বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে সুপরিচিত অভিনেত্রী সারাহ বেগম কবরী, যাঁর অভিনয় রুপালি পর্দায় দেখে আমরা মুগ্ধ হয়েছি। গেল অতিমারিকালে কোভিড প্রায় অকালেই কেড়ে নেয় তাঁর অমূল্য প্রাণ। তাঁর জীবনীভিত্তিক উপন্যাস কবরী রচনায় কেন প্রবৃত্ত হলেন কবি ও কথাসাহিত্যিক বিশ্বজিৎ চৌধুরী?
আলোচ্য উপন্যাসটি সংলাপবহুল। সাংবাদিক সজীব কবরীর সাক্ষাৎকার নেয় প্রায় পুরো বইতেই। এতে কথোপকথন ও ফ্লাশব্যাকের সমন্বয়ে সৃষ্টি হয় ভিন্নতর আঙ্গিক। যুক্তরাষ্ট্রের কিছু হরর নভেল সাক্ষাৎকারভিত্তিক। কিন্তু বাংলায়? নজির সুলভ নয়। লেখকের ভাষাও কি সহজ-সরল? সংলাপ কঠিন নয় স্বাভাবিকভাবেই। কিন্তু ঔপন্যাসিকের ন্যারেশন কোনো কোনো ক্ষেত্রে কাব্যিক এবং এর কিছু চিরন্তন মানবিক সত্য উচ্চারণ চিত্তাকর্ষক। আর পাঠকের মনের কথা বলার ক্ষমতা? এখানে সজীবই কৌতূহলী পাঠকের প্রতিনিধি। তাই কবরীর কোনো কোনো উত্তরে সংবেদনশীল পাঠকের চোখ ভিজে আসে। কবরী শুরুতে মধ্যবিত্ত ছিলেন না। নিম্নমধ্যবিত্ত বাবা কৃষ্ণদাস পাল ১৩ বছর বয়সী কন্যা মিনা দাসকে (কবরী) বড় পরিবারের আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্যের আশায় সিনেমায় অভিনয় করতে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় পাঠান। এ ঘটনা এখনো অকল্পনীয় ঠেকে প্রায়। ২০ বছর বয়সের মধ্যেই তিনি জমি ও গাড়ির মালিক হয়ে উঠলেও দাম্পত্য জীবনে প্রায় সর্বহারাই থেকে যান কবরী। বাবার বয়সী প্রথম স্বামী চিত্ত চৌধুরীর সঙ্গে ১৪ বছরের সংসারে তিনি কেবল শোষিতই হন না, নিয়মিত নির্যাতিতও হন। তাঁর অজানা অধ্যায় কী? সজীব এখানে নায়িকাকে খুঁচিয়ে-খেপিয়ে তুলে আনে কিংবদন্তি পরিচালক জহির রায়হানের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের অজ্ঞাত গল্প। জহিরের মৃত্যুর ঘটনাও লোমহর্ষক। এগুলো অবশ্য এ উপন্যাস পাঠের তথ্যগত প্রাপ্তি।
এ উপন্যাসের প্রধান ভিত্তি কবরীর লেখা আত্মজীবনী স্মৃতিটুকু থাক। তা হলে কবরীর বিশিষ্টতা কোথায়? অনুকরণ নয়, উল্লিখিত জীবনীর অনুসৃজনে ব্রতী হন ঔপন্যাসিক। সজীবের সঙ্গে আলাপকালীন কবরীর প্রতিটি অভিব্যক্তির উৎস, কার্যকারণ—সব মিলিয়ে তিনি বাঙ্ময় করে তোলেন গভীর অভিনিবেশযোগে, নিবিড় পর্যবেক্ষকের দৃষ্টিতে। এভাবে সচেতন পাঠকের পরম সম্পদ হয়ে ওঠে বিশ ও একুশতম অধ্যায়ে বিধৃত কবরীর ১৯৭১ পর্ব। ভারতের বিভিন্ন জনসমাবেশে কবরীর ভাষণ দেওয়া, সে দেশের ফিল্মে অভিনয়ের জন্য প্রাপ্ত সম্মানীর অর্ধেক বাংলাদেশের যুদ্ধাহত শরণার্থীদের দান, সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ ইত্যাদি ঘটনা স্মৃতিকথার অধিক ব্যঞ্জনা লাভ করে বিশ্বজিতের হাতে।
এক রাজনীতিক পরিবারের সন্তান সফিউদ্দীন সারোয়ারের সঙ্গে দ্বিতীয় বিয়ের ২০ বছর পর রাজনৈতিক হিংসা-প্রতিহিংসার কারণে তা ভেঙে গেলেও এ পর্বে কবরীকে আমরা হার না-মানা সংগ্রামী ব্যক্তিত্বরূপে পাই। বিষম সমাজ-আরোপিত লৈঙ্গিক ও সাম্প্রদায়িক বিভেদের ঊর্ধ্বে নিজেকে স্থাপন তাঁকে মহিমান্বিত করে তোলে। জীবনের শেষ পর্বে সুচিত্রা সেন ও এই বাংলারও একাধিক নায়ক-নায়িকা যেখানে যাঁর যাঁর সাম্প্রদায়িক পরিচয়কে প্রাধান্য দেন, কবরী সেখানে থাকেন উদার এবং প্রাগ্রসর জীবনচেতনার প্রতি উন্মুখ।
ঔপন্যাসিকের সৃজনশীল কল্পনা এই জীবনীভিত্তিক আখ্যানকে প্রাঞ্জল করে তুলেছে। যদিও উপন্যাসের কোথাও সজীব বলেনি, সারেং বৌ ছবিতে কবরী নবিতুনের সঙ্গে জীবন বদল করেছিলেন। তবে শেষ চার অধ্যায় লেখকের নিজস্ব রচনা, বলা যায়। এ অংশে করোনাকালের ভয়াবহতার বিবরণ পাঠককে সেই দুঃস্বপ্নে ফিরিয়ে নিয়ে যায়। তিন বছর পর সজীবের স্ত্রীর প্রত্যাবর্তন কিছুটা অস্বাভাবিক ঠেকলেও অনতি পরে এ ক্ষেত্রে মহানুভব কবরী ম্যাডামের গোপন ভূমিকা পাঠককে তাঁর প্রতি আরও শ্রদ্ধাশীল করে তোলে। তবু সেই অবস্থায় সজীবের সস্ত্রীক কক্সবাজার যাত্রা, তাঁদের কন্যার অবাধ্যতা ইত্যাদি যেন মেনে নেওয়া যায় না। তবে শেষ অধ্যায়ে কবরীর অসুস্থতার সংবাদে সজীবের অসম্ভব বিচলিত হওয়ার বর্ণনায় পাঠকও ভীষণ উদ্বিগ্ন বোধ করে।
কবরী
বিশ্বজিৎ চৌধুরী
প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন
প্রকাশ: ফেব্রুয়ারি ২০২৫
প্রচ্ছদ: মাসুক হেলাল
পৃষ্ঠা: ২০০
মূল্য: ৫০০ ৳
উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
যথাসময়ে জকসু নির্বাচন না হলে প্রশাসনকে ক্যাম্পাস ছাড়তে হবে
বিভিন্ন মহল থেকে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় (জবি) কেন্দ্রীয় শিক্ষার্থী সংসদ (জকসু) নির্বাচন বানচালের চেষ্টা করা হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন জাতীয় ছাত্রশক্তি সমর্থিত ঐক্যবদ্ধ জবিয়ান প্যানেলের প্রার্থীরা। যথাসময় জকসু নির্বাচন না হলে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে পদত্যাগ করে ক্যাম্পাস ছাড়তে হবে বলেও হুঁশিয়ার করেছেন তারা।
বুধবার (৩ ডিসেম্বর) বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষা শহীদ রফিক ভবনের নিচে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে এ হুঁশিয়ারি দেন প্যানেলের সমাজসেবা সম্পাদক পদপ্রার্থী ও জবি শাখা জাতীয় ছাত্রশক্তির মুখ্য সংগঠক ফেরদৌস শেখ।
তিনি বলেন, বিভিন্ন মহল থেকে পরিকল্পিতভাবে জকসু নির্বাচন বানচাল করার চেষ্টা চলছে। ভূমিকম্পের অজুহাতে অযথা ছুটি বাড়িয়ে নির্বাচন পিছিয়ে দেওয়ার অপচেষ্টা দৃশ্যমান। জকসু নিয়ে কোনো ধরনের টালবাহানা সহ্য করা হবে না।
নির্বাচন কমিশনের সমালোচনা করে ফেরদৌস শেখ বলেন, নির্বাচন কমিশন এক প্যানেলকে আচরণবিধি ভঙ্গের অভিযোগে শোকজ নোটিশ দিলেও আরেকটি প্যানেলের প্রকাশ্য লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। এতে কমিশনের নিরপেক্ষতা নিয়ে শিক্ষার্থীদের মনে গভীর প্রশ্ন তৈরি হয়েছে।
তিনি আরো বলেন, ভূমিকম্পের পর ঘোষিত দুই সপ্তাহের ছুটি ছিল অদূরদর্শী সিদ্ধান্ত। এতে সেমিস্টার সূচি, পরীক্ষা ও চাকরির আবেদনের সুযোগ মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়েছে। অথচ, ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলোর মেরামতে কোনো দৃশ্যমান অগ্রগতি নেই।
জাতীয় ছাত্রশক্তির জবি শাখার এই নেতা বলেন, সম্পূরক বৃত্তিপ্রাপ্তদের তালিকা সময়মতো প্রকাশ করতে প্রশাসন ব্যর্থ হয়েছে। নভেম্বরের মধ্যে তালিকা প্রকাশের প্রতিশ্রুতি থাকলেও ডিসেম্বরেও তা প্রকাশ করা হয়নি।
ফেরদৌস শেখ বলেন, জকসু নির্বাচন যথাসময় করতে হলে আগামী রবিবারের মধ্যেই বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দিতে হবে। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎকে অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দেওয়া আমরা মেনে নেব না।
তিনি আরো বলেন, আমরা শুনতে পাচ্ছি, ১৮ ডিসেম্বর শিক্ষক সমিতির নির্বাচন হবে। তার আগে জকসু নির্বাচন দিতে হবে। ছাত্রদের নির্বাচন বানচাল করে শিক্ষকদের নির্বাচন আমরা করতে দেব না।
ঢাকা/লিমন/রফিক