চিকিৎসার খরচ জোগাতে হিমশিম খাচ্ছেন রোগীরা
Published: 9th, October 2025 GMT
গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জে অ্যানথ্রাক্সের উপসর্গ নিয়ে অসুস্থ রোগীরা চিকিৎসার খরচ জোগাতে হিমশিম খাচ্ছেন। তাঁরা সরকারি হাসপাতালে কাঙ্ক্ষিত সেবা না পেয়ে বাধ্য হয়ে বেসরকারি হাসপাতালের চর্মরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিয়ে ওষুধ সেবন করছেন। অনেকে ধারদেনা করে ওষুধ কিনছেন।
রোগীরা বলছেন, অ্যানথ্রাক্সের উপসর্গ দেখা দেওয়ার পরই তাঁরা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গেলেও তাঁদের ভর্তি নেওয়া হয়নি। দূর থেকে দেখে ব্যবস্থাপত্র দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়। কোনো ওষুধও দেওয়া হয়নি। ব্যক্তি উদ্যোগে তাঁরা ওষুধ কিনে বাড়িতেই চিকিৎসা নিচ্ছেন।
গত ২৭ আগস্ট সুন্দরগঞ্জের বেলকা ইউনিয়নের কিশামত সদর গ্রামে অ্যানথ্রাক্স আক্রান্ত একটি গরু জবাই করা হয়। গরু কাটাকাটিতে অংশ নেওয়া ১১ জনের শরীরে দুই দিন পর ফোসকা পড়ে। অ্যানথ্রাক্সের নানা উপসর্গ দেখা যায়। তাঁরা হলেন কিশামত সদর গ্রামের মোজাফফর আলী (৫০), মোজাহার আলী (৬০), শফিউল ইসলাম (৩৫), গোলজার মিয়া (২৫), খতিব মিয়া (৩৫), হাসান আলী (১৫), নুরুন্নবী মিয়া (১৬), ফরিদুল মিয়া (২০), মারুফ মিয়া (১৬), কুদ্দুস মিয়া (১৬) ও মিঠু মিয়া (১৬)। তাঁদের মধ্যে মোজাফফর আলী বাঁ চোখে ১০ দিন ধরে দেখছেন না বলে জানান।
ওই ঘটনার কয়েক দিন পর পাশের পশ্চিম বেলকা গ্রামের গৃহবধূ রোজিনা বেগম (৪৫) একটি অসুস্থ ছাগল জবাই করে মাংস কাটাকাটি করেন। গত ৪ সেপ্টেম্বর অ্যানথ্রাক্সের উপসর্গ নিয়ে তিনি রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হন। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান।
আরও পড়ুনঅ্যানথ্রাক্স আক্রান্ত গরুর মাংস কাটার সঙ্গে যুক্ত আরও ৭ জনের উপসর্গ শনাক্ত০৪ অক্টোবর ২০২৫তবে ওই নারী অ্যানথ্রাক্সে আক্রান্ত ছিলেন না বলে দাবি করেন সুন্দরগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা দিবাকর বসাক। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর শরীরে অ্যানথ্রাক্সের উপসর্গ ছিল। খুব খারাপ অবস্থায় তাঁকে হাসপাতালে আনা হয়। হৃদ্রোগ ও ফুসফুসে সমস্যাসহ অন্য জটিলতা ছিল। তাঁর রক্তচাপ কমে গিয়েছিল এবং শ্বাসকষ্ট হচ্ছিল। প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দিয়ে তাঁকে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান।
বুধবার সকালে কিশামত সদর গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, কৃষক মোজাফফর আলী চোখ ফোলা ও বাঁ হাতে ফোসকা নিয়ে বাড়ির উঠোনে বসে আছেন। তিনি গরুর মাংস কাটাকাটিতে মূল ভূমিকায় ছিলেন। গরুর রক্তের ছিটা তাঁর চোখে পড়েছিল। আক্রান্ত অন্যদের কারও এক হাতে, কারও দুই হাতেই ফোসকা পড়েছে। অনেকে হাতে ফোসকা নিয়ে সাংসারিক কাজ করছেন।
আরও পড়ুনঅ্যানথ্রাক্স উপসর্গের রোগীদের চিকিৎসা নিয়ে উদ্বিগ্ন স্বজনেরা০৭ অক্টোবর ২০২৫মোজাফফর আলী প্রথম আলোকে বলেন, অসুস্থ হওয়ার পর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গিয়ে ভর্তি হতে চাইলে চিকিৎসক ওষুধ লিখে বিদায় করে দেন। বাড়িতে ফিরে দুই দিন ওষুধ খেলেও ফোসকা ভালো হয়নি। পরে গত শুক্রবার রংপুর থেকে গাইবান্ধায় আসা এক চর্মরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে যান। তাঁর দেওয়া ব্যবস্থাপত্র অনুযায়ী ওষুধ খাচ্ছেন। ১০ দিন ধরে বাঁ চোখে দেখতে পাচ্ছেন না। তিনি বলেন, ‘আমার চোখের জন্য উন্নত চিকিৎসা দরকার। কিন্তু সেই টাকা কোথায় পাব? এখন পর্যন্ত চিকিৎসার পেছনে ১০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। এর মধ্যে ৫ হাজার টাকা ধার করা। চিকিৎসক দুই মাস ওষুধ খেতে বলেছেন। প্রতিদিন ওষুধ খেতে হয়। ওষুধের অনেক দাম।’
অ্যানথ্রাক্সে আক্রান্ত শফিউল ইসলাম বলেন, ‘দুই হাতের ফোসকা এখনো ভালো হয়নি। এ পর্যন্ত সাড়ে আট হাজার টাকা খরচ হয়েছে। এর মধ্যে চড়া সুদে পাঁচ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছি। সেই টাকা পরিশোধ করব নাকি ওষুধ কিনব, তা নিয়ে চিন্তায় আছি। দেড় বিঘা জমি বর্গা চাষ করে কোনোমতে সংসার চলে। মাঝেমধ্যে অন্য জেলায় গিয়ে রিকশা চালাই। এখন অসুস্থ হয়ে সেটাও পারছি না। খুব বিপদে আছি।’
আরও পড়ুনগাইবান্ধায় অ্যানথ্রাক্স রোগের উপসর্গ নিয়ে নারীর মৃত্যু০৫ অক্টোবর ২০২৫গোলজার মিয়া নামের আরেক ব্যক্তি বলেন, ‘দিনমজুরের কাজ করে সংসার চলে। এ পর্যন্ত দেনা করে ৯ হাজার চিকিৎসার পেছনে খরচ করেছি। প্রতিদিন ওষুধ কিনতে হচ্ছে। একদিকে বাজার খরচ, আরেক দিকে ওষুধ কেনা—কোনটা আগে করব চিন্তা করে পারছি না।’
গরু জবাইয়ে অংশ নেওয়া নুরুন্নবীর মা নুরনাহার বেগম (৫৬) বলেন, ‘ছেলের ডান হাতে ফোসকা পড়েছে। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ভর্তি করতে চেয়েছিলাম। চিকিৎসকেরা ভর্তি নেননি। চিকিৎসক দূরে থেকে ওষুধ লিখে দেন। পরে গাইবান্ধায় গিয়ে চর্মরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শে চিকিৎসা চলছে। ছেলে অনেকটা উপকৃত হয়েছে।’
আরও পড়ুনঅ্যানথ্রাক্স কী, কীভাবে ছড়ায়০৪ অক্টোবর ২০২৫এ বিষয়ে স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা দিবাকর বসাক বলেন, অ্যানথ্রাক্সের উপসর্গ নিয়ে যাঁরা হাসপাতালে এসেছিলেন, তাঁদের মধ্যে কেউ মারাত্মকভাবে আক্রান্ত ছিলেন না। তাই ভর্তি রাখার প্রয়োজন হয়নি।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: র উপসর গ ন য় চ ক ৎসক উপজ ল
এছাড়াও পড়ুন:
অ্যানথ্রাক্স নিয়ে কিছুটা চিন্তিত স্বাস্থ্য বিভাগ
নতুন এলাকায় অ্যানথ্রাক্স শনাক্ত হওয়ায় কিছুটা চিন্তায় পড়েছে স্বাস্থ্য বিভাগ। কেন রংপুরে বা গাইবান্ধায় অ্যানথ্রাক্স ছড়াল, তা অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর)। প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে উপদ্রুত এলাকা ও এর আশপাশ এলাকার মানুষকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার অনুরোধ জানানো হয়েছে।
সেপ্টেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে উত্তরের জেলা রংপুরের পীরগাছা উপজেলায় কয়েকজন মানুষের শরীরে অ্যানথ্রাক্সের উপসর্গ দেখা দেয়। এরপর কয়েকজন অসুস্থ মানুষের নমুনা পরীক্ষায় অ্যানথ্রাক্স শনাক্ত করে আইইডিসিআর। আইইডিসিআর বলছে, রংপুরে এই প্রথম অ্যানথ্রাক্স শনাক্ত হলো।
কেন নতুন জায়গায় (রংপুর) অ্যানথ্রাক্স দেখা দিল, আমরা তা বোঝার চেষ্টা করছি। আমরা নজরদারিও বাড়াচ্ছি। ওই সব এলাকায় গবাদিপশু কোথা থেকে আসে, তা–ও জানার চেষ্টা আমরা করব।অধ্যাপক তাহমিনা শিরীন, আইইডিসিআরের পরিচালকগতকাল সোমবার সকালে সর্বশেষ অ্যানথ্রাক্স পরিস্থিতি পর্যালোচনা ও করণীয় বিষয়ে আইইডিসিআরে একটি সভা হয়। সভায় আইইডিসিআর ছাড়াও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বিভিন্ন শাখার কর্মকর্তা, প্রাণিসম্পদ বিভাগের কর্মকর্তা ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা উপস্থিত ছিলেন। ওই সভায় রংপুরে অ্যানথ্রাক্সের জীবাণু কীভাবে ছড়াল, তা খতিয়ে দেখার সিদ্ধান্ত হয়।
সভা শেষে নিজ কার্যালয়ে আইইডিসিআরের পরিচালক অধ্যাপক তাহমিনা শিরীন প্রথম আলোকে বলেন, ‘কেন নতুন জায়গায় (রংপুর) অ্যানথ্রাক্স দেখা দিল, আমরা তা বোঝার চেষ্টা করছি। আমরা নজরদারিও বাড়াচ্ছি। ওই সব এলাকায় গবাদিপশু কোথা থেকে আসে, তা–ও জানার চেষ্টা আমরা করব।’
আইইডিসিআর সূত্রে জানা গেছে, দেশে অ্যানথ্রাক্স আক্রান্ত মানুষ সবচেয়ে বেশি শনাক্ত হয়েছে মেহেরপুরের গাংনী উপজেলায়। এর আগে বিভিন্ন সময়ে ১৪টি জেলায় অ্যানথ্রাক্স শনাক্ত হয়েছে। এই তালিকায় আছে মেহেরপুর, সিরাজগঞ্জ, নাটোর, চট্টগ্রাম, কুষ্টিয়া, লালমনিরহাট, লক্ষ্মীপুর, মানিকগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, পাবনা, রাজশাহী, সাতক্ষীরা, টাঙ্গাইল ও গাজীপুর।
আরও পড়ুনঅ্যানথ্রাক্স কী, কীভাবে ছড়ায়০৪ অক্টোবর ২০২৫জনস্বাস্থ্যবিদ অধ্যাপক মাহমুদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, অ্যানথ্রাক্সের জীবাণু মাটিতে ১০০ বছরের মতো টিকে থাকতে পারে। কচি বা ছোট ঘাস খাওয়ার সময় গরু, ছাগল, মহিষের মুখে মাটিও চলে যায়, সঙ্গে অ্যানথ্রাক্সের জীবাণু। এরপর ওই পশু অ্যানথ্রাক্সে আক্রান্ত হয়। আক্রান্ত প্রাণীর মাংস, রক্ত, হাড় বা পশমের সংস্পর্শে এলে মানুষের অ্যানথ্রাক্সের ঝুঁকি দেখা দেয়।
এ বছর রংপুরের পীরগাছা, মিঠাপুকুর ও কাউনিয়া উপজেলায় অন্তত ৫০ জনের অ্যানথ্রাক্সের উপসর্গ দেখা দিয়েছে। গাইবান্ধা জেলার সুন্দরগঞ্জ উপজেলায় অন্তত ১১ জনের অ্যানথ্রাক্সের উপসর্গ দেখা দিয়েছে। এর মধ্যে এক নারীর মৃত্যু হয়েছে। এ ব্যাপারে আইইডিসিআরের পরিচালক প্রথম আলোকে বলেন, ‘ওই নারীর প্রাণীর মাংসের সংস্পর্শে আসার ইতিহাস ছিল। তাঁর শরীরে ঘায়ের চিহ্নও ছিল। তিনি অন্য রোগে ভুগছিলেন। তাঁর মৃত্যু হয়েছে অন্য রোগে, অ্যানথ্রাক্সে নয়।’
অ্যানথ্রাক্সের জীবাণু মাটিতে ১০০ বছরের মতো টিকে থাকতে পারে। কচি বা ছোট ঘাস খাওয়ার সময় গরু, ছাগল, মহিষের মুখে মাটিও চলে যায়, সঙ্গে অ্যানথ্রাক্সের জীবাণু। এরপর ওই পশু অ্যানথ্রাক্সে আক্রান্ত হয়। আক্রান্ত প্রাণীর মাংস, রক্ত, হাড় বা পশমের সংস্পর্শে এলে মানুষের অ্যানথ্রাক্সের ঝুঁকি দেখা দেয়।জনস্বাস্থ্যবিদ অধ্যাপক মাহমুদুর রহমান সতর্কতা ও করণীয়অ্যানথ্রাক্সে আক্রান্ত প্রাণীর জ্বর ও শ্বাসকষ্ট দেখা দেয়, শরীর কাঁপতে থাকে। প্রাণীর শরীর থেকে লোম খসে পড়তে থাকে। দ্রুত চিকিৎসা করানো না হলে আক্রান্ত প্রাণী ২ থেকে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে মারা যায়। মৃত প্রাণীর পেট দ্রুত ফেঁপে ওঠে। মৃত প্রাণীর নাক, মুখ, কান, মলদ্বার দিয়ে আলকাতরার মতো কালো রক্ত বের হয়।
এসব লক্ষণ দেখা দিলে দ্রুত প্রাণিসম্পদ বিভাগে যোগাযোগ করার পরামর্শ দিয়েছে সরকার। আক্রান্ত প্রাণীকে অন্য প্রাণী থেকে আলাদা করতে হবে। আক্রান্ত প্রাণী জবাই যাবে না বা তার মাংস খাওয়া যাবে না।
অন্যদিকে মানুষের ত্বক কেটে গেলে বা ফেটে গেলে সেই ক্ষতস্থানে অ্যানথ্রাক্সের জীবাণু ঢুকলে ত্বকে চুলকানি হয়, ফোসকা পড়ে এবং ঘা দ্রুত কালো আকার ধারণ করে। এর সঙ্গে মাথাব্যথা, জ্বর, শরীর ব্যথা ও বমির ভাব থাকলে দ্রুত হাসপাতালে যেতে হবে বা চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
আরও পড়ুনদেশে আবার অ্যানথ্রাক্স, সুস্থ থাকতে যা জানা জরুরি০১ অক্টোবর ২০২৫