২৪ বছর বয়সী সীমা আখতার ফুটবল খেলার অনুশীলন করছিলেন। হঠাৎই এক বন্ধু এসে তাঁকে থামিয়ে দিয়ে একটি খবর জানালেন। বললেন, বাংলাদেশের পলাতক সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই শিক্ষার্থীর কাছে রায়টিকে ন্যায়বিচারের এক মুহূর্ত বলে মনে হচ্ছিল।

গত বছর বিক্ষোভকারীদের ওপর শেখ হাসিনার নিরাপত্তা বাহিনী দমন–পীড়ন চালায়। সে সময় সীমা আখতারের কয়েকজন বন্ধুও নিহত হন।

শেখ হাসিনা শেষ পর্যন্ত পদত্যাগ করেন এবং বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে যান।

ঢাকায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে ৭৮ বছর বয়সী এ নেত্রীর বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনের অভিযোগে বিচারকাজ চলেছে। কয়েক মাস ধরে বিচারপ্রক্রিয়া চলার পর আদালত তাঁকে মৃত্যুদণ্ড দেন। গত বছর বিক্ষোভ দমনে প্রাণঘাতী অভিযান চালানোর জন্য নির্দেশ দেওয়ার দায়ে তাঁকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে।

ঢাকা থেকে সীমা আখতার বলেন, ‘ফ্যাসিবাদী হাসিনা ভেবেছিলেন, তাঁকে কখনো পরাজিত করা যাবে না। তিনি চিরদিন শাসনক্ষমতায় থাকতে পারবেন। তাঁর মৃত্যুদণ্ড আমাদের শহীদদের জন্য ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার পথে একটি পদক্ষেপ।’

সীমা মনে করেন, শুধু সাজা ঘোষণাই যথেষ্ট নয়। তিনি বলেন, ‘আমরা দেখতে চাই, তাঁকে এই ঢাকাতেই ফাঁসিতে ঝোলানো হয়েছে।’

কিন্তু কাজটা এত সহজ নয়।

২০২৪ সালের আগস্টে শেখ হাসিনা ঢাকা ছেড়ে চলে যান। বর্তমানে তিনি ভারতের আশ্রয়ে আছেন।

শেখ হাসিনাকে ফেরত দেওয়ার জন্য বারবার বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ভারত সরকারের কাছে অনুরোধ সত্ত্বেও তাঁকে ফেরত দেওয়া হয়নি। বিষয়টি ১৫ মাস ধরে দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে উত্তেজনার অন্যতম কারণ হয়ে উঠেছে। এখন হাসিনাকে মানবতাবিরোধী অপরাধে দোষী সাব্যস্ত করে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার ঘটনায় এই উত্তেজনা নতুন উচ্চতায় পৌঁছাবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

যদিও ভারত হাসিনা–পরবর্তী বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে সহযোগিতামূলক সম্পর্ক গড়ে তুলতে আগ্রহী। কয়েকজন ভূরাজনৈতিক বিশ্লেষক বলেছেন, তাঁরা এমন কোনো দৃশ্য কল্পনাও করতে পারছেন না যে নয়াদিল্লি সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে মৃত্যুদণ্ডের মুখোমুখি করতে বাংলাদেশে ফেরত পাঠাবে।

ঢাকায় ভারতের সাবেক হাইকমিশনার পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তী প্রশ্ন করেন, ‘নয়াদিল্লি কীভাবে তাঁকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিতে পারে?’

ওয়াশিংটন ডিসিভিত্তিক দক্ষিণ এশীয় বিশ্লেষক মাইকেল কুগেলম্যান বলেন, ভারতে হাসিনার উপস্থিতিটা ‘দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের মধ্যে কাঁটা হয়ে থাকবে’। তবে এর মধ্য দিয়ে ভারত তার মিত্রদের প্রতি বিশ্বস্ত থাকার প্রতিশ্রুতি পালন করতে সক্ষম হয়েছে।

‘অত্যন্ত অবন্ধুসুলভ পদক্ষেপ’

হাসিনা বাংলাদেশের দীর্ঘতম সময় ধরে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী শেখ মুজিবুর রহমানের বড় মেয়ে তিনি।

শেখ হাসিনা প্রথম প্রধানমন্ত্রী হন ১৯৯৬ সালে। ২০০১ সালের নির্বাচনে পরাজিত হওয়ার পর তিনি কয়েক বছর ক্ষমতার বাইরে ছিলেন। ২০০৯ সালের নির্বাচনে জয়ী হয়ে তিনি আবার ক্ষমতায় ফেরেন। এরপর টানা ১৫ বছর ক্ষমতায় ছিলেন শেখ হাসিনা। এ সময় তিনি যে নির্বাচনগুলোতে জয়ী হয়েছেন, সেগুলো প্রায়ই বিরোধী দল বর্জন করেছে কিংবা প্রতিদ্বন্দ্বিতার সুযোগ পায়নি।

এ সময় হাজার হাজার মানুষকে জোরপূর্বক গুম করা হয়েছে। অনেককে বিচারবহির্ভূতভাবে হত্যা করা হয়েছে। ওই সময় নির্যাতনের ঘটনা সাধারণ বিষয় হয়ে উঠেছিল এবং রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের অনেককে কোনো বিচার ছাড়াই কারাগারে পাঠানো হয়েছে।

হাসিনা সরকার তাদের অর্থনৈতিক সাফল্যকে সামনে এনে তাঁর শাসনকে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করেছিল। সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার একসময় বাংলাদেশের অর্থনীতিকে ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ আখ্যা দিয়েছিলেন। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশের মোট দেশীয় উৎপাদন (জিডিপি) দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে এবং মাথাপিছু আয়ের দিক থেকে ভারতের তুলনায় এগিয়ে গেছে।

মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তান ও নাতি–নাতনিদের জন্য সরকারি চাকরিতে কোটার বিধানে সংস্কার চেয়ে ২০২৪ সালের জুলাইয়ে শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ শুরু করেন। বিক্ষোভকারীদের ওপর নিরাপত্তাবাহিনীর নৃশংস দমন অভিযানের পর ওই বিক্ষোভ হাসিনার পদত্যাগের দাবিতে রূপ নেয়। তখন দেশজুড়ে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। ঢাকায় বিক্ষোভকারীরা পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে।

শেখ হাসিনার সঙ্গে ভারতের দীর্ঘদিনের মিত্রতা। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট তিনি নয়াদিল্লিতে পালিয়ে যান। নোবেল শান্তি পুরস্কারজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস তখন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব নেন। এরপর মুহাম্মদ ইউনূসের সরকার ভারতের সঙ্গে উত্তেজনা চলার মধ্যে পাকিস্তানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলে। শেখ হাসিনাকে ফেরত দেওয়াসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে ভারতের সঙ্গে উত্তদেজনা দেখা দেয়।

গত মঙ্গলবার ঢাকার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় নয়াদিল্লির বিরুদ্ধে কণ্ঠস্বর আরও জোরালো করেছে। মন্ত্রণালয় ভারতের সঙ্গে একটি প্রত্যর্পণ চুক্তির কথা উল্লেখ করেছে। তারা বলেছে, প্রত্যর্পণ চুক্তি অনুযায়ী হাসিনাকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো নয়াদিল্লির জন্য ‘আবশ্যিক দায়িত্ব’। তারা আরও বলেছে, ভারত যদি হাসিনাকে ক্রমাগত আশ্রয় দিয়ে যায়, তাহলে তা হবে ‘অত্যন্ত অবন্ধুসুলভ পদক্ষেপ এবং ন্যায়বিচারের প্রতি অসম্মান’।

তবে ভারতের রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা আল–জাজিরাকে বলেছেন, প্রত্যর্পণ চুক্তিতে একটি ব্যতিক্রমের কথা বলা আছে। ‘রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের’ ক্ষেত্রে এ ব্যতিক্রমী ধারা ব্যবহার করা যাবে।

নয়াদিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ এশিয়া অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক সঞ্জয় ভরধোয়াজ বলেন, ‘ভারত এই ঘটনাকে (হাসিনার মামলা) বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক শক্তিগুলোর রাজনৈতিক প্রতিশোধ হিসেবে দেখছে।’

ভরধোয়াজ আল–জাজিরাকে আরও বলেন, নয়াদিল্লি মনে করে, বর্তমানে বাংলাদেশে ‘ভারতবিরোধী শক্তি’ ক্ষমতায় আছে। ইউনূস প্রায়ই ভারতের সমালোচনা করেন। হাসিনাকে পদত্যাগে বাধ্য করা বিক্ষোভ আন্দোলনের নেতা ও অংশগ্রহণকারীরাও প্রায়ই সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে সমর্থন দেওয়ার জন্য নয়াদিল্লিকে দায়ী করেন।

ভরধোয়াজ মনে করেন, এসব দিক বিবেচনায় নিলে হাসিনাকে হস্তান্তর করার মানে হবে ‘ভারতবিরোধী শক্তিকে’ বৈধতা দেওয়া।

হাসিনার বিরুদ্ধে রায় ঘোষণার পর ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় একটি বিবৃতি দিয়েছে। এতে বলা হয়েছে, হাসিনার রায়ের বিষয়ে ভারত অবগত হয়েছে এবং তারা সব সময় সব অংশীজনের সঙ্গে গঠনমূলকভাবে যুক্ত থাকবে।

‘ভারতের সমীকরণ পাল্টানো প্রয়োজন’

হাসিনার বিরুদ্ধে রায় ঘোষণার পর ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় একটি বিবৃতি দিয়েছে। এতে বলা হয়েছে, হাসিনার রায়ের বিষয়ে ভারত অবগত হয়েছে এবং তারা সব সময় সব অংশীজনের সঙ্গে গঠনমূলকভাবে যুক্ত থাকবে।

ভারত আরও বলেছে, তারা বিশেষ করে শান্তি, গণতন্ত্র, অন্তর্ভুক্তি এবং স্থিতিশীলতার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের জনগণের সর্বোত্তম স্বার্থ নিশ্চিত করার বিষয়ে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।

তবু বর্তমানে নয়াদিল্লি ও ঢাকার মধ্যকার সম্পর্কটা শীতল। হাসিনার শাসনকালে যে সমৃদ্ধশীল অর্থনৈতিক, নিরাপত্তা এবং রাজনৈতিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল, তা এখন অনাস্থার সম্পর্কে রূপ নিয়েছে।

ভারতের সাবেক হাইকমিশনার পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তী বলেছেন, শিগগিরই এ অবস্থার পরিবর্তন হবে বলে তিনি মনে করেন না।

পিনাক চক্রবর্তী আল–জাজিরাকে বলেন, ‘এই সরকারের (বাংলাদেশ) অধীনে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের টানাপোড়েন থেকে যাবে। কারণ, তারা বারবার বলতে থাকবে, ভারত আমাদের কাছে হাসিনাকে ফেরত দিচ্ছে না।’

পিনাক চক্রবর্তী মনে করেন, আগামী বছরের ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশে অনুষ্ঠেয় নির্বাচনের মধ্য দিয়ে নতুন সূচনা হতে পারে। যদিও নির্বাচনে হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগকে অংশগ্রহণের সুযোগ দেওয়া হচ্ছে না। বড় বিরোধী দল বিএনপিসহ অন্যান্য বড় রাজনৈতিক শক্তি ভারতের সমালোচক। তবু নির্বাচিত প্রশাসনের সঙ্গে কাজ করাটা ভারতের জন্য স্বস্তির হবে।

ভারতের জিন্দাল গ্লোবাল ইউনিভার্সিটির দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক শ্রীরাধা দত্ত বলেন, হাসিনার বিষয়ে ভারত জটিলতার মধ্যে পড়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে তাঁর প্রতি জনগণের ক্ষোভকে তারা উপেক্ষা করতে পারে না।

শ্রীরাধা আরও বলেন, স্বাভাবিকভাবেই নয়াদিল্লি চাইবে, ভবিষ্যতে কোনো না কোনোভাবে আওয়ামী লীগ আবার ক্ষমতায় ফিরুক। তিনি (হাসিনা) ভারতের জন্য সব সময়ই সর্বোত্তম পছন্দ। কিন্তু বাস্তবতা হলো, ভারতকে মানতে হবে, বাংলাদেশে হাসিনাকে আর কখনো সুযোগ দেওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। এর পরিবর্তে ভারতের উচিত, ঢাকার অন্য রাজনৈতিক শক্তির সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলা।

শ্রীরাধা দত্ত বলেন, বর্তমানে আমাদের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক অত্যন্ত নাজুক অবস্থায় রয়েছে। কিন্তু আমাদের অবশ্যই এই নির্দিষ্ট এজেন্ডা (হাসিনার প্রত্যর্পণ) ছেড়ে এগিয়ে যেতে হবে।’

শেখ হাসিনা এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: পরর ষ ট র নয় দ ল ল র জন ত ক সরক র র র ক ষমত আরও বল র জন য আম দ র বছর ব

এছাড়াও পড়ুন:

সংস্কার নাকি দুর্বল সরকার গঠনের চেষ্টা

সংস্কার নিয়ে তামাশা চলছেই; সংস্কারের কথা বলে দেশটাকেই যেন অনেকটা স্থবির করে দেওয়া হয়েছে। ব্যবসায়ীরা নতুন বিনিয়োগ করতে ভয় পাচ্ছেন। নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ মেলেনি লাখো বেকার তরুণ-তরুণীর। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি আশানুরূপ হয়নি—সব মিলিয়ে কোথায় যেন একধরনের খাপছাড়া পরিস্থিতি।

দেশের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে কয়েক দিন আগে কথা বলছিলাম বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে। তিনি বলেন, সংস্কারের নামে আমাদের আশাহত করা হয়েছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সেবা খাতে দৃশ্যমান কোনো সংস্কার করা হয়নি। পরিবেশ ও নদ-নদীগুলো রক্ষার কোনো উদ্যোগ আমরা দেখিনি। আমরা তিস্তার পানির জন্য সমাবেশ করেছি। খালগুলোকে উদ্ধারের কথা বলছি। এ ছাড়া দেশের ব্যবসায়ীরা দ্বিধাগ্রস্ত। বিনিয়োগ কমে গেছে। নতুন কোনো কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়নি। বেকারত্ব বাড়ছে, অনিশ্চয়তা বাড়ছে। বিনিয়োগের জন্য দেশে স্থিতিশীলতা দরকার। নির্বাচিত রাজনৈতিক সরকার দেশে সেই স্থিতিশীলতা আনতে পারে। এ জন্যই আমরা শুরু থেকেই দ্রুত নির্বাচনের কথা বলেছিলাম। রাষ্ট্রের স্বাভাবিক কার্যক্রম পরিচালনার জন্যই নির্বাচন দ্রুত হওয়া দরকার ছিল। এটা কোনো দলের ক্ষমতায় যাওয়ার বিষয় ছিল না। নির্বাচিত রাজনৈতিক সরকার দেশের জন্য যা করতে পারবে, অনির্বাচিত অস্থায়ী সরকার তা করতে পারবে না। কে কতবার প্রধানমন্ত্রী হবে তার থেকে জনবান্ধব রাষ্ট্র গঠন করা জরুরি। জনবান্ধব রাষ্ট্র গঠন করতে পারলে শাসনতান্ত্রিক অন্যান্য সংকট এমনিতেই কেটে যাবে।

সব মিলিয়ে দেশে একটা অনিশ্চয়তার পরিবেশ তৈরি হয়েছে। এই পরিবেশের মধ্যেই সরকার জুলাই সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ ২০২৫ অনুমোদন করেছে। এখানে নতুন কী আছে? ভবিষ্যতে একটি অতি দুর্বল সরকার গঠনের অভিলাষ নিয়ে এই আদেশ করা হয়েছে। যেমন সাংবিধানিক বিভিন্ন পদে নিয়োগের জন্য যে বোর্ড বা কমিটি গঠন করা হবে, সেখানে ক্ষমতাসীন দলের কোনো ক্ষমতা থাকবে না। ক্ষমতা থাকবে সব বিরোধী দল ও নিরপেক্ষ ব্যক্তিদের হাতে। অধিকাংশ বিল সংসদে অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে বিলম্বিত হবে। জুলাই সনদের নামে একধরনের সাংবিধানিক ক্যুর বন্দোবস্ত রেখেই সরকার আদেশ অনুমোদন করেছে। ফলে দেশে ভবিষ্যতে তিউনিসিয়ার মতো দুর্বল সরকার গঠিত হবে এবং বারবার সরকার পরিবর্তন হবে। এর ফলে অরাজনৈতিক শক্তির নিয়ন্ত্রণ বৃদ্ধি পাবে রাষ্ট্রের ওপর।

বিএনপিসহ কয়েকটি দল অভিযোগ করছে, এই আদেশ অনুমোদনের মাধ্যমে সরকার স্বাক্ষর করা সনদ থেকে সরে এসেছে। এটাকে তারা দেশ ও রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সরাসরি বেইমানি বলে অভিযোগ করছেন। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান সম্প্রতি বলেছেন, ‘এমন তো হওয়ার কথা ছিল না।’ আমরা তারেক রহমানের সঙ্গে একমত। দেশ যে অনিশ্চিত পরিস্থিতির মুখে এসে দাঁড়িয়েছে, তা আদৌ হওয়ার কথা ছিল না।

আমরা দেশের সার্বিক অবস্থার সংস্কার চেয়েছিলাম। আমরা চেয়েছিলাম, আমাদের শিক্ষা খাতের ব্যাপক সংস্কার হবে। কোচিং ব্যবসার কবল থেকে রক্ষা পাবে জাতি। শিক্ষকেরা প্রাইভেট পড়ানোর থেকে শ্রেণিকক্ষে বেশি মনোযোগ দেবেন। বইয়ের বোঝা নিয়ে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়ে যেতে হবে না।

আমাদের আশা ছিল রাষ্ট্র সংস্কারের মাধ্যমে স্বাস্থ্য খাতের অরাজক পরিস্থিতির অবসান ঘটবে। সরকারি হাসপাতালগুলো রোগীদের আস্থার জায়গায় পরিণত হবে। বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলো রোগীদের পকেট কাটার মেশিন হওয়ার দুর্নাম ঘোচাবে। স্বাস্থ্যসেবা দেশে রীতিমতো এক আতঙ্কের নাম। কারও কোনো ব্যাধি হলে চিকিৎসা ব্যয়ের কথা মনে করেই অর্ধেক আয়ু কমে যায়। বাকিটুকু শেষ হয় চিকিৎসা করাতে গিয়ে। এ অবস্থার অবসান ঘটিয়ে জনমানুষের দোরগোড়ায় নাগরিক সুবিধা নিশ্চিত করার উদ্যোগ নিতে পারত সরকার।

সড়ক-মহাসড়কে স্বস্তি ফিরে আসবে বলে আমরা মনে করেছিলাম। বেপরোয়া গাড়ি চালাতে গিয়ে দুর্ঘটনার সংখ্যা কমে আসবে। ফিটনেসবিহীন গাড়ি আর রাস্তায় নামবে না। ঘরে না ফেরা পর্যন্ত পরিবারের সদস্যরা দুশ্চিন্তায় থাকবেন না। শহরের ফুটপাতগুলো দখলমুক্ত হবে। ফুটপাত মুক্ত করতে পারলে স্থানীয় পর্যায়ে চাঁদাবাজির রাজনীতি স্বয়ংক্রিয়ভাবেই বন্ধ হয়ে যেত।

আরও পড়ুনরাষ্ট্র ও রাজনীতিতে জনগণের হিস্যা কোথায়১৪ জুন ২০২৫

মোদ্দাকথা, গত ১৭ বছর বা তার আগে থেকে আমাদের দেশে অরাজকতার যে জঞ্জাল জমেছিল, তা পরিষ্কার হবে। আমরা ফের নতুন করে যাত্রা শুরু করব; কিন্তু আমরা কি আদৌ শুরু করতে পেরেছি? না, আমরা পারিনি। হ্যাঁ, আমরা এটাও জানি, রাতারাতি আকাশসম চাহিদা অনুসারে পরিবর্তন করা সম্ভব নয়। হুট করে এক সকালেই সবকিছুর পরিবর্তন হয়ে যাবে না; কিন্তু আমরা অন্তত শুরুটা দেখতে চেয়েছিলাম। আমরা চেয়েছিলাম, দখল হয়ে যাওয়া নদীগুলো উদ্ধার হোক, পরিবেশদূষণ বন্ধ হোক। খাবারে ভেজাল দেওয়া কারবারিরা জবাবদিহির মুখোমুখি হোক। কথায় আছে—সকালের রোদ দেখেই দিনের ভাব বোঝা যায়। আমরা আদৌ সরকারের কার্যকলাপের মধ্যে সে রকম কোনো ভাব দেখতে পাইনি। আমরা চেয়েছিলাম, রাষ্ট্র পরিচালনার একটি আদর্শ মডেল এই সরকার তৈরি করে দিয়ে যাক; কিন্তু সরকার সেদিকে না হেঁটে রাজনৈতিক দলগুলোর মতো ক্ষমতা ভাগাভাগির পথে গেছে সংস্কারের নামে।

এখন সরকারের পক্ষ থেকে বলা হতে পারে, এতসব সমস্যার সমাধান করা আমাদের কাজ নয়। এটা অন্তর্বর্তী সরকার। এর চরিত্র অনুসারে সব কাজ করা সম্ভব নয়। তাহলে এই সরকারের উচিত ছিল অনেক আগেই নির্বাচন দেওয়া। যদি কোনো কাজই করতে না পারে, তাহলে গদিতে বসে থেকে জনগণের অর্থ অপচয়ের কোনো কারণ থাকতে পারে না। একগাদা কমিশন বানিয়ে জনগণের চোখে ধুলো দেওয়ার কোনো দরকার ছিল না।

সংস্কারের নামে আমরা দেখছি বিরোধী দলের শাসন কায়েমের পরিকল্পনা। শাসনব্যবস্থায় ক্ষমতার ভারসাম্য আনার কথা বলে সরকারি দলের হাত-পা বেঁধে ফেলার পরিকল্পনা হচ্ছে। সাংবিধানিক পদগুলোতে নিয়োগ কমিটিতে সরকারি দলকে সংখ্যালঘু বানানো হয়েছে। বিরোধী ও নিরপেক্ষ সদস্যদের সংখ্যাগরিষ্ঠ বানানো হয়েছে। এই নিরপেক্ষ সদস্যরা আবার আসবেন বিরোধী মত থেকে বা তাদের পছন্দ অনুসারে। কারণ, বিরোধীদের পছন্দ অনুসারে না দিলে আবার এক অচলাবস্থার সৃষ্টি হবে।

প্রকৃতপক্ষে বিশাল এক সুদূরপ্রসারী চিন্তা নিয়ে ভবিষ্যতে একধরনের দুর্বল সরকার গঠনের পরিকল্পনা করেছে সরকার ও কমিশন। এমন একধরনের পরিস্থিতি সৃষ্টির পরিকল্পনা করা হয়েছে, যাতে কোনো সরকার সুষ্ঠুভাবে সরকার পরিচালনা করতে না পারে।

নির্বাচিত সরকার এলেই কি সব সমস্যার সমাধান হবে? না, রাতারাতি পরিবর্তন হবে না। অতীতের অভিজ্ঞতা তা বলে না; কিন্তু তাই বলে নতুন করে শুরু করা যাবে না এমন কোনো কথা নেই। ’২৪ সালের আগস্ট আমাদের সেই সুযোগ সামনে নিয়ে এসেছিল। একটি জবাবদিহিমূলক সরকার গঠনের সুযোগ করে দিয়েছিল। কিন্তু কতিপয় রাজনৈতিক দল ও সরকারের অদূরদর্শিতার কারণে আমরা এই সুযোগ হারাতে বসেছি।

ড. মারুফ মল্লিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক

*মতামত লেখকের নিজস্ব

সম্পর্কিত নিবন্ধ