জাতীয় ঐকমত্য কমিশন যখন দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদীয় ব্যবস্থা প্রবর্তনের সুপারিশ করতে যাচ্ছে, তখন তা বাদ দেওয়ার পরামর্শ এল সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) কাছ থেকে।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশের এককক্ষ ও দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদীয় ব্যবস্থা ও সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের সংসদীয় জবাবদিহির পদ্ধতি বিশ্লেষণ করে এই পরামর্শ দিয়েছে বেসরকারি গবেষণা সংস্থাটি। তারা মনে করছে, বর্তমান ব্যবস্থায় দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদীয় কাঠামো চালু করলেও জবাবদিহি নিশ্চিত করা যাবে না।

আজ বৃহস্পতিবার ঢাকার ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে সিপিডি ‘প্রস্তাবিত উচ্চকক্ষ কি জাতীয় সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের জবাবদিহি নিশ্চিত করতে পারবে’ শিরোনামে এক জাতীয় সংলাপ আয়োজন করে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের অংশগ্রহণে সেই অনুষ্ঠানে সংসদ দ্বিকক্ষ করার প্রস্তাব বাদ দেওয়ার সুপারিশ করা হয়।

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত বছর আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গঠিত অন্তর্বর্তী সরকার সংবিধানসহ নানা ক্ষেত্রে ব্যাপক সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে। সংস্কারে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতৈক্য প্রতিষ্ঠায় গঠন করা হয় জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। সেই কমিশন ধারাবাহিক বৈঠকের পর গতকাল বুধবার জানায়, তারা দু-এক দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দেবে। এই প্রতিবেদনে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদের কথা থাকছে। কারণ, দলগুলো এতে একমত হয়েছে বলে আগেই জানানো হয়।

কমিশনের প্রতিবেদন দেওয়ার ঠিক আগে বিদ্যমান সংসদীয় ব্যবস্থার দুর্বলতা, সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের সংসদে জবাবদিহির পদ্ধতি, সংসদীয় ব্যবস্থার সংস্কার নিয়ে বৈশ্বিক উদাহরণগুলো বিশ্লেষণ করে বৃহস্পতিবারের সংলাপে একটি গবেষণা প্রতিবেদন উত্থাপন করেন সিপিডির গবেষণা পরিচালক গোলাম মোয়াজ্জেম ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক নিজাম আহমদ।

গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ২০২৪ সালে যখন বাংলাদেশে রাজনৈতিক উত্তরণ ঘটেছে, তখন যে চাহিদাটা ছিল জনগণের কাছ থেকে, সেটা হলো সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের জবাবদিহি যেন নিশ্চিত হয়। তার মাধ্যমে ‘চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স’—এ দুটো হবে।

দেশে গত ৫০ বছরে ওয়েস্ট মিনস্টার সিস্টেম ঠিকভাবে কাজ করেনি মন্তব্য করে গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ‘ওয়েস্ট মিনস্টার সিস্টেম আসলে সঠিকভাবে এটি ফাংশন করে না।’

উদাহরণ দিয়ে গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ‘বিভিন্ন সময় আমাদের এখানে ছোট ছোট সংস্কার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। যেমন কমিটি ফর্ম করা হয়েছে। কমিটিগুলোর দায়িত্ব বিরোধী দলকে দেওয়া হয়েছে। এখানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার আনা হয়েছে। কিন্তু তারপরও দেখা গেছে যে কাজের কাজ হয়নি।’

বাংলাদেশের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদের ধারণার যৌক্তিকতা প্রশ্নবিদ্ধ মন্তব্য করে গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ১৮৬২ সালের বেঙ্গল লেজিসলেটিভ কাউন্সিল থেকে শুরু করে ১৯৭২ সালের সংবিধান পর্যন্ত এই ভূখণ্ড একটি ভাষা ও সংস্কৃতিগতভাবে একক ও সমজাতীয় সমাজ হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। তাই ঐতিহাসিকভাবে একক সংসদই এখানে প্রাসঙ্গিক ছিল।

বাংলাদেশে সংসদের কার্যক্রম বিশ্লেষণ করে গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, এটি আইন প্রণয়নের আসল ক্ষেত্র না হয়ে কেবল আইন পাসের স্থান হয়ে দাঁড়িয়েছে। আবার সংসদে বেসরকারি বিল পাস করার সুযোগ থাকলেও সেটি রাজনৈতিক বাধা, দলীয় চাপ ও জটিল সংসদীয় প্রক্রিয়ার কারণে করা যায় না। এ অবস্থার পেছনে রাজনৈতিক বাধা, দলীয় চাপ এবং জটিল সংসদীয় প্রক্রিয়া দায়ী। এমনকি যখন বিল সংসদে যায়, কমিটিতে তা রেফার হলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সংশোধন সীমিত থাকে শব্দ বা অনুচ্ছেদ বদলের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। গুণগত আলোচনা অনুপস্থিত থাকে।

তদারকির ক্ষেত্রেও দুর্বলতাগুলো চিহ্নিত করে গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, সংসদীয় তদারকি হওয়ার কথা তিনটি স্তরে—আইন প্রণয়ন, বাজেট ও সাধারণ তদারকি। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর প্রশ্নোত্তর পর্ব প্রায়ই আনুষ্ঠানিকতা মাত্র; সেখানে নির্বাচিত প্রশ্নগুলোই আসে, সমালোচনামূলক আলোচনা নয়। সংসদের ৫০টির বেশি কমিটি থাকলেও নিয়মিত বৈঠক হয় না; পাঁচ বছরে প্রয়োজনীয় ৩ হাজার বৈঠকের বিপরীতে বছরে গড়ে ১২টি বৈঠক হয়। ফলে কার্যকর জবাবদিহি গড়ে ওঠে না।

এই দুর্বল কাঠামোর মধ্যে দ্বিকক্ষের মতো নতুন কোনো সংসদীয় কাঠামো চালু করলেও জবাবদিহি নিশ্চিত হবে না বলে মনে করেন গোলাম মোয়াজ্জেম।

তবে সংলাপে উচ্চকক্ষের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে বক্তব্য দেন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সদস্য ও নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান বদিউল আলম মজুমদার। তিনি বলেন, ২০০৮ সালের নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতার সুযোগ নিয়ে শেখ হাসিনা ‘দানবে’ পরিণত হয়েছিলেন। ২০০৮ সালের নির্বাচনে উচ্চকক্ষ থাকলে এবং আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব থাকলে বিএনপি কমপক্ষে ৯৩টি সংসদীয় আসন পেত। আওয়ামী লীগ পেত ১৪৪টির মতো। যে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করা হলো, উচ্চকক্ষ থাকলে সেটি পাস করা কঠিন হতো।

তবে গোলাম মোয়াজ্জেম আরও বলেন, ‘আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি বদলাতে হবে, না হলে কোনো পদ্ধতিই কাজ করবে না।’

সিপিডির ডিস্টিংগুইশড ফেলো রওনক জাহানের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত এই সংলাপে বিএনপি,এনসিপি ও গণসংহতি আন্দোলনের নেতারা অংশ নেন।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: গ ল ম ম য় জ জ ম বল ন র জন ত ক সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

ঐকমত্য কমিশনের বিরুদ্ধে আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগ নেই

জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বিরুদ্ধে কোনো আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগ নেই বলে দাবি করেছেন কমিশনের সাবেক সহসভাপতি এবং সদ্য নিয়োগ পাওয়া প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী অধ্যাপক আলী রীয়াজ। তিনি বলেছেন, ‘আর্থিক দুর্নীতির প্রশ্নটা আপনি (প্রশ্নকর্তা) তুলেছেন, সেটি তথ্যগতভাবে ভুল। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বিরুদ্ধে কোনো আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগ নেই। কোনো বিশেষ ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান যদি কোনো মিথ্যাচার করে থাকে, তার দায়িত্ব তাকেই নিতে হবে।’

বে অব বেঙ্গল কনভারসেশন সম্মেলনের একটি পর্বে বক্তব্য দেওয়ার পর সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে অধ্যাপক আলী রীয়াজ এ কথাগুলো বলেন। আজ রোববার রাজধানীর একটি হোটেলে এ সম্মেলনের আয়োজন করে সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজ (সিজিএস)।

জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বিরুদ্ধে আর্থিক অসংগতির বিষয়ে জানতে চাইলে আলী রীয়াজ বলেন, ‘জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের পক্ষ থেকে সুস্পষ্টভাবে টাকার হিসাব দেওয়া হয়েছে। সরকারের বরাদ্দকৃত সাত কোটি টাকার মধ্যে দুই কোটি টাকার কম খরচ করা হয়েছে এবং কীভাবে খরচ করা হয়েছে, সেটা চিফ অ্যাডভাইজারের (প্রধান উপদেষ্টা) অফিস থেকে এবং কমিশনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে।’

অভিযোগকে মিথ্যাচার উল্লেখ করে কমিশনের সাবেক এই সহসভাপতি বলেন, ‘আপনি যে মিথ্যাচারটা রিপিট (পুনরাবৃত্তি) করেছেন, সেটার জন্য আপনাকে আমি আরেকবার শুধু স্মরণ করিয়ে দেব, যেকোনো তথ্যের সর্বশেষ ভাষ্যটি লক্ষ করা খুব জরুরি। কেননা যে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান বা সংগঠন যাঁরা এই প্রশ্ন তুলেছিলেন, তাঁরা কিন্তু এই হিসাবের পরে আর কোনো কথা বলেননি।’

এ ছাড়া আলী রীয়াজের কাছে জানতে চাওয়া হয় জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর অভিযোগের বিষয়ে। জবাবে তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ কেন, এমন পাল্টা প্রশ্ন তুলে তিনি একে মতপ্রকাশের সুযোগ সৃষ্টি বলে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, ‘দেশটার খানিকটা হলো কথাবার্তা বলার, চর্চার একটা সুযোগ তৈরি হয়েছে। যেকোনো রকম কাজ করলে তাদের সমালোচিত হওয়াটাই স্বাভাবিক। ৩০টির বেশি রাজনৈতিক দলের মধ্যে আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়ে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন একটি জাতীয় সনদ তৈরি করতে পেরেছে। এবং সেগুলো বাস্তবায়নের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। আমরা করছি।’

জনগণের সমর্থনে ভবিষ্যতে বাংলাদেশে বিভিন্নভাবে কাঠামোগত এবং সাংবিধানিক সংস্কার সম্ভব হবে—এমন আশাবাদ জানিয়ে আলী রীয়াজ বলেন, ‘ফলে যদি কেউ মনে করেন যে সংস্কারের প্রশ্নটি ইতিমধ্যে মারা গেছে এবং যাঁরা অবিচ্যুয়ারি লিখতে চান, তাঁরা লিখতে পারেন। কারণ, অবিচ্যুয়ারি লেখার অভ্যাস তাঁদের আছে এবং অন্যরা অবিচ্যুয়ারি লিখতে পারেন।’

‘বাংলাদেশের একটা ঐতিহাসিক সুযোগ তৈরি হয়েছে’ এবং তা অব্যাহত থাকবে বলে মনে করেন অধ্যাপক আলী রীয়াজ। তিনি বলেন, ‘আমি জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের পক্ষ থেকে যখন জুলাই জাতীয় সনদ স্বাক্ষরিত হয়, সেই অনুষ্ঠানে সুস্পষ্টভাবে বলেছিলাম যে একটি দলিল দিয়ে আসলে সমস্ত রকম সংস্কার সম্ভব নয়। এটি সূচনা মাত্র এবং জাতীয় সনদের যে শিরোনাম করা হয়েছে, সেটা হচ্ছে—ভবিষ্যতের পথরেখা। আশা করি, সেটা আপনাদের সবারই নজরে থাকবে।’

এর আগে সম্মেলনে অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, দক্ষিণ এশিয়ায় অনেক দেশেই ক্ষমতাসীনেরা নিজেদের ক্ষমতাকে সুসংহত করতে রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করেছে। কর্তৃত্ববাদীরা অর্থনৈতিক উন্নয়ন করলেও গণতন্ত্র ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে না পারায় বাংলাদেশে গণ-অভ্যুত্থান হয়েছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

অধ্যাপক আলী রীয়াজ মনে করেন, সরকারের মাধ্যমে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি হচ্ছে অথবা রাষ্ট্রগুলো দমনমূলক হয়ে উঠছে। তিনি বলেন, নজরদারির ক্ষমতা বৃদ্ধি করে সরকার সংকটকে টিকিয়ে রাখছে। আবার তার বিপরীতে প্রায়ই রাষ্ট্র নিজেও বহিরাগত শক্তির চাপে ভীষণভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে বলেও উল্লেখ করেন তিনি। এ ছাড়া তাঁর বক্তব্যে উঠে আসে সমসাময়িক বাংলাদেশ ও দক্ষিণ এশিয়াসহ বৈশ্বিক পরিস্থিতি।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • ইজমা: ইসলামি আইনের অন্যতম ‘দলিল’
  • জাতীয় নির্বাচন ও নারী: ইশতেহারের প্রতিশ্রুতি ও বাস্তবায়নে ফারাক কি ঘুচবে
  • গণভোটের ব্যালট পেপার হবে রঙিন
  • ঐকমত্য কমিশনের বিরুদ্ধে আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগ নেই