মানিকগঞ্জ জেলায় প্রায় ৩০০ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ফায়ার সার্ভিসের অনুমোদন বা সনদ ছাড়াই পরিচালিত হচ্ছে। তবে যেসব প্রতিষ্ঠান ফায়ার সনদ পেয়েছে, তাদের অনেকেই পূর্ণাঙ্গভাবে নিয়মনীতি অনুসরণ না করেও সেই সনদ লাভ করেছে। এতে পুরো জেলার ব্যবসা ও শিল্প খাত পড়েছে অগ্নি ঝুঁকিতে।

স্থানীয়রা বলছেন, জেলায় নতুন ভবন, দোকান ও শিল্প প্রতিষ্ঠান দ্রুত বাড়ছে কিন্তু ফায়ার সেফটি অবহেলিতই থেকে যাচ্ছে। পরিদর্শনে ঘাটতি, দুর্বল তদারকি ও অনিয়মের সংস্কৃতি চলতে থাকলে জেলার শতাধিক প্রতিষ্ঠান অগ্নিকাণ্ডের বড় ঝুঁকিতে পড়বে বলে অভিমত তাদের। 

ফায়ার সার্ভিস কার্যালয় থেকে জানা গেছে, মানিকগঞ্জ জেলায় সাতটি উপজেলার মধ্যে সদর অঞ্চলে সবচেয়ে বেশি ফায়ার লাইসেন্স নবায়নবিহীন প্রতিষ্ঠান রয়েছে। সাতটি উপজেলার জন্য মাত্র তিনজন ওয়্যারহাউজ ইন্সপেক্টর রয়েছেন। 

তথ্য অধিকার আইন ব্যবহার করে প্রাপ্ত নথিপত্র ঘেঁটে দেখা গেছে, ২০২৩ সালের জানুয়ারি মাস থেকে ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত অগ্নি প্রতিরোধ ও নির্বাপন আইন ২০০৩ লঙ্ঘন করায় জেলা প্রশাসনের সহায়তায় ফায়ার সার্ভিস মাত্র তিনটি প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা করেছেন। এরমধ্যে সদর উপজেলার মেসার্স রাইয়ান ট্রেডার্সকে পাঁচ হাজার টাকা, ক্যাফে হাইওয়ে চাইনিজ এন্ড রেস্তোরাঁকে পাঁচ হাজার টাকা এবং ধানসিঁড়ি হোটেল এন্ড রেস্তোরাঁকে তিন হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে। কিন্তু জেলার প্রায় ৩০০ প্রতিষ্ঠান লাইসেন্স নবায়ন ছাড়াই চলছে। আর যারা নবায়ন পেয়েছেন তাদের একাংশেরও নানা ঘাটতি রয়েছে। অনিয়ম নিয়ন্ত্রণে ফায়ার সার্ভিসের অভিযানের হার একেবারেই নগণ্য। 

আইন অনুযায়ী, অনলাইনে আবেদন করার পর সংশ্লিষ্ট ফায়ার সার্ভিস কার্যালয়ের ওয়্যার হাউজ ইন্সপেক্টর পরিদর্শন শেষে অগ্নি নিরাপত্তা ব্যবস্থা সঠিক থাকলে সনদের সুপারিশ করেন। সেখানে অগ্নি নির্বাপক যন্ত্র, পানি সরবরাহ, নির্গমন পথ ও অ্যালার্ম ব্যবস্থা থাকতে হয়। তবে বহু প্রতিষ্ঠানে এসবের ঘাটতি থাকা সত্ত্বেও ফায়ার সনদ দেওয়া হচ্ছে।

ফায়ার লাইসেন্সপ্রাপ্ত ১৩টি প্রতিষ্ঠানের মালিক ও দায়িত্বরতদের সঙ্গে কথা বলেছেন এ প্রতিবেদক। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তারা বলেছেন, “শতভাগ নিয়ম মেনে চললে জেলার কোনো প্রতিষ্ঠানই লাইসেন্স পাওয়ার যোগ্য নয়। অল্পবিস্তর ঘাটতি তো থাকেই। তাই কিছু খরচ করেই কাজটা হয়ে যায়। পরিদর্শনের সময় তথাকথিত ‘উপরি খরচ’ প্রদান করেই অনেক প্রতিষ্ঠান সনদ নিচ্ছে। প্রতিটি পরিদর্শনের আগে দুই থেকে চার হাজার টাকা পর্যন্ত দিতে হয়। কখনও কখনও ক্ষেত্র বিশেষে উপরি খরচ আরও বেশি হয়। এতে করে অনেক ঘাটতিপূর্ণ প্রতিষ্ঠানও সহজে সনদ নবায়ন করতে পারছে। একেবারেই অযোগ্য প্রতিষ্ঠানগুলোকে সনদ দেওয়া হয় না, তবে মাঝামাঝি অবস্থার প্রতিষ্ঠানগুলো ‘খরচাপাতি’ দিয়েই ছাড়পত্র পেয়ে যায়। প্রতি বছর একইভাবে লাইসেন্স নবায়নও করা হয়।”

উন্নয়নকর্মী ও কলেজ শিক্ষক ইয়াসিনুর রহমান বলেন, “ফায়ার সনদ শুধু একটি আনুষ্ঠানিকতা নয়, এটা নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি। এখানে সেটি ব্যবসায়িক লেনদেনে পরিণত হয়েছে। এখনই যদি কঠোর নজরদারি না হয়, তাহলে অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকি ভয়াবহ পর্যায়ে পৌঁছাবে।”

সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) মানিকগঞ্জ জেলা কমিটির সভাপতি অধ্যাপক ইন্তাজ উদ্দিন বলেন, “এটা স্পষ্ট দুর্নীতির উদাহরণ। ফায়ার সনদ মানে মানুষের জীবনের নিরাপত্তা। নিয়ম না মেনে সনদ দেওয়া মানে নাগরিকদের জীবন নিয়ে খেলা। প্রশাসনের কঠোর নজরদারি, জবাবদিহি ও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা না থাকলে বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। আমরা চাই প্রতিষ্ঠান যাচাই করে ফায়ার সনদ দেওয়া হোক। নবায়নের সময়ও যেন বাস্তব পরিদর্শন নিশ্চিত করা হয়। আর যারা নিয়ম ভেঙে সনদ দিয়েছেন বা নিয়েছেন, তাদের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি।”

মানিকগঞ্জ কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের উপমহাপরিদর্শক মো.

মোজাম্মেল হোসেন বলেন, “অগ্নি দুর্ঘটনা এড়াতে ফায়ার লাইসেন্স অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ফায়ার লাইসেন্স ছাড়া আমাদের দপ্তরের লাইসেন্স প্রদান করা হয় না। যারা কলকারখানা ও পরিদর্শন দপ্তরের লাইসেন্স নবায়ন করছে না, তাদের নোটিশ দেওয়া হচ্ছে, প্রয়োজনে মামলা করা হচ্ছে। অগ্নি ঝুঁকি এড়াতে সবাইকে সচেতন করা আমাদের চলমান প্রচেষ্টার অংশ।”

মানিকগঞ্জ পরিবেশ অধিদপ্তরের উপপরিচালক আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, “জেনেছি, প্রতি বছর জুন থেকে জুন পর্যন্ত ফায়ার লাইসেন্স হালনাগাদ হয়। তবে এই জেলায় এতগুলো প্রতিষ্ঠান কেন লাইসেন্স নবায়ন করেনি, সে বিষয়ে আমি অবগত নই। আমরা সাধারণত ফায়ার লাইসেন্স নবায়ন ছাড়া পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র দিই না। কারণ অগ্নি ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে পরিবেশের সুরক্ষা নিশ্চিত করা কষ্টসাধ্য।”

মানিকগঞ্জ ফায়ার সার্ভিসের উপসহকারী পরিচালক মুহাম্মদ আব্দুল হামিদ বলেন, “ফায়ার লাইসেন্স তদারকির জন্য তিনজন ইন্সপেক্টর দায়িত্বে আছেন। কোন প্রতিষ্ঠানে ঘাটতি থাকলে আমরা সনদ দিই না। বাড়তি টাকা নিয়ে সনদ দেওয়ার অভিযোগ ভিত্তিহীন। কেউ যদি লিখিত অভিযোগ করে, তাহলে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।” 

‘অনিয়ম নিয়ন্ত্রণে আপনাদের অভিযান পরিচালনার হার খুব কম’ এমন মন্তব্যে তিনি বলেন, “অচিরেই অভিযান শুরু হবে।” 

মানিকগঞ্জের জেলা প্রশাসক (যুগ্ম সচিব) ড. মানোয়ার হোসেন মোল্লা বলেন, “আইন অনুযায়ী যেসব প্রতিষ্ঠান বা ভবনের ফায়ার লাইসেন্স নেওয়া বাধ্যতামূলক, তাদের অবশ্যই তা নিতে হবে। কেউ অগ্নি নিরাপত্তা নিশ্চিত না করলে বিষয়টি ফায়ার সার্ভিস কর্তৃপক্ষের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। আমাদের কাছে অভিযোগ এলে আমরা আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করব।”

ঢাকা/এস

উৎস: Risingbd

কীওয়ার্ড: চ কর চ কর ম ন কগঞ জ ফ য় র সনদ ব যবস থ পর চ ল ন বল ন

এছাড়াও পড়ুন:

লকার থেকে উদ্ধার করা সোনা শেখ হাসিনার হলফনামায় দেখানো হয়েছিল কি

অগ্রণী ব্যাংকে দুটি লকার থেকে ৮৩২ ভরি সোনা পাওয়ার কথা জানিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এর মধ্যে একটি লকার জুলাই গণ–অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তাঁর মেয়ে সায়মা ওয়াজেদের নামে। অন্যটি শেখ হাসিনা ও তাঁর বোন শেখ রেহানার নামে।

দুদক আজ বুধবার বলেছে, অগ্রণী ব্যাংকের প্রিন্সিপাল শাখায় শেখ হাসিনা ও সায়মা ওয়াজেদের নামে থাকা একটি লকারে ৪২২ ভরির কিছু বেশি সোনা পাওয়া যায়। শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার নামে থাকা একটি লকারে পাওয়া গেছে ৪১০ ভরি সোনা।

পূবালী ব্যাংকেও শেখ হাসিনার নামে একটি লকার থাকার কথা জানিয়েছে দুদক। সেখানে পাওয়া গেছে একটি ছোট চটের ব্যাগ। সেটি খালি ছিল।

দুদক বলছে, লকারের রক্ষিত চিরকুট ও বর্ণনা অনুযায়ী স্বর্ণালংকারগুলো শেখ হাসিনা, সায়মা ওয়াজেদ, শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় এবং শেখ রেহানা ও তাঁর ছেলে রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববির বলে ধারণা করা যাচ্ছে। সংস্থাটি সোনার মালিকানা সুনির্দিষ্ট করে আইনগত দায় নিরূপণ করবে বলে জানিয়েছে।

প্রশ্ন হলো, এই সোনা কি শেখ হাসিনার হলফনামায় দেখানো হয়েছিল?

২০২৪ সালের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রার্থী হতে শেখ হাসিনা হলফনামা জমা দিয়েছিলেন। তিনি প্রার্থী হয়েছিলেন গোপালগঞ্জ–৩ আসন থেকে।

নির্বাচন কমিশনের (ইসি) ওয়েবসাইটে শেখ হাসিনার হলফনামাটি এখনো আছে। তাতে দেখা যায়, তিনি নিজের নামে ৪ কোটি ৩৪ লাখ টাকার স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদ দেখিয়েছিলেন। সোনা ও মূল্যবান ধাতুর অর্জনকালীন মূল্য দেখিয়েছিলেন ১৩ লাখ ২৫ হাজার টাকা। সেখানে সোনার পরিমাণ উল্লেখ করা হয়নি।

শেখ হাসিনা ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনের সময়ও হলফনামায় সোনা ও মূল্যবান ধাতুর মূল্য বাবদ ১৩ লাখ ২৫ হাজার টাকা দেখিয়েছিলেন।

আয়, সম্পদসহ আট ধরনের তথ্য হলফনামায় দেওয়া বাধ্যতামূলক করা হয় ২০০৮ সালের নির্বাচন থেকেই।

দেখা যাচ্ছে, ২০০৮ ও ২০২৪ সালের নির্বাচনের হলফনামায় শেখ হাসিনার সম্পদের মধ্যে সোনা ও মূল্যবান ধাতুর মূল্যে কোনো হেরফের নেই।

রাজধানীর মতিঝিলে অগ্রণী ব্যাংকের প্রিন্সিপাল শাখায় শেখ হাসিনা ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের নামে থাকা লকারে স্বর্ণালংকারের পাশাপাশি সোনার নৌকা ও হরিণ পাওয়া গেছে

সম্পর্কিত নিবন্ধ