জুলাই যোদ্ধা রিকশাচালকের আকুতি, ‘স্ত্রীর জন্য একটি পা চাই’
Published: 9th, October 2025 GMT
পরিবারের অভাব ঘোচাতে ঢাকায় রিকশা চালাতেন শওকত মণ্ডল (৪৮)। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে শাহবাগ এলাকায় আহত শিক্ষার্থীদের হাসপাতালে আনা-নেওয়ার সময় তিনি গুলিবিদ্ধ হন। গত ঈদুল ফিতরের আগে অসুস্থ স্ত্রী আকলিমার ডান পায়ে লোহা বিঁধে পচন ধরলে হাঁটুর নিচ থেকে কেটে ফেলতে হয়। একমাত্র কন্যাসন্তানও মানসিকভাবে বিকারগ্রস্ত। আহত এই জুলাই যোদ্ধার আকুতি, ‘স্ত্রীর জন্য একটি পা চাই।’
শওকত মণ্ডল রাজবাড়ী সদর উপজেলার বরাট ইউনিয়নের কাঁচারাঁধা ভরাত গ্রামের বাসিন্দা। গ্রামের বাড়িতে জায়গাজমি না থাকায় রাজবাড়ী পৌরসভার লোকোশেড ছোট নূরপুর এলাকায় শ্বশুরবাড়িতে শাশুড়িকে নিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছেন।
গত সোমবার দুপুরে রাজবাড়ী জেলা প্রশাসকের কার্যালয় চত্বরের আম্রকাননে শওকত মণ্ডলের সঙ্গে দেখা হয়। অনেকটা আবেগপ্রবণ হয়ে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের কাছে নিজের কষ্টের কথা বলছিলেন তিনি।
শওকত মণ্ডল বলেন, প্রায় ১৫ বছর ঢাকার খিলগাঁও এলাকায় স্ত্রী-সন্তান নিয়ে থাকতেন, রিকশা চালাতেন। খরচ সামলাতে না পেরে ২০১৫ সালে স্ত্রী-সন্তানকে গ্রামে পাঠিয়ে দেন। গত বছর জুলাই আন্দোলনে শাহবাগ এলাকায় রিকশায় করে আহত শিক্ষার্থীদের হাসপাতালে আনা-নেওয়ার সময় তাঁর শরীরে আটটি গুলি লাগে। স্থানীয় লোকজন তাঁকে ঢাকা মেডিকেল কলেজে ভর্তি করেন। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে জুলাই যোদ্ধার কার্ড করে দেওয়া হয়েছে। সরকারিভাবে প্রথমে ১ লাখ টাকার চেক এবং পরে ২০ হাজার ও ১০ হাজার টাকা পেয়েছেন।
হাত-পায়ে গুলির চিহ্ন দেখিয়ে শওকত মণ্ডল বলেন, এখন ঠিকমতো রিকশা চালাতে পারেন না। সুযোগ পেলে পুরোনো লোহা-টিনের ব্যবসা করেন। গত রমজান মাসের প্রথম সপ্তাহে স্ত্রী আকলিমার ডান পায়ে লোহা বিঁধে ঘা হয়ে যায়। রাজবাড়ী সদর হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার দুই সপ্তাহ পর ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ট্রমা সেন্টারে পাঠানো হয়। পায়ে পচন ধরায় ডান পায়ের হাঁটুর নিচ থেকে কেটে ফেলতে হয়। প্রায় দুই মাস স্ত্রীর চিকিৎসা করতে গিয়ে ধারদেনা করে চার লাখ টাকা খরচ করেন। গ্রামের বাড়ি জায়গা না থাকায় আশ্রয় নেন শ্বশুরবাড়িতে।
রাজবাড়ীতে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া মেরাজুল মাজিদ বলেন, শওকত মণ্ডল একজন জুলাই যোদ্ধা। এখন অনেকটাই অসুস্থ। তাঁর স্ত্রী একটি পা হারিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছেন। স্ত্রীর চলার জন্য একটি কৃত্রিম পা সংযোজন করতে পারলে অন্তত রান্নার কাজ সামলাতে পারতেন।
শওকত মণ্ডলের কথা শুনে প্রায় দুই কিলোমিটার দূরে লোকোশেড ছোট নূরপুরে তাঁর শ্বশুরবাড়িতে যান এ প্রতিবেদক। রাস্তা থেকে কিছুটা দূরে গিয়ে মাঠে একটি চৌচালা টিনশেড ঘর দেখা যায়। উঠানের পাশে জরাজীর্ণ ঘরে রান্নার চেষ্টা করছেন স্ত্রী তাঁর আকলিমা। কোনোভাবে তাঁকে কিছুটা গুছিয়ে দুই হাতে ক্রাচে ভর দিয়ে স্ত্রীকে সামনে নিয়ে আসেন শওকত মণ্ডল। তাঁকে সহযোগিতা করছেন বৃদ্ধা শাশুড়ি।
আবেগপ্রবণ হয়ে আকলিমা বলেন, বিয়ের প্রায় ৯ বছর পর একটি মেয়েসন্তানের জন্ম হয়। ৯-১০ বছর বয়সে মেয়েটির একদিন জ্বর হলে খুব অসুস্থ হয়ে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। প্রায় চার বছর আগে মেয়েটিকে বিয়ে দিয়েছেন। এখন মেয়ের বয়স ২১ বছর। তাঁকেও মাঝেমধ্যে সামাল দিতে হয়। কিন্তু তিনি নিজেই আর চলতে পারছেন না।
আকলিমা প্রথম আলোকে বলেন, ‘পায়ে ঘা হয়ে পচন ধরায় ক্যানসারের ঝুঁকি থাকায় ডাক্তার হাঁটুর নিচ থেকে কেটে ফেলেন। নিজের শরীরে ডায়াবেটিসসহ নানা রোগ বাসা বেঁধেছে। এখন রান্নাবান্নাও করতে পারি না। বাবা মারা গেছেন অনেক আগে। বৃদ্ধ মা মাঝেমধ্যে কোনোমতে রান্না করে দেয়। নিজেই চলতে পারছি না; স্বামী ও বৃদ্ধ মাকে দেখব কীভাবে? এখন চলার মতো একটি পা লাগানোর ব্যবস্থা হলে অন্তত তাঁদের রান্না করে খাওয়াতে পারতাম।’
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: সন ত ন এল ক য় করছ ন আকল ম
এছাড়াও পড়ুন:
জুলাই যোদ্ধা রিকশাচালকের আকুতি, ‘স্ত্রীর জন্য একটি পা চাই’
পরিবারের অভাব ঘোচাতে ঢাকায় রিকশা চালাতেন শওকত মণ্ডল (৪৮)। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে শাহবাগ এলাকায় আহত শিক্ষার্থীদের হাসপাতালে আনা-নেওয়ার সময় তিনি গুলিবিদ্ধ হন। গত ঈদুল ফিতরের আগে অসুস্থ স্ত্রী আকলিমার ডান পায়ে লোহা বিঁধে পচন ধরলে হাঁটুর নিচ থেকে কেটে ফেলতে হয়। একমাত্র কন্যাসন্তানও মানসিকভাবে বিকারগ্রস্ত। আহত এই জুলাই যোদ্ধার আকুতি, ‘স্ত্রীর জন্য একটি পা চাই।’
শওকত মণ্ডল রাজবাড়ী সদর উপজেলার বরাট ইউনিয়নের কাঁচারাঁধা ভরাত গ্রামের বাসিন্দা। গ্রামের বাড়িতে জায়গাজমি না থাকায় রাজবাড়ী পৌরসভার লোকোশেড ছোট নূরপুর এলাকায় শ্বশুরবাড়িতে শাশুড়িকে নিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছেন।
গত সোমবার দুপুরে রাজবাড়ী জেলা প্রশাসকের কার্যালয় চত্বরের আম্রকাননে শওকত মণ্ডলের সঙ্গে দেখা হয়। অনেকটা আবেগপ্রবণ হয়ে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের কাছে নিজের কষ্টের কথা বলছিলেন তিনি।
শওকত মণ্ডল বলেন, প্রায় ১৫ বছর ঢাকার খিলগাঁও এলাকায় স্ত্রী-সন্তান নিয়ে থাকতেন, রিকশা চালাতেন। খরচ সামলাতে না পেরে ২০১৫ সালে স্ত্রী-সন্তানকে গ্রামে পাঠিয়ে দেন। গত বছর জুলাই আন্দোলনে শাহবাগ এলাকায় রিকশায় করে আহত শিক্ষার্থীদের হাসপাতালে আনা-নেওয়ার সময় তাঁর শরীরে আটটি গুলি লাগে। স্থানীয় লোকজন তাঁকে ঢাকা মেডিকেল কলেজে ভর্তি করেন। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে জুলাই যোদ্ধার কার্ড করে দেওয়া হয়েছে। সরকারিভাবে প্রথমে ১ লাখ টাকার চেক এবং পরে ২০ হাজার ও ১০ হাজার টাকা পেয়েছেন।
হাত-পায়ে গুলির চিহ্ন দেখিয়ে শওকত মণ্ডল বলেন, এখন ঠিকমতো রিকশা চালাতে পারেন না। সুযোগ পেলে পুরোনো লোহা-টিনের ব্যবসা করেন। গত রমজান মাসের প্রথম সপ্তাহে স্ত্রী আকলিমার ডান পায়ে লোহা বিঁধে ঘা হয়ে যায়। রাজবাড়ী সদর হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার দুই সপ্তাহ পর ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ট্রমা সেন্টারে পাঠানো হয়। পায়ে পচন ধরায় ডান পায়ের হাঁটুর নিচ থেকে কেটে ফেলতে হয়। প্রায় দুই মাস স্ত্রীর চিকিৎসা করতে গিয়ে ধারদেনা করে চার লাখ টাকা খরচ করেন। গ্রামের বাড়ি জায়গা না থাকায় আশ্রয় নেন শ্বশুরবাড়িতে।
রাজবাড়ীতে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া মেরাজুল মাজিদ বলেন, শওকত মণ্ডল একজন জুলাই যোদ্ধা। এখন অনেকটাই অসুস্থ। তাঁর স্ত্রী একটি পা হারিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছেন। স্ত্রীর চলার জন্য একটি কৃত্রিম পা সংযোজন করতে পারলে অন্তত রান্নার কাজ সামলাতে পারতেন।
শওকত মণ্ডলের কথা শুনে প্রায় দুই কিলোমিটার দূরে লোকোশেড ছোট নূরপুরে তাঁর শ্বশুরবাড়িতে যান এ প্রতিবেদক। রাস্তা থেকে কিছুটা দূরে গিয়ে মাঠে একটি চৌচালা টিনশেড ঘর দেখা যায়। উঠানের পাশে জরাজীর্ণ ঘরে রান্নার চেষ্টা করছেন স্ত্রী তাঁর আকলিমা। কোনোভাবে তাঁকে কিছুটা গুছিয়ে দুই হাতে ক্রাচে ভর দিয়ে স্ত্রীকে সামনে নিয়ে আসেন শওকত মণ্ডল। তাঁকে সহযোগিতা করছেন বৃদ্ধা শাশুড়ি।
আবেগপ্রবণ হয়ে আকলিমা বলেন, বিয়ের প্রায় ৯ বছর পর একটি মেয়েসন্তানের জন্ম হয়। ৯-১০ বছর বয়সে মেয়েটির একদিন জ্বর হলে খুব অসুস্থ হয়ে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। প্রায় চার বছর আগে মেয়েটিকে বিয়ে দিয়েছেন। এখন মেয়ের বয়স ২১ বছর। তাঁকেও মাঝেমধ্যে সামাল দিতে হয়। কিন্তু তিনি নিজেই আর চলতে পারছেন না।
আকলিমা প্রথম আলোকে বলেন, ‘পায়ে ঘা হয়ে পচন ধরায় ক্যানসারের ঝুঁকি থাকায় ডাক্তার হাঁটুর নিচ থেকে কেটে ফেলেন। নিজের শরীরে ডায়াবেটিসসহ নানা রোগ বাসা বেঁধেছে। এখন রান্নাবান্নাও করতে পারি না। বাবা মারা গেছেন অনেক আগে। বৃদ্ধ মা মাঝেমধ্যে কোনোমতে রান্না করে দেয়। নিজেই চলতে পারছি না; স্বামী ও বৃদ্ধ মাকে দেখব কীভাবে? এখন চলার মতো একটি পা লাগানোর ব্যবস্থা হলে অন্তত তাঁদের রান্না করে খাওয়াতে পারতাম।’