শোক, শ্রদ্ধা ও প্রীতির স্পর্শে স্মৃতির মানুষকে ফিরে পাওয়া
Published: 18th, October 2025 GMT
স্বজন, সুহৃদেরা তাঁকে ভুলতে পারছেন না। সৈয়দ মনজুরুল ইসলামকে তাঁরা রেখেছেন স্মৃতিতে অম্লান। রেখেছেন স্মরণে নিরন্তর। তাঁকে হারিয়ে শোক, শ্রদ্ধা, প্রীতির স্পর্শে যেন নতুন করে ফিরে পেলেন বেঙ্গল শিল্পালয়ে। আজ শনিবার বিকেলে সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের স্মরণসভার আয়োজন করেছিল বেঙ্গল ফাউন্ডেশন।
নির্ধারিত সময় ঠিক বিকেল চারটায় শুরু হয়েছিল বিষাদময় এই আয়োজন। কয়েক প্রজন্মের প্রিয় শিক্ষক, কথাশিল্পী, প্রাবন্ধিক, নন্দনতত্ত্ববিদ, অনুবাদক এবং সর্বোপরি আপাদমস্তক সজ্জন ইমেরিটাস অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম অনেকটা আকস্মিকভাবেই চলে গেলেন ১০ অক্টোবর। তিনি হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন ৩ অক্টোবর। সুস্থই ছিলেন। সেদিন ইউল্যাবে ক্লাস নিতে যাচ্ছিলেন। তার পরের ঘটনা তো ইতিমধ্যে সবারই জানা। সেই শোকের ছায়া প্রিয়জনের মন থেকে যে সরেনি, এই স্মরণসভাতেও তার প্রকাশ দেখা গেল। ঢাকার দুর্বিষহ যানজটের সঙ্গে যুদ্ধ করে তাঁর অনুরাগীরা অনুষ্ঠান শুরুর অনেক আগেই এসে পুরো কক্ষ পূর্ণ করে তুলেছিলেন। আসন না পেয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন অনেকে। বাইরে চেয়ার পাতা হলো। সেখানেও অচিরেই সব আসন পূর্ণ হলো। বাইরেও দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ডিজিটাল পর্দায় ভেতরের কার্যক্রম দেখছিলেন অনেকে।
শুরুতেই বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক লুভা নাহিদ চৌধুরী সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের বহুমুখী প্রতিভা ও কাজের পরিচিতি তুলে ধরেন। বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের তিনি ছিলেন সহসভাপতি। বেঙ্গল গ্যালারির প্রতিষ্ঠাকাল থেকে তাঁর যুক্ততা ছিল। জড়িত ছিলেন বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের শিল্পকলাবিষয়ক পত্রিকা যামিনী, জীবনধারা পত্রিকা চারবেলা চারদিক, আইস টুডের সঙ্গে। দেশের চারুকলার পরিচিতি বিদেশে তুলে ধরার ক্ষেত্রে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। এখন তিনি কাছের মানুষ থেকে স্মৃতির মানুষে পরিণত হয়েছেন।
অনুষ্ঠানের শুরুতে তাঁর প্রতি শোক ও শ্রদ্ধা নিবেদন করে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। তাঁর জীবন ও কর্ম নিয়ে একটি প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শন করা হয়।
আলোচনা পর্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দীর্ঘদিনের সহকর্মী অধ্যাপক ফখরুল আলম বলেন, মনজুরুল ইসলামের সঙ্গে দীর্ঘ ৫১ বছরের সম্পর্ক। বড় মাপের লেখক ছিলেন। বহুমাত্রিক প্রতিভাবান ছিলেন তিনি। আড্ডা দিতে ভালোবাসতেন। একটা সময় প্রায় প্রতিদিন তাঁরা আড্ডা দিয়েছেন। সুরসিক ছিলেন। সংবেদনশীল ছিলেন। বহু মানুষকে তিনি বহুভাবে উপকার করেছেন। তাঁর কাছে কেউ কিছু চেয়ে বিফল হননি। ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার চাকরিটাও তাঁর সহায়তায় হয়েছে’ বলে তিনি ভারাক্রান্ত হৃদয়ে সেই স্মৃতিচারণা করেন। মৃত্যুর দিন পনেরো আগে তাঁর সঙ্গে আড্ডায় মনে হয়েছিল তিনি যেন কিছুটা অসুস্থ। কিন্তু অসুস্থতার কথা তিনি আড়ালে রেখেছিলেন। সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের চলে যাওয়ার দুঃখটা তাঁর মনে চেপে বসেছে বলে জানালেন।
আরেক সহকর্মী ও বন্ধু অধ্যাপক কায়সার হক বললেন, সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, ফখরুল ইসলাম ও তিনি একসঙ্গে বহু কাজ করেছেন। ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব ছিল তাঁদের। সেই বন্ধন ছিন্ন হলো। তাঁকে নিয়ে এখন শোকসভা হচ্ছে। যেখানেই তাঁর কথা আলোচনা হচ্ছে, তাঁর অনুরাগী ও ছাত্রছাত্রীদের অনেকে তাঁর জন্য কেঁদেছে। তাঁর প্রতি এই ভালোবাসা সবার মনে থেকে যাবে। সাহিত্যে অবদান প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘মনজুরুল ইসলাম কবিতা দিয়ে তাঁর লেখালেখি শুরু করলেও পরে গদ্যের দিকে চলে যান। বিশেষ করে অভিনব ছিল তাঁর ছোট গল্পগুলো। গল্প লেখার ক্ষেত্রে একটি বিশেষ রীতি ছিল তাঁর। তাঁকে আমরা মনে রাখব, তিনি যা করে গেছেন, সেখান থেকে যা শিক্ষণীয়, তা অনুসরণ করব।’
শিল্পী অধ্যাপক ফরিদা জামান দীর্ঘদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিকের একই ভবনে থাকতেন। তিনি সেসব দিনের স্মৃতিচারণা করে বলেন, সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম শিল্পকলার উঁচু স্তরের সমালোচক ছিলেন। বিদেশে দেশের চারুকলার প্রচার-প্রসারে তাঁর বিশেষ অবদান রয়েছে। শিল্পকলাকে তিনি খুব ভালোভাবে ব্যাখ্যা করতে পারতেন। সহজবোধ্যভাবে লিখতেন। শিল্পী যে আনন্দ ও বেদনা তাঁর সৃষ্টিতে অনুভব করেছেন, বাস্তবতার সঙ্গে মিলিয়ে তিনি সেই অনুভব সহজভাবে ব্যাখ্যা করতেন। এ জন্য সাধারণ পাঠক ও দর্শকেরাও তা বুঝতে পারতেন। বাংলাদেশে শিল্পকলার প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গেলে তাঁর ভূমিকার কথা উল্লেখ করতেই হবে।
ইউল্যাবের উপাচার্য অধ্যাপক ইমরান রহমান বলেন, শিক্ষকতার বাইরেও ছিল তাঁর বিশাল ভুবন। ইউল্যাবে শিক্ষকতা ছাড়াও অনেক কার্যক্রমে যুক্ত ছিলেন। অসাম্প্রদায়িক, উদার মানসিকতা ও মুক্তচিন্তার মানুষ ছিলেন। তিনি যে মূল্যবোধ ধারণ করেছেন, তা পরের প্রজন্মের জন্য অনুসরণীয় হয়ে থাকবে।
পরিবারের পক্ষে তাঁর ভাগনে ড.
প্রথম আলোর নির্বাহী সম্পাদক সাজ্জাদ শরিফ বলেন, তাঁর সঙ্গে কথা বলা ছিল আনন্দময় অভিজ্ঞতা। তিনি ছাত্রদের কাছে বন্ধু হয়ে উঠেছিলেন। কাছের মানুষেরা তাঁর থেকে উপকৃত হয়েছেন। এমনি আন্তরিক ছিলেন তিনি যে প্রত্যেকেই মনে করতেন তাঁর সঙ্গেই তাঁর সম্পর্ক সবচেয়ে নিবিড়। সফল মানুষেরা নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েন। কিন্তু সার্থক মানুষেরা সবাইকে নিয়ে একসঙ্গে থাকেন। তিনি সার্থক মানুষের জীবন যাপন করেছেন।
লেখক ও সিটি ব্যাংক পিএলসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মাসরুর আরেফিন তাঁর প্রিয় শিক্ষক সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের দীর্ঘ স্মৃতিচারণা করে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় জীবন থেকে শেষ পর্যন্ত তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছিলেন। অসংখ্য মানুষের জন্য তিনি ছিলেন আলোকবর্তিকা।
উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
শাহজালাল বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে আগুন, ৭ ঘণ্টা উড়োজাহাজ ওঠানামা বন্ধ
ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজ কমপ্লেক্স ভবনে গতকাল শনিবার বেলা আড়াইটার দিকে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। ১৩টি ফায়ার স্টেশনের ৩৭টি ইউনিটের প্রায় সাড়ে ছয় ঘণ্টার চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা হয়। আগুনে নেভাতে গিয়ে আনসার বাহিনীর ২৫ সদস্যসহ মোট ৩৫ জন আহত হয়েছেন বলে জানা গেছে।
অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার পর বিমানবন্দরে সব ধরনের উড়োজাহাজ ওঠানামা বন্ধ হয়ে যায়। আগুন নিয়ন্ত্রণে আসার পর রাত ৯টার দিকে বিমানবন্দর চালু হয়। রাত ৯টা ৬ মিনিটে ফ্লাই দুবাই এয়ারলাইনসের একটি উড়োজাহাজ শাহজালাল বিমানবন্দরে অবতরণ করে।
শাহজালাল বিমানবন্দরের পোস্ট অফিস ও হ্যাঙ্গারের মাঝামাঝি স্থানে কার্গো ভিলেজ। আগুন লেগেছে বিমানবন্দরের ৮ নম্বর গেটের পাশে কার্গো কমপ্লেক্স ভবনে। এই গেটকে হ্যাঙ্গার গেট বলা হয়। কার্গো ভিলেজের (পণ্য রাখার স্থান) যে অংশে আগুন লেগেছে, সেখানে আমদানি করা পণ্য রাখা হয়।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, বেলা আড়াইটার দিকে হঠাৎ বিমানবন্দরের ফায়ার অ্যালার্ম বেজে ওঠে। সবাই তখন নিচে নেমে আসেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই আগুন ছড়িয়ে পড়ে প্রচুর ধোঁয়া বের হতে থাকে।
আগুন নিয়ন্ত্রণে ফায়ার সার্ভিসের সঙ্গে সেনাবাহিনী, বিমানবাহিনীর দুটি ফায়ার ইউনিটও কাজ করেছে বলে জানিয়েছে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর। যোগ দিয়েছে নৌবাহিনীও। দুই প্লাটুন বিজিবিও সেখানে কাজ করেছে। উৎসুক জনতার ভিড় ঠেকাতে বিমানবাহিনীর পক্ষ থেকে মাইকে ঘোষণা দিয়ে সবাইকে সরে যেতে বলা হয়।
বিমানবন্দরের নিরাপত্তায় এক হাজার আনসার সদস্য ঘটনাস্থলে উদ্ধার ও আগুন নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমে সক্রিয়ভাবে সহযোগিতা করেন। এ সময় ২৫ জন সদস্য আহত হলে তাঁদের দ্রুত সিএমএইচ ও কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে পাঠানো হয়।
আগুন নিয়ন্ত্রণে আসার পরও আমদানি কার্গো কমপ্লেক্সের বিভিন্ন জায়গা থেকে বের হচ্ছিল আগুনের স্ফুলিঙ্গ