মানিকগঞ্জের হরিরামপুর উপজেলা পানচাষে বিখ্যাত। এক সময় এ অঞ্চলের উৎপাদিত পান দেশের গন্ডি পেরিয়ে বিদেশে রপ্তানি হতো। সম্প্রতি বন্ধ রয়েছে রপ্তানি। চাষিদের ভাষ্য, ভালো ফলন হওয়া সত্ত্বেও উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি এবং ন্যায্য দাম না পাওয়ায় দুশ্চিন্তায় রয়েছেন তারা।

হরিরামপুরের মানিকনগর, কৃত্তিপুর, গারুটিয়া ও ধুলিশ্বর গ্রামের মাঠজুড়ে একসময় ছিল অসংখ্য পানবরজ। এখন ৩০টির মতো বরজ আছে। সকালের সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে চাষিরা বরজে যান, কাজ শুরু করেন। কেউ পান পাতা তোলেন, কেউ গাছের গোড়ায় পানি দেন, কেউ আগাছা পরিষ্কার করেন। তবে, তাদের মুখে নেই তৃপ্তির হাসি। সার, কীটনাশক, বাঁশ, পাটখড়ির দাম এবং শ্রমিকের মজুরি বেড়ে যাওয়ায় পান উৎপাদনে খরচ বৃদ্ধি পেয়েছে কয়েকগুণ। পাশাপাশি বাজারে কমেছে পানের দাম। যে কারণে ন্যায্য দাম পাওয়া নিয়ে শঙ্কিত চাষিরা।

আরো পড়ুন:

আটপাড়ায় নদীতে গোসল করতে নেমে কৃষক নিখোঁজ

কুষ্টিয়ার সাইফুল মাশরুম চাষে সফল, দিয়েছেন ৫০০ জনকে প্রশিক্ষণ 

মানিকনগর গ্রামের কৃষক লতিফ মিয়া বলেন, “একটা পান বরজের খরচ এখন আগের চেয়ে তিনগুণ বেশি। আগে শ্রমিকের মজুরি ছিল ৬০০–৭০০ টাকা, এখন দিতে হয় ৮০০ থেকে ১,০০০ টাকা। বাঁশ, পাটখড়ি, সার সবকিছুর দাম বেড়েছে। বাজারে দাম না থাকায় বরজে থাকা পানের অর্ধেকই তোলা হয় না।”

মো.

আকছেদ নামে অপর চাষি বলেন, “৬৬ শতাংশ জমিতে পানচাষ করতে খরচ হয়েছে প্রায় ৬ লাখ টাকা। বাজারে এখন পানের দাম নেই। অবস্থা এমন যে খরচই উঠছে না। সরকার যদি ভর্তুকি বা প্রণোদনা দিত, তাহলে আমরা টিকে থাকতে পারতাম। বিনা মূল্যে সার-বীজ ও কীটনাশক সরকার অনেক ফসলের জন্য দেয়, পানচাষিরা সব সময়ই বঞ্চিত। কৃষি অফিস থেকেও কোনো প্রশিক্ষণ বা সহায়তা পাই না।”

পানচাষে দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞ চাষি আলম মিয়া বলেন, “হরিরামপুর একসময় ‘পানের রাজ্য’ নামে পরিচিত ছিল। এখানকার সাঁচি ও গয়াচি দুইটি জাতের পানের সুনাম ছিল দেশজুড়ে। বিশেষ করে সাঁচি পানের রপ্তানি থেকে চাষিরা লাভবান হতেন। রপ্তানি বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর সেই বাজার হারিয়ে গেছে। আগে ১০০ পাতা পান বিক্রি হতো ৮০ থেকে ১০০ টাকায়, এখন তা নেমে এসেছে ৪০–৫০ টাকায়। ফলে, অনেকে নতুন মৌসুমে আর পান চাষে আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। আমরা যদি সহায়তা না পাই, আগামী কয়েক বছরে হরিরামপুরে পানচাষ থাকবে না। বরজ চালানো এখন লোকসানের কাজ।”

নিজের পানের বরজে কাজ করছেন এক কৃষক

বংশপরম্পরায় পানচাষ করছেন লতিফ মিয়ার পরিবার। দাদা-বাবা সবাই এই বরজে কাজ করেছেন। তিনি বলেন, “আমাদের কাছে এটা শুধু চাষ নয়, জীবনযাপন। এখন যদি পানের দাম না পাই, তাহলে এই ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখা কঠিন হবে।”

মানিকগঞ্জ কৃষি উন্নয়ন কমিটির সমন্বয়কারী নজরুল ইসলাম বলেন, “পান চাষিদের চোখে ভর করছে অনিশ্চয়তার ছায়া। সরকারি সহায়তা আর ন্যায্যমূল্যের নিশ্চয়তা না এলে, হয়তো একদিন হারিয়ে যাবে মানিকগঞ্জের ‘পানের রাজ্য’ হরিরামপুর’।”

হরিরামপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. তৌহিদুজ্জামান খান বলেন, “বর্তমানে প্রায় ৩ হেক্টর জমিতে ৩০টির মতো পানবরজ আছে। সাঁচি পানের রপ্তানি বন্ধ থাকায় এখন গয়াচি জাতের পান বেশি চাষ হচ্ছে। সরবরাহ বেড়ে যাওয়ায় বাজারে দাম কিছুটা কমেছে। আমরা কৃষকদের পরামর্শ দিচ্ছি এবং প্রশিক্ষণ কর্মসূচি হাতে নিয়েছি।”

ঢাকা/মাসুদ

উৎস: Risingbd

কীওয়ার্ড: চ কর চ কর ম ন কগঞ জ

এছাড়াও পড়ুন:

ক্ষতবিক্ষত সড়ক, কালভার্টে সাঁকো বানিয়ে চলাচল

ইটের খোয়া ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে চারদিকে। বিধ্বস্ত সড়কে পিচ ঢালাইয়ের কোনো চিহ্ন নেই। সড়কের বহু স্থান ভেঙে মিশে গেছে পাশের জমির সঙ্গে। পুরোপুরি বিধ্বস্ত হয়েছে ৩০ ফুট দীর্ঘ একটি কালভার্ট। সেখানে বাঁশের সাঁকো বানিয়ে পারাপার করছেন মানুষজন।

চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলা সদর থেকে মাত্র ১৫ কিলোমিটার দূরে মদুনা জঙ্গল সড়কের এমন দশা। গত জুলাই মাসের শুরুর দিকে তীব্র বর্ষণে সৃষ্ট পাহাড়ি ঢল ও হালদা নদীর স্রোতে সাড়ে তিন কিলোমিটার দীর্ঘ এই পাকা সড়ক পুরোপুরি বিধ্বস্ত হয়েছে। তিন মাস আগেও ওই সড়ক দিয়ে প্রতিদিন অন্তত ১০ হাজার মানুষ যাতায়াত করতেন। চলত ট্রাক, ব্যক্তিগত গাড়ি, বাস, অটোরিকশা সবই।

সড়কটি চট্টগ্রামের রাউজানের নোয়াপাড়া এবং উড়কিরচর ইউনিয়নকে যুক্ত করেছে। নোয়াপাড়া, উড়কিরচর ও হাটহাজারীর মদুনাঘাটের মানুষজন এই সড়ক ব্যবহার করতেন। সড়কটি বিধ্বস্ত হওয়ার তিন মাস পার হলেও সংস্কার হয়নি। কালভার্টটিও পুনর্নির্মাণের কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।

ওই এলাকার বাসিন্দারা জানিয়েছেন, ভাঙা সড়ক দিয়ে কোনো রকমে হেঁটে চলাচল করেন গ্রামের শিক্ষার্থী ও শ্রমজীবী মানুষজন। তবে কালভার্ট ভাঙা থাকায় ওই পথে গাছ ফেলে ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করতে হতো। গত শুক্রবার ও গতকাল শনিবার টানা দুদিন স্বেচ্ছাশ্রমে কাজ করে ভাঙা কালভার্টে বাঁশের সাঁকো বানিয়ে পারাপারের উপযোগী করেছেন স্থানীয় গাউসিয়া কমিটির সদস্যরা।

নোয়াপাড়া, উড়কিরচর ও হাটহাজারীর মদুনাঘাটের মানুষজন এই সড়ক ব্যবহার করতেন। সড়কটি বিধ্বস্ত হওয়ার তিন মাস পার হলেও সংস্কার হয়নি। কালভার্টটিও পুনর্নির্মাণের কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।

গত রোববার সরেজমিনে দেখা যায়, সড়ক দিয়ে শিক্ষার্থী, শ্রমজীবী মানুষসহ গ্রামবাসী যাতায়াত করছেন। অসমান খোয়া ছড়ানো সড়কে হেঁটে চলাচলও কষ্টকর। সড়কে কথা হয় মুহাম্মদ ইব্রাহিম নামের স্থানীয় একজনের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আমরা ভীষণ কষ্টে আছি। বাঁশের সাঁকো দিয়ে শিশু, নারী ও বয়স্করা চলাচল করতে ভয় পান। রোগীদের হাসপাতালে নেওয়া যাচ্ছে না। একরকম অবরুদ্ধ হয়ে বসবাস করছি আমরা।’

স্বেচ্ছাশ্রমে কালভার্টে বাঁশের সাঁকো বানানোর কাজে অংশ নেন গাউসিয়া কমিটির তানভীর আলম ও মুহাম্মদ জাবেদ। তাঁরা  প্রথম আলোকে বলেন, গাউসিয়া কমিটির ২৫ সদস্য দুই দিন কাজ করে বাঁশের সাঁকো তৈরি করেছেন। দীর্ঘ তিন মাস এই সড়কে চলাচল বন্ধ ছিল। নিরুপায় হয়ে নিজেরাই সাঁকো তৈরির কাজে হাত দেন। তাঁদের কাজে গ্রামের মানুষও বাঁশ, গাছ দিয়ে সহযোগিতা করেছেন।

সড়কের এই দশা নিয়ে ক্ষুব্ধ এলাকাবাসী একাধিকবার বিক্ষোভও করেছেন। গত ৩ অক্টোবর দুপুরে কয়েক শ গ্রামবাসী সড়ক সংস্কার ও ভাঙা কালভার্টে সেতু নির্মাণের দাবিতে মানববন্ধন করেন। তাঁরা বলেছেন, সরকার ১৫ বছরে সড়ক ও সেতুর উন্নয়নে তাঁদের এলাকায় কিছু করেনি।

আমরা ভীষণ কষ্টে আছি। বাঁশের সাঁকো দিয়ে শিশু, নারী ও বয়স্করা চলাচল করতে ভয় পান। রোগীদের হাসপাতালে নেওয়া যাচ্ছে না। একরকম অবরুদ্ধ হয়ে বসবাস করছি আমরা।মুহাম্মদ ইব্রাহিম, স্থানীয় বাসিন্দা

নোয়াপাড়া ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য মাসুদ পারভেজ প্রথম আলোকে বলেন, মদুনা জঙ্গল উপজেলার সবচেয়ে সুবিধাবঞ্চিত এলাকা। এখানকার সড়কটি উড়কিরচর ইউনিয়ন ও নোয়াপাড়া ইউনিয়নকে যুক্ত করেছে। এটি দ্রুত সংস্কার হওয়া জরুরি।

স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) উপজেলা প্রকৌশলী আবুল কালাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা সড়কে আরসিসি ঢালাইসহ প্রয়োজনীয় সংস্কারের জন্য বরাদ্দ চেয়েছি। তবে বরাদ্দ পাওয়া যায়নি। তাই মদুনা জঙ্গল সড়কও সংস্কার হয়নি।’

সম্পর্কিত নিবন্ধ