স্বপ্নের মতো শুরু। ১৩ মিনিটে  উল্লাসে মেতে ওঠার উপলক্ষ পেয়ে গেল বাংলাদেশ। ঢাকার জাতীয় স্টেডিয়ামে গ্যালারি ভরা দর্শকের কাছে ধরা দিল  দারুণ এক মুহূর্ত। হামজা চৌধুরীর দুর্দান্ত ফ্রিকিক গোলে প্রথমার্ধে এগিয়ে থেকে হংকংয়ের বিপক্ষে এশিয়ান কাপে বাছাইয়ে গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচের প্রথমার্ধ শেষ করার স্বপ্ন যখন দেখছিল বাংলাদেশ, ঠিক তখনই গোল খেয়ে বসেছে লালসবুজের দল। প্রথমার্ধ শেষ হয়েছে ১-১ সমতায়।

প্রথমার্ধের শেষ বাঁশি যখন বাজি বাজি করছে, তখনই গোল খেল বাংলাদেশ। কর্নার থেকে দ্বিতীয়বারের চেষ্টাতেও বল ক্লিয়ার করতে পারেনি বাংলাদেশ। প্রথমার্ধ শেষ হওয়ার ৩০ সেকেন্ড বাকি থাকতে ফাঁকায় বল পেয়ে আলতো টোকায় ১-১ করেন হংকংয়ে ব্রাজিলিয়ান বংশোদ্ভূত ফরোয়ার্ড এভারটন কামারগো।

এর আগে হামজার গোলটা ছিল দেখার মতো। হংকংয়ের লেফট ব্যাক যেখানে দাঁড়ান, ঠিক এর কাছাকাছি জায়গা থেকে ফ্রিকিক পায় বাংলাদেশ। হামজা বল বাঁক খাইয়ে জালে পাঠাতে চাইছিলেন। শটটাও হলো দুর্দান্ত। হংকংয়ে খেলোয়াড়েরা বল ক্লিয়ার করতে লাফিয়ে ওঠেন,  ফরোয়ার্ড মাত ওর মাথায় হালকা ছোঁয়া নিয়ে বলে চলে যায় জালে। বাংলাদেশের হয়ে ছোট্ট ক্যারিয়ারে হামজার এটি দ্বিতীয় গোল।

বাংলাদেশ প্রথম আক্রমণটা করেছে নবম মিনিটে। পরপরই রাকিবের ক্রস কর্নারের বিনিময়ে বল বাইরে পাঠান হংকংয়ের এক খেলোয়াড়। ১৩ মিনিটে আচমকা পাওয়া হামজার গোল বাংলাদেশকে উজ্জীবিত করে তুলেছে।

গত ১০ জুন জাতীয় স্টেডিয়ামেই সিঙ্গাপুরের বিপক্ষ হামজা রক্ষণে সহায়তার পাশাপাশি আক্রমণেও নেতৃত্ব দেন দলকে। সে ম্যাচে অনেকটা ওপরে দেখা গেছে তাঁকে। তবে আজকের ম্যাচের প্রথমার্ধে হামজা একটু রয়েসয়ে খেলছেন। আক্রমণে বল তৈরি করে দিয়ে খুব একটা উঠেছেন না তিনি, রক্ষণ যাতে প্রয়োজনীয় সহায়তা করতে পারেন। সেটি তিনি করেছেনও। প্রথমার্ধের শেষ দিকে হেডে বল ক্লিয়ার করে রুখে  দিয়েছেন হংকংয়ের আক্রমণ।

হংকং বেশ দ্রুতগতির ফুটবল খেলছে। ম্যাচের শুরু থেকেই প্রাধান্য তাদের হাতে। আক্রমণ গড়েছে বেশ কয়েকবার। সপ্তম মিনিটেই গোল পেতে পারত অতিথি দল। ফরোয়ার্ড মাত ওর প্লেসিং যায় পোস্টে বাতাস লাগিয়ে। আরেকটি আক্রমণ থেকে প্রথমার্ধে গোল পেতে পারত। কিন্তু বাধা হয়ে দাঁড়ান বাংলাদেশ গোলকিপার মিতুল মারমা। ৪০ মিনিটে ব্রাজিলিয়ান বংশোদ্ভূত ফরোয়ার্ড এভারটন কামাগোর প্লেসিং অল্পের জন্য চলে যায় বাইরে। বেঁচে গেছে বাংলাদেশ। তবে শেষ রক্ষা হয়নি।

২০২৭ এশিয়ান কাপের বাছাইয়ে আজ বাংলাদেশের গ্রুপের অন্য দুটি দল ভারত ও সিঙ্গাপুর মুখোমুখি হয়েছিল ভারতের মাটিতে। ম্যাচটি ১-১ গোলে ড্র হয়েছে। তিন ম্যাচে ভাতের দুই পয়েন্ট, সিঙ্গাপুরের পাঁচ। দুই ম্যাচে বাংলাদেশের এক, হংকংয়ের চার।


হংকংয়ের বিপক্ষে বাংলাদেশের একাদশে কোচ কাবরেরা রাখেননি কানাডা প্রবাসী শমিত সোম ও ইতালিপ্রবাসী ফাহামিদুল ইসলামকে। রাখা হয়নি নিয়মিত অধিনায়ক জামাল ভূঁইয়া, তপু বর্মণকেও। তপু পুরো ফিট না থাকায় বাদ পড়েছেন। এই ম্যাচে দলকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন সোহেল রানা সিনিয়র।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: প রথম র ধ

এছাড়াও পড়ুন:

আবুল হাসানের কবিতা: ঘনায়মান চিত্রাল্পনা

মাঝে মাঝে মনে হয়, কবিতায় মিলিত অক্ষরপুঞ্জের কোনো অর্থ নেই; অক্ষর দিয়ে মিলিত শব্দপ্রবাহ যতই প্রেমের, যতই রহস্য-রোমাঞ্চের অভিজ্ঞতা দিক, শব্দবিবাহের দাম্পত্য মধু যতই আলোড়িত করুক, শব্দপরকীয়ার নিষিদ্ধ সুখ যতই ভাসিয়ে দিক। তাহলে কোন অভিঘাতে কবি লিখে ফেলেন এই সব নিঃশব্দ চলিষ্ণু ধ্বনিশব্দবাক্যচরণধারা, যা স্থির থেকেও থাকে কলরবমুখর, নিয়ে যায় দূরত্বে। দূরগামী এই সব পুঞ্জের এত ক্ষমতা কেন! আবেগবিদ্ধ করে কে কবির দ্বারা লিখিয়ে নেয় এই সব চরণ! কে কবিকে সংযত করে প্রবাহিত শৃঙ্খলে! কে কবিকে সংহত করে গতি বিনির্মাণে! কে কবিকে নিবিষ্ট করে শব্দের পরিমিত ব্যবহারে! কে যে করে তা জানার উপায় নেই। কিন্তু ‘করে যে’ তা তো অবধারিত। তাই পেছনের সত্তার খোঁজে না গিয়ে প্রাপ্ত অস্তিত্বের ভেতরে বহমান নিষ্ঠুর রহস্যের দিকে যাই। সেখানে দেখি অনেক কিছু।

দুই

সেই যে প্রারম্ভিক যৌবনে হাতে উঠে এসেছিল কোনো এক কবির ভয়ার্ত নিঃসঙ্গতা, উঠে এসেছিল বিজন বিষণ্নতা, উঠে এসেছিল চিত্রার্পিত হাহাকার। আজও কোনো পতনাকাঙ্ক্ষা ছাড়াই বেজে চলেছে সেই সুর। মাঝে মাঝে সংশয়ী হয়ে উঠেছি। তবু কৈ ও মেঘের প্রেমের মতো আমার পতনগুলো প্রার্থনা হয়ে উঠেছে। কোন সে কবি! যার জন্য মিথ্যা হয়ে গেল পতনশীল রহস্যের অস্তিত্ব! নিজের ভেতরে বিরাজিত নিঃসঙ্গতা আবিষ্কৃত হলো! করল বিষণ্ন! ভরিয়ে দিল হাহাকারে! তাঁর শিল্পভাষ্যের সংক্রাম এভাবে আবিষ্কার করল আমাকে।

মনে পড়ে, কবিতায় যখন উন্মেষ ঘটছে, জীবন হয়ে উঠছে উন্মুলাকাঙ্ক্ষায় উন্মুখ, হয়ে উঠছে ব্যগ্র, ব্যাকুল, তেজি, বুঝে না বুঝে ভুলভ্রান্তির হোচটে টলটলায়মান, তখন লাল লাল চোখের দিকে তাকিয়ে কেউ একজন হাতে তুলে দিয়েছিল আবুল হাসান সমগ্র। যেন হাতে তুলে দিয়েছিল তুমুল আকাশ। যেন হাতে তুলে দিয়েছিল নিঃসঙ্গ প্রান্তরে হু হু করে বয়ে যাওয়া হাহাকার। ঠিক তখনই নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল নিঃসঙ্গতার যেমন মৃত্যু নেই, তেমনি মৃত্যু নেই রহস্যের। বিজন প্রান্তরে তখনই দেখা হয়ে যায় বিষণ্নতার সাথে। দেখা হয়ে যায় চিত্রার্পিত হাহাকারের সঙ্গে। তখন কেবলই ‘রাজা যায় রাজা আসে’। তখন কেবলই ‘যে তুমি হরণ করো’। তখন কেবলই ‘পৃথক পালঙ্ক।’

নীল পাখিটিই তখন আবুল হাসান। আমাদের নাগরিক চেতনা, স্বদেশচিন্তা, ব্যক্তিগত বিষয়-আশয় আর প্রেমের যুগপৎ রসায়নে ব্যক্ত বিপর্যস্ত উপকূল। ব্যাপ্ত জনপদের হাহাকার।

আজ এত দিনে ঝরে ঝরে গেছে কত কত রোদ! রোদ থেকে সরে গেছে না-দেখা আলোর রং। পথে পথে পা ফেলে জীবন চলে গেছে ইচ্ছা-অনিচ্ছার প্রান্তরে। কিন্তু বড় বিস্ময় হয়ে আজও বজে সেই সুর। এখনো পুরোনো হলো না তাঁর কুহেলি মাঠ। এখনো চোখ বন্ধ করলেই দেখা যায় তাঁর কল্পিত প্রান্তরের দেবদূত। আবার দিকে দিকে ঝরে ঝরে যাচ্ছে প্রিয়তম পাতাগুলি—

‘প্রিয়তম পাতাগুলি ঝরে যাবে, কেউ মনেও রাখবে না,
আমি কে ছিলাম, কী ছিলাম
কেন আমি মানুষ না হয়ে খুব রাগ করে হয়েছি সন্যাসী
হয়েছি বিজন ব্যথা, হয়েছি আগুন।’

এই যে বিচ্ছিন্নতাবোধ, এই যে সমাচ্ছন্ন নিঃসঙ্গতা, এই যে ব্যর্থতাবোধ থেকে উঠে আসা কথিত আত্মবিমুগ্ধতা—এগুলো যেন বরাবর কাতর করে চলেছে। ব্যক্তির ভেতরে আবির্ভাব ঘটিয়েছে অন্য ব্যক্তির। যে ব্যক্তির আর্ত অন্তর্লোকে আলো ফেলতে চেয়েছে, চেয়েছে নিঃসঙ্গতাকে শিল্প করতে। চেয়েছে যার কাছে, সে আবুল হাসান, ‘সে এক পাথর’। কিন্তু সেখানে কেবলই ‘লাবণ্য ধরে’। উজ্জ্বলতা ধরে মায়াবী করুণ। বহুবার ভেবেছি। এটা কি সেই পাথর, ‘পৃথিবীর তিনভাগ জলের সমান কান্নাভেজা চোখ’ নিয়ে দাঁড়ানো প্রথম যৌবনের ভোর, নাকি স্বল্প বৃষ্টিতে ভেজা বিকেলের চোখ!

ইট–পাথরের এই নগরে থাকতে হয় বহুতল ভবনে। জানালার ওপাশে বিস্ময়কর সব দালান। একটুখানি খোলা আকাশ। প্রতি ভোরবেলা যখন শিশাস্নিগ্ধ বাতাস ঢুকে পড়ে আধুনিক আততায়ীর মতো, ঘুম ও ঘামের ঘনত্বে তখন আমাদের ভোর হয় না। অজান্তে বন্ধ করে ফেলি আমরা কাচের জানালা। পৃথিবী আলোকিত হয়। আলো এসে আঘাত করে। কিন্তু নাগরিক ক্লান্তিকে পরাস্ত করতে পারে না ওই আলো। একসময় কাচের জানালায় ঠকঠক ঠক। আচমকা ঘুম থেকে জেগে দেখি, মাথার কাছেই এক কালো কাক ঠোঁট দিয়ে জানালার কাচে ঠোকর দিচ্ছে। ধড়ফড় করে উঠে জানালা খুলতেই পাখিটি চলে যায়, একটু দূরে, আপাত চঞ্চলতায়। আমরা দেখি কোথায় যেন এক আলোছায়ার খেলা। কাক উড়ে গিয়ে অন্য কিছুতে বসে। তারপর আস্তে আস্তে চলে যায় দূরে। তার অপস্রিয়মাণ দৃশ্যের দিকে তাকিয়ে মনে হতে থাকে পাখিটির রং আসলে নীল, কালো নয়। মনে হয়, জীবনের যাপিত গরল পান করে করে সে হয়ে উঠেছে আকর্ষণীয় আর্দ্র।

আবুল হাসান (৪ আগস্ট ১৯৪৭—২৬ নভেম্বর ২০২৫)

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • আবুল হাসানের কবিতা: ঘনায়মান চিত্রাল্পনা