শেষ পর্যায়ে রাকসুর সংস্কার কাজ, রবিবার থেকেই বসতে পারবেন নির্বাচি
Published: 18th, October 2025 GMT
দীর্ঘ ৩৫ পর নানা ‘চড়াই-উৎরাই’ পেরিয়ে বৃহস্পতিবার (১৬ অক্টোবর) অনুষ্ঠিত হয় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (রাকসু) নির্বাচন। শুক্রবার (১৭ অক্টোবর) ফলাফল ঘোষণার মাধ্যমে শেষ হয় নির্বাচনী কার্যক্রম; বাকি শুধু নির্বাচিত প্রতিনিধিদের শপথ গ্রহণ।
এবারের রাকসু নির্বাচনে ভূমিধস বিজয় অর্জন করেছে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির সমর্থিত প্যানেল। নির্বাচনে ২৩টি পদের মধ্যে ভিপি, এজিএসসহ ২০টি পদেই জয়লাভ করেছেন তারা। বাকি তিনটি পদে একজন করে ছাত্রদল প্যানেল, আধিপত্যবিরোধী ঐক্য প্যানেল ও স্বতন্ত্র থেকে জয়লাভ করেছে।
আরো পড়ুন:
ভিপি পদে ছাত্রদল প্রার্থীর ৪ গুণ ভোট পেয়েছে শিবিরের জাহিদ
জিএস পদে হারলেও সিনেটে নির্বাচিত ফাহিম
নর্বনির্বাচিত এসব প্রার্থীদের জন্য তৈরি করা হচ্ছে রাকসু ভবন। প্রস্তুত করা হচ্ছে ভিপি, জিএস, এজিএসসহ সব প্রার্থীর বসার কক্ষ। আগামীকালকের মধ্যেই কাজ শেষ হবে বলে জানিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের পেছনে রাকসুর দোতলা ভবন। ভবনে রাকসুর ভিপি হিসেবে সবশেষ নিজের কক্ষে বসেছিলেন বিএনপির যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী।
তিনি নির্বাচিত হয়েছিলেন ১৯৯০-১৯৯১ সালের জন্য। পরের বছর নির্বাচন না হওয়ায় ১৯৯১-১৯৯২ মেয়াদেও তিনি দায়িত্ব পালন করেন। তারপর আর কোনো ভিপি পায়নি রাকসু ভবন।
গত ৩৫ বছর রাকসু না হওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তত ১৫টি সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠন রাকসু ভবনের বিভিন্ন কক্ষে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছিল। পাশাপাশি সাংবাদিকদের সংগঠন ‘রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় রিপোর্টার্স ইউনিটি’র অফিসও ছিল। তারা যে কক্ষটি ব্যবহার করছিল, সেটিই রাকসুর সহ-সভাপতির (ভিপি) কক্ষ। গেল সপ্তাহে সব সংগঠনকেই ভবন ছাড়তে হয়েছে।
বুধবার (১৫ অক্টোবর) সকাল থেকে অন্তত ৫০ জন শ্রমিক একসঙ্গে প্রতিটি কক্ষ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও ঘষামাজার কাজ শুরু করেন। একইসঙ্গে চলে দেয়ালগুলোতে নতুন রঙ করার কাজও।
আব্দুল ওয়াহাব নামের একজন ঠিকাদার জানান, তারা মোট পাঁচজন ঠিকাদার কাজ করছেন। মঙ্গলবার (১৪ অক্টোবর) রাতে তাদের কাজ বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। বুধবার (১৫ অক্টোবর) সকাল ৮টা থেকে তারা ৫০ জন শ্রমিক নিয়ে কাজ শুরু করেছেন।
তিনি জানান, বৃহস্পতিবার (১৬ অক্টোবর) সন্ধ্যার মধ্যে তাদের কাজ শেষ করতে বলা হয়েছিল। এই সময়ের মধ্যে কাজ শেষ করা কষ্টকর। তারা শুক্রবার সকালের মধ্যে সব কাজ শেষ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তা সম্ভব হয়নি। আজ (শনিবার) রাতের মধ্যেই শেষ হয়ে যাবে।
রাকসু ভবন সংস্কারের দায়িত্বে আছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক মাঈন উদ্দীন।
তিনি বলেন, “রাকসু ভবনে থাকা সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোকে আপাতত বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি স্কুলের টিনশেড ভবনে জায়গা দেওয়া হয়েছে। তারপর থেকেই ভবনটিতে রং করাসহ সংস্কারের কাজ শুরু হয়েছে। আগামীকাল রবিবারে (১৯ অক্টোবর) মধ্যেই কাজ শেষ হয়ে যাবে। আগামীকাল রবিবার থেকেই নবনির্বাচিতরা তাদের কক্ষগুলোতে বসতে পারবেন।”
১৬ অক্টোবর অনুষ্ঠিত রাকসু নির্বাচনে ভিপি পদে জয়লাভ করেছে ছাত্রশিবির সমর্থিত সম্মিলিত শিক্ষার্থী জোটের মোস্তাকুর রহমান জাহিদ ও এজিএস পদে নির্বাচিত হয়েছেন একই প্যানেলের এস এম সালমান সাব্বির, জিএস নির্বাচিত হয়েছেন বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক সমন্বয়ক সালাউদ্দিন আম্মার।
এবারের নির্বাচনে ২৩টি পদের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন ২৪৭ জন প্রার্থী। এর মধ্যে ভিপি পদে ১৮, জিএস পদে ১৩ এবং এজিএস পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন ১৬ জন। ছাত্রদল ও শিবির সমর্থিতসহ মোট ১১টি প্যানেল ঘোষণা করা হয়েছে। এছাড়াও, সিনেট ছাত্র প্রতিনিধি নির্বাচনের ৫টি পদে ৫৮ জন প্রার্থী ও হল সংসদ নির্বাচনে ১৫টি পদে মোট ১৭টি হলে ৫৯৭ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন।
রাকসু ও সিনেট নির্বাচনে মোট ভোটার সংখ্যা ২৮ হাজার ৯০১ জন। এর মধ্যে নারী ভোটার ১১ হাজার ৩০৫ এবং পুরুষ ভোটার ১৭ হাজার ৫৯৬ জন ছিল।
ঢাকা/ফাহিম/মেহেদী
.উৎস: Risingbd
এছাড়াও পড়ুন:
ইমরান খানকে কি ভুট্টোর পরিণতি বরণ করতে হচ্ছে
একসময়ের ক্যারিশমেটিক ক্রিকেটার থেকে রাজনীতিবিদ হওয়া ইমরান খান পাকিস্তানে সংস্কার ও পুনর্জাগরণের আশার প্রতীক হয়ে উঠেছিলেন। তাঁকে নিয়ে এখন গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে, তিনি রাওয়ালপুরির আদিয়ালা কারাগারে রহস্যজনক পরিস্থিতিতে মারা গেছেন।
২০২৩ সাল থেকে ইমরান এই কারাগারেই বন্দী। তাঁর ছেলে কাসিম খান এখন বাবার ‘জীবিত থাকার প্রমাণ’ এবং মুক্তির দাবি জানাচ্ছেন। ইমরান খানের বয়স ৭২ বছর।
ইমরানের মৃত্যু যদি সত্য হয়, তবে এটি হবে এমন এক জীবনের করুণ পরিসমাপ্তি, যেখানে ছিল আন্তর্জাতিক খ্যাতি, রাষ্ট্রক্ষমতা এবং শেষ পর্যন্ত রাজনৈতিক নিপীড়ন।
লাহোরে ১৯৫২ সালে এক সম্ভ্রান্ত পশতুন পরিবারে জন্ম নেওয়া ইমরান খান ক্রিকেট বিশ্বের অন্যতম সেরা অলরাউন্ডার হিসেবে আন্তর্জাতিক খ্যাতি অর্জন করেন। তিনি পড়েছেন আইচিসন কলেজ, রয়্যাল গ্রামার স্কুল, উস্টার এবং অক্সফোর্ডের কেবল কলেজে।
আরও পড়ুন‘আর্মির দেশ’ পাকিস্তান ও ইমরান খানের লড়াই২৯ মে ২০২৩খেলোয়াড় হিসেবে ইমরানের উত্থান শুরু হয় ১৯৭০-এর দশকের শুরুতে। আর তাঁর চূড়ান্ত সাফল্য আসে ১৯৯২ সালের ক্রিকেট বিশ্বকাপে পাকিস্তানের ঐতিহাসিক জয়ের মধ্য দিয়ে। অধিনায়ক হিসেবে তিনি কৌশলগত দীক্ষা, তীব্র প্রতিযোগিতামূলক মনোভাব এবং ভেতরে ভাঙন ধরা দলকে একত্র করার সক্ষমতার জন্য প্রশংসিত ছিলেন।
ক্রিকেট ছেড়ে দেওয়ার পর ইমরান খান মানবসেবায় মনোনিবেশ করেন। তিনি তাঁর মায়ের স্মৃতিতে প্রতিষ্ঠা করেন শওকত খানুম মেমোরিয়াল ক্যানসার হাসপাতাল। এটি ছিল পাকিস্তানের প্রথম এমন প্রতিষ্ঠান, যেখানে হাজারো মানুষ বিনা মূল্যে চিকিৎসা পেয়েছে। এই হাসপাতাল গড়ে ওঠে মূলত সাধারণ মানুষের অনুদানে। এটি ইমরানের জনপ্রিয়তা ও মানুষের সঙ্গে তাঁর গভীর সংযোগের প্রমাণ দেয়।
এক ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ মোড়কিন্তু ইমরানের জীবনের দ্বিতীয়ার্ধ পুরোপুরি রাজনীতিতে নিমজ্জিত ছিল। ১৯৯৬ সালে তিনি পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই) দল গঠন করেন। শুরুতে দলটি রাজনীতির প্রান্তেই ছিল। কিন্তু ২০১০-এর দশকে এসে হঠাৎ করেই এর ব্যাপক উত্থান ঘটে। দুর্নীতিবিরোধিতা, জাতীয় মর্যাদা এবং ইসলামি কল্যাণরাষ্ট্র—এই তিনটি তাঁর মূল স্লোগান ছিল।
রাজতন্ত্রসুলভ রাজনীতি ও সামরিক হস্তক্ষেপে বিরক্ত এক নতুন প্রজন্মের মধ্যে এসব কথা গভীর প্রভাব ফেলে। ২০১৮ সালে ইমরান প্রধানমন্ত্রী হন এবং ‘নয়া পাকিস্তান’ গড়ার প্রতিশ্রুতি দেন। কিন্তু তাঁর শাসনামল ছিল অর্থনৈতিক সংকট, কূটনৈতিক ভারসাম্য রক্ষা এবং পাকিস্তানের সামরিক প্রতিষ্ঠানের সর্বদা উপস্থিত ছায়ার সঙ্গে এক কঠিন লড়াইয়ে পরিপূর্ণ। এই ‘ডিপ স্টেট’ শেষ পর্যন্ত তাঁর পথচলাকেই থামিয়ে দেয়।
আমি ইমরান খানকে তাঁর জীবনের তিনটি ভিন্ন পর্যায়ে দেখেছি। তাঁর সঙ্গে আমার প্রথম দেখা নিউইয়র্কে, জাতিসংঘে কাজ করার সময়। তাঁর বোন (যিনি জাতিসংঘের কর্মকর্তা ছিলেন) নিজের বাড়িতে একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিলেন। সেখানে ইমরান খানও উপস্থিত ছিলেন। তখন তিনি বিশ্বখ্যাত ক্রিকেট তারকা। আমি তাঁর উষ্ণতা, সহজ ভঙ্গি এবং মানুষকে আপন করে নেওয়ার ক্ষমতায় মুগ্ধ হয়েছিলাম। তিনি কোনো দূরত্ব রাখা নায়ক নন, বরং ছিলেন কৌতূহলী ও বন্ধুবৎসল এক মানুষ।
ইমরানের মৃত্যুর গুজব এখনো স্পষ্ট নয়। নানা মহল থেকে বলা হচ্ছে, সামরিক গোয়েন্দা কাঠামোর ভেতরের কোনো অংশ তাঁকে হত্যা করেছে। কিন্তু সরকারিভাবে এখনো কিছু জানানো হয়নি। এই নীরবতাই অনেক কিছু বলে দেয়।বছর কয়েক পরে ইমরান যখন অবসরপ্রাপ্ত ক্রিকেটার হিসেবে ভারতে আসতেন, তখন আরও কয়েকবার তাঁর সঙ্গে দেখা হয়। আমরা একই সামাজিক অনুষ্ঠানে যেতাম, এমনকি ভারতীয় টিভি চ্যানেলের বিভিন্ন আলোচনাতেও মুখোমুখি হতাম।
ক্রিকেট, রাজনীতি বা ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক—সব বিষয়ে তিনি ছিলেন স্পষ্টভাষী, তর্কপ্রবণ এবং চ্যালেঞ্জ জানাতে আগ্রহী। আমাদের দুই দেশের উত্তেজনার মাঝেও তিনি ভারতে যথেষ্ট জনপ্রিয় ছিলেন। বিশেষ করে নারীদের মধ্যে তাঁর তুমুল জনপ্রিয়তা ছিল। তাঁর ক্রীড়া-উত্তরাধিকার আর ব্যক্তিগত ভদ্রতা তাঁকে মানুষের কাছে আরও আকর্ষণীয় করে তুলেছিল।
এক ঘণ্টার কথোপকথনইমরান খানের সঙ্গে আমার সবচেয়ে স্মরণীয় সাক্ষাৎ হয় ২০১৭ সালে। তখন আমি ভারতীয় পার্লামেন্টের একটি প্রতিনিধিদল নিয়ে ইসলামাবাদে এশীয় সংসদ সদস্যদের এক সম্মেলনে গিয়েছিলাম। তখন ইমরান খান ছিলেন বিরোধীদলীয় নেতা। তিনি আমার সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু পাকিস্তান সরকার নিরাপত্তার অজুহাত দেখিয়ে আমাকে হোটেলের বাইরে যেতে দেয়নি। এতে তিনি দমে যাননি। উল্টো তিনি নিজেই আমার কাছে আসার প্রস্তাব দেন।
তিনি ছয়-সাতজন সহযোগী নিয়ে আমার হোটেলে আসেন। আমি তাঁকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাগত জানাই। আমার সঙ্গে তখন ছিলেন বিজেপির দুই সহকর্মী—স্বপন দাশগুপ্ত ও মীনাক্ষী লেখী, যাতে কেউ এই বৈঠক নিয়ে কোনো অনৈতিকতার অভিযোগ তুলতে না পারে।
এরপর প্রায় এক ঘণ্টা আমরা কথা বলি। আশ্চর্যের বিষয়, সেই আলোচনা রাজনীতি নিয়ে ছিল না; ছিল ইতিহাস নিয়ে। ইমরান তখন আমার লেখা বই অ্যান এরা অব ডার্কনেস পড়া শেষ করেছেন। তিনি আমাকে জানালেন, বইটি তিনি বেশ আগ্রহ নিয়ে পড়েছেন। তিনি বইয়ের বিভিন্ন অংশ থেকে উদ্ধৃতি দেন, নানা তথ্য নিয়ে প্রশ্ন করেন এবং অবিভক্ত ভারতের সময়কার ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের ওপর নিজের ভাবনাও ভাগ করে নেন। তিনি জোর দিয়ে বলেছিলেন, আমি যেন পাকিস্তানে তাঁর অতিথি হয়ে এসে এই বিষয় নিয়ে প্রকাশ্যে কথা বলি। বিষয়টি আর বাস্তবায়িত হয়নি। তবু ওই সাক্ষাৎ আমার মনে গভীর ছাপ ফেলে।
আমি দেখলাম, রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা থাকা সত্ত্বেও ইমরান একজন চিন্তাশীল মানুষ। উপমহাদেশের যৌথ ইতিহাস বিষয়ে তিনি গভীর আগ্রহ ও আবেগ পোষণ করেন।
আরও পড়ুনপাকিস্তানে রাজনৈতিক ঝড় ও ইমরানের ‘বাংলাদেশ দর্শন’২৫ মে ২০২৩বিরুদ্ধতায় ভরা নেতৃত্বসেনাবাহিনীর সক্রিয় সমর্থনে ইমরান খানের প্রধানমন্ত্রী হওয়া ছিল একধরনের বিরোধাভাসের উদাহরণ। তিনি ভারতের সঙ্গে শান্তি চেয়েছিলেন, কিন্তু সেনাবাহিনীর কৌশলগত চিন্তার কারণে সে পথে এগোনো তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়নি। তিনি অর্থনৈতিক সংস্কারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কিন্তু মূল্যস্ফীতি ও ঋণের ভার সামলাতে পারেননি। তিনি দুর্নীতিবিরোধী অবস্থান নিয়েছিলেন। অথচ তাঁকেও নানা দুর্নীতির অভিযোগের মুখে পড়তে হয়েছে।
২০২২ সাল থেকে তাঁর পতন শুরু হয়। সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপে তিনি ক্ষুব্ধ হয়ে পড়েন। পাকিস্তানের ‘ডিপ স্টেট’-এর সঙ্গে তিনি মুখোমুখি সংঘর্ষে যান। এর ফলেই অনাস্থা ভোটের মাধ্যমে তাঁকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। এরপর তাঁর বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা, গ্রেপ্তার এবং একঘরে করার প্রক্রিয়া শুরু হয়। ২০২৩ সালের মধ্যে তিনি কারাগারে চলে যান এবং একাধিক মামলায় দোষী সাব্যস্ত হন। অনেকের কাছে এই মামলাগুলো রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলেই মনে হয়েছে।
আরও পড়ুনযে পাঁচ কারণে ইমরানের পিটিআই ব্যর্থ হলো০৩ এপ্রিল ২০২২গত কয়েক বছর পাকিস্তানে দমন-পীড়ন আরও বেড়েছে। ইমরান খানকে পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে দেওয়া হয়নি। তাঁকে কঠোর অবস্থায় রাখা হয়েছে। দল থেকে তাঁকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়েছে।
অনেক পাকিস্তানির কাছে তিনি তখন প্রতিরোধের প্রতীক হয়ে ওঠেন। তাঁর বোনেরা যখন আদিয়ালা কারাগারের বাইরে প্রতিবাদ করছিলেন, তখন নাকি পুলিশ তাঁদের ওপর হামলা চালায়। এটি দেখায়, রাষ্ট্র তাঁর প্রভাব মুছে ফেলতে কতটা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিল।
ইমরানের মৃত্যুর গুজব এখনো স্পষ্ট নয়। নানা মহল থেকে বলা হচ্ছে, সামরিক গোয়েন্দা কাঠামোর ভেতরের কোনো অংশ তাঁকে হত্যা করেছে। কিন্তু সরকারিভাবে এখনো কিছু জানানো হয়নি। এই নীরবতাই অনেক কিছু বলে দেয়।
যদি এটি সত্য হয়, তাহলে কারাগারে তাঁর মৃত্যু পাকিস্তানের অন্ধকার ও যন্ত্রণাদায়ক রাজনৈতিক ইতিহাসে আরেকটি ভয়াবহ অধ্যায় হয়ে থাকবে। এটি মনে করিয়ে দেয়, ক্ষমতাকাঠামোর বিরুদ্ধে দাঁড়ালে কী ভয়ংকর পরিণতি হতে পারে।
আরও পড়ুনগদিহারা ইমরানের জন্য রাজপথে এত মানুষ কেন১২ এপ্রিল ২০২২ভাঙা স্বপ্নইমরান খানের উত্তরাধিকার জটিল। তিনি একাধারে জাতীয় নায়ক, বৈশ্বিক আইকন, সংস্কারক নেতা এবং একজন রাষ্ট্রনায়ক। তিনি লাখো মানুষকে অনুপ্রাণিত করেছেন, অনেককেই হতাশ করেছেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত মাথা নত করেননি। তাঁর জীবন উচ্চাকাঙ্ক্ষার সাক্ষ্য দেয়—কি খেলায়, কি ব্যক্তিজীবনে, কি রাষ্ট্রে, কি রাজনীতিতে।
ইমরানের মৃত্যু যদি সত্যি হয়ে থাকে, তা শুধু পাকিস্তানের জন্য নয়, বরং সবার জন্যই এক বড় ট্র্যাজেডি। বিশেষ করে যাঁরা অস্থির সময়ে নীতিনিষ্ঠ নেতৃত্বে বিশ্বাস করেন, তাঁদের জন্য তাঁর মৃত্যু গভীর বেদনার বিষয় হবে।
ইমরানের পরিণতি স্মরণ করিয়ে দেয় আরেক পাকিস্তানি নেতার কথা। তিনি জুলফিকার আলী ভুট্টো। তিনিও ভেবেছিলেন, তিনি শক্তিশালী সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বে উঠতে পারবেন। কিন্তু সেই ভুল ধারণার মূল্য তাঁকে প্রাণ দিয়ে দিতে হয়েছিল।
আমার কাছে ইমরান খান সব সময় সেই মানুষটিই হয়ে থাকবেন, যিনি ইসলামাবাদে আমার হোটেলে এসেছিলেন—রাজনীতি নিয়ে কথা বলতে নয়, ইতিহাস নিয়ে আলোচনা করতে। চিন্তা, আবেগ ও বিশ্বাসে দৃঢ় একজন মানুষ। তিনি যে ‘ডিপ স্টেট’-এর সহায়তায় ক্ষমতায় উঠতে চেয়েছিলেন, পরে সেটাকেই নিয়ন্ত্রণ করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেটিকে জয় করতে পারেননি। আর সেখানেই তাঁর স্বপ্ন ভেঙে যায়।
শশী থারুর ভারতের কেরালা রাজ্যের তিরুঅনন্তপুরম থেকে নির্বাচিত কংগ্রেস পার্টির পার্লামেন্ট সদস্য।
এনডিটিভি থেকে নেওয়া, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ