একাডেমিক কার্যক্রমে না ফেরার ঘোষণা দিয়েছেন শিক্ষার্থীরা।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, তড়িৎ প্রকৌশল বিভাগের কয়েকজন শিক্ষক ও শিক্ষার্থী সূত্রে জানা গেছে, গত রোববার থেকে বিভাগটির স্নাতক প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত চলমান পাঁচটি ব্যাচের শিক্ষার্থীরা ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন করেছেন। এর আগে চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থীরা বিভাগের বিভিন্ন সংকট ও বিভাগীয় প্রধানের আচরণগত সমস্যার কথা ছাত্র উপদেষ্টাদের জানিয়ে সমাধানের আহ্বান করেন। তবে সমাধান না পাওয়ায় ১৬ নভেম্বর থেকে চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থীরা ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন করে আসছেন। পরবর্তী সময়ে তাঁদের সঙ্গে অন্য ব্যাচের শিক্ষার্থীরা একাত্মতা পোষণ করে চলতি সপ্তাহ থেকে ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন করেন। এতে বিভাগটির শিক্ষা কার্যক্রমে কার্যত অচলাবস্থা বিরাজ করছে।
শিক্ষার্থীদের দাবি, ইফতে খাইরুল আমিনের মধ্যে শিক্ষকসুলভ আচরণ অনুপস্থিত। শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবন, কোর্সে পাস করার পাশাপাশি সার্টিফিকেট নিয়ে বের হতে না দেওয়ার হুমকি, তুচ্ছ বিষয় নিয়ে অভিভাবকদের ফোন করে অপমান, আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতার জন্য কোনো সহযোগিতা না পাওয়া, কথা বলতে গেলে ভয় দেখানো, শিক্ষার্থীদের অপমান-অপদস্থ করার অভিযোগ আছে তাঁর বিরুদ্ধে। এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে স্মারকলিপি দিয়েছেন তাঁরা।
শিক্ষার্থীদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে গত মঙ্গলবার রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রারের সই করা এক অফিস আদেশে জানানো হয়, ‘তড়িৎ প্রকৌশল বিভাগের বিভাগীয় প্রধান সংশ্লিষ্ট উদ্ভূত পরিস্থিতে স্কুল অব অ্যাপ্লাইড সায়েন্সেস অ্যান্ড টেকনোলজি অনুষদের ডিনকে কর্তৃপক্ষের অনুমোদনক্রমে পুনরাদেশ না দেওয়া পর্যন্ত বিভাগীয় প্রধানের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।’ বিষয়টি নিশ্চিত করে রেজিস্ট্রার সৈয়দ ছলিম মোহাম্মদ আবদুল কাদির বলেন, এর পরিপ্রেক্ষিতে সাত সদস্যবিশিষ্ট কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্ত সাপেক্ষে কর্তৃপক্ষ পরবর্তীতে সিদ্ধান্ত নেবেন।
অভিযোগের বিষয়ে ইফতে খাইরুল আমিন বলেন, ‘সব অভিযোগের আগে তদন্ত হয়, আমার ক্ষেত্রে রায় শুনিয়ে দেওয়া হয়েছে। আমার কাছে অভিযোগের কোনো কপি দেওয়া হয়নি, জবাব দেওয়ারও সুযোগ দেওয়া হয়নি। বরং আমাকে সরাসরি সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। আমি কর্তৃপক্ষের এই সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করছি। আমি নিজে থেকে কোনো অব্যাহতিপত্র দেব না। অভিযোগের জবাব দিতে আমি প্রস্তুত। যদি আমার কথায় কেউ কষ্ট পেয়ে থাকেন, শিক্ষার্থী কিংবা অ্যালমনাইদের কাছে দুঃখ প্রকাশ করব। তবে অভিযোগের যথাযথ প্রমাণ থাকতে হবে।’
ইফতে খাইরুল আমিনের বিরুদ্ধের আনা অভিযোগের বিষয়ে গতকাল বুধবার বিকেল থেকে তদন্তের কাজ শুরু হয়েছে বলে জানিয়েছেন কমিটির প্রধান ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ-উপাচার্য সাজেদুল করিম।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ক ল স পর ক ষ
এছাড়াও পড়ুন:
গণ-অভ্যুত্থান–পরবর্তী বাংলাদেশ ও বেহাত বিপ্লব
বাংলাদেশের ইতিহাস মূলত গণমানুষের জাগরণের ইতিহাস। ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন থেকে ২০২৪ সালের গণ-অভ্যুত্থান—প্রতিটি অধ্যায়ে তৃণমূল মানুষের আত্মত্যাগ, রক্ত ও স্বাধীনভাবে বাঁচার আকাঙ্ক্ষা আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে। কিন্তু প্রতিটি বিজয়ের পর ইতিহাস যেন এক অপ্রিয় বাস্তবতার পুনরাবৃত্তি ঘটায়। বিপ্লব হয়, পরিবর্তনের সুর বাজে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত ক্ষমতা ফিরে যায় ভিন্ন মুখোশধারী একই গোষ্ঠীর হাতে। যেন—যে যায় লঙ্কায়, সে-ই হয় রাবণ।
তাহলে প্রশ্ন জাগে—আমাদের গণ-অভ্যুত্থানগুলো কি সত্যিই জনগণের জন্য, নাকি সাধারণ মানুষের রক্তের ওপর দিয়ে রাজনীতিবিদদের ক্ষমতার পালাবদলের হাতিয়ার?
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ ছিল এক মহান সামাজিক বিপ্লবের সামগ্রিক ফসল। কিন্তু যুদ্ধ-পরবর্তী সময়েই সেই বিপ্লবের নেতৃত্ব চলে যায় রাজনৈতিকভাবে বিভক্ত এক এলিট শ্রেণির হাতে। যাদের ওপর আস্থা রেখে জনগণ শাসনক্ষমতা অর্পণ করেছিলেন, কালের পরিক্রমায় তারাই শাসক থেকে শোষকে রূপান্তরিত হলেন। হয়ে উঠলেন রক্ষক থেকে ভক্ষক। অথচ জনতার স্বপ্ন ছিল একটি ন্যায়ভিত্তিক সমাজ ও জনগণের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠা। কিন্তু বাস্তবে তার সম্পূর্ণ উল্টো চিত্র পরিলক্ষিত হলো—যেখানে আদর্শ হার মানল লোভের কাছে, আর রাজনীতি পরিণত হলো স্বার্থ চরিতার্থ করার যন্ত্রে। ফলস্বরূপ, জনমনে জন্ম নিল নতুন অসন্তোষ।
এরপর এল ১৯৯০ সালের গণ-অভ্যুত্থান। ছাত্রসমাজ ও সাধারণ জনগণ একত্র হয়ে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের মাধ্যমে রচনা করল এক নতুন ইতিহাস। সবাই ভেবেছিল, এবার হয়তো সত্যিকারের গণতন্ত্রের সূর্যোদয় হবে। কিন্তু না—ইতিহাস আবারও নিজেকে পুনরাবৃত্ত করল। আন্দোলনের সুফল ভোগ করল রাজনীতির পুরোনো খেলোয়াড়েরা, আর যারা রাস্তায় রক্ত দিল, যাদের পরিবারের সদস্যরা জীবন বিপন্ন করল, তারাই রইল মঞ্চের বাইরে। শাসক বদলাল, কিন্তু চরিত্র বদলাল না। আবারও বিপ্লব বেহাত হলো।
সর্বশেষ ২০২৪ সালের স্বৈরাচারবিরোধী গণ-অভ্যুত্থানেও দৃশ্যপট প্রায় অভিন্ন। হাজারো শহীদের আত্মত্যাগ আর অসংখ্য মানুষের পঙ্গুত্বের বিনিময়ে উদিত হয়েছিল এক নতুন সূর্য। কিন্তু বছর না ঘুরতেই দেখা গেল সেই পুরোনো পরিচিত চিত্র—চাঁদাবাজি, বদলি বাণিজ্য, রাজনৈতিক কোন্দল এবং অভ্যন্তরীণ বিভাজনে বিপ্লবের চেতনা ক্ষয় হতে শুরু করল। সংস্কার নিয়ে ঐকমত্যে বিরোধ, ক্ষমতার ভাগাভাগি নিয়ে তর্ক—সব মিলিয়ে গণ-অভ্যুত্থানের মূল চেতনা আজ প্রায় বিপর্যস্ত। যাদের আত্মত্যাগে এই আন্দোলন সফল হয়েছিল, তাদের প্রতি দেখা যাচ্ছে অবহেলা। অন্যদিকে পরাজিত শক্তিও আবার মাথা তুলছে—নাশকতা, ককটেল বিস্ফোরণ, রাজনৈতিক সহিংসতা—সবকিছু যেন ফিরে এসেছে পুরোনো চিত্রে।
সব মিলিয়ে আজকের বাংলাদেশ যেন তাসের ঘরের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা এক বেহাত বিপ্লবের নাম। দুই দিন পর হয়তো নির্বাচন হবে, সরকার গঠিত হবে, কিন্তু তারপর? হয়তো দলীয় এজেন্ডা বাস্তবায়নেই ব্যস্ত থাকবে রাজনৈতিক দলগুলো। জনগণকে তখন মনে পড়বে কেবল ভোটের দিনে, আর বাকিটা সময় তারা হয়ে থাকবে নিছক এক ‘সংখ্যা’।
ইতিহাস সাক্ষী—প্রয়োজনে যতবারই ক্রান্তিকাল এসেছে, কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র ও সাধারণ জনতা রক্ত দিয়েছে। অথচ ক্ষমতার স্বাদ নিয়েছেন রাজনীতিবিদেরা ও মুষ্টিমেয় এলিট শ্রেণি। বিপ্লবের চেতনা রাস্তায় জন্ম নেয়, কিন্তু ফল ভোগ করে চৌহদ্দিতে বন্দী কিছু সুযোগসন্ধানী। এই চক্র ভাঙতেই হবে—এবং ভাঙতেই হবে। তবে এর জন্য কেবল বিপ্লব বা সরকার পরিবর্তনই যথেষ্ট নয়; প্রয়োজন মানুষের মানসিকতার গভীর পরিবর্তন। বিপ্লবীদেরও বুঝতে হবে—অভ্যুত্থানের পর ক্ষমতা হস্তান্তরই চূড়ান্ত দায়িত্ব নয়; নিজেদের হাতে নিয়ে দায়িত্বশীলভাবে রাষ্ট্রকে পুনর্গঠন করাও তাদের কর্তব্য। জনগণকে নিজেদের ক্ষমতা, অধিকার ও দায়িত্ব সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ সচেতন হতে হবে। রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিককে রাজনীতি-সচেতন, নেতৃত্ব নির্বাচনে সজাগ ও দায়িত্বশীল হতে হবে।
তবেই হয়তো এই হতভাগ্য রাষ্ট্রের ভাগ্য আকাশে সুবাতাস বইবে; নয়তো এই অন্ধকার চক্র চলবে শেষনিশ্বাস পর্যন্ত।
সাব্বির রহমান
শিক্ষার্থী, রাজনীতিবিজ্ঞান, ঢাকা কলেজ।