ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাবে এনসিপি
Published: 18th, October 2025 GMT
জুলাই সনদে সই না করলেও আইনি জটিলতা নিরসনে এবং এই সনদকে একটি যথাযথ আইনি ভিত্তি দিতে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে আগের মতো আলোচনা চালিয়ে যাবে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। আইনি ভিত্তি ও বৈধতা–সংক্রান্ত বিষয়াবলি সম্পর্কে সুনিশ্চিত হলেই তারা সনদে সই করবে।
জুলাই সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠান হয়ে যাওয়ার এক দিন পর আজ শনিবার এনসিপির যুগ্ম সদস্যসচিব (দপ্তর) সালেহ উদ্দিন সিফাত স্বাক্ষরিত এক বিবৃতিতে এ কথা জানানো হয়।
গতকাল সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় আনুষ্ঠানিক আয়োজনে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের উপস্থিতিতে জুলাই জাতীয় সনদে সই করে ২৪টি রাজনৈতিক দল। জুলাই অভ্যুত্থানে সামনের কাতারে থাকা তরুণদের গড়া দল এনসিপি এই অনুষ্ঠানে যায়নি।
না যাওয়ার ব্যাখ্যায় এনসিপির বিবৃতিতে বলা হয়, জুলাই সনদের আইনগত ভিত্তি ও বৈধতা নিশ্চিত না করে এবং বাস্তবায়নপ্রক্রিয়া সম্পর্কে জাতিকে স্বচ্ছ ধারণা না দিয়েই জুলাই সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠান আয়োজন করে সরকার। জুলাই সনদের কোনো আইনি ভিত্তি প্রদান না করা, জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশের খসড়া প্রকাশ না করা এবং সনদ বাস্তবায়ন পদ্ধতির পূর্ণাঙ্গ রূপরেখা জাতির সামনে উন্মোচন না করায় শুধু আনুষ্ঠানিকতার জন্য গতকাল জুলাই সনদে স্বাক্ষর থেকে বিরত থেকেছে এনসিপি।
প্রতিষ্ঠার দিন থেকেই এনসিপি ‘বাহাত্তরের ফ্যাসিবাদী বন্দোবস্তের’ বিলোপ ঘটিয়ে নতুন সংবিধানের জন্য সরকারসহ রাজনৈতিক দলগুলোকে আহ্বান জানিয়ে আসছে। সারা দেশে জনসংযোগসহ ঐকমত্য কমিশনেও রাষ্ট্রের কাঠামোগত সংস্কারপ্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করতে নিজেদের ভূমিকার কথা উল্লেখ করা হয় বিবৃতিতে।
জুলাই সনদ বাস্তবায়ন পদ্ধতি নিয়ে জাতিকে ধোঁয়াশায় রাখা হয়েছে দাবি করে এনসিপি বলেছে, এর আইনি ভিত্তি হিসেবে ‘জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশ’ এর কথা উল্লেখ নেই। অভ্যুত্থান–পরবর্তী যেকোনো বন্দোবস্তের নৈতিক ও আইনি ভিত্তি হতে হবে জুলাই অভ্যুত্থানে প্রকাশিত জনগণের ‘সার্বভৌম ও গাঠনিক ক্ষমতা’। কিন্তু জুলাই সনদে জনগণের ‘সার্বভৌম ও গাঠনিক ক্ষমতা’ সম্পর্কিত মৌলিক সত্যের কোনো উল্লেখ নাই।
সব রাজনৈতিক দল ‘গণভোট’–এ সম্মত হলেও তার আইনি কাঠামো তথা জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশের কথা সনদে না থাকায় বাস্তবায়নের নিশ্চয়তা থাকছে না বলে এনসিপি মনে করে।
বিবৃতিতে বলা হয়, ‘জুলাই সনদে রাজনৈতিক দলগুলো সংবিধানের এমন কিছু অনুচ্ছেদ পরিবর্তনের ব্যাপারে সম্মত হয়েছে, যা বিদ্যমান সংবিধানের তথাকথিত “বেসিক স্ট্রাকচার”–এর আওতাভুক্ত। ফলে বাহাত্তরের সাংবিধানিক কাঠামোর অধীনে থেকে খোদ এর “বেসিক স্ট্রাকচার”কে লঙ্ঘন করে সংবিধান সংশোধন বা সংস্কার করলেও অদূর ভবিষ্যতে এই প্রক্রিয়া আদালতে চ্যালেঞ্জড এবং বাতিল হওয়ার সম্ভাবনা রাখে। কাজেই এই প্রক্রিয়ায় “জুলাই সনদ” পাস হলে, এটি জনগণের সঙ্গে একটি সাংবিধানিক প্রতারণা ছাড়া আর কিছু হবে না।’
তাই এনসিপি গণভোটের আগে জনগণের সার্বভৌম ইচ্ছার বহিঃপ্রকাশ হিসেবে সরকারপ্রধান অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস কর্তৃক জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশ জারির দাবি তুলেছে, যে আদেশের খসড়ায় এর আইনি ভিত্তি ও বৈধতা তথা জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের কথা স্পষ্ট উল্লেখ থাকবে।
বিবৃতিতে বলা হয়, ফ্যাসিবাদবিরোধী অনেক রাজনৈতিক দল আগামী দিনে জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি দেওয়া হবে এমন আশাবাদ নিয়ে সনদে সই করেছে। ঐকমত্য কমিশনের মেয়াদ বেড়েছে। জুলাই সনদের আইনি ভিত্তিসংক্রান্ত আগামী কয়েক দিনের আলোচনায় এই রাজনৈতিক দলগুলোকে তারা পাশে পাবে।
কোনো অবস্থাতেই জুলাই সনদকে জুলাই ঘোষণাপত্রের মতো আইনি ভিত্তিহীন রাজনৈতিক সমঝোতার দলিল বা ‘জেন্টেলম্যান'স অ্যাগ্রিমেন্টে’ পর্যবসিত করা যাবে না বলে হুঁশিয়ারি দিয়ে এনসিপি বলেছে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার জুলাই অভ্যুত্থানের অভিপ্রায়কে ধারণ করে জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি ও বাস্তবায়নে কার্যকর উদ্যোগ নেবে বলে তারা আশা করেছে।
‘জুলাই যোদ্ধাদের’ ওপর হামলার নিন্দাএনসিপির বিবৃতিতে গতকাল সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠানের আগে জুলাই যোদ্ধাদের ওপর হামলার নিন্দাও জানানো হয়।
এতে বলা হয়, জুলাইয়ের শহীদ পরিবার ও আহত ব্যক্তিরা কিছু দাবি নিয়ে সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে যান। তাঁদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে জুলাই সনদের অঙ্গীকারনামার পঞ্চম দফা সংশোধন করার ঘোষণাও দেয় ঐকমত্য কমিশন। কিন্তু কমিশন এই বিষয়টি প্রথমেই আমলে নিলে শহীদ পরিবার ও আহত যোদ্ধাদের রাজপথে নামতে হতো না।
সংকটের শান্তিপূর্ণ সমাধান না করে আহত ‘জুলাই যোদ্ধাদের’ ওপর হামলার প্রতিবাদ জানিয়ে এ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার দাবি করেছে এনসিপি। বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘শহীদ ও আহতদের আত্মত্যাগের বলেই আজকের জুলাই সনদ। তাঁদের ওপর হামলা করে এবং তাঁদের অসম্মান করে “জুলাই সনদ”কে পাওয়ার এলিটদের সেটেলমেন্ট বানাতে চাওয়া হয়েছে।’
আমন্ত্রিত শহীদ পরিবারগুলোও এই অনুষ্ঠানে প্রাপ্য সম্মান পাননি অভিযোগ করে এনসিপি বলেছে, শহীদ পরিবাররাই জুলাই সনদ আয়োজন অনুষ্ঠানের মূল আকর্ষণ। মঞ্চ থেকে এক কোণে বসিয়ে তাঁদের অমর্যাদা করা হয়েছে। প্রশাসন তাঁদের সঙ্গে উচ্চবাচ্য করেছে।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: জ ল ই সনদ র আইন প রক র য় জনগণ র উল ল খ এনস প সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় স্থাপন–কার্যক্রম চালুর জন্য গেজেটসহ যাবতীয় কাজ শেষ করার আহ্বান
জরুরি ভিত্তিতে সুপ্রিম কোর্টের জন্য পৃথক সচিবালয় স্থাপন, সচিবালয়ের কার্যক্রম চালুর জন্য গেজেট প্রজ্ঞাপনসহ যাবতীয় কাজ সম্পন্ন করতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন।
আজ সোমবার বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের এক বিবৃতিতে এ আহ্বান জানানো হয়।
অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদে খসড়া অনুমোদনের পর গতকাল রোববার সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় অধ্যাদেশ ২০২৫ জারি করেন রাষ্ট্রপতি। সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় প্রতিষ্ঠা হলে অধস্তন আদালত ও প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনালের তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণসংক্রান্ত সব প্রশাসনিক ও সাচিবিক দায়িত্ব পালন করবে এই সচিবালয়।
বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন বিবৃতিতে বলেছে, জারি করা অধ্যাদেশের ধারা ১ (২)–এ উল্লেখ রয়েছে, ‘(২) সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় স্থাপন সম্পন্ন ও ইহার কার্যক্রম পূর্ণরূপে চালু হওয়া সাপেক্ষে সরকার, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের সহিত পরামর্শক্রমে, ধারা ৭–এর বিধানাবলি সরকারি গেজেটে প্রজ্ঞাপন দ্বারা কার্যকর করিবে।’ অর্থাৎ সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় প্রতিষ্ঠার আইন হলেও তা বাস্তবায়ন হওয়ার আগপর্যন্ত বিচারকদের বদলি, পদায়ন, নিয়ন্ত্রণ ও শৃঙ্খলাবিধান–সংক্রান্ত বিষয় সরকারের অধীনই রয়ে গেছে। তাই অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারকে তার মেয়াদের মধ্যেই জরুরি ভিত্তিতে পৃথক সচিবালয় স্থাপন ও এর কার্যক্রম চালুর জন্য গেজেট প্রজ্ঞাপনসহ যাবতীয় কাজ সম্পন্ন করার জন্য উদাত্ত আহ্বান জানাচ্ছে।
বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মো. আমিরুল ইসলাম ও মহাসচিব মুহাম্মদ মাজহারুল ইসলাম বিবৃতিতে বলেছেন, তাঁরা অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে জানাচ্ছেন, বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার দেশের জনগণের বহুল আকাঙ্ক্ষিত স্বাধীন বিচার বিভাগ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় অধ্যাদেশ ২০২৫ জারি করেছে। এই অধ্যাদেশ জনগণের ন্যায়বিচার প্রাপ্তির অন্যতম বন্দোবস্ত এবং ঐতিহাসিক দলিল হয়ে থাকবে। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ঐতিহাসিকভাবে আলোচিত হলেও তা বিভিন্ন কারণে এ দেশে বাস্তবায়ন করা হয়নি। ১৯৯৯ সালে বিখ্যাত মাসদার হোসেন মামলার রায়ে স্বাধীন বিচার বিভাগ প্রতিষ্ঠার নির্দেশনা দেওয়া হয়।
বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়, ২০০৭ সালে নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ আলাদা হলেও কার্যত তা নির্বাহী বিভাগের অধীন থেকে যায়। জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানের পরবর্তী সময়ে আপামর জনগণ স্বাধীন বিচার বিভাগ প্রতিষ্ঠার বিষয়ে আশাবাদী হয়। অভ্যুত্থানের পরবর্তী সময়ে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রথমবারের মতো তরুণ বিচারকদের সমন্বয়ে গঠিত ‘ইয়ং জাজেস ফর জুডিশিয়াল রিফর্ম’ তাদের ১২ দফা দাবি ঘোষণা করে। এর ১ নম্বর দফা ছিল সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় গঠন।
বিবৃতিতে আরও বলা হয়, দেশের প্রধান বিচারপতি সারা দেশের বিচারকদের সম্মুখে অভিভাষণের সময় স্বাধীন বিচার বিভাগ প্রতিষ্ঠার প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন, যা বিচারকদের মনে অকৃত্রিম আশার সঞ্চার করে। এর পরিপ্রেক্ষিতে অ্যাসোসিয়েশন ২০২৪ সালের ২০ নভেম্বর অফিশিয়াল বিবৃতির মাধ্যমে অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে দ্রুত সময়ের মধ্যে বিচার বিভাগীয় সচিবালয় প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানায়। পাশাপাশি প্রথমবারের মতো গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটি গত ১ বছরে স্বাধীন বিচার বিভাগ ও পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে প্রতিটি বিভাগীয় শহরে সব বিচারক এবং বিচার বিভাগ–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নিয়ে মতবিনিময় সভা ও সেমিনারের আয়োজন করে।
‘আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় মাইলফলক হয়ে থাকবে’
বিবৃতিতে বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন বলেছে, অবশেষে দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর ৩০ নভেম্বর অন্তর্বর্তী সরকার সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় অধ্যাদেশ ২০২৫ জারি করেছে, যা এ দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় মাইলফলক হয়ে থাকবে। এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্য অ্যাসোসিয়েশন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা, বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি, আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ নজরুল, সর্বোপরি অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি অশেষ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছে।